মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

বঙ্গে মহাত্মা


।।সমৃদ্ধ দত্ত।।

1538214908_gandhijpg.jpg যে বঙ্গ তাঁকে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল, পরে সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল তঁার সাফল্যযাত্রা। তাঁর প্রকৃত ভারতদর্শন শুরু এই বাংলা থেকেই। মহাত্মা গান্ধীর জন্ম সার্ধশতবর্ষের প্রাক্কালে সেই সংযোগেরই স্মৃতিচারণ...।

লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসার পর পশ্চিম ও মধ্য ভারতের সিংহভাগ আইনজীবী সম্প্রদায়ই চান বোম্বাই শহরে প্র্যাকটিস করতে। কারণ সেটি সামগ্রিকভাবে ব্যস্ত হাইকোর্ট। এই শহরে ১০ লক্ষের মতো জনসংখ্যা। তবে শিল্প আর বা঩ণিজ্যিক কার্যকলাপ যথেষ্ট উৎকৃষ্ট। ১৮৯০ এর দশকে অন্তত ৫০টি কটন মিল সেই শহরে। যেখানে কর্মরত কর্মীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। এছাড়া আরও অসংখ্য কমার্শিয়াল দপ্তর রয়েছে। সর্বোপরি বেশ একটা অল ইন্ডিয়া সমন্বয়ের আবহ। ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটলে একসঙ্গে হয়তো ৪০টি পথচলতি ভাষা শোনা যাবে। লন্ডনের অভিজাত ইনার টেম্পল আইন কলেজ থেকে পাশ করে আসা যুবক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৯১ সালের নভেম্বর মাসে রাজকোটের বাড়িতে বসে দাদা লক্ষ্মীদাস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলেন, বোম্বাই হাইকোর্টে গিয়ে প্র্যাকটিস করাই ভালো। সেই মতো হাইকোর্টে আবেদন করে ইনার টেম্পলের সার্টিফিকেটের মাধ্যমে লাইসেন্স পেলেন। কিন্তু প্র্যাকটিস জমছে না। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল প্রসিডিওর কোড প্রচণ্ড জটিল। সেভাবে বড় কোনও ব্রিফও আসছে না। একজন কৃষকের হয়ে কিছু জমিবিবাদ মামলায় ড্রাফট তৈরি করে দিয়েছিলেন লোয়ার কোর্টে। এরকম বিক্ষিপ্ত সব কেস। এরকম ব্যয়সাপেক্ষ শহরে নিয়মিত আয় না থাকলে কীভাবে চলবে? ততদিনে দ্বিতীয় সন্তান মণিলালের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ পারিবারিক দায়িত্ব বাড়ছে। চিন্তাভাবনা করে অবশেষে নিজের শহর রাজকোটে ফিরে এলেন মোহনদাস। সেখানে নিজস্ব চেম্বার খুললেন। তবে আদালতে শুনানিতে প্লিড করায় তিনি যে যথেষ্ট দক্ষ নন, সেটা স্পষ্ট। তাই যে কাজ সবথেকে ভালো পারেন, সেটাই শুরু হল... বিভিন্ন কেসের ড্রাফট আর পিটিশন রচনা। এভাবে মাসে ৩০০ টাকা মোটামুটি আয় হতে লাগল। যেটা ১৮৯২-৯৩ সালে বেশ যথেষ্ট। ঠিক সেই সময় এই গান্ধী পরিবারের প্রকৃত জন্মভিটে পোরবন্দরের এক ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে ল’ইয়ার মোহনদাস গান্ধীর কাছে একটা অফার এল। সেই ব্যবসায়ীর নাম দাদা আবদাল্লা। তিনি অনেক আগেই একটি সফল বিজনেস ফার্ম খুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল, ট্রান্সভাল এবং পর্তুগিজ ইস্ট আফ্রিকায়। তাঁর সাতটি দোকান নিজেরই এক আত্মীয়কে বিক্রি করেছিলেন। সেই সম্পত্তি নিয়ে মামলা করলেন দাদা আবদাল্লা। তাঁর হয়ে ব্রিটিশ আইনজীবীরা কোর্টে লড়ছেন বটে, কিন্তু দাদা আবদাল্লার যাবতীয় সম্পত্তির রেকর্ড গুজরাতি ভাষায়। সেটা একটা কমিউনিকেশন প্রবলেম। তাই তিনি চাইছেন একজন গুজরাতি ব্যারিস্টার। অফারটি গ্রহণ করলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বোম্বাই বন্দর থেকে ১৮৯৩ সালের ২৪ এপ্রিল মোহনদাস দক্ষিণ আফ্রিকাগামী জাহাজে উঠলেন। তখনও ভারত জানে না যে, এই জীবিকাসন্ধানী আইনজীবী যখন ২২ বছর পর স্থায়ীভাবে স্বদেশে ফিরবেন, তখন তাঁর ব্যারিস্টার পরিচয়টি গৌণ হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ অন্য রূপে তাঁর প্রত্যাবর্তন হবে। এবং কী আশ্চর্য সমাপতন। ঠিক একমাস পর ২৪ মে ১৮৯৩ মোহনদাস গান্ধীকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ যখন ডারবান পৌঁছল, সেই তারিখের ৬ দিন পর বোম্বাই বন্দর থেকে আর একটি জাহাজ ছেড়েছিল। ৩১ মে ১৮৯৩। পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্ট কোম্পানির সেই জাহাজের নাম ছিল কোম্পানির নামেই। পেনিনসুলার। অন্য অনেক বিদেশি ও ভারতীয় যাত্রীর মধ্যে ছিলেন এক অদ্ভুতদর্শন পোশাক পরিহিত উজ্জ্বল যুবক। রেশমের আলখাল্লা ও পাগড়ি। সেই যুবকটির গন্তব্য ছিল শিকাগো শহর। তিনিও যখন সেই শিকাগোপর্ব সাঙ্গ করে ফিরবেন, তখন এক অন্য মানুষ। এবং তিনি একা ফেরেননি। ফিরেছিলেন এক আবহমানকালের জন্য চেতনার আলো নিয়ে। সেই আলোটি আজও প্রজ্জ্বলিত। মোহনদাস গান্ধীকে ডারবান বন্দরে রিসিভ করতে স্বয়ং দাদা আবদাল্লা হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু ওই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ যুবক প্রায় দু’মাস পর অন্য একটি জাহাজ এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়ায় চেপে (ইয়াকোহামায় জাহাজ পরিবর্তন হয়েছিল) যখন অচেনা ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে পা রাখলেন, তখন তাঁর জন্য কেউ সেখানে ছিল না। সেখান থেকে একাই তাঁকে কানাডা প্যাসিফিক রেলপথে পৌঁছতে হয়েছিল শিকাগোয়। রাত সাড়ে ১০টায়। ৩০ জুলাই। একা! সে অন্য রূপকথা। কারণ সেটি ছিল ভারতের বিশ্বজয়ের প্রথম কাহিনী। শিকাগোর সেন্ট অব কলম্বাস হলে সেই বিশ্বজয়টি হয়েছিল এই জ্যোতিষ্কের হাত ধরে। তাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। এই প্রতিবেদনে এই অন্য প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হল কেন? কারণ এই নিবন্ধে আমরা সন্ধান করব এই যুবকের নিজের রাজ্য বাংলার সঙ্গে ওই ডারবান যাওয়া আইনজীবী মোহনদাসের পরবর্তীকালে ঠিক কেমন সম্পর্ক তৈরি হবে। আর ঘটনাচক্রে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম সাদৃশ্য হল, প্রবাস থেকে ফেরার পর তাঁদের প্রভাব থেকে ভারত মুক্ত হতে পারেনি। দু’জনের পথ ভিন্ন। লক্ষ্য ভিন্ন। কিন্তু তাঁদের প্রভাব ভারতের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জাতিগত আচরণের সঙ্গে আজও সম্পৃক্ত। 
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের মধ্যে মোহনদাস গান্ধী পরিচিত ও সমীহ সৃষ্টিকারী একটি নামে পরিচিত হয়ে গেল। কারণ ব্রিটিশ শাসকদের বৈষম্য, সাদা কালো বিভেদের শাসনপ্রণালী, সামাজিক শোষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই প্রথম আইনি সহায়তা করলেন গান্ধী। মোহনদাস গান্ধী ডারবানে পা রাখার প্রায় ৩৩ বছর আগে প্রথম ভারতীয়দের পদার্পণ ঘটেছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৮৬০ সালের নভেম্বর মাসে এস এস ট্রিউরো নামক একটি জাহাজে করে আখের চাষ, আর চিনির কারখানার জন্য শ্রমিক এসেছিল দলে দলে। সেই শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয় ভারত থেকে। এরপর এই ভারতীয় শ্রমিকরা নাটাল সরকারের রেল এবং কয়লা খনিতেও কাজ পেয়েছিল। ১৮৭০-এর পর ধীরে ধীরে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ঢুকতে শুরু করলেন। উল্লেখযোগ্য, নাটালে প্রথম যে ভারতীয় ব্যবসায়ী আসেন তিনি ছিলেন কলকাতার। নাম আমোদ জাভেরি। সুতরাং ক্রমেই দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতীয়দের বিরাট বড় এক বাসস্থানে পরিণত হয়। কিন্তু ছিল প্রবল বৈষম্য। এই নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও প্রতিবাদের স্বরূপটি জানা ছিল না। মোহনদাস গান্ধী এসে একটা সমন্বয় তৈরি করে সেই পথ খুলে দিলেন। তিনি ব্রিটেনের সরকারকে চিঠি লিখে এবং প্যামফ্লেট জারি করে সরাসরি বিরোধের রাস্তায় গেলেন। প্যামফ্লেটে লিখলেন, ভারতীয়দের ভোটাধিকার দিন। দেখবেন আমি ভোটে দাঁড়ালে ইউরোপীয়রা হেরে যাবে। এছাড়া দীর্ঘ রচনায় তিনি স্পষ্ট জানালেন কেন ভারতীয়রা সমাধানাধিকারের যোগ্য। একই চিঠি তিনি ইংল্যান্ডে পাঠালেন। এবং ভারতের কংগ্রেস পার্টির কাছে। ডারবানে ততদিনে বাড়ি কিনে ফেলেছেন মোহনদাস গান্ধী। ব্রিচ গ্রোভ এলাকায়। যেটি যথেষ্ট অভিজাত পাড়া। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁকে সকলে সম্বোধন করেন গান্ধীভাই নামে। গান্ধী এবার চাইছেন দেশ থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসতে। সেইমতো ১৮৯৬ সালের ৪ জুন মোহনদাস গান্ধী ক্ল্যান ম্যাকলয়েড নামক একটি জাহাজে উঠলেন ভারতে ফেরার জন্য। তিন সপ্তাহ পর সেই জাহাজ এসে পৌঁছল এমন এক শহরে, যেটি ভারতের রাজধানী। তখন, অর্থাৎ ১৮৯৬ সালে ভারতের জাতীয় সংগ্রামের সবথেকে বড় ভরকেন্দ্র। সমস্ত ইন্টেলেকচুয়াল নেতার স্থান। সেই প্রথম এই শহরে পা রাখলেন মোহনদাস গান্ধী। শহরের নাম কলকাতা! সেই শুরু এই শহরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। এই ঘটনার ঠিক ৫১ বছর বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাঙ্ক্ষিত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণের দিনটিতে মোহনদাস গান্ধী নির্জনে একাকী থাকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন তাঁর এই প্রিয় শহরটিকে। সেখানেই শেষ নয়। এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী যুবকের অবিমৃষ্যকারী ঘৃণার প্রেক্ষিতে আকস্মিক জীবনাবসানের প্রাক্কালে কয়েকমাস আগে এই শহরেই তিনি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। অন্তহীন ও নৃশংস দাঙ্গা হানাহানি থামিয়ে হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্য রক্ষার কঠিনতম লক্ষ্যে। ১৮৯৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে যে শহরে তিনি পা রেখেছিলেন প্রথমবার, সেই শহর ও রাজ্য তাঁকে আগামীদিনে দেবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মননের চেতনা এবং সামাজিক চর্চার সুযোগ। কিন্তু সেই শহরে প্রথমে তিনি কতটা গ্রহণীয় হয়েছিলেন? হননি...। 
পা রাখার পর প্রথমেই মোহনদাস গান্ধী গিয়েছিলেন রাজকোটে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে। এরপর তিনি ভারত দর্শনে বেরলেন। প্রথমে বোম্বাই, তারপর পুনে এবং শেষে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। মোহনদাস গান্ধী নিজে লেখা একটি প্যামফ্লেট ১০ হাজার কপি ছাপিয়ে সমস্ত সংবাদপত্র দপ্তর, সংগঠন, রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বিলি করলেন। এই তিন শহরেই তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেন। একাধিক সভা করলেন। কারণ তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার সাফল্য এই দুই শহরই জানে। কিন্তু তিনি ধাক্কা খেলেন অন্য শহরে। কলকাতায়। সেখানে একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা তাঁকে বসার ঘরে ১ ঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন দেখা না করে। এবং তারপর তাঁর একটি বক্তৃতার আয়োজনের প্রস্তাব শুনে তিনি বললেন, তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় সময় দেওয়া। এরকম লোক অনেক আসে। দু’টি সংবাদপত্রের সম্পাদক তাঁকে সেরকম পাত্তাই দিলেন না। মোহনদাস থাকছিলেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। প্রায় দু’সপ্তাহ এই শহরে থেকেও তিনি তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারলেন না। কেউই তাঁর বক্তৃতা অথবা সভার আয়োজন করতে চায় না। প্রথমবারের কলকাতা শহর তাঁকে প্রায় অগ্রাহ্যই করল। 
ফিরে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু পাঁচ বছর পর এই শহরেই তিনি ফিরলেন সম্পূর্ণ অন্য রূপে। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অন্যতম ডেলিগেট হিসেবে। সেবার কলকাতায় বসেছিল কংগ্রেসের অধিবেশন। ১৯০১ সাল। ৮৯৬ জন প্রতিনিধির সিংহভাগই বাঙালি। মোহনদাস গান্ধী অন্যতম ডেলিগেট। তিনি থাকার জন্য উঠলেন ইন্ডিয়া ক্লাবে। জায়গাটি স্ট্র্যান্ড রোডে। সেখান থেকে রিকশ চেপে প্রতিদিন বিডন স্ট্রিটের অধিবেশন স্থলে আসতেন। অধিবেশনটি শুরু হল একটি গান দিয়ে। গানটি রচনা করেছেন সরলা দেবী ঘোষাল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক পরিচিত কবি রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী। সরলা দেবীর সঙ্গে সেই প্রথম দেখা ও পরিচয় মোহনদাস গান্ধীর। সেই সম্পর্ক পরবর্তীকালে আরও ঘনিষ্ঠ হবে। কংগ্রেস অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসেবে মোহনদাস তাঁর বক্তৃতায় বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী ভারতীয়দের প্রতি দেশবাসীর আরও সহানুভূতি কাম্য। বোম্বাই প্রদেশের দুর্ভিক্ষের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা কিন্তু ২ হাজার পাউন্ড নিজেরা ফান্ড তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন পীড়িতদের জন্য। ভারতীয়রা অন্তত কিছু প্রতিদান দিন! দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে ভারতীয়দের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে, এখানে ভারতের নেতা ও মানুষ তার প্রতিবাদে সরব হোন। তাহলেই ব্রিটিশ সরকার নড়েচড়ে বসবে। কংগ্রেসের এই কলকাতা অধিবেশনে মোহনদাস গান্ধীর সবথেকে বড় যে অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক লাভ হল, সেটি মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। গান্ধীকে প্রথম থেকেই পছন্দ করলেন গোখলে। অধিবেশনের পর মোহনদাস উঠলেন কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে গোখলের বাসভবনে। সেখানেই তিনি ভারতের সমাজ, রাজনীতি, সম্প্রদায় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করলেন। একটি নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছিল তাঁর কাছে। ১৯০২ সালের ১৯ জানুয়ারি মোহনদাস গান্ধী ছিলেন একটি সভার প্রধান বক্তা। সেই সভাটি আয়োজিত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে। সেই সভায় তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন গোখলে স্বয়ং। এবং অসম্ভব প্রশংসাবাক্যে। সেই প্রথম কলকাতা তাঁকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করল। ১৯০২ সালের জানুয়ারি থেকে একটানা বহুদিন কলকাতায় রইলেন মোহনদাস। একের পর এক সভায় প্রধান বক্তা তিনিই। শহরটি তাঁকে আকর্ষণ করছিল। কারণ এই শহরের সংস্কৃতি আর মননশীল কালচার। যদিও তিনি সাংস্কৃতিকভাবে তেমন নন্দনচর্চায় আগ্রহী ছিলেন না। তবে ১৮৯৬ সালে প্রথমবার কলকাতায় এসে যখন তাঁর প্রায় কিছুই করার ছিল না, তখন একটি বাংলা নৃত্যনাট্য দেখতে গিয়েছিলেন সময় কাটাতে। ওই প্রথম, ওই শেষ। কলকাতার বাস সমাপ্ত হলে জাহাজে তিনি থেকে রেঙ্গুন চলে যান। ১৯০২ সালের নভেম্বর মাসে ভারত ছেড়ে আবার মোহনদাস গান্ধী ফিরলেন তাঁর কর্মস্থল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওই বছর দু’দফায় মোহনদাস ছিলেন কলকাতায়। এবং একবার তো একটানা দু’সপ্তাহেরও বেশি। কিন্তু এই গোটা সময়সীমা পেরিয়ে গেল, তিনি একবারও কলকাতার পশ্চিম তীরে যাননি। তাই ১৯০২ সালে তিনি কলকাতায় অনেকটা সময় থাকলেও তাঁর সঙ্গে দেখা হল না এক মহামানবের। ১৯০২ সালে যখন আবার তিনি ফিরে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, তখন জানতেই পারলেন না সেই বছরের জুলাই মাসে গঙ্গার পশ্চিম তীরের বেলুড়ের এক নির্জন ঘরে এক মহাপুরুষ অন্য জগতে চলে গেলেন। খুব কাছাকাছি এক শহরে থাকা সত্ত্বেও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে দেখা হল না স্বামী বিবেকানন্দের। 
দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর আরব্ধ কাজকে আরও আগ্রাসীভাবে এবার এগিয়ে নিয়ে গেলেন মোহনদাস গান্ধী। তিনি শুধু নাটাল নয়, ট্রান্সভাল, ফিনিক্স, প্রিটোরিয়া সর্বত্র ভারতীয়দের সমানাধিকারের দাবিতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির রাজনীতি শুরু করলেন। বিশেষ করে একটি প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে যে তীব্র বৈষম্যমূলক আইন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ সরকার কায়েম করল, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ চরমে উঠল। ক্রমেই হয়ে উঠলেন একমেবাদ্বিতীয়ম এক দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় নেতা। ২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম ফিনিক্স থেকে ১৬ জন ভারতীয় ট্রান্সভালে প্রবেশ করার চেষ্টা করল। সত্যাগ্রহের প্রথম নজির। এবং সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল অন্য শহরগুলিতে। আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সমস্ত কাজ বন্ধ করা হল ধর্মঘট ডেকে। শুরু হল গ্রেপ্তারি। বহুদিন দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার দ্বিধান্বিত ছিল গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে... কারণ, তেমন কিছু হলে ফল হবে মারাত্মক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধীর আগ্রাসী অহিংস সত্যাগ্রহে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়রা যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অবশেষে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। তার আগেই গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী। এবং এবার ভারতেও ছড়িয়ে গেল তাঁর নাম। গোপালকৃষ্ণ গোখলে গোটা দেশের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের জন্য অর্থসাহায্যের আবেদন জানালেন। এবং অভূতপূর্ব সাড়াও পাওয়া গেল। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে সাউথ আফ্রিকান ইন্ডিয়ান ফান্ডে একদিন গোপালকৃষ্ণ গোখলের কাছে ১০০ টাকার একটি চেক এসে পৌঁছল অন্যান্য নানাবিধ আর্থিক সাহায্যের মধ্যেই। সেই চেকটি এসেছে কলকাতা থেকে। পাঠিয়েছেন দু’বছর আগে নোবেল প্রাইজ পাওয়া এক কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে একটি চিঠি... আমার দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইবোনেদের জন্য। 
ঠিক পরের মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার কস্তুরবা গান্ধী এবং মোহনদাস গান্ধীকে জেল থেকে মুক্তি দিল। ১৯১৪ সালের ২ জানুয়ারি দু’জন সাহেব দেখা করতে এলেন মোহনদাস গান্ধীর সঙ্গে। ডারবানে। তাঁদের নাম সি এফ অ্যান্ড্রুজ এবং ডব্লু ডব্লু পিয়ারসন। দুজনেই দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অধ্যাপক। তাঁদের ডারবান পাঠিয়েছেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার ও ভারতীয়দের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য। তাঁরা বললেন, আপনার কথা গুরুদেবও বলেন। মোহনদাস বিস্মিত! গুরুদেব আবার কে? 
ইতিমধ্যেই একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই বিষয়গুলির প্রতিপাদ্য অনেক বিস্তারিত। মূলত ভারতীয়দের অধিকার, বিবাহ, কাজের বণ্টন এবং আন্দোলনে গুলিচালনা ইত্যাদি নিয়ে। রিপোর্টে কমবেশি মোহনদাস গান্ধী সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এবং তারপরই তিনি ঠিক করলেন, তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগের সময় হয়েছে। এবার নতুন কর্মক্ষেত্র ভারত। গোপালকৃষ্ণ গোখলে বারংবার সেটাই চাইছিলেন। ভারত অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। কেপটাউন থেকে ১৯১৪ সালের ১৮ জুলাই মোহনদাস গান্ধী ও কস্তুরবা জাহাজে চাপলেন লন্ডনের উদ্দেশে। লন্ডনের হোটেল সিসিলে একটি রিসেপশন পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভায় প্রধান অতিথি মোহনদাস গান্ধী ও কস্তুরবা গান্ধী। সভাটিতে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন ভারতীয় নেতাও। তাঁদের মধ্যে তিনজন গান্ধীর সঙ্গে বারংবার এগিয়ে এসে কথা বলছিলেন। তাঁদের নাম সরোজিনী নাইডু, লালা লাজপৎ রাই এবং আর একজন লম্বা ভদ্রলোক। মহম্মদ আলি জিন্না। আশ্চর্য ব্যাপার! এই ভদ্রলোকের বাড়িও কাঠিয়াওয়াড়ায়। মোহনদাসের পৈতৃক ভিটে যেখানে। এই ভদ্রলোকও মোহনদাসের মতোই লন্ডনের ইনার টেম্পলে আইন পড়েছেন। এবং ইনিও বম্বে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন মোহনদাসের মতোই। পরবর্তীকালে এই আইনজীবীর সঙ্গে মোহনদাস গান্ধীর সবথেকে বড় বিরোধ তৈরি হবে। এবং ভারতবর্ষের সবথেকে বৃহৎ ট্র্যাজেডির কারণ হবেন এই ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট বলা রোগাটে চেহারার ভদ্রলোক। 
‘এস এস আরাবিয়া‘ নামক একটি জাহাজে ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি সকাল ৯টার সময় মোহনদাস গান্ধী ভারতে নামলেন। একমাস পরই তিনি যখন পুনেয় গোপালকৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে দেখা করে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য মনেপ্রাণে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তাঁর কাছে একটি চিঠি এল। সেই সি এফ অ্যান্ড্রুজ চিঠি লিখেছেন। এতদিনে মোহনদাস গান্ধী জানতে পেরেছেন এই সি এফ অ্যান্ড্রুজ ও ডব্লু ডব্লু পিয়ারসন সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে পড়ালেও তাঁরা মনেপ্রাণে একজনের ভক্ত এবং শিষ্যও বলা যায়। তাঁকেই এঁরা গুরুদেব বলেন। তাঁর একটি আশ্রম রয়েছে। আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অভিনব। অ্যান্ড্রুজ লিখেছেন একবার এখানে আসুন। মোহনদাস গান্ধী রাজি হলেন। ২২ বছর পর স্থায়ীভাবে ভারতে ফিরে তিনি সর্বাগ্রে সেই আশ্রমে গিয়ে বেশ কিছুদিন সময় কাটিয়ে অভিভূত হলেন। এবং সেখান থেকেই তাঁর প্রকৃত ভারতদর্শন শুরু হল। পরবর্তী সময়ে বারংবার তিনি আজীবন ওই আশ্রমে যাবেন দিশার জন্য, শান্তির জন্য। আশ্রম পরিচালকের সঙ্গে অনেকবার মতান্তর হলেও তাঁর পরামর্শ সবথেকে মূল্যবান ছিল মোহনদাসের কাছে। আশ্রমটি বংলায় অবস্থিত। নাম শান্তিনিকেতন। এই আশ্রম থেকেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর যাত্রা শুরু হয়েছিল এক নতুন অস্তিত্বের দিকে। সেই অস্তিত্বের নাম—মহাত্মা গান্ধী।