মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪

​সত্যজিৎ পারাবারে – ‘ছেলেরা করে খেলা’

বাংলা শিশুসাহিত্যের জগৎ খুবই সমৃদ্ধ। প্রথম যাঁদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার। এঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যে পরিবারে সত্যজিতের জন্ম, সেই ‘রায়চৌধুরী’ পরিবারের মত প্রতিভাসম্পন্ন পরিবার বাংলায় দুর্লভ। এই পরিবারের প্রথম যিনি বাংলা শিশু সাহিত্যে সাড়া ফেলে দেন তিনি নিঃসন্দেহে উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর রচিত বইগুলোর মধ্যে ছিল টুনটুনির বই, সেকালের কথা, ছেলেদের রামায়ণ, ছেলেদের মহাভারত ইত্যাদি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের অবলম্বনেই তাঁর পৌত্র সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করেন গুপী বাঘার মত চরিত্র যা আজো সব বয়সের বাঙালীদের মনোহরণ করে। উপেন্দ্রকিশোরকে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের অন্যতম অগ্রপথিক বলা চলে। একেবারে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এক পরাধীন দেশে একটি আঞ্চলিক ভাষাতে উঁচু মানের শিশু সাহিত্য পত্রিকা (সন্দেশ) প্রকাশ করে তিনি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটালেন। সত্যজিতের পিতা সুকুমারের হাতে সৃষ্ট হল পাগলা দাশুর মত প্রিয় চরিত্র, আবোল তাবোলের মত এক আশ্চর্য জগৎ।

রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা শিশু সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হল। ‘শিশু’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘ছেলেবেলা’ ইত্যাদি বই বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।‘শিশু’র ভূমিকাতে তিনি লিখলেন –

“ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে,

তরণী ডুবে সুদূর জলে,

মরণ-দূত উড়িয়া চলে,

ছেলেরা করে খেলা।

জগৎ-পারাবারের তীরে

শিশুর মহামেলা।”

তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ঠাকুর সহজপাঠের ছবিগুলি এঁকেছিলেন, নন্দলাল – সত্যজিতের শিক্ষক। ইতিমধ্যে তিনি সিগনেট প্রেসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। সিগনেট প্রেসের কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্ত তাঁকে দিয়ে আঁকিয়েছিলেন পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণের ছবি। নাম ছিল ‘আম আঁটির ভেঁপু’। এছাড়া ‘ক্ষীরের পুতুল’ ও ‘রাজকাহিনী’রও অলঙ্করণ করেন তিনি। যত বড় হলেন, ছোটবেলার শিশুদের প্রতি সত্যজিতের ভালোলাগা যেন আরো গভীরতা লাভ করলো।

চলচ্চিত্র জীবন -

১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পথের পাঁচালী ছবির মূল চরিত্রেই ছিল দুই শিশুশিল্পী - অপু ও দুর্গা। চলচ্চিত্রের অনেক নতুন ধারার সঙ্গে আরেক নতুন প্রাপ্তি ছিল কৌতূহলী অথচ পরিণত শিশু চরিত্রের প্রয়োগ!

আঁকা ছবি – 5d40643b19003.jpg


আম আঁটির ভেঁপুসিনেমাতে সেই দৃশ্য 5d406a0c06e81.jpg

১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে তাঁকে যখন রবীন্দ্র কাহিনী অবলম্বনে ছবি করতে বলা হয়, সেখানেও তিনি বাছেন শিশু মনের ভালোবাসার গল্প – ‘পোস্টমাস্টার’। সুতরাং ক্রমশই তাঁর এই জগৎটির সম্পর্কে ভালোলাগা বাড়ছিল।

‘সন্দেশ’ সম্পাদনা

এইভাল লাগা থেকেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পুনর্জন্ম। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ষাটের দশকে সন্দেশ সম্পাদনা করতে করতে তাঁর মনে জন্ম নিল শিশুদের জগৎ সম্পর্কে অসামান্য কৌতূহল। ১৯৬১ সালে পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই তাঁর সঙ্গে সমগ্র বাংলার শিশু ও কিশোরদের যেন এক আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠলো। দুই অতি জনপ্রিয় চরিত্রের সৃষ্টি হল - ‘ফেলুদা’ ও ‘প্রফেসর শঙ্কু’।

এর মধ্যেই কিন্তু সত্যজিৎ দুটি বেশ অন্যরকমের কাজ করে ফেলেছিলেন। তাঁর কাজের ধারার ক্ষেত্রেও এগুলি বেশ ব্যতিক্রমী।

দুটি গল্প লিখেছিলেন তিনি – পিকুর ডায়েরি ও সদানন্দের ক্ষুদে জগৎ। দুটির মূল চরিত্র একটি শিশু। এর মধ্যে ‘পিকু’ অবলম্বনে তিনি ফরাসী টেলিভিসনের জন্য তৈরি করেন একটি চলচ্চিত্র – ‘পিকুর ডায়রি’। ছবিটি কিন্তু পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।

তুলনামূলক ভাবে অনালোচিত চলচ্চিত্র – বিস্তারিত আলোচনা

১ – Two

1962সালে তাঁর প্রথম নিজের কাহিনী অবলম্বনে ছবি বলে যে ছবিটিকে ধরা যেতে পারে, তাহল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’।তারপর ১৯৬৪ সালেএইছবিটি – Two।সত্যজিতের প্রথম ছোটছবি। ESSO World যখন তাঁকে বাংলার মানুষকে নিয়ে ইংরেজিতে একটি ছোটছবি করতে বলেন, তখন সেটি সম্ভবতঃ তাঁর খুব মনঃপূত হয়নি।বাংলার মানুষ ইংরেজিতে কথা বলবে? এটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়।আবার নির্বাক ছব র তিনি ছিলেন খুব ভক্ত।কাজেই তাঁর মনে হল, এরকম একটি জায়গাতে নির্বাক ছবিই খুব উপযুক্ত।নির্বাক ছবির প্রতি তাঁর ভক্তিলিপিবদ্ধ করেছেন – তাঁর একটি প্রবন্ধে, ‘The art of Silence”।

প্রবন্ধটির প্রতি ছত্রে নির্বাক ছবির প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ। লিখছেন,

“No wonder silent film made a silent exit. ---Ideally two (Silent & non silent) should have coexisted. The fact that they couldn’t do so only goes to prove the cruel illogicality of commercial pressures which decide the fate of films and film makers.”

তাই তাঁর ভালোবাসার একটি স্বাক্ষর রাখতে তিনি উদগ্রীব ছিলেন। মাধ্যম ঠিক হয়ে গেলে তিনি বিষয়ও এমন নির্বাচন করলেন, যা নির্বাক ছবির উপযুক্ত।

জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

বাহির বলিয়া একটি অনন্ত-প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বার-জানলার নানা ফাঁক-ফুকর দিয়া এদিক-ওদিক হইতে আমাকে চকিতে ছুঁইয়া যাইত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করিবার নানা চেষ্টা করিত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ— মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল। ----বড়ো হইয়া যে কবিতাটি লিখিয়াছিলাম তাহাই মনে পড়ে—

খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে,

বনের পাখি ছিল বনে।

একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,

কী ছিল বিধাতার মনে।----

ছবির কেন্দ্রে দুইশিশু – তাদের মধ্যে দূরত্ব এতটা যেকথা বললেও শোনা যাবেনা।সুতরাং কথার গুরুত্ব নেই, যা কিছু হবে সবই কাজের মাধ্যমে।এরা যেন উপরে উল্লিখিত ‘দুইপাখি’ কবিতার দুইচরিত্র – ‘খাঁচারপাখি’ আর ‘বনেরপাখি’। ছবিটি দেখে মনে হয়, এই কবিতাটির কিছু প্রভাব যেন ছবিতে রয়ে গেছে, অন্ততঃ সেই ‘একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে, কি ছিল বিধাতার মনে’। তবে এই ক্ষেত্রে ‘প্রণয়ের আকর্ষণ’আদৌ নেই। বরং আছে বৈরিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রায় যুদ্ধমাফিক।

দুটি শিশু অভিনেতা থাকলেও ছবিটি কিন্তু আদৌ শিশু চিত্র নয়। মাত্র বারো মিনিটের এই চিত্রটিতে যে ভাবে আর্থ সামাজিক দ্বন্দ্বকে রূপায়িত করা হয়েছে তা সম্যক ভাবে আত্মসাৎ করা শিশুদের পক্ষে সম্ভব নয়।

দুটি শিশুর একটি মুক্ত, অন্যটি বদ্ধ। মুক্ত শিশুটি ‘গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায়’ খেলার চেষ্টাকরেছে কিনা আমরা জানিনা। হয়তো সে করতো, বন্দী শিশুটি সে খেলায় যোগ দিলে অন্য কিছু হতে পারতো। বন্দী শিশুটি এখানে অন্যরকম, আদৌ রাবীন্দ্রিক নয়। সেটাই এই কাহিনির ট্র্যাজেডি।

‘খাঁচার পাখি’ অর্থাৎ ঘরের শিশুটি তার নিজের বাড়িতে সচ্ছল পরিবেশে মানুষ। শুরুতেই দেখা যায় তার প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি করে তার অভিভাবক বেরিয়ে গেলে সে একেবারে একলা। সম্ভবত গতদিনে তার বার্থ ডে পার্টি ছিল, সে তাতে অনেক দামী উপহার পেয়েছে। বিসদৃশ ভাবে তার বাঁহাতে আটকানো একটি ঘড়িও তার প্রমাণ। নিজের জগতে সে মশগুল থাকে, তার খেলার সাথীরা সকলেই যান্ত্রিক, তাদের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন নেই। একাকীত্বের মধ্যে বন্দী জগতে তার মধ্যে একটা ধ্বংসাত্মক মনস্তত্ত্ব খেলা করে। আগুন জালিয়ে সে বেলুনগুলিকে ফাটিয়ে দিতে থাকে।

বনের পাখি – খোলা হাওয়াতে খাঁচার পাখি – গরাদের ব্যবধান

হঠাৎ যেন অতর্কিতেই তার জীবনে জানলার বাইরে খোলা আকাশে ধরা দেয় ‘বনের পাখি’। জানলার বাইরে বাঁশির অপরিচিত আওয়াজ তার মনে দোলা দেয়, সংশয় জাগায়। পাশে একটি অন্য শিশুকে দেখে সে অবাক হলেও অপ্রতিভ হয় না। তাকে হারানোর চেষ্টায় সে মত্ত হয়ে ওঠে, পদে পদে হারিয়েও দেয়।শেষে আকাশে খোলা একটা ঘুড়িকে উড়তে দেখে সে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে, গুলতি দিয়ে না পেরে তার হাওয়া বন্দুক দিয়ে ঘুড়িটিকে মাটিতে নামিয়ে শান্তি পায়। কিন্তু সত্যিই কি পায়? পরাজিত ছেলেটি কিন্তু ঘুড়িটিকে পরম মমতায় হাতে নিয়ে চলে যায়। তার চোখে বেদনা, কিন্তু সে শান্ত। আপাত জয়ী ছেলেটি কিন্তু অশান্ত মনে থাকে। সে আবার তার যান্ত্রিকসঙ্গীগুলিকে চালনা করে, কর্তৃত্বের আনন্দ পায়।হঠাৎআবার বাইরে থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে।সে আর লড়তে চায়না, সে যেন জেনে গেছে এই জয়ে কোন আনন্দ নেই।বাইরের খোলা হাওয়া এসে তার গড়া একটি স্তম্ভকে ধূলিসাৎ করে দেয়, তার যন্ত্র খেলনাগুলি মুখ থুবড়ে পড়ে। তার মুখে নেমে আসে একরাশ বেদনা।


মাত্র ১২ মিনিটের ছবিটি পুরোপুরিই রূপকধর্মী, allegorical. বস্তুতঃসত্যজিতের অন্য কোনছবিই এতটানয়। দুটিশিশু – একজন প্রাণহীন, ঈর্ষাতুর নাগরিক সভ্যতার প্রতিনিধি, অন্য শিশুটি প্রকৃতির মধ্যে থাকা একটি সহজ সরল মানুষ।


হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার”!!

নাগরিকসভ্যতার মধ্যে নিরাপত্তা আছে, স্বাচ্ছন্দ্য, ‌ প্রাচুর্য আছে, যা নেই তা হল প্রাণের পরশ। তা ধরা পড়ে যায় একটি শিশুর কাছে কারণ তারা এখনো নিজেদের ঠকাতে শেখেনি। শেষমুহুর্তে ঘরবন্দী শিশুটি যে হার স্বীকার করে তার একটাই কারণ - তার মনে এখনো প্রতারণার প্রবৃত্তি জন্মায়নি, আত্ম-প্রতারণা তো আরো অনেক দূরের। তাই প্রাসাদের শিশু যেন খাঁচার পাখিরমত ইহারস্বীকার করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে

হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার”!!

সত্যজিৎ নিজেও ছবিটি করে খুব খুশী হয়েছিলেন। মারী সেটনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘film that packs quite a punch in its 10 minutes’. দৈর্ঘ্য অবশ্য ১২ মিনিটের। - ৪

আরো বেশী অবাক হতে হয় এই দেখে যে মারি সেটনের বিখ্যাত বই ‘Portrait of a Director” এ এই সিনেমা সম্পর্কে মাত্র একটি অনুচ্ছেদেই খুব হালকা কিছু কথা বলা আছে, সেরকম বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই।- ৫

এমনকি বিজয়া রায়ের ‘আমাদের কথা’ তেও খুব নামমাত্রই উল্লেখ রয়েছে এই সিনেমাটির। একবার লিখছেন –‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’- এর আগে উনি ESSO ওয়ার্ল্ড থিয়েটারের জন্য Two বলে নিজের কাহিনী লিখে চৌদ্দ মিনিটের একটি ছোট ছবি করেছিলেন যাতে কোন কথা ছিল না।”- ৬

আর এক জায়গাতে লিখছেন- এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ –

‘২০শে এপ্রিল (১৯৮৫) এসো (ESSO) থেকে ওদের জন্য মানিকের করা টু (‘Two’) ছবিটা পাঠিয়ে দিল। রাত্রে নির্মাল্য এলে সবাই মিলে বসে একসঙ্গে দেখলাম। খুবই ছোট ছবি কিন্তু শেষের দিকে চোখ ভিজে যায়।”- ৭

খুব সম্প্রতিই ছবিটির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।এখন সহজেই দেখা যেতে পারে।

অনেকের মতে এই সিনেমাটিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি সত্যজিতের বিরূপ মনোভাব প্রতিভাত। ১৯৬৪ সালে আমেরিকা ভিয়েতনামের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল অন্যায়ভাবে। সেইপরিপ্রেক্ষিতে হয়তো এর কিছু প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।

কিন্তু আমার মনে হয়, এই ছবিটি এক চিরকালীন সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ। বস্তু মানুষকে আনন্দ দিলেও তা ক্ষণকালীন। তার চিরন্তনের আনন্দ তাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়, তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে। সেই যে বালক সত্যজিতের অটোগ্রাফের খাতায় স্বয়ং রবিঠাকুর লিখে দিয়েছিলেন, একটি ধানের শীষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু”খুঁজে নেওয়ার আনন্দের কথা, এই ছোট্ট ছবিটি তারই প্রতীক। রবিঠাকুরতো বলেইছিলেন, কবিতারমানেও একটু বড় হলে বুঝবে।বড়হয়ে এই ছোট্টছবির মাধ্যমেই সেই বোঝাকে ব্যক্ত করলেন তিনি।Andrew Robinson ও লিখছেন,

Ray’s story shows a remarkable convergence of spirit with an anecdote by Tagore, who tells of the moment in his Calcutta childhood in the 1870s when one of his friends was given a toy ‘bought from an English shop’ which was ‘perfect, big and wonderfully life-like’. It soon killed off the fun of their games together. Tagore was certain, he said, that if his friend could have used ‘the modern language of history’, he would have said that ‘he was more civilised than ourselves to the extent of his owning that ridiculously perfect toy.’ - - ৮

সত্যজিৎনিজে আদ্যন্ত নগরপ্রেমিক হয়েও নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতাবাদকে মূর্ত করেছেন।নগরের প্রাণচাঞ্চল্য তাঁর খুব প্রিয়, শান্তিনিকেতন বাসকালীন তিনি সেটি অনুভব করেছেন।রাবীন্দ্রিক"দাওফিরেসেঅরণ্য" হয়তো তাঁর ধারণা নয় ।কিন্তু প্রাসাদোপম অট্টালিকা,নাগরিকজৌলুষ বা বৈভবের তিনি চিরবিরোধী।সেখানে গ্রামীণ বাঁশির সুর তাঁর অনেক বেশিপ্রিয়। অনেকটা বিখ্যাতসেই গানের মতই –

তোমার ঐ দেহাতী গান দোলে যখন বাঁশির মুখে

আমাদের নকল-ভণ্ড কৃষ্টি চালায় করাত বুকে

বুকে আর গলায় আমার শহর কলকাতায়

গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়।”

ছবিটির ছোট্টনামকরণও বিস্ময়কর।একটি বা দেড়খানিঅক্ষর – ‘টু’। টু মানে দুই,-দ্বিধা,দ্বৈরথ বা দ্বন্দ্ব - এ ছবির প্রাণ।একদিকে থাকবে যান্ত্রিক সভ্যতা ও বৈভব, অন্য দিকে দারিদ্র্য অথচ প্রাণের পরশ।

সুতরাংকিছুআলোচনায় ‘টু’ ছবিতে কোকাকোলাকে মার্কিন সাম্রাজ্য বাদী বা আগ্রাসনের প্রতীক ভাবা হয়েছে, আমার মনেহয় তা বড়োই কষ্টকল্পনা।ভিয়েতনাম বা মার্কিন আগ্রাসন ছাড়িয়ে ‘টু’ এরযাত্রা আরো অনেক গভীরে। একেবারে মর্মমূলে গিয়ে নাড়া দেয়।

২ – পিকু

সত্যজিতের প্রকাশিত বড়দের লেখা – ‘পিকুর ডায়রি’। এটি শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়, ১৯৭০ সালে। গল্পটিতে মূল চরিত্র পিকুই। সে আপনমনে ডাইরি লেখে। প্রথম লেখাটি যখন শারদীয়াতে পড়েছিলাম, তখন আমি বেশ ছোট। ডাইরী লেখার ধরনটি দেখে মনে হয়েছিল খুব পরিচিত। আন্তরিক, সহজ অথচ অবিন্যস্ত। যতিচিহ্নের অশুদ্ধ প্রয়োগ, অনেক বানান ভুলও আছে, খুব স্বাভাবিক ভাবে তা ছড়িয়ে আছে পুরো ডাইরি জুড়ে। পিকুর মা ও বাবার সম্পর্ক ভাল নয়, তাঁদের মধ্যে আছেন এক তৃতীয় ব্যাক্তি – হিতেস কাকু। ঘটনার বর্ণনা আছে –

“এখন মা নেই মা হিতেসকাকুর সঙ্গে গেছে। --আজকাল মা খুব জিনিষ দেয় –কাল মা এআরগান দিলেন নিউ মারকেট থেকে – হিতেসকাকু ঘড়ির একটা ব্যান কিনেছে – বাবা আপিস থেকে বাবা এসে বোল্লেন আবার বোনদুক কেন মা বোল্লেন তাতে কি বাবা বোল্লেন এমনিতেই দুমদাম লেগেই আছে,--” -

গল্পের ছবিসিনেমার পিকু

ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অদ্ভুত সুন্দরভাবে লেখা আছে তার বাড়ির অবস্থা। পিকু যেন ‘টু’ এর সেই ছেলেটিরই একটু অন্যরূপ। প্রাসাদোপম বাড়িতে সে থাকে। সামগ্রীর অভাব নেই কিন্তু তার বাবা মা তার কাছের লোক নন। তাই সে আশ্রয় নেয় ডাইরির পাতায়। ডাইরিকে সে লুকিয়েও রাখে। এত ছোট বয়সেই সে গোপনীয়তার স্বাদ ও গুরুত্ব বুঝতে পেরে গেছে। আদতে দুটি শিশুই নিঃসঙ্গ, টু সিনেমা না করলে সম্ভবতঃ ‘পিকুর ডায়রি’ তাঁর লেখা হতনা।



আশির দশকের গোড়ার দিকে ‘হীরক রাজার দেশে’র পর ফরাসী টেলিভিশনের জন্য তিনি এই ছবিটিতে হাত দেন। আগের ছবি ‘টু’ এর দৈর্ঘ্য ছিলমাত্র ১২ মিনিট – ‘পিকুর দৈর্ঘ্য ছিল – ২৬ মিনিট। টু তে মাত্র দুটি চরিত্র, এখানে চরিত্র বেশ কটি। এখানে জটিলতা আরো অনেক বেশী।


‘পিকু’ ছবিতে ‘পিকুর ডায়রি’র আভাসগুলি অনেক বেশী পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে। দুটি মাধ্যমের তফাতের কথা ভেবেই। পাঠের সময়ে ‘ডায়রি’ সুখপাঠ্য কিন্তু একটি ভিজুয়াল মাধ্যমে তার অভিঘাত ধরা মুশকিল। এছাড়া উপরে উল্লিখিত ডায়রির অবিন্যস্ত, আন্তরিক ভাষা থেকে পিকুর মানসিক গঠনের যে পরিচিতি পাঠক পাবেন, তা সিনেমাতে পাওয়া সম্ভবই না।

আশ্চর্যজনকভাবে দুটি বাড়ি প্রায় একই রকম প্রাসাদোপম। দুটি ছবিতেই গাড়ি বেরিয়ে যাওয়া আর ওপর থেকে শিশুদের হাত নাড়ার দৃশ্য। ইতিমধ্যে পিকুর চোখের আড়ালেই বাবা-মার সম্পর্কের নির্লিপ্ততা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। পিকুর সঙ্গে তার অসুস্থ ঠাকুর্দার ভালোবাসার সম্পর্ককেও আমরা বুঝতে পারি। পিকুর মা কর্তব্যপরায়না, তার প্রতি, তার বাবার প্রতি বা ঠাকুর্দার প্রতি সব কাজই সে করে। কিন্তু তার নিজের প্রতি? বা অন্যদের প্রতি কর্তব্যগুলি কি নিষ্প্রাণ?

পিকুর মার জীবনের দ্বিধা, দ্বন্দ্বকেও চমৎকার দেখিয়েছেন পরিচালক। অসফল বিবাহের ফলে সে যে অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে, তার জন্যও তার একটা দ্বন্দ্ব আছে। বিশেষতঃ তার ছেলের চোখে সে কি ছোট হয়ে যাচ্ছে? পিকু কি ধরতে পারছে তার মার দ্বিচারিতা?

গল্পটিতেও একটু উল্লেখ ছিল – “কাল আমি যখন বুদবুদ করছিলাম তখন ঠিক শুনলাম হ্রন পেলাম আর বললাম হিতেসকাকু আর মা বল্লেন ডারলিং তুমি ধিংড়ার বাড়ি যাও না----- মা তকখুনি একটা মারলো জোরসে”। ১০

সিনেমাতে পিকুর বাড়ী বেড়ানো, ঠাকুর্দার সঙ্গে গল্প করা, দুপুরে নিস্তব্ধ বাড়ির মধ্যে একাকীত্ব, মাকে বিরক্ত করা, মার ঘরে হিতেসের সঙ্গে ঝগড়ার আওয়াজ শোনা – সব কিছুর মধ্যেই এমন ছবি ফুটে উঠেছে যা বোঝায় আপাত এক সুখী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যেও সবাই কত একা।

তবে সাহিত্যে যে পরিসমাপ্তি সম্ভব তা ছবিতে চলে না। গল্পের শেষে ছিল – ‘বাস এইবার পাতা শেস খাতা শেস বাস শেস”।

বলা বাহুল্য, ছবিতে এই সাহিত্যিক বোধ কাজ করবে না। তাই ছবির শেষদৃশ্যে ঠাকুর্দার মৃত্যু এক অন্যমাত্রার অভিঘাত দেয়, পিকু বুঝতে পেরেও তার মা কে জানাতে পারে না। সে বুঝতে পারছে যে মা তার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। সেই মা নেই যার সঙ্গে তার দুঃখ, ব্যথার অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া চলে। কাহিনীর পিকুর ছিল ডাইরী, আর সিনেমার পিকুর অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র জায়গা -আঁকার খাতা। সে আবার আঁকার খাতা তুলে নেয়, তার দুচোখে জল!

‘পিকু’ ছবিটিশিক্ষণীয় এই কারণে যে একটি ছোট্ট ছবির মাধ্যমে তিনি দেখালেন সাহিত্যের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষার তফাৎ। আমরা যারা আগে ডায়রিটি পড়েছি, তাদের কাছে মনে হয়েছে এই কাহিনির মূল ট্র্যাজিক থীম হল পিকুর নিঃসঙ্গতাযা তাকে ডাইরি লেখার দিকে ঠেলে দেয়।

সিনেমাতেও তাই – কিন্তু মাধ্যমের তফাতের জন্য ডাইরির বদলে এসে গেল আঁকার খাতা। তাই সিনেমার নাম পালটে গেল – ডায়রিহীন – ‘পিকু’।

এই দুটি (টু ও পিকু) ছবিঅনন্য। এদের মূল সাদৃশ্য এক জায়গাতেই। সেটি হল দুটি ছবিতেইশিশুরাইসত্যজিতেরমূলবক্তা।তাদের চোখ দিয়েই পুরো পৃথিবীটাকেই দেখা হয়। এবং সেই দেখাটা সহজ সত্যের দেখা। তার মধ্যে সভ্যতার পালিশ বা কলুষ নেই। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালোবাসে বা উপেক্ষা করে।

টু ছবির দুটি শিশুই ভণিতাহীন, পিকুও তাই। তার বেদনা তাই চোখের জলে ঝরে পড়ে। সে কর্তব্যের খাতিরেও মার কাছে ঠাকুর্দার কথা বলে না, এতই তীব্র তার অভিমান। সে জানে তার মা তার থেকে দূরে আছে।

শেষকথা

তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ যে তাঁর প্রাণের কাছাকাছি তা আমরা জানি। এখানে অবশ্য শিশুরা নয়, বৃদ্ধ মনোমোহন তাঁর ঘোষিত প্রতিনিধি। মনোমোহনের বিশ্বাস এখনো শিশুরা অম্লান, নিষ্কলঙ্ক – তারাই আশা। তাই সংসারের কাছে দুঃখ পেলেও গড়ের মাঠে ছোটদের নিয়ে তিনি আনন্দে থাকেন। সামাজিক নিয়ম তাদের ওপর চাপাতে নেই, তাতে তাদের জগৎ নষ্ট হতে পারে। ছবির শেষে তিনি তাঁর জামাইকে একটু তিরস্কারের সুরেই বলেন,

– “নোও, এই হাসির চেয়ে ভালো থ্যাঙ্কিউ আর হয় না!

জামাইয়ের শিশুকে শেখানো ‘থ্যাঙ্কিউ’ এর মধ্যে আদৌ আন্তরিকতা থাকতো না, বরং তার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হত।


শিশুর মুখের অনাবিল আন্তরিক হাসি – অমূল্য

পৃথিবীর অনেক পরিচালকের সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারিতে হয় এক সারিতে। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে যে এক চিরন্তন শিশুকে তিনি লালন করেছেন আজীবন, সম্ভবত সেখানে তিনি অনন্য।

দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।



প্রথম ঘটনাটির সাক্ষীও লেখকআর কেউ নন, স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি হলেন সত্যজিতের ভাবশিষ্য। তাঁর ‘মানিকদার সঙ্গে’ বইটিতে তিনি লিখছেন –

‘অভিযান’ ছবির শুটিংয়ের সেই মামা-ভাগনে পাহাড় দেখে মানিকদার কি উচ্ছ্বাস! বললেন, ’কি অদ্ভুত ব্যাপার বলতো? এই পাথরগুলো অদ্ভুতভাবে এখানে এল কিকরে? কে আনলো? একেবারে শিশুর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। সত্যিকারের রোমান্টিসিজিমের সংজ্ঞা আমরা সকলেই পড়েছি, সেই রেনেসাঁ অব ওয়ান্ডার একটা অদ্ভুত বিস্ময় বোধ। সেটা একটা শিশুর মধ্যে যেমন থাকে, চারিদিকের যাবতীয় বস্তু সে যেন প্রথম দেখল– সেইভাবে রিঅ্যাক্ট করার দুর্লভ ব্যাপারটা মানিকদার মধ্যে ছিল। - ১০



দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো বিস্ময়কর। শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের লেখায় আছে, একবার আমজাদ খান কলকাতায় এসেছিলেন। ‘শতরঞ্জ কা খিলাড়ী’র স্যুটিং এর সময়। ফেরার পথে যখন গাড়ি করে এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন, আমজাদের সঙ্গে ছিলেন শঙ্করলাল। আমজাদ বলেছিলেন - "মানিকদার মধ্যে একটা বিরাট শিশু লুকিয়ে আছে, যে পৃথিবীর সব কিছু জানতে চায়। মানিকদার চোখদুটো হল সেই বিস্ময়াবিষ্ট বালকের চোখ"। - ১১

‘আমাদের কথা’ তে বিজয়া রায় লিখছেন –

আমজাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় খুব বেশি নয়, তাও অতি অল্প পরিচয়েই ধরা পড়েগেছে সার সত্য। আমরা, তাঁর অনুরাগীরা সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত কাজকর্মের মধ্যেই এই লুকনো ‘সত্য’ খুঁজে চলেছি। এও ভাবতে চেষ্টা করি, তাঁর এই জীবনদর্শন অনুসরণ করেআমরা ও লাভবান হতে পারি কিনা।

তথ্যসূচী -

১-The art of silence – Deep Focus – Harper Collins – 2013 – pp – 92 - 96

২-The art of silence – Deep Focus – Harper Collins – 2013 – pp – 96

৩-https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/14917

৪ -Andrew Robinson – Satyajit Ray - The Inner Eye –Univ. Of California Press – 1st Edition 1989 p – 252

৫ -Marie Seton – Portrait of a director - Satyajit Ray – Indiana University Press, First Edition, 1971 –pp – 276 - 277

- Andrew Robinson – Satyajit Ray - The Inner Eye –Univ. Of California Press – 1st Edition 1989 p – 253

- গল্প ১০১ – সত্যজিৎ রায় – আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০২, পৃঃ - ৭৬৬

৮- গল্প ১০১ – সত্যজিৎ রায় – আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০২, পৃঃ - ৭৬৯

৯-গল্প ১০১ – সত্যজিৎ রায় – আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০২, পৃঃ – ৭৬৯

১০-মানিকদার সঙ্গে – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজকাল প্রকাশনী সপ্তম মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১১পৃঃ - ২৭

১১- সত্যজিৎকে নিয়ে – শঙ্করলাল ভট্টাচার্য – সুমিত্রা প্রকাশনী, চতুর্থ সংস্করণ, বইমেলা জানুয়ারি ২০১৮। পৃঃ – ৫১

ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে গৃহীত