শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

আমরা শাড়ি পরব না, পরব না শাড়ি, পর্ব --১০

মেঘমালা দে --

অধ্যাপনা করেন । পড়তে ও পড়াতে ভালোবাসেন । মেঘমালা শিলচরের মেয়ে । কাব্যে ও গদ্যে সমান হাত । অন্যদেশের শাড়ি সিরিজে মেঘমালা বলছেন , 'শাড়ি মানে নস্টালজিয়া' ...

শাড়ি মানেই শৈশব কৈশোর পেরিয়ে বড়ো হয়ে ওঠা।

শৈশবে মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে, চোখে কিছু পড়ে গেলে মায়ের শাড়ির আঁচল পাকিয়ে গরম ভাপ নিতে নিতে, একটা একটা করে কুঁচি দিয়ে আঁচলটাকে পরিপাটি করে মায়ের শাড়ি পরা অবাক চোখে দেখতে দেখতে একটাই আবদার -
আমি শাড়ি পরব না মা?

5f95c43c94754.jpg


আমার মা কলেজে পড়াতেন। রোজ কলেজ যাওয়ার সময় এই একই বায়না করতাম। হাতে সময় থাকলে মা পরিয়ে দিতেন বিশাল দশ হাত শাড়িটি ভাঁজ করে ছোট্ট আমিকে, আর যেদিন সময়ে কুলোতো না সেদিন আমি নিজেই দুটো গামছা দিয়ে পরে নিতাম আমার শাড়ি সাহায্যকারী সেদিন আমার দাদু। তারপর মা কলেজে চলে গেলে ছোট্ট দিদিমণি আমি-র শুরু হতো স্কুল স্কুল খেলা।
গামছা দিয়ে শাড়ি পরার পাট চলতে চলতেই আমার দিদিমা নবদ্বীপ থেকে আমাকে এনে দিলেন একটা ছোট্ট শাড়ি। আমার মাপে আমার নিজস্ব শাড়ি! যেন সাত রাজার ধন সেদিন আমার হস্তগত।

5f95c477f36f9.jpg


সেই ছোট্ট শাড়ির পাট চুকতে চুকতেই এল সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পরার পালা। তখন আরেকটু বড়ো। বছরভর অপেক্ষা এই দিনটির জন্য সমস্ত স্কুলজীবন। সারা বছর জুড়েই মায়ের শাড়ি ভাঁড়ার ঘাঁটাঘাটি, কোন শাড়িটা পরতে হবে ওইদিন।
সেই ছোট্টবেলা থেকেই একটা ব্যাপার খুব নিশ্চিত করে বুঝে নিয়েছিলাম বা নিজের মনে স্থির করে নিয়েছিলাম যে শাড়ি পরা মানেই বড়ো হয়ে গেছি। শাড়ি পরলেই নিজের অজান্তেই যেন আরো একটু বাড়তি গাম্ভীর্য আমাকে জড়িয়ে ধরত। জানিনা সব মেয়েরই হয়তো ছোটবেলায় এমন হয়। 'ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরা' কথাটা মানেই তো বোধহয় তাই।

5f95c49f1a25e.jpg


জানিনা এখনকার বাচ্চা মেয়েরা মায়ের কাছে শাড়ি পরার জন্য বায়না করে কিনা কিংবা করলেও শাড়ি মানেই একটা মা মা গন্ধ, এমন সুখানুভূতিতে তাদের বুক তির তির করে কিনা। কারণ ঘরোয়া পোশাক হিসেবে মায়ের শাড়ির আঁচল হারিয়ে যাচ্ছে নাইটি আর টি-শার্টের রমরমায়। আমাদের সবার কাছেই আসলে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মহিলা আমাদের মা, আর এখনো আমরা যারা মা এবং শাড়িকে অভিন্ন করতে পারি না তারা যতই রকমারি ডিজাইনের পোশাক পরি না কেন আসলে শাড়িতেই আমাদের সবথেকে সুন্দর দেখায় এই সত্যটি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারিনা। কর্মব্যস্ত জীবনে নানা দৌড়ঝাঁপের জন্য চুড়িদার কিংবা জিন্স শাড়ি থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবশ্যই জানি এবং মানি কিন্তু মায়ের মতো সুন্দর হতে হলে শাড়িই এক এবং একমাত্র।
সারাবছর তেমন করে শাড়ি পড়া হয়না রোজ সেই দৌড়ঝাঁপময় জীবনের ঘানি টানা জন্য। তবে সুযোগ পেলেই শাড়ি পরি, মনে মনে আজও আরেকটু বড়ো হয়ে উঠি আরেকটু গাম্ভীর্য জড়িয়ে নিই সেই ছোট্টবেলার অভ্যেসে। যে কোনো ছিমছাম হালকা শাড়িই পছন্দের তবে খুব ভালোবাসি তাঁতের শাড়ি।

5f95c4f1397a5.jpg


প্রতিদিনের দৌড়ঝাঁপ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুজোর কটা দিন আমি নিজের মতো করে ঘরে শুয়ে বসে, বই পড়ে, বারান্দায় বসে অগুনতি মানুষের সুন্দর করে সেজে গুজে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া দেখে দেখে কাটাতে ভালোবাসি। ঘোরাঘুরি করতে বের হই না ঠিক কিন্তু একবার কোনো একটা মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করে আসি এবং অবশ্যই তা শাড়ি পরে। পূজোর শাড়ি অনেকগুলো জুটে যায় পুজোর ক'দিন আগেই। প্রায় সবগুলো শাড়িই ষষ্ঠীতে কলেজ বন্ধ হবার আগেই পরে নিই। আমার পূজোর শাড়ি পুজোর আগেই পরা হয়ে যায় কলেজে। নতুন শাড়ি না পরে ফেলে রাখার মতো মানসিক জোর জুটিয়ে উঠতে পারেনি আজও, হল-ই বা সে পূজোর শাড়ি। পরতেই হবে।

এবারও হোক না যতই করোনা কাল, থাকনা যতই বিধি নিষেধ তাই বলে পূজোর শাড়ি পড়বো না?

অবশ্যই পরবো শাড়ি দিয়েই হবে শারদীয় পূজা।