শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

করোনা কালের ডায়েরি, প্রথম পাঠ

ঘুম থেকে জেগে উঠলেই খালি খারাপ খবর, খালি খারাপখবর ...কার শরীরে করোনা সংক্রমিত হলো ...কারা কোয়ারেনটাইনে গেল , কারা হাসপাতালে ভর্তি হলো , কে ভেন্টিলেশনে গেল , কে আর টিকে রইলো না ...।মনে মনে কর গুনে গুনে হিসেব করলেন শেখরবাবু , এ ভাবেই ছটা মাস পেরিয়ে এসেছেন ! কী অব্যক্ত যণ্ত্রণা , আতঙ্ক আর উত্তেজনারপারাবার সাঁতরে এখনো বেঁচে আছেন তিনি । আর কতোদিন এভাবে সাঁতরাতে হবে তাঁকে । ততদিন বেঁচে থাকবেন তো তিনি ? এই অন্তরীণ দশা আর কতো দিন ? নিয়মিতসকালসন্ধের হাঁটাটাতো প্রায় ভুলেই গেছেন । সকালসন্ধের বন্ধুদের মুখ দেখা হয় না অনেকদিন । হাঁটা হয়না বলে হাঁটুতে আজকাল ব্যথা ওঠে । কেউ কেউ ফোন করলে এ কথাই দুঃখ করে বলেন তাঁদের তিনি ।

তিনি নিজে কাউকেফোন করলে কোনো ভালো খবর পান না ।যাকেই ফোন করেন সে যেন সব তাজা তাজা খারাপখবর নিয়ে তৈরিহয়েই বসেথাকে। একবার এক বন্ধুকে তার কুশলজানার জন্যে ফোন করলে ওপার থেকে সে অনেকটা ফিলোসফাররের মতো জবাব দেয় ---

--- আরে বন্ধু , আমি কেমন আছি নিজেই বলতে পারছি না , আজ যদি বলি ভালো কাল হয়ে যাবে খারাপ ।শুনেছেন তো আমাদের অত্যন্ত কাছের একজন বিজ্ঞানমঞ্চের পুরোধা তপোতেষবাবু হাসপাতালে ...

শেখরবাবুঅনেকটা হিক্কে খেয়ে জানতে চাইলেন , ' কি হয়েছে ওর ? '

--- কি হয়েছে আবার , ওটাই , করোনা ...

শেখরবাবুথম মেরে যান ,তাঁরমুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না ...

শেখরবাবুকোনো কথা বলছেননা দেখে ওপারে মোবাইল অফ করে দেয় ।

এরপর শেখরবাবুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে , তপোতেষকী ভাবে আক্রান্ত হলেন ! ওর জীবনযাত্রা তো খুব সাবধানী । প্রয়োজন ছাড়া তো তিনি এমনিতেই ঘর থেকে বেরোন না । বিজ্ঞানমঞ্চনিয়েই মেতে থাকেন । এ ভাবনাটাই শেখরবাবুকে কুরে কুরে খাচ্ছে কয়েকদিন ধরে । সদ্য এম টেক পাশ করা তাঁর একমাত্র নাতি শুভরকানে যখন খবরটা পৌঁছুলো , সে বলে উঠলো , আরে ঠাউদ্দা, বিশেষজ্ঞরা কইতাছে , করোনা ভাইরাস অখন বাতাসে বাতাসে ঘুরতাছে । কুনো করোনা রুগী যদি কাশে বা হাঁচি দেয় তার রেণু একশ চল্লিশ কিলো মিটার দূর অব্দি হাওয়ায় ভাইস্যাযাইতে পারে , সুতরাং ...

নাতির কথা আর কী শুনবেন , তিনি যেন ধ্বসে যেতে থাকলেন । গতকালই তো বাজার করতে গিয়ে এক সবজিওয়ালাএকটা জোরে হাঁচি দিয়েছিল ।তখন তো তিনি কাছেই ছিলেন ।হাত -পা দুটো তাঁর কাঁপতে থাকে ।তাঁর বুঝি সময় ঘনিয়ে এলো।তার ওপরবুড়োদের নাকি করোনা ঝটপট জাপটে ধরে ।শেখরবাবুর মাথা কুটতে ইচ্ছে করছে , কেন এতো তাড়াতাড়ি তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন ।বার্ধক্যেরপরও যদি শৈশব আর যৌবনকালটা আবার ফিরে আসতো !এ সময়টায়তাঁর শৈশব আর যৌবনেরদিনগুলির কথা খুব মনে পড়ে ।প্রতি রাতে স্বপ্নও দেখতে থাকলেন শৈশবের খোলামেলা আনন্দের দিনগুলি ,দুর্গোৎসবের মেলায বন্ধুদের সংগে চরকি ঘোরাতে ঘোরাতেঘুরে বেড়ানো , বার্ষিক পরীক্ষার পর হাড় কাঁপানো শীতের দিনে বড়দের সংগে পাহাড়ের ঝরনার কাছে কুয়াশার ভেতর দিয়ে বনভোজে যাওয়া । ছুটির দিনের শীতের দুপুরে খাওয়ার পর বারান্দায় রোদ পিঠে নিয়ে শুয়ে শুয়ে ' আম আঁটির ভেঁপু ' , ' ঠাকুরমার ঝুলি ' , ' শুকতারা ' পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া । ...আজো তাই হলো ...!

ওই মুহূর্তেই শ্যামলীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল শেখরবাবুর। সকাল হয়ে গেছে । শেখরবাবুর তো এইবয়সেদুবার ঘুম ভাঙে।প্রথম বার রাত সাড়ে তিনটা । এরপর এক ঘন্টা লেখার ঘরে , এই সময়টায় মাথাটা বেশ ফ্রেস থাকে , আখ্যানের জটগুলিখুলে যায় ।কোনো কোনো দিন একটুধ্যানও করে নেন... তারপর আবার বিছানায় গিয়ে একটু গা এলিয়ে দেন ।স্বপ্নগুলো তখনইআসে ...। আজকের ওই স্বপ্নগুলো ভেঙে দিয়েশ্যামলী বজ্রপাতের মতো একটা খবর দিল , শুনছ , রতন ঠাকুরপো এই মাত্র খবর দিল ভাস্করদামারা গেছে ...

শেখরবাবুআঁতকে ওঠেন , কওকি !

--- হ , চাইরদিন ভ্যানটিলেশনে আছিল ...।

ভাস্করকে করোনায় ধরেছিলআগেই জেনেছিলেনশেখরবাবু।কিন্তু এ ভাবে চলে যাবে কিছুতেইমেনে নিতেপারছেননা তিনি।এই ভাস্কর তাঁর শৈশবের সহপাঠী । শৈশবের সহপাঠীরাযৌবনে এসে হয়ে গেছিলবন্ধু। ওই বন্ধুদের কেউ কেউ আজ আর এ পৃথিবীতে নেই । শেখরবাবু মনে মনে ভেবে এই স্বস্তিটুকুপেলেন যে , ওদের আর এই করোনার জ্বালা পোহাতে হলো না ! কিন্তু ভাস্করের তো পোহাতে হবে । অজান্তেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো শেখরবাবুর । এই করোনাকালে মরেও তো শান্তি নেই ! পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া যায় না । স্বাস্থ্য-কর্মীর লোকেরা শহরের বাইরে কোথায় কোন ঝোপে-জংগলে পুড়িয়ে ফেলছেকেউই জানতে পারে না ।পরিবারকে শুধু ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয় বডি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।শেখরবাবুভাবতে থাকেনতাঁরও যদি করোনায মৃত্যু হয় এই অবস্থাই হবে । চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো তার । ...

কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে যায় শেখরবাবুর , ভাস্করের বৌ । তাঁরও বাল্যসঙ্গিনী ছিল । দুই ক্লাস নিচে পড়ত , একই স্কুলে । মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলায় সেও অংশ নিত । মেয়েরা কেউ বাধা দিত না । কি কারণে যেন তাঁকে নিয়েকৃষ্ণার মাতামাতিটা বেশি ছিল । সে-ইতাঁকে ডাকতো খেলার জন্য ।কৃষ্ণা কখনো কখনো আসতো তার বাড়িতে এক্কাদোক্কা খেলতে, মাঝে মাঝে লুডো । শেখরের মা খুব আদর করতনকৃষ্ণাকে । কাছে ডেকে চুমো দিতেন । হাতে তুলে দিতেন খইয়ের মোয়া । শেখরও যেত কৃষ্ণার বাড়ি । কৃষ্ণার বাবা ছিলেন রেলের ডাক্তার । স্বভাবতই স্বচ্ছল পরিবার । নানা ধরনেরখেলাধুলোর সরঞ্জাম থাকতো ওদের বাড়িতে ।খেলনাও ছিল নানা কিসিমের । দুজনে খেলায় মেতে উঠত।এ ভাবে খেলায় খেলায়দিন কাটতে কাটতে কৃষ্ণা যেন একদিন ওর গার্জেন হয়ে উঠেছিলো।যেন দিদি । আচরণে ব্যবহারে ও- রকমই করতো ও । আর শেখরও ওর সব আজ্ঞা-হুকুম আনন্দে মাথা পেতে নিত ।অবজ্ঞাকরতে পারত না ।কৃষ্ণার বিরুদ্ধে যেতেও মন চাইত না । ওর সব আদেশ তালিম করলে কি যে খুশি হতো কৃষ্ণা ! ! শেখরও হেসে ফেলত । কেমন একটা মিতালির মজা খুঁজে পেয়েছিল ওরা । এরপর একদিন কৃষ্ণার বাবা লামডিং হাসপাতালে বদলি হওয়ার ফলে কৃষ্ণাদের সবাইকে পান্ডুর পাট চুকিয়েচলে যেতে হয়েছিল সেখানে । কৃষ্ণার সংগে দীর্ঘদিন আর কোনো যোগাযোগ ছিল না শেখরের ।

space ##

যৌবনের মধ্যপ্রান্তে কৃষ্ণা অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই পান্ডুতে ফিরে এসেছিল ভাস্করের বৌ হয়ে । ভাস্কর তখন ওয়েল কোম্পানির একজন ডাকসাইটে ইন্জিনিয়ার । বৌভাতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন শেখরবাবু। ভাস্করের জোরাজুরি সত্ত্বেও সেদিনকৃষ্ণার কাছে যাননি তিনি। দূর থেকে দেখে ভাস্করের বোনের হাতে উপহার হিসেবে দেওয়া রবিঠাকুরের 'শেষের কবিতা ' বইটি দিয়ে চলে এসেছিলেন।তখনও শ্যামলী তাঁর জীবনে আসেনি । কৃষ্ণাকে দেখতে সেদিনলেগেছিল একটা ডানাকাটা পরি ।আজ সেই কৃষ্ণা স্বামী হারা হলো । শেখরবাবুর ইচ্ছে হলো এই বিপদের দিনে এখনই গিয়ে কৃষ্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। যদিও ভাস্কর ওর দুই উপযুক্ত ছেলে মেয়েকে রেখে গেছে কৃষ্ণার কাছে।বৈভবের অভাব নেই । তবুও শেখরবাবুস্বীকার করেনিতে পারছেননা করোনার প্রকোপেই যে ভাস্করের মতো একজন সদাচারী বন্ধুর মৃত্যু হতে পারে । স্বীকার করে নিতে পারছেননা, কৃষ্ণার মতো সরল মেয়েটির এই অকাল বৈধব্য ।ওর স্বামীহারার আর্তবেদনাযে তাঁরও বুকে বাজছে নিরন্তর । শ্যামলী কোথায় ? ও তো তাঁকে খবরটা দিয়ে গেল যেআর দেখা নেই । নাতনি সাগরিকাজানালো , শ্যামলী নাকি কৃষ্ণার কাছে গেছে ।

...এমন সময় মোবাইলটাবেজেওঠে।শেখরবাবুমোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখেনভবানীস্যারের ফোন । অনেকদিন পরস্যারের গলা শুনে পুলকিত হয়ে উঠলেন শেখরবাবু । ভবানীস্যার তাঁর ছাত্রকালের বাংলার মাস্টারমশাই । তৎকালীন কলেজ পড়ুয়া বা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন অনেকটা গডফাদারের মতো । অত্যন্ত জনপ্রিয় । তিনি এখন থাকেন শিলিগুড়ি । বয়েস পঁচাশিছুঁয়েছে ।তাঁর সংগে শেখরবাবুরফোনে যোগাযোগ প্রায়ই হয় । স্যার আবেগমথিত হয়ে প্রায়ইবলেন , ' শেখর, পান্ডু ছেড়ে চলে এসেছি কতদি-ন হয়ে গেল , কিন্তু পান্ডুর স্মৃতি কখনোই ভুলবো না , তুমিই তো নিয়মিত যোগাযোগ রাখো আমার সংগে, তোমার মাধ্যমেই পান্ডুর সব খবরাখবর পাই, তুমি ফোন করা বন্ধ করো না ...' । এরপর আলাপচারিতায়কুশল বিনিময় দিয়ে শুরু হয় তারপর সাহিত্যের খবর , লেখালেখির খবর , শেখরবাবু যে পত্রিকাগোষ্ঠীতে আছেন সে -গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের খবরাখবর নেন তিনি। কিন্তু আজ স্যারের গলার স্বরটাঅন্য রকম ।শুরুটা এভাবে করলেন ---

--- কী হলো শেখর অনেকদিন হয়ে গেল তোমার কোনো ফোন পাচ্ছি না , কী ব্যাপার বলো তো ? কোথায় তুমি আমার খোঁজ নেবে তাই না, অবশেষে আমি চিন্তায় পড়ে তোমায় করলাম , ভালো আছো তো ?

শেখরবাবুকোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেননা । ভালোর চিরাচরিত সংজ্ঞাটিতাঁর কাছে এখন বেমানান মনে হচ্ছে ।

--- ভালোর অর্থ ভুলে গেছি স্যার ...

ওপারে নৈঃশব্দ্য ।

তারপর এক সময় বলে ওঠেন , হ্যালো হ্যালো তুমি শেখর বলছো তো ?

--- হ্যাঁ স্যার আমি শেখর বলছি ...

--- কিন্তু তোমার গলার স্বর চেনা যাচ্ছে না কেন ? কেমন কাঁপা কাঁপা মনে হচ্ছে ...

--- কথা বলতে ভুলে গেছি স্যার ...

--- এতোই ভেংগে পড়লে !

--- চারদিক থেকে শুধু মৃত্যুর খবর পাচ্ছি স্যার, আমার নিকটাত্মীয়রমৃত্যু , কাছের বন্ধুর মৃত্যু , প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু ...

বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে শেখরবাবুর ।

ভবানীস্যার বলে ওঠেন , অতো মৃত্যুর কথা চিন্তা করলে সত্যিকারের মৃত্যুর আগেই তো তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে , মানসিক মৃত্যু । এই মৃত্যুর তো যন্ত্রণা অসীম , রন্ধ্রে রন্ধ্রে তুমি অনুভব করবে ...এই সময় চেষ্টা করতে হয় মনটাকে শক্ত করতে , কাজে ডুবে থাকতে ...


ক্রমশ ...