বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

​মহাসত্যের বিপরীতে,পর্ব-৬


কিন্টুপের কাঠি

#ও

"আলমারি অগোছালো রেখে / আমি চলে যাচ্ছি / যারা পারে তারা গুছিয়ে রেখে যায় /

আমি বাবার মত/ সৌন্দর্য কুড়োতে কুড়োতে পরিপাটির দিকে / যার খেয়ালই ছিল না কোনোদিনও..." সঞ্জয় চক্রবর্তী

#

সোনার কাঠি রূপোর কাঠি নয়। পণ্ডিত কিন্টুপের কাঠি। ছোট লাঠিও বলা যায়।

কিন্টুপের গল্প অলক আগেও শুনেছে; ভাসা ভাসা। কিন্তু দার্জিলিং এর সেই অবিরাম বৃষ্টি ঝড়া দুপুরে পাহাড়ের গায়ে তৈরি অধ্যাপক পরিমল ভট্টাচার্যের ভাড়াবাড়িতে বসে বিস্তারীত জানলো। বিমানবাহিনীর চাকরি ছেড়ে সবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে অলক। সেই সূত্রেই দার্জিলিং। সেখানে এই প্রথম একজন বাঙালিকে পেল যিনি তিব্বত নিয়ে আগ্রহী। ঘরের পেছনের দেওয়ালটা পাহাড়ের গা বলে অঝোরে জলধারা নেমে ঘরের মধ্যেই তৈরি নালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বয়সে ছোট পরিমলবাবু তিব্বতে ব্রিটিশের পাঠানো ভারতীয় গোয়েন্দাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জোগাড় করেছেন, আরও তথ্যের সন্ধানে আছেন, তাদের নিয়ে লিখবেন। এর আগেও দার্জিলিং এর শাংগ্রিলা বারে তাঁর সঙ্গে ঘন্টাদুয়েক কথা হয়েছে। অলক ঐতিহাসিক নয়। এসব কথা শুনতে শুনতে তাঁর মনে মাঝেমধ্যেই একটা সমান্তরাল গল্প চলে। ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ে ইতিহাস কথা বলে না। সেখানে সেতু বাঁধতে হয় কল্পনা দিয়ে।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা “আমেরিকা” গল্পের সেই খুনখুনে তিব্বতি বুড়ির কথা মনে আছে? তিনি যখন শুনলেন, আমেরিকায় নামবার আগে ভালো করে দাঁত মাজতে হবে, কারণ দাঁতে প্রাচ্যদেশিয় বীজাণু থাকতে পারে। হাতঘড়ির সময়টাও মিলিয়ে নিতে হবে, কারণ আমেরিকায় সবকিছু ঘড়ি ধরে চলে। জুতোর তলার প্রাচ্যদেশিয় ধুলো-ময়লা রুমালে সাবধানে মুছে নিতে হবে!

তখন বুড়ি নাকি হিন্দিতে বিড়বিড় করে বলেন, আমার দাঁত নেই, হাতঘড়ি নেই, রুমাল নেই! বাঁচলাম। নীচে ওই যে জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে, মস্ত-মস্ত উচু গাছ অথচ ডালপালা নেই ওটা কী জায়গা বলো তো?

চুপ-চুপ। গল্পের কথক নিচু গলায় বলে, ওটাই নিউ ইয়র্ক!

নিউ ইয়র্ক ! বুড়ি চোখ কপালে তুলে বলল, কিন্তু কারপেটটা দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো। আমার ছেলে নিউ ইয়র্ক থেকে লিখেছিল গোটা আমেরিকাই একটা মস্ত কারপেট দিয়ে মোড়া।

আমাদের কিন্টুপের মনেও তিব্বত নিয়ে এরকমই অনেক বিভ্রান্তি ছিল। সে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কিন্টুপ সাংপো নদের রহস্য সন্ধানে বেরিয়েছিল ১৮৭৯ সালে। হিমালয়ের ওপাশে তিব্বত চিররহস্যের দেশ, তখন অতিব্বতিদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সেদেশে বসবাসকারী মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা, বিচিত্র দুর্গম ভূপ্রকৃতি -সবই তখনও ব্রিটিশের অজানা। ততদিনে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে উঠে এসেছে। অগম্য, অনাবিষ্কৃত প্রায় কিছুই বাকি ছিল না! কিন্তু সেই মানচিত্রে তিব্বত ছিল একটি সাদা উৎকণ্ঠার শূন্যস্থান। উৎকণ্ঠা কেন? তিব্বতের উত্তর ও উত্তরপূর্বে চীন আর উত্তর পশ্চিমে প্রবল শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া। তাই ব্রিটিশ শাসকদের কাছে কূটনীতির তাগিদে পৃথিবীর ছাদে প্রায় অগম্য দেশ তিব্বতকে জানা জরুরি হয়ে উঠেছিল।

অর্থনৈতিক তাগিদও ছিল। ভিনদেশিদের জন্য তিব্বতের দরজা বন্ধ থাকলেও পণ্য যাতায়াতে নিষেধ ছিল না। প্রাচীনকাল থেকেই ভারত থেকে নানা দুর্গম গিরিপথ দিয়ে খচ্চর, চমরী, ঘোড়া ও গাধার পিঠে বোঝাই রেশম, নানা ধাতু ও হাতির দাঁতের জিনিস, লবণ আর নানা খাদ্যশস্য যেত আর আমদানি হত পশম, ঘি, শিলাজিৎ , চমরী গাইয়ের লেজের চামর আর নানা প্রাণির চামড়া। এই রেশম পথগুলি ধরে বাণিজ্য চলতো চীন আর মঙ্গোলিয়ার সঙ্গেও। ভারতে ব্রিটিশরাজ গেড়ে বসলে রপ্তানি হতে শুরু করে নতুন নতুন বিলিতি পণ্যও। এই বাণিজ্য সম্ভাবনা টের পেয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস কিন্টুপের সাংপো অভিযানের একশো বছর আগেই তিব্বতে দূত পাঠিয়েছিলেন। সেই দৌত্য সফলও হয়েছিল। প্রতাপশালী পাঞ্চেম লামার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু হেস্টিংসের উত্তরসূরিরা সেই দুর্গম পথে না হেঁটে তিব্বতের দক্ষিণে তিন প্রতিবেশী দেশ নেপাল, সিকিম আর ভূটানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।

এসব খবর পেয়ে তিব্বত গিরিপথগুলিতে কঠোর পাহারা বসায়। সেই পাহারা এড়িয়ে তিব্বতে ঢোকা সাধারণ ভারতীয়দের পক্ষেই ছিল দুরূহ, শ্বেতাঙ্গদের তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তিব্বতি আর ভারতের কিছু পাহাড়ি জনজাতির মানুষ চমরী আর খচ্চরের পিঠে সওদা চাপিয়ে আমদানি রপ্তানি করতো। আর যাতায়াত করতে পারতো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ লামার ছদ্মবেশে তিব্বতে গুপ্তচর পাঠাতে শুরু করে। তাদের পদবি হয় পণ্ডিত। মূলত মোংগলিয়ান চেহারার বুদ্ধিমান পাহাড়িদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হত। এই পণ্ডিতদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিত সার্ভে বিভাগ। লামার পোশাকে লুকানো থাকতো জরিপের সরঞ্জাম। লাঠির মাথায় কম্পাস, প্রার্থনাচক্রের ভেতর কাগজ-পেন্সিল, জপমালায় ১০৮টির জায়গায় ১০০টি পুঁতি যাতে চলার পথে পদক্ষেপ গুণে দূরত্বের হিসেব রাখতে পারে। আর থাকতো ক্রনোমিটার, সেক্সট্যান্ট, স্ফুটনাঙ্ক থার্মোমিটার- আর কত কী! পরের দিকে ধরা পড়ে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাগজ পেন্সিল নেওয়া বন্ধ হয়েছিল। পণ্ডিতরা জরিপের খুঁটিনাটি তথ্য ছন্দে গেঁথে বৌদ্ধমন্ত্রের মতন আউড়ে চলতো। এভাবে এই পণ্ডিতদের নোট আর জবানবন্দী নথিবদ্ধ করে একটু একটু করে গোয়েন্দা মানচিত্রের সাদা অংশগুলি ভরে উঠতে থাকে।

ধন্দ ছিল সাংপো নিয়ে। পশ্চিম তিব্বতের সাং প্রদেশে খ্যাং তিসে বা কৈলাস পর্বতের পাদদেশে প্রায় চব্বিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে উৎসারিত সেই ‘পো’ বা নদী পূর্বদিকে হিমালয়ের একটি ভাঁজ বরাবর প্রবাহিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাকাশে পাঠানো নানা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পাওয়া ভূচিত্রে হিমালয়ের প্রায় সমান্তরাল ভাঁজগুলিকে দেখতে গিলে করা কাপড়ের মতন লাগে। সেগুলি আসলে বিশ্বের গভীরতম উপত্যকা, পনের-কুড়ি হাজার ফুট তাদের বেধ। এরকম একটি ভাঁজ দিয়েই প্রায় হাজারমাইল প্রবাহিত হয়ে সাংপো ঢুকে পড়ে অগম্য গিরিখাতে, লুকিয়ে পড়ে আকাশচুম্বী শৈলশিখরের জটে। এভাবে দুশো মাইলেরও কম দূরত্বে নেমে আসে প্রায় ন’হাজার ফুট। তারপরই হঠাৎ দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ হয়ে আসামে। তখন তার নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু পণ্ডিত কিন্টুপের অভিযানের আগে অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করতেন যে পূর্ববাহিনী সাংপো ব্রহ্মদেশে ঢুকে ইয়ারডি নদ হয়েছে। আবার অনেকে ভাবতেন সাংপো আর ব্রহ্মপুত্রকে জুড়েছে সুবনসিড়ি। নিজে উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষ হওয়ায় অলক জানে, ওই অঞ্চল দিয়ে আরও নদী ভারতে ঢুকে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। এগুলির মধ্যে দুটো বড় নদী হল দিবাং আর লোহিত। সাংপোকেই পূর্ব তিব্বতে বলা হয় ইয়ারলুং সাংপো, অরুণাচলে দিহাং, আসামে ব্রহ্মপুত্র, আর বাংলাদেশে মেঘনা। পৃথিবীর আর কোনও নদীর এতবার নাম বদলায় নি। ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল জেমস রেনেল সেই ১৭৬৫ সালেই ব্রহ্মপুত্রের খাত জরিপ করার পর লিখেছিলেন, সাংপোই যে ব্রহ্মপুত্র তা অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

তারপর থেকে প্রায় একশো পনের বছর ধরে ব্রহ্মপুত্রের উজানপথে বেশ কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয় দুর্গম প্রকৃতি, রাজনৈতিক সীমানা আর সীমান্তবর্তী বৈরী জনজাতির আক্রমণে। ব্রিটিশ প্রশাসন অবশেষে বুঝতে পারে যে এই জরিপ কোনও শ্বেতাঙ্গের কাজ নয়। কোনও পণ্ডিতকেই নিয়োগ করতে হবে।

তখন দার্জিলিং-এ সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রধান হিসেবে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট হেনরি হার্মান। তিনিই বেছে নিলেন ছোটখাট সাধারণ চেহারার বছর ত্রিশেক বয়সী কিন্টুপকে। দার্জিলিংয়ের গুণ্ডরি বাজারে এক দর্জির দোকানে সেলাইয়ের কাজ করতো সে। পরে সেই বাজারটির নাম বদলে হয়েছে চকবাজার। নিমা শেরিং ওরফে নেম সিং নামে এক পণ্ডিত গুপ্তচরের সহকারী হয়ে একবার গোপনে তিব্বত গেছে আর এধরণের অভিযানে যে বুদ্ধি, কষ্টসহিষ্ণুতা আর বিশ্বস্ততা থাকতে হয়, সেসব যোগ্যতার প্রমাণ সে দিয়েছে।

সেই সময় এক চীনা লামা দার্জিলিং-এ এসেছিলেন। তাঁর তিব্বতে ঢোকার ছাড়পত্র ছিল, লেখাপড়া জানতেন। স্থির হয়, ওই লামার চাকর সাজিয়ে নিরক্ষর কিন্টুপকে পাঠানো হবে। অবশ্য নিরক্ষর হলেও আগের অভিযানে তিব্বতে গিয়ে গোপন জরিপের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছিল সে। গোপন যন্ত্রপাতির ব্যবহার জানতো। স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। দর্জির দোকানে একসঙ্গে অনেক সাহেব ও ম্যাডামের জামাকাপড়ের মাপ মনে রাখার অদ্ভূত ক্ষমতা দেখেই প্রথমবার নেম সিং এর সহকারী করা হয়েছিল। আর নেম সিং এর রিপোর্টে তাঁর দুর্গম জটিল অরণ্যপথ ও গিরিপথগুলির টপোগ্রাফি স্মৃতিতে খোদাই করে নেওয়ার অদ্ভূত ক্ষমতার কথা পড়েই হার্মান সাহেব এই অভিযানের জন্যে তাকে চূড়ান্ত করেন। এখন নেম সিং-এর বয়স হয়ে গেছে। আর আগের মতো প্রতিবর্ত ক্রিয়া কাজ করে না। এভাবেই পদোন্নতি কিন্টুপের।

সেপ্টেম্বর মাসের এক কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে ভারী মনে দার্জিলিং থেকে তিব্বতের পথে রওয়ানা দেয় নবনিযুক্ত পণ্ডিত কিন্টুপ, ওরফে ‘কেপি’। কার্ট রোডের নীচে বুচার বস্তিতে তাঁর ছোট্ট কাঠের ডেরায় তখন তাঁর স্ত্রীর কোলে সদ্যোজাত কন্যাসন্তান। এছাড়া ছিল দুই ছেলে। কিন্তু পণ্ডিত পদে নিয়োগের সময় বলে দেওয়া নিয়ম অনুসারে স্ত্রী লালির কাছেও যাত্রার আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখতে হয়। এই অভিযানে মাস চারেক লাগতে পারে অনুমান করে তাঁর পরিবারের জন্য এককালীন কিছু অর্থ বরাদ্দ করেন হার্মান সাহেব। তাছাড়া রাহাখরচের জন্যে একশ টাকা আর বিনিময়যোগ্য রূপোর মূদ্রা আর সার্ভের সরঞ্জাম।

কথা ছিল তিব্বতে ঢোকার পর চেতাং থেকে সেই গহীন গিরিখাত ধরে সাংপোর গতিপথেই যতদূর সম্ভব ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দিকে যাবে ওরা। কিন্তু তিব্বতে ঢোকার পরই বৌদ্ধ লামার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে এক পানাসক্ত লম্পট। কিন্টুপের সঙ্গে সে কিন্তু প্রভুর মতনই আচরণ করতে থাকে। তাঁর জন্যে ওই অভিযান যেন ব্রিটিশ সরকারের দাক্ষিণ্যে এক প্রমোদ ভ্রমণ। এরকম কঠিন অভিযানের জন্যে যেমন উদ্যম আর সংকল্প লাগে, তা তার ছিল না। পথে নানা পাহাড়ি গ্রামে নেশায় চুর হয়ে সময় নষ্ট করতে থাকে। চেতাং উপত্যকা পার হয়ে লোপা জনজাতিদের একটি গ্রামে মোড়লের বাড়িতে অতিথি হয়ে সে মোড়লপত্নীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে। কিন্টুপ কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। দিনের পর দিন এমনি পেরিয়ে যেতে থাকে।

প্রতি সন্ধ্যায় মোড়লকে বেশি করে নেশায় অচৈতণ্য প্রায় করে দিয়ে কিন্টুপকে পাহারায় বসিয়ে রোজই দুজন শোবার ঘরে চলে যায়। কিন্টুপ যেন একটা মানুষ না! তাঁর অসহ্য লাগে। প্রতিদিন কিন্টুপ একা বসে বসে রাগে গজগজ করে। একটু পরেই ওদের সশব্দ রতিক্রীড়ার আবেশে সে-ও উত্তেজিত হয়।

অবশেষে বাধ্য হয়ে একদিন জনান্তিকে লামাকে সে এগিয়ে চলার কথা বলে।

নিতান্ত অনিচ্ছায় লামা পরদিন রওয়ানা হয়। কিন্তু পথে পা রাখার সময় মোড়লপত্নীর চোখে চোখ রেখে কী যেন ইশারা করে। কিন্টুপ প্রমাদ গোনে। কিন্তু কিছুই বলতে পারেনা। সে যে চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করছে! উদ্দিষ্ট সেই গিরিখাত তখনও অনেক দূরে।

সারাদিন সাংপোর পাড় ধরে এগিয়ে যেতে যেতে লামা কী যেন বিড়বিড় করে বলতে থাকে। সারাদিন হাঁটার পর নদীর পাড়েই তাঁবু খাটিয়ে শুকনো ডালপালা জোগাড় করে আগুন ধরায়। আগুন পোহানোর পাশাপাশি হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষা পেতে আগুনের কোনও বিকল্প নেই। আগুনকে বন্যপ্রাণীরা ভয় পায়। লামা তবু কেমন যেন সিঁটিয়ে থাকে। মদ খেতেও ভয় পায়। আর মদ না খেলে তাঁর ঘুম আসে না। কিন্টুপ কিন্তু ঠিকই ঘুমিয়ে নেয়। পরদিন সকালে উঠে চা আর ৎসাম্পা খেয়ে ওরা আবার বেরিয়ে পড়ে। এগিয়ে যেতে যেতে পথ চলা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পড়তে থাকে। দুপাশে পাহাড় উঁচু হয়ে খাতের দুদিকে ঘন হতে থাকে। হাঁটার জায়গা কমে যায়। ঘন দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে থাকে নানা শক্ত লতাপাতা বেষ্টিত বৃক্ষরাজি ও তাঁর দশগুণ আগাছা। সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য পোকামাকড় আর হাড়কাঁপানো শীত। যতক্ষণ চলতে থাকে এই শীত এত অনুভূত হয় না। কিন্তু বিশ্রাম নিতে গেলেই শীত জাঁকিয়ে বসে। লামা বুঝতে পারে যে এই অভিযান তাঁর জন্যে নয়। শুরুর দিকে বেহিসেবি খরচ করায় পাথেয় ক্রমে ফুরিয়ে আসতে থাকে। তাছাড়া কিন্টুপের গতি ও শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে চলতেও পারছিল না।

সেদিন বিকেলে সাংপোর খাড়া পাড়ে থংকিয়ুক নামে একটি ছোট পাহাড়ি বস্তি দেখে ওরা সেখানে উঠে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে বুড়ো মোড়লের ঘরে রাতে শুয়ে মুহূর্তের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করে লামা। কিন্টুপ ঘুমনোর সময় এরকম শব্দ পছন্দ করে না। সে কানে আঙ্গুল দিয়ে ঘুমায়। কিন্তু শেষরাতে ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে। লামা কিন্টুপের গায়ে হামলে পড়ে তাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্টুপ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার কিন্টুপ ক্ষেপে যায়। সে জোরে থাপ্পড় মারে লোকটাকে।

লামা ওর থাপ্পড়ে জোর দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে ছিটকে পড়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণ শুধু জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ শোনা যায়। তারপরই সে কাঁদতে শুরু করে। কিন্টুপ অবাক। সে অনেক আগেই বুঝে গেছে যে লোকটা ভণ্ড। কিন্তু কান্নাকাটির শব্দে গৃহকর্তার মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলে বিপদ হতে পারে। একথা ভেবে কিন্টুপ তীক্ষ্ণ চাপা আওয়াজে হুশিয়ার করে, চুপ! একদম চুপ!

পরদিন ভোরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে লামা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, মোড়লবউয়ের জন্য আমার ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়েছে, ঘোর পাপী আমি। এখন তার জন্যে মন কাঁদছে। ছ’দিনের ছুটি দাও। দুই রাত ওর সঙ্গে কাটিয়ে আবার ফিরে আসবো। তোমার জন্যেও কিছু খাবারদাবার নিয়ে আসবো!

কী আর করবে কিন্টুপ। সে নীরবে মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ মোড়লের সঙ্গে কিছু কথা বলে লামা বেরিয়ে যায়। সেদিন কিন্টুপ প্রায় সারাদিন শান্তিতে ঘুমিয়ে কাটায়। রাতেও অকাতরে ঘুমায়। কেউ ওকে বিরক্ত করে না।

পরদিন বৃদ্ধ মোড়ল তাকে সকালে অনেক নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া ইয়ারলুং সাংপো থেকে খাবার জল তুলে আনতে বলে। আর দুপুরে অনুরোধ করে জঙ্গল থেকে লাকড়ি কেটে আনতে। আর পরদিন থেকে সেটাই তার নৈমিত্তিক কাজ হয়ে পড়ে। সঙ্গে তেমন টাকাপয়সা না থাকায় গ্রামবুড়োর বাড়িতে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের বদলে ওই নদী থেকে জল আনা আর কাঠ কেটে আনাকে বৈধ শ্রম ভেবেই করে যায় সে। তাছাড়া পরিশ্রম করলে ঠান্ডা কম লাগে। শরীর ভাল থাকে। ছ’দিনের পর আরও ছ’দিন কেটে গেলেও লামা আর ফিরে আসে না। কিন্টুপ তবু অপেক্ষা করে। কুড়ি দিনের মাথায় কাঠ কেটে ফিরে আসার পর মোড়লবুড়ো তাকে যবক্ষেতের ধারে ঘাসপাতায় ছাওয়া ভেড়ার খোঁয়াড়ে গিয়ে থাকতে বলে। কিন্টুপ নীরবে মাথা নেড়ে চলে যায়। কিন্তু প্রতিদিনকার কাজ চলতে থাকে সমান তালে। পাহাড়ের ঢালে থাকে থাকে বাড়ি। উপরের দিকে ফার আর রডোডেন্ড্রনের অরণ্য, আর তার ওপারে উঁকি দেয় পাহাড়ের চুড়োয় শাদা বরফ। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার আর ভাল লাগে না। ইয়ারলুং সাংপোর নুড়িপাথরে ধাক্কা লেগে লেগে সরব জলের কলরোল তাকে অবিরাম ডাকতে থাকে। নিজের কর্তব্যবোধ তাকে হাতছানি দেয়।

একদিন তাই মনস্থির করে সে গ্রামপ্রধানের কাছে গিয়ে বলে, আমার প্রভু কবে ফিরবেন জানি না, আমাকে এবার যেতে হবে!

তামাকপাতা খেয়ে খেয়ে কালো হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে বুড়ো হো হো করে হেসে উঠে বলে, তোর প্রভুও আর ফিরেছে, তুইও আর গিয়েছিস!

অগত্যা ক্রীতদাস হয়ে বর্ষার দীর্ঘ পাঁচ মাস একরকম মুখ বুজে থংকিয়ুক গ্রামেই কাটে কিন্টুপের। সারাদিন মাথার মধ্যে কলকল করে বয়ে যায় ইয়ারলুং সাংপো, সেই জলে টলটল করতে থাকে স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের মুখগুলি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে জরিপের যন্ত্রপাতিগুলি বের করে নাড়াচাড়া করে আর মনে মনে সেই চীনা লামাকে শাপশাপান্ত করতে থাকে। তারপর একদিন দূরবর্তী অরণ্যে কাঠ কাটতে যাওয়ার অছিলায় পালিয়ে যায় সে।

অবশ্য সাংপোকে ছাড়ে না। গহীন অরণ্য আর পাহাড়ের গা আঁকড়ে পথ করে নিয়ে নদীর খাত ধরেই এগুতে থাকে। জপমালায় পদক্ষেপ গুণে গুণে, লাঠির কম্পাসে দিকনির্ণয় করে প্রতিটি বাঁক, খাদ, ঝর্ণা, বালুতট – ভূপ্রকৃতির সকল বৈচিত্র মস্তিষ্কে গেঁথে নিতে নিতে কখনও মেষপালক কিম্বা রাখাল বালকদের ডেরায়, আবার কখনও নানা জংলি ফল-মূল-পাতা খেয়ে, সকল কষ্ট অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলে দিনের পর দিন। কখনও গাছের ডালে ঘুমাতে হয়। কিন্তু অভিযানের নেশা তাকে পাগল করে রাখে।

অবশেষে একদিন একজায়গায় এসে সে আবিষ্কার করে একটি বিশাল ঝর্ণা, যার গায়ে মেঘের ওড়নার মতন জলকণায় ফুটে থাকে রামধনু। আর এ কী, তিনি চোখ কচলান, রামধনুর গায়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এক মেঘরঙের পরী। তাঁর চেহারা দেখে আরও অবাক কিন্টুপ। এ যে দেখতে একেবারে তাঁর স্ত্রী লালির মতন। সে স্বপ্ন দেখছে না তো! নিজেকে চিমটি কাটে কিন্টুপ। না, সে ঘুমিয়ে নেই। স্পষ্ট দেখছে লালিকে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সে পরীটিকে মিলিয়ে যেতে দেখে। তারপর অনেক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও ওই আশ্চর্য দৃশ্যকে জীবন্ত করে তোলা আদরের পরীটিকে আর দেখতে পায়না।

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখার পর এগিয়ে যেতে যেতেও সে ফিরে ফিরে তাকায়, যতদূর চোখ যায়। কিন্তু আর প্রিয় পরীটিকে দেখতে পায় না। কিন্তু একটু এগিয়ে গিয়ে একজায়গায় নদীর তীরে ভেজা বালির উপর মানুষের পায়ের ছাপ দেখে চমকে ওঠে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখতে থাকে। তারপর নদীতীরের ঢাল ধরে চলতে চলতে চলতে চলতে পৌঁছোয় উঁচু পাহাড়ে ঘেরা মায়াবী এক সবুজ উপত্যকায়। সেখানেই সাংপোর তীরে খাড়া পাহাড়ের খাঁজে পদ্ম পাপড়ির মতন একটি গোম্পা। কিন্টুপ অনেক কষ্টে পাহাড় বেয়ে সেই গোম্পায় গিয়ে পৌঁছুতেই সাড়া পড়ে যায়। রে রে করে তেড়ে আসে একদল লোক, এসেছে, এসেছে, পালাবি কোথায় বাছাধন?

কিন্টুপ ওদের চিনতে পারে। এরা সবাই থঙ্কিয়ুক গ্রামের মানুষ। পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসকে খুঁজতে খুঁজতে তাদের চেনা অপেক্ষাকৃত সহজ পথে এখানে চলে এসেছে তার আগেই। কিন্টুপ পৌঁছুতেই পাকড়াও করে। কিন্তু ততক্ষণে সে ছুটতে ছুটতে গোম্পার ভেতর ঢুকে পড়েছে। প্রধান লামা সবার কথা শুনে কিন্টুপের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ওদেরকে ৫০ টাকা দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে নেন একটি শর্তে। ওই টাকা উসুল না হওয়া পর্যন্ত গোম্পায় শ্রমদান করতে হবে।

কিন্টুপ খুশিমনে রাজি হয়ে যায়। থঙ্কিয়ুকবাসীরাও চলে যায়। সে শোনে যে এই মায়াবী উপত্যকাটির নাম পেমাকো। সাংপো এখানেই প্রথম মন্থরগতি হয়েছে। চারপাশে আকাশছোঁয়া পাহাড়, সেগুলির হিমবাহ থেকেও অসংখ্য ধারায় সুজলা সুফলা হচ্ছে পবিত্র উপত্যকা। নদীতীরে শান্ত জনপদ আর কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে বৃক্ষগুল্মহীন মসৃনপ্রায় পাহাড়ের খাঁজে ঝুলে থাকে পেমাকোচুং গোম্পা। এখানে প্রতিশ্রুতিমতন তাকে যে শ্রম দিতে হয়, লামাদের টুকটাক ফাইফরমায়েশ খাটা, উপাসনা ঘরের মেঝে ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে করে রাখা আর একদিন পর পর অন্য নবীন ভিক্ষুদের সঙ্গে গিয়ে নীচের বস্তি থেকে আনাজপাতি ফলমূল আনা - কিন্টুপ এসব কাজ মহানন্দে পালন করে। যদিও তখন বর্ষাকাল, পাহাড়ে ওঠানামা খুব কঠিন।

পেমাকো থেকে সাংপো আরও কয়েকশো ফুট নিম্নগামী হয়ে ঘন জঙ্গলে ঢাকা খাতের ভেতর ঢুকে পড়েছে। যে দিন ঘন বৃষ্টি থাকেনা, কুয়াশাও থাকে না, গোম্পার জানালা দিয়ে রূপোর পাতের মতন চকচক করে সাংপো। সেসব দিনেই বাতাসে ভেসে আসে ঈগলের ডাক। ছোটবেলা থেকেই এই ডাক চেনে কিন্টুপ। দার্জিলিং-এ অনেক ঈগল আছে। তাদের বুচার বস্তির কাছেও আছে ঈগলের বাসা। সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। বিশেষ করে হাঁস মুরগী সামলে রাখতে হয়, কখন যে ছোঁ মেরে কাকে তুলে নিয়ে যাবে! সেজন্যে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে আর সদ্যোজাত কন্যাকে গ্রীষ্মের দুপুরে গায়ে তেল মাখিয়ে রোদে দিলেও মাথার ওপর ওড়নার চাঁদোয়া টাঙ্গাত। যাতে রোদ আসে আর ঈগলদের শ্যেন দৃষ্টি থেকেও আড়াল করা যায়। লালির কথা মনে পড়ায় তাঁর আবার মনে পড়ে সেই আশ্চর্য প্রপাতে রামধনুর গায়ে জলকণার রঙে রঙিন পরীর চেহারা। এমন অলৌকিক দৃশ্যের মানে কি? লালি সুস্থ আছে তো? দুশ্চিন্তায় উচাটন হয়ে ওঠে কিন্টুপ।

পেমাকোচুং মঠে সারাদিন খাটুনির পর সন্ধ্যায় উপাসনা মন্দিরের চৌকাঠে বসে জপমালা হাতে প্রার্থনা করে কিন্টুপ। পথের দূরত্ব মাপতে মাপতে এই জপমালাও এখন তাঁর কাছে সাংপোর মতন একটি নদী। যত দিন যায়, দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। মনে প্রাণে মাখনের প্রদীপে উজ্জ্বল বিশাল বুদ্ধমূর্তির নিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে সে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে। করতেই থাকে প্রতিদিন। দেখতে দেখতে কয়েক মাস পর বর্ষা চলে গিয়ে নেমে আসে হাড়কাঁপুনি শীত। প্রিয়জন থেকে দূরে থাকলে শীতটাও বেশি লাগে। তাছাড়া প্রায়ই মাঝরাতে ওদের স্বপ্নে দেখে ধড়মড়িয়ে ওঠে। তেমনি এক রাতে উঠে জানালা দিয়ে দেখে আকাশ পরিস্কার, কুয়াশা নেই, তারা ঝলমলে বেগুনি আকাশের গায়ে একটি স্ফটিকের পিরামিড, সেই স্বচ্ছ পিরামিডে সে আবার লালি আর তাঁর কোলে শুয়ে দুধ খেতে থাকা মেয়েটিকে অস্পষ্ট দেখে। এরকম দেখছে কেন সে? ওদের শরীরভাল আছে তো?

এই উৎকণ্ঠাতেও অনেক নিচে কোন সে পাতাল থেকে ভেসে আসে অবিরাম জলের শব্দ। নাকি সে নিজের রক্ত-লসিকা প্রবাহের শব্দ শুনতে পায়? ক্রীতদাসের রক্ত-লসিকা প্রবাহ যে কী বেদনাদায়ক!

পরদিন প্রধান লামার কাছে গিয়ে সে তীর্থপরিক্রমার জন্য কিছুদিনের ছুটি প্রার্থনা করে। প্রধান লামা কী ভেবে তাঁর ছুটি মঞ্জুর করেন।

আনন্দে কিন্টুপ একঘন্টার মধ্যেই প্রস্তুতি নিয়ে নেমে যায় সাংপোর খাত বরাবর। খাড়া পাথরে বন্য ছাগল, ভেড়া কিম্বা হরিণের পায়ের ছাপ কিম্বা যাতায়াতের নানা চিহ্ন দেখে এগিয়ে চলে অভীষ্ঠের দিকে।

যত এগোয় ততই ঘন হতে থাকে অরণ্য, দুর্গম হতে থাকে পথ, আকাশচুম্বী গিরিখাতের গায়ে অনেক জায়গায় জমাট রডোডেন্ড্রনের ঝোপ, অন্যখানে আদিম বার্চের ডাল থেকে অজস্র সর্পিল ঝুরি নেমে দিনের বেলাতেও আঁধার নেমে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা কোনও বন্যপ্রাণির ডাক নেই, কোনও পাখি কিম্বা স্নো ফেজেন্টের কাকলি নেই, শুধু পাথরের পর পাথরে আছড়ে পড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বয়ে চলা সাংপোর একটানা গর্জন। এভাবে সারাদিন চলার পথে যেখানেই শুকনো ডালপালা পায় সেগুলি সে পিঠে বেঁধে নিতে থাকে। সন্ধ্যার আগেই যেখানে একটু জায়গা পায় তাঁবু খাটায়। তাঁবুর সামনেই আগুন ধরিয়ে ছোট্ট কেটলিতে জল গরম করে প্রথমে চা বানায়, মেস্টিনে ৎসাম্পা গুলে খায়। তারপর স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন ভোরে আবার আগুন জ্বালিয়ে চা আর ৎসাম্পা খেয়ে তাঁবু গুটিয়ে পিঠের রুকস্যাখে ভরে হাঁটা শুরু। অবিরাম এগিয়ে যাওয়া। এভাবে এগারো দিন চলার পর খাতের একটি বাঁকে এসে থামে সে। নদীর পাড় ঘেঁষে কিছুটা ঘাসজমি, তাঁর ওপরে প্রায় দুশো ফুট উঁচুতে পাথরের খাঁজে একটি ছোট প্রাকৃতিক গুহা। কিন্টুপ অনেকগুলি রডোডেন্ড্রনের ডাল কেটে তিনদিন ধরে সেই গুহায় বসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেগুলি কেটে চেঁছে চেঁছে পাঁচশোটি এক ফুট লম্বা কাঠি তৈরি করে। চাছতে গিয়ে বারবার হাতের পেশী পায়ের পেশীতে টান ধরে বেঁকে যেতে চায়। কিন্টুপ বারবার আগুনে হাত পা সেঁকে, বারবার বিরাম নিয়ে গরম চা আর ৎসাম্পা খেয়ে অবশেষে পাঁচশোটি কাঠি বানাতে পারে। তারপর সেগুলিকে পঞ্চাশটি করে দশটি আঁটি বেঁধে ওই গুহার মধ্যেই রেখে এবার চেনা পথে ন’দিনের মধ্যেই গোম্পায় ফিরে আসে।

আবার শুরু হয় নৈমিত্তিক শ্রমদান, ফাইফরমায়েশ খাটা, উপাসনা ঘরের মেঝে ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে করে রাখা আর একদিন পর পর অন্য নবীন ভিক্ষুদের সঙ্গে গিয়ে নীচের বস্তি থেকে আনাজপাতি ফলমূল আনা। তারপর সন্ধ্যায় আগের মতনই উপাসনা মন্দিরের চৌকাঠে বসে জপমালা হাতে প্রার্থনা, মাখনের প্রদীপে সমুজ্জ্বল বিশাল বুদ্ধমূর্তির নিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের মঙ্গল কামনা। আর অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা...

কয়েক মাস পরে বুদ্ধের জন্মতিথির উৎসবে ওই গোম্পা থেকে একটা ছোট দল লাসায় যাবে শুনে কিন্টুপও তাদের সঙ্গে যাওয়ার আবদার করে। মঠাধীশ তাঁর একনিষ্ঠ শ্রম আর ভক্তিতে খুশি হয়ে সস্নেহে আর্জি মঞ্জুর করেন। মহানন্দে ভগবান বুদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে তেমনি মনে মনে জপমালায় পদক্ষেপ গুণতে গুণতে লাসাগামী দলের ভিক্ষুদের ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে খচ্চরের পিঠে চেপে লাসা যায়। সেখানে দর্শন মেলে মহামান্য ত্রয়োদশ দলাই লামার। দেবশিশুর মতন দেখতে বালক দলাই লামা তখন পোটালা প্রাসাদ থেকে নরবুলিংকা প্রাসাদের পথে শোভাযাত্রায় ঘোড়ার পিঠে বসে ছিলেন। আর চোখ বড় বড় করে অবাক চোখে সবাইকে দেখছিলেন। মুখের ভাবটি এমন যেন, কেন এত মানুষ তাঁকে প্রণাম জানাচ্ছে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না!

কিন্টুপ মনে মনে ভাবে, অথচ তিনিই অবলোকিতেশ্বর, স্বয়ং চেং রে জি, ঈশ্বরের কত লীলা!

লাসায় সঙ্গী ভিক্ষুরা যখন ক্লান্ত হয়ে দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কিন্টুপ গিয়ে বাজারে ঘুরে এক দার্জিলিংবাসী কম্বলব্যাপারীর দেখা পায়। তাঁর হাতে চারআনা পয়সা দিয়ে একটি চিঠি লিখিয়ে, তারই মারফৎ সে নেম সিংকে খবর পাঠায়। পথে আসতে আসতে ওই পেমাকো অঞ্চলের ঋতুভিত্তিক নানা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে মনে মনে অনেক হিসেব করে এই বার্তার বয়ান ভেবে রেখেছিল সে। বুদ্ধপূর্ণিমার পর ন’টি চান্দ্রমাস পার হলে অমাবস্যা থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন পঞ্চাশটি করে বিশেষ চিহ্নিত কাঠি সাংপোর স্রোতে ভাসানো হবে। নেম সিং যেন পত্রপাঠ এই বার্তা হার্মান সাহেবের কাছে পৌঁছে দেন।

সঙ্গীদের সঙ্গে পেমাকোচুং গোম্পায় ফিরে আবার শুরু হয় শ্রমদান, ফাইফ্রমায়েশ খাটা, উপাস্না ঘরের মেঝে ঝকঝকে করে রাখা আর একদিন পর পর নীচের বস্তি থেকে আনাজপাতি, ফলমূল আনা। সন্ধ্যায় বুদ্ধমূর্তির নিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে লালি আর ছেলেমেয়েদের মঙ্গল কামনা।

আবার অদৃশ্য ঈগলের দূরাগত ডাক আর নীচের উপত্যকা থেকে উঠে আসা সাংপোর জলকল্লোল। প্রতিদিন চাঁদ শুকোতে শুকোতে অমাবস্যা হয়, আবার পাকতে পাকতে ক্রমে পূর্ণিমা হয়। পেমাকো উপত্যকায় মূলতঃ দুটো ঋতু; শীত আর বর্ষা। এবার বর্ষা নামলে মঠাধীশের কাছে আবার তীর্থযাত্রার প্রার্থনা জানায় কিন্টুপ।

মঠাধীশ তাঁর সেবা ও ভক্তির পুরস্কারস্বরূপ এবার তাকে মুক্তি দিয়ে বলেন, এবার তুই বাড়ি ফিরে যা বাবা! আর দীর্ঘপথের সম্বল হিসেবে তাকে দেন কয়েক কেজি ৎসাম্পা, রোদে শুকানো ভেড়ার মাংস, চিজ আর একমুঠো তিব্বতী মুদ্রা। গোম্পার লামাদের থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়ে কিন্টুপ ফিরে যায় সাংপোর খাতের বাঁকে সেই গুহায়, যেখানে রডোডেন্ড্রনের কাঠিগুলি রেখেছিল। বর্ষায় নদী তখন ফুলে উঠেছে। পাড় ঘেঁষে ছাগল-ভেড়া ও হরিণের পায়েচলা পথের চিহ্নগুলো হারিয়ে গেছে। পথে অনেকগুলি ছোট ছোট হিমবাহ গলে নামা ঝর্ণা পার হয়ে ১১দিনের রাস্তা যেতে এবার লাগে প্রায় ২৫ দিন। গুহার কাছে পৌঁছে কিন্টুপ দেখে সেই ঘাসজমিটা ডুবে গেছে, জল উঠে এসেছে প্রায় গুহার মুখের কাছাকাছি। গুহায় ঢুকে একেকটি আঁটি খুলে প্রত্যেকটি লাঠিতে ব্রিটিশ সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সিল এঁটে নির্ধারিত দিন থেকে দশদিন ধরে রোজ পঞ্চাশটি করে লাঠি ভাসিয়ে দেয়।

সেখান থেকে একটু এগিয়েই তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সাংপো ২৫হাজার ফুটের বেশি উঁচু নামচে বারোয়া আর গ্যালা পেরি শৃঙ্গের মাঝে গভীর খাতের মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০মাইল প্রবাহিত হয়ে ভারতে ঢুকবে। সেই গভীর গিরিখাতে মানুষ প্রথম ঢুকবে আরও ১১৯ বছর পর। ২০০২সালে এক ইউরোপীয় অভিযাত্রী দল কায়াত বেয়ে প্রথম পার হবেন সেই গভীর খাত। তাঁদের অবশ্য কিন্টুপের মতন অজানা পথে যেতে হয়নি। প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁরা আগেই জানতেন ইয়ারলুং সাংপোর পথ আর ভারতে ঢুকে ব্রহ্মপুত্র হওয়ার খুঁটিনাটি। তার আগে কিন্টুপ- বর্ণিত রামধনুর ওড়না পরিহিতা এক সুন্দরী ঝর্ণার খোঁজে একাধিক অভিযাত্রী দল গেছে। যাইহোক, আমরা কিন্টুপের গল্পে ফিরি।

দশদিনে মোট ৫০০টি লাঠি ভাসিয়ে দিয়ে নামচে বারোয়া –গ্যালা পেরির সেই অগম্যপ্রায় গতিপথ এড়িয়ে আবার সাংপো ধরে যতদূর সম্ভব এগিয়েছিল কিন্টুপ। সেদিক দিয়েই সে ব্রিটিশ ভারতে ঢুকতে চেয়েছিল। ঘন জঙ্গল, ছোট ছোট অনেক ঝর্ণা পেরিয়ে, নানা পাহাড়ি জনজাতির গ্রামে আশ্রয় নিয়ে, আবার কখনো গাছের ডালে বা পাহাড়ের গুহায় রাত কাটিয়ে সে প্রায় সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ওলোন নামে একটা গ্রামে পৌঁছে দেখে স্বপ্নের মতন দৃশ্য, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পাহাড়শ্রেণী সেই গ্রামের পর হঠাৎই শেষ হয়েছে সমতলে, আর দূরে দিগন্তবিস্তৃত কালচে-সবুজ অরণ্যভূমির বুক চিরে মন্থর কুয়াশার মতন বয়ে যাচ্ছে দিবাং, যা আসামে ঢুকেই ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত হবে।

কিন্তু অবোর জনজাতির জঙ্গী প্রহরা এড়িয়ে কিন্টুপ ওই পথে ভারতে ঢুকতে পারেনি। অগত্যা পাহাড়ি পথেই অনেক কষ্টে ভূটানের পথে দার্জিলিং ফিরে আসে সে। ততদিনে প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেছে। এই চার বছরে দার্জিলিং বদলে গেছে অনেকটা। টয়ট্রেন চালু হয়েছে, বাজারগুলি জমজমাট হয়েছে, অনেক নতুন মানুষ আর বাড়িঘর হয়েছে। অথচ ভেঙ্গে নুয়ে পড়েছে তাঁর বুচারবস্তির বাড়িটি। তাঁর আদরের স্ত্রী লালি আর শিশুকন্যাটি রোগে ভুগে মারা গেছে। তাঁর অভিভাবক নেম সিং ও মারা গেছেন লাসা থেকে কম্বল ব্যবসায়ীর হাতে পাঠানো তাঁর চিঠি না পড়েই। তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখে চিঠিটা টেবিলের উপর রাখা আছে না খোলা অবস্থাতেই। হার্মান সাহেবও দেশে ফিরে গেছেন। তাঁর মানে সেই সাংপোয় ভাসিয়ে দেওয়া সিল আঁটা লাঠিগুলি ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে উদ্ধার করে কিন্টুপের অমানুষিক অভিযানের সাফল্য স্বীকার করে নেওয়ার জন্য কেউ ছিল না। সেগুলি এমনি ভেসে ভেসে চলে গেছে সমুদ্রে। এমনকি সে যে এতবড় অভিযানে গেছিল, তাঁর বৃত্তান্ত শুনে বিশ্বাস করার মতন কেউ ছিলনা ওই নির্মম স্যাঁতস্যাঁতে শহরে।

ব্যক্তিগত দুঃখের অভিঘাত সামলে সে হার্মান সাহেবের অফিসে যায়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর জায়গায় যিনি এসেছেন তাকেই সে সব খুলে বলার চেষ্টা করে। দাখিল করার মতন কোনও তথ্য-প্রমাণ ছিল না তাঁর হাতে – ছিল কেবল স্মৃতি। অনেক গড়িমসির পর আকাউন্ট বিভাগে তাঁর যাওয়ার সময় অগ্রিম টাকা দেওয়ার রেকর্ড দেখে নতুন সাহেব দার্জিলিং ভুটিয়া স্কুলের শিক্ষক লামা উগেন গিয়াৎসোকে দিয়ে কিন্টুপের জবানবন্দী অনুলিখন করান। রামধনুর গায়ে ভেসে বেড়ানো পরী আর নিঝুম রাতে স্বচ্ছ স্ফটিকের মধ্যে দেখা স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে দেখার কথা ছাড়া আর সব কিছু বলে কিন্টুপ। তারপর সেটির অনুবাদ করিয়ে সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এভাবে মুখের কথা দুই ভাষায় হাতবদল হয়ে বর্ণনার অনেক খুঁটিনাটি বিকৃত হয়, তথ্যে অসঙ্গতি ঢোকায় বিবরণটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

কিন্টুপ তাঁর প্রাপ্য অর্থ বা সম্মান কিছুই পায় না। সে ফিরে যায় গুন্ডরিবাজারে তাঁর পুরনো পেশায়, চার বছরে ছিঁড়ে খান খান হয়ে যাওয়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনটাকে রিফু করার চেষ্টা করতে থাকে।

এরপর ইতিহাসের অনেক পাতা উলটে যায়। ১৯০৩ সালে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে তিব্বতে সেনা অভিযান করে ব্রিটিশ সরকার সাফল্য পায়। তারপর আর পণ্ডিত পদের প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। পেশাদার ভূপর্যটকরা নিজেরাই গিয়ে জ্ঞানবিশ্বের শেষ অনাবিষ্কৃত দেশের নদী, পাহাড়, অরণ্য, মালভূমির খুঁটিনাটি তুলে আনেন মানচিত্রের সুস্পষ্ট রেখায়। কিন্তু এত কিছুর পরও দুর্গমতার কারণে অস্পষ্ট থেকে যায় একটি নদের পথ।

১৯০৩ এ তিব্বতে সেনা অভিযান থেকে ফিরে ভূতত্ত্ববিদ ক্যাপ্টেন এরিক বেইলি সাংপোর রহস্যময় গতিপথ সম্পর্কে আগ্রহী হন। পড়াশুনা করতে করতে কিন্টুপের অভিযানের অস্বীকৃত রিপোর্ট তাঁর চোখে পড়ে। তিনি ভাবেন, পূর্ব তিব্বতের ন’হাজার ফুট উচ্চতা থেকে মাত্র দুশো মাইলের মধ্যে আসামের সমতলে যদি নেমে এসে থাকে এই নদ তাহলে কিন্টুপের বিবরণ অনুযায়ী একটি বা একাধিক বিশাল প্রপাত থাকা জরুরী। নাহলে হিসেব মেলেনা। তাছাড়া কিন্টুপের বিবরণে কুয়াশার ওড়নায় ঢাকা সেই রামধনু দেখার ইচ্ছা তাঁর মনে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ১৯১২ সালে সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসার হেনরি মোর্সহেডকে সঙ্গী করে তিনি আসাম উপত্যকা থেকে উজানপথে সাংপো অনুসন্ধানে গিয়ে পান সেই অগম্য গিরিখাত। সেই দুর্গমতম অংশ ছাড়া পেমাকো উপত্যকা পেরিয়ে পূর্ব তিব্বত ঘুরে এসে তাঁরা ঘোষণা করেন যে কিন্টুপের জরিপ প্রায় নিখুঁত ছিল।

ততদিনে এশিয়ার ভূরাজনৈতিক চিত্র বদলে গেছে। চীনে মিং সাম্রাজ্যের পতনের পর তিব্বতের শাসনব্যবস্থায় চীনের প্রভাব শিথিল হয়েছে। ততদিনে অভিজ্ঞ ত্রয়োদশ দলাই লামা রাশিয়ার জারের সঙ্গে বন্ধুত্বস্থাপনের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেছেন। ব্রিটিশ রিজেন্টকেও তেমন আমল দিচ্ছেন না আর। তখন একটি সুস্পষ্ট ভারত-তিব্বত সীমান্ত চুক্তি করার জন্যে ১৯১৩ সালের মার্চে সিমলায় একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকে ব্রিটিশ সরকার – তিব্বত, চীন আর ভারত সরকারের মধ্যে। কিন্তু চীনের প্রতিনিধি সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি এবং পরবর্তীকালে চীন সেটির বৈধতা অস্বীকার করে। তখনই দার্জিলিংয়ে খোঁজ পড়ে এক বৃদ্ধের, খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে পাওয়া যায় বাজারের এক কোণে একটি দর্জির দোকানে। তাঁকে সরকারি খরচে নিয়ে যাওয়া হয় সিমলায়। ত্রিশ বছর ধরে লাগাতার রিফু আর সেলাইয়ের কাজ করে তখন তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, শরীর নুয়ব্জ অশক্ত। কিন্তু তিনি যে হার না মানা জেদি মানুষ কিন্টুপ! ১৯১৪র ২৫-২৮ মার্চ, চারদিন ধরে টিবেট ফ্রন্টিয়ার কমিশনের অফিসারদের সামনে বসে ত্রিশ বছর পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বলে গেলেন বিশ্বের শেষ অনাবিষ্কৃত এলাকার এক আশ্চর্য অনুপুঙ্খ বর্ণনা। এবারেও শুধু রামধনুর গায়ে ভেসে বেড়ানো পরী আর নিঝুম রাতে স্বচ্ছ স্ফটিকের মধ্যে লালি আর তাঁর মেয়েকে দেখার কথা ছাড়া আর সব কিছু বলে কিন্টুপ। এবার তাঁর বক্তব্য ইংরেজি তর্জমা করলেন ক্যাপ্টেন বেইলি নিজে। উত্তরপূর্ব হিমালয়ের নানা এলাকায় দীর্ঘকাল কাটানোর ফলে তিনি অনেক জনজাতির ভাষা জানতেন। কিন্টুপের বর্ণনার সঙ্গে বেইলি ও মোর্সহেডের রিপোর্ট মিলিয়ে মানচিত্রের উপর ফেল্ট নিব দিয়ে লাল কালিতে একটি রেখা টানলেন তৎকালীন বিদেশ সচিব হেনরি ম্যাকমোহন। সুউচ্চ পর্বতমালা, ঘন পাহাড়শ্রেনী আর অরণ্যঘন উপত্যকার ওপর দিয়ে আঁকা এই কাল্পনিক রেখার নাম ম্যাকমোহন লাইন, যা পরবর্তীকালে অনেক অশান্তি ও রক্তপাতের কারণ হয়ে উঠবে।

বেইলির উদ্যোগে এতদিনে ব্রিটিশ সরকার সাংপো অভিযানের স্বীকৃতি হিসেবে কিন্টুপের হাতে তুলে দেয় একটি মেডেল আর একহাজার টাকা। বেইলি তাঁর জন্যে মাসিক পেনশনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু এই প্রখর স্মৃতিধর বৃদ্ধ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে সরকারের অনেক খরচ হবে, এই যুক্তিতে বেইলির প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।

কিন্তু দার্জিলিং ফিরে এসে পরের বছরই মারা যান কিন্টুপ। আর বেইলির মতন অফিসার ছিলেন বলে সাংপো যেখানে প্রায় ছ’হাজার ফুট নেমে আসে সেই কুয়াশার ওড়নার গায়ে সারাদিন রামধনু মাখা জলপ্রপাতটির নামকরণ হয় - কিন্টুপ ফলস!


চলবে ...