রত্নদীপা কথা ঃ রত্নদীপা দে ঘোষ। জন্ম ১৯৭২, কোচবিহার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। বর্তমানে কর্ণাটকের বাসিন্দা। নেশা, একাকাশের তান। পেশা, পাখিলেখা বাগান। তুঙ্গভদ্রার কলমে, গ্রীষ্ম-কুয়াশার অক্ষরে কী যেন একটা খুঁজছেন!
প্রবন্ধ-গদ্যেভোর, নিসর্গে-দেরাজ নাকি পিলসুজে সুর? যে আজো সঠিক তরঙ্গে হারমোনিয়াম ব্যবহার শেখেনি, নাকি কবিতা? অথবা কবিতার মতো দেখতে অন্যকিছু?শতচ্ছিন্ন স্মৃতি? কোলাহল দোপাটি? হয়ত নিজেকেই। অথবা অন্য কাউকে। খোঁজাখুঁজি চলছে হন্যে হয়ে।
এই হন্যেটুকুই রত্নদীপা ।
শিশুচোখে –
শাড়ি মানেই মা। আলোর কুসুম গড়া। হালকা ছাপা শাড়ি। লালফুল নীলাকাশ পাখিপলক আঁকা সেইসব শাড়ি। দুধেঘ্রাণ কাশফুল। মায়ের আঁচলে কতো অজস্র তারাফুল ! আদর আদর আর আদর। আকুলি আর বিকুলির ধনেখালি, কখনো আবার তাঁতের ফুলকারি পরতেন মা, যখন স্কুলে যেতেন। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাদেমির শিক্ষিকা আমার মা, আমার সারাদিন কাটতো ঠাকুমাদাদুর কাছে।
ঠাকুমাকে আমি ডাকতুম আম্মা। আম্মার শাড়িঘ্রাণ বড়ই মনোরম। গাঁদাফুলের বাগান। এক ছটাক উঠোন সেই নক্ষত্রের গন্ধ। আর আমি সেই শাড়ি জড়ানো কোলভরা দুপুর থেকে বিকেল যতক্ষণ না মা বাড়ি ফেরেন!
আমার আম্মা সাধারণ ভাবে শাড়ি পড়তেন! অপূর্ব রাজকীয় ছিল সেই পরার ধরণ। শিশুগান শিশুছড়া রূপকথা গল্পেগড়া ছিল সেইসব শাড়ি। আম্মাকে জড়িয়েই দুপুরের ঘুম, বিকেলের দুষ্টুবেলা। মিঠেতান। মা ফিরতেন সাড়ে চারটে নাগাদ। মা’কে দেখেই শিশুআমি এক ঝাঁপ। এক কোল থেকে অন্যকোল।
কুন্নুর সিল্ক
এক শাড়ি থেকে অন্য শাড়ি। শাড়িদের গোত্রবর্ণ আলাদা, একটি শাড়ি রঙ্গন রংদার, অন্য শাড়িটি সাদা, লালপাড়। অথচ দু’জনের আদরের আকার এবং আয়তন এক।
দুইটি অসমবয়েসী শাড়ির মাঝে আমি যেন একটি ছোট্ট-দুলুনি।
বালিকাচোখে –
একটু একটু বড় হতে শুরু করেছে আকাশ, দিগন্তের রাজপুকুর। দীঘিপাখির দল। স্কুলদুপুর। পাঠশালা-নূপুর। চক আর স্লেটপেন্সিলে কথাবলা। নীলনবগগনে বর্ষা-অঝোর ছুটিদুপুর। মনে হত এক ছুটে বড় হয়ে যাই। মায়ের মতো, ঠাকুমার মতো। যখন তখন আলনা থেকে টেনে নিই মায়ের ঘরেপরা শাড়িদের। অপটু হাতে কোমরে জড়াই। শাড়ি তো নয়। সমুদ্রমহা। যতোই পরিধান করি, ফুরোতে চায় না সেই বৃহৎ সাগরের রহস্য অমনিবাস। ভাবি, মা- আম্মা যে কী করে সারাদিন শাড়িবন্দি থাকে। আমি যে এর কূল দেখতে পাইনে, কিনারাই বা কই। বারবার চেষ্টা করি, করতেই থাকি মায়ের মতো, কখনো আম্মার মতো … কিছুতেই পেরে উঠি না …
শেষ অবধি মায়ের কাছে গিয়ে বায়না, আম্মার কাছে আবদার! কখনো মা পরিয়ে দেন কখনো আম্মাশাড়ি। অই ছোট্ট শরীরে অতোবড়ো শাড়ি ধরে নাকি!
কিন্তু কী করে কী জানি, ওঁরা দুজনেই সেই অসাধ্য সাধনটি করতে পারতেন। আমি সেই শাড়ি পরে কখনো মায়ের মতো স্কুলদিদিমনি আবার কখনো আম্মার মতো পানের বাটা, সুপুরি মশলা সহ গৃহিণী! সংসারের রংমঞ্চে অবতীর্ণ হই। কী যে মজার ছিল, সেইসব রান্নাবাটির স্বর্ণজরি।
শাড়িভরা এইটুকুনি আমি, চোখে টুকিখেলার জারদৌসী। লুকোচুরির কারুকাজ!
ঢাকাই জামদানি
প্রাক-কিশোরী হ্রদবালিকার সুবর্ণভাণ্ডার, জগৎ ও বটে।
কিশোরী চোখে-
শরীর জাগছে, খুশবুদারপরম। জাগছে মনবীণ। আমি সেইসব বকুলরঞ্জিত সুবাতাস কর গুনে শেষ করতে পারি নে। বুলবুলির পোষা লাস্যহরিণের চমক ক্রমশ বাড়িয়ে দ্যায় গানসাইকেলের গতিবেগ। তখন আমি নবম শ্রেণী, তখন আমি শাড়িভরা তন্ময়শিখা।
সুনীতি অ্যাকাদেমির ড্রেস ছিল সাদা শাড়ি সবুজ পাড়। প্রথম শাড়িপরার একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে, আশ্চর্য মেধাঘরানার দ্যুতি। যেন প্রথম চন্দ্ররমণীর আসমান, পরতে পরতে আলোরম্ভা, চুম্বকেরঅপ্সরা।
নিজেকে বারবার আয়নায় দ্যাখা। দ্যাখার শেষ নেই যেন। মনে হয় চিনি বুঝি শাড়িবালিকার অতল-খনি।
আসাম সিল্ক
সেই স্কুলপোশাকের নিজস্ব জৌলুস নেই, কিন্তু আমার শরীরেই জমকালো, অজস্র রাজার প্রতাপ।জোনাকির লাবণ্য। সসাগরা রামধনু, আলেয়ার উদ্দীপনা। সবুজ পাড় শুধু পাড় তো নয়, হাজার মৃগশিরার রূপলাবণ্য। কুচি যদিও পাঁচমাত্রার অধিক নয়, তবু যেন অনন্ত কুতূহলী রাজকন্যানদী। বুকের পাড়ায় দুয়ার হাজার লাখো পলাশ, মাঝে মাঝে উঁকি ময়ূরের ম্যুরাল। অপাপবিদ্ধা সূর্যালোক। ভুবনমোহিনী কাহন!
এরই মধ্যে পুজো আসে। দিগবিদিক শাড়ির ছটা। বিশেষ করে, সরস্বতীপুজোর সকালগুলোহলদে আভাযুক্ত। রক্তগাঁদার ছিটকিনি খুলে গেলে, অজইস্র গোমেদবতী আমি। হাতভরা পুষ্পাঞ্জলি। কিশোরী থেকে যুবতী হবার মুহূর্তেপেখমের বনিবনা দশমিকের বিনুনি খুলে দিচ্ছে কে? কে শোনাচ্ছে বিহ্বল বিহঙ্গের আশ্চর্যগীতি? কে পাঠ করছে রতিসিন্ধু বালক, বৃন্দাবন-নামা? কার চুম্বনে কেঁপে কেঁপে উঠছে মুরলীর কেয়া।
আর কে? অই যমুনা বিস্তৃত অগাধ রেশমের শাড়িটি। সে-ই আমাকে শেখাচ্ছেআলো বাসতে, ভালো বাসতে! সৎ স্বরে সঙ্গীতকের বসুধাকে চোখে টেনে নিতে আদেশ দিচ্ছে তো সে-ই।
যুবতীচোখে –
এখন শিখরবর্শা তন্বীশাড়িটি, যুবতী ঘোর। পূর্ণ থেকেও অধিক তীব্র তীর। মশালের মআগুন মন্তাজের বারোয়াঁ। । আলমারি বোঝাই। কেউ বালুচরি, সিল্কপশমে বোনা সীতাকাহিনী রোমন্থন। কেউ আবার একঘর ডাকবাক্স। আঁচলে আঁকা চিঠিবুনটের তুলি। কোনটির কুচিবোঝাই কাঁথাকাজের পাখিসংসার।
একটি শাড়ি তো প্রতিদিন ভোরবেলায় একতারা, আমাকেশোনায় বাউলরাগ। বর্ষাকালের প্রধান শাড়িটি রেইনিডে আঁকা, কেবলি নৌকোছন্দে ভাষায় আমার গোধূলি।
পৈঠানি সিল্ক
আরেকজন শাড়ি, সোনার গরদে সিঁদুর লাবণ্য উপচানো।আরেকটি শাড়ি পাড়ের দিকে জংলাছাপ। একটি শাড়ি এমন গাঢ়সবুজ যে তাকে পরিধান করলে লোকে আমাকে বৃক্ষকন্যা বলে, ডাকে। আরেকজন শাড়ি রয়েছে, ওজনে হাল্কা থেকে ভারি গভীর রহস্যের যাদুকাঠি। এই শাড়িটিকে আমি ম্যাজিসিয়ান বলে ডাকি।
আম্মার বিয়ের বেনারসিটিকে আমি গুছিয়ে রেখেছি একদম ওপরের তাকে। মেরুন রঙের। দোপাটির সেতার, হারমোনিয়ামের গোলাপে ছয়লাপ সেই শাড়ি। বিবাহের জ্যোৎস্না বেজে ওঠে সেই শাড়িকণ্ঠে, আমি শুনতে পাই কবেকার শুকসারিস্বর্ণসুধায় আক্রান্ত।চরম ভ্রমরগুঞ্জন, ঝিকমিক রূপকথার বাসর যেন। যেদিন এই শাড়িটি আমাকে পরে, সেদিন ঠিক ছোটবেলার মতোই আসর সাজিয়ে আমাকে গল্প শোনাতে বসেন আমার দাদু আমার আম্মা!
কথাকলি শাড়িটি, বাবার দেওয়া প্রথম উপহার আমার মা’কে।
অজস্র সরোদ আকা এই শাড়ি মায়াবী গানধানে পূর্ণ। নরম আর লক্ষবুটির তুলতুলে সানাইক্ষেত। এমন বিবাহের ঝঙ্কার প্রজাপতির স্রোত আজকাল আর দ্যাখাই যায় না। রেকাবিময় ফসলফুল, ফিনকি দেওয়া রোদের ফলন। সেলাই হয় না এমন সব পংক্তির মসলিনে ঘেরা এই শাড়ির চিদাকাশ, আঁচলের অবকাশে দুইটি ছুটিপেয়ালা। প্রাচীরে খোদাই তেষ্টা আর পিপাসা, কয়েক বর্গমাইল ওষ্ঠপ্রান্তর।
এমন গভীর বরজের বুনন আর পিউকাঁহার রেখাদীপ্ত এই শাড়ি যে অমিত আর লাবণ্যের দেরাজটিও মানে হার! এই শাড়ি পরলেই আমার মেয়ে বলে, ‘ মা, তোমাকে একদম কবিতার মতো দ্যাখাচ্ছে!’