বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

​নীলাচল পাহাড়ের বাংলা ও বাঙালি

উত্তরপূর্বের অন্যতম ঔপন্যাাসিক কুমার অজিত দত্ত একাধারে গল্পকার প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক ।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, বিশেষ করে আহোম রাজত্বের কালে কবে থেকে যে বাঙালিদের আগমন শুরু হয়েছিল বা বঙ্গদেশের সঙ্গে শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যোগাযোগ শুরু হয়েছিল ,তার কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের শাসন কালের আগে পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তখন তো স্বেচ্ছায় কেউ এই উপত্যকায় আসতে চাইতো না। একদিকে ছিল দুর্গম গিরিপথ, গভীর জঙ্গল আর অন্যদিকে ম্যালেরিয়ার আতংক!যদি কেউ আসত, রাজানুকূল্যে, আমন্ত্রিত হয়ে। তাঁকে আনার জন্য পাঠানো হতো পাইক-বরকন্দাজ।

যতদূর জানা যায়,স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের(১৬৯৬—১৭১৪)আমল থেকে শুরু হয় এ যোগাযোগ।এই স্বর্গদেবের আমল থেকেই আহোম সাম্রাজ্যে স্থাপিত হতে শুরু করে বিদ্যাশিক্ষার প্রতিষ্ঠান,অর্থাৎ পাঠশালা।স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ব্রাহ্মণদের বিশেষভাবে সম্মান করতেন। তাঁর এই সম্মান-প্রদানের ধারণা ছিল একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে।তিনি ভাবতেন, ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের বরপুত্র। তাই ব্রাহ্মণদের প্রতি পক্ষপাতিত্বটা ছিল তাঁর অপরিসীম।তাঁদের বংশ-মর্যাদার দিকটাও তিনি খুব ভাবতেন।তাঁদের সামাজিক অবস্থানটা যাতে ওপরের দিকে থাকে সে নিয়েও তাঁর মাথাব্যথা ছিল। সেটা করার একমাত্র মাধ্যম ছিল শিক্ষা-দীক্ষা। তাই তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা শেখাবার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। স্থাপন করেছিলেন পাঠশালা। ওইসব পাঠশালায় শিক্ষাদানের জন্য ডাকিয়ে এনেছিলেন সব বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।শিক্ষার্থী হিসেবে ওইসব পাঠশালায় একমাত্র ব্রাহ্মণ সন্তানদেরই প্রবেশের অধিকার ছিল। বিশেষ শিক্ষার জন্য রাজা তাঁর নিজের রাজকুমারদের সঙ্গে তাদেরও কখনো কখনো পাঠাতেন বঙ্গদেশে।(প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখা ভালো,স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ তৎকালীন আহোম সাম্রাজ্যের রাজধানী রংপুর ও চরাইদেওকে সাজিয় তোলার জন্য একজন বাঙালি স্থপতিকেও ডেকে এনেছিলেন কোচবিহার থেকে, তাঁর নাম ঘনশ্যাম।)যতদূর জানা যায়, তাঁর রাজকুমারদের পড়াশোনা শেখাবার জন্য কান্যকুব্জ(কনৌজ) থেকেও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আনিয়েছিলেন তিনি। যেমন পুরুষোত্তম পণ্ডিত(ন-গোঁসাই)।এই ন-গোঁসাইকে রাজা পরবর্তী কালে ভূ-সম্পত্তি দান করে কয়েকটি শাক্ত-দেবালয়ের পূজাপাঠের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

5e52982a89881.jpg


  • প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাইর ৯ম বংশধর প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য ও তাঁর ধর্মপত্নী প্রয়াতা অনুপমা ভট্টাচার্য। -- ছবিটি প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাইর একাদশ বংশধর শ্রী পিনাকী ভট্টাচার্যের সৌজন্যে প্রাপ্ত।


স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ একসময় বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। আউনিআটি বৈষ্ণব সত্রের সত্রাধিকারী গোঁসাই হরিদেবের শরণ নিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে ধর্মগুরু হিসেবেও মানতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কী কারণে যেন শিবভক্ত হয়ে উঠেছিলেন স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ।একসময় নৈষ্ঠিক হিন্দু হওয়ার লক্ষ্যে খুঁজতে থাকেন একজন আধ্যাত্মিক শাক্ত-গুরু, যিনি তাঁকে গোপন মন্ত্র শিখিয়ে আধ্যাত্মিক আশ্রয়ের পথ দেখাবেন।অবশেষে খোঁজ পেলেন ওই শাক্ত-গুরুর, নাম কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য, যিনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মালিপোতা গাঁয়ের(শান্তিপুরের কাছেই) একজন বিখ্যাত শাক্ত-পুরোহিত ও ন্যায়বাগীশ।স্বর্গদেব এ-ও স্থির করলেন যে, কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে নীলাচলের কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবেও নিযুক্তি দেবেন। তাঁকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠালেন তিনি।একসময় ন্যায়বাগীশ কৃষ্ণরাম এসে পৌঁছে গেলেন।কিন্তু তাঁকে দেখে মন ভেঙে গেল স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের। স্বর্গদেবের বদ্ধমূল ধারণা ছিল তিনি যে পণ্ডিত-গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নেবেন তার চেহারা হবে দেবতার মতো উজ্জ্বল। কিন্তু কৃষ্ণরামের চেহারা তো সাধারণ মানুষের মতো!তিনি কৃষ্ণরামের কাছ থেকে দীক্ষা না নিয়ে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। কৃষ্ণরাম অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন এবং ফিরে গেলেন নিজের গাঁয়ে।

এর পরে-পরেই অসমে শুরু হয়ে যায় প্রলয়ংকর ভূমিকম্প।ওই ভূমিকম্পের ফলে বেশ ক’টি মন্দির,ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ভীত হয়ে পড়লেন এবং ব্যাখ্যা করলেন এই ভাবে যে, ন্যায়বাগীশ কৃষ্ণরামকে বিমুখ করেছেন বলেই বুঝি এই ভূমিকম্প।তিনি আবার ডেকে পাঠালেন কৃষ্ণরামকে।স্বর্গদেবের অনুগত পারিষদেরা অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে তাঁকে নিয়ে এলোস্বর্গদেবের রাজ্যে। স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ তাঁকে সসম্মানে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি দান করে অধিষ্ঠিত করলেন কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রূপে।সেখানেই তাঁর বাসস্থান নির্ধারিতও করে দিলেন।এবং তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণেরও ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।তবে, এই স্বর্গদেব রুদ্রসিংহই যে একসময় তাঁর চেহারা দেখে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন,এই ব্যথিত-স্মৃতি মুছে যায়নি তখনো কৃষ্ণরামের মন থেকে। তাই দীক্ষাকাল উপস্থিত হলে কৃষ্ণরাম সশরীরে স্বর্গদেবের কাছে হাজির না হয়ে বেল পাতায় লাল চন্দনে বীজমন্ত্র লিখে তাঁর দেখতে সুন্দর শিষ্য একজনকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্বর্গদেবের কাছে।স্বর্গদেবও এতে অপমানিত বোধ করেছিলেন।কৃষ্ণরামের কাছ থেকে আর দীক্ষা গ্রহণ করেননি। তবে কৃষ্ণরামকে ফের ফেরত পাঠাতে সাহস করেননি এই ভেবে যে, যদি আবার ভূমিকম্প আসে!ইত্যবসরে স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অবশ্য তাঁর পাঁচ পুত্রকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন এই বলে যে, তারা যেন সপরিবারে সবাই কৃষ্ণরামেরই দীক্ষা গ্রহণ করে।

এরপর আহোম রাজ্যাসনে বসলেন প্রয়াত স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের জ্যেষ্ঠপুত্র স্বর্গদেব শিব সিংহ(১৭১৪—১৭৪৪)।সিংহাসনে আসীন হয়েই রাজ্যের ব্রাহ্মণকুল ও রাজপরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে,পিতার আদেশ মেনে,তিনি কৃষ্ণরামের দীক্ষা নিয়েছিলেন।সেই থেকেই নীলাচল পর্বতে আসীন হয়েছিলেন বলে কৃষ্ণরাম, ‘পর্বতীয়া গোঁসাই’-- এই নতুন নামে পরিচিত হতে থাকলেন সেখানে।এবং তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, আহোম রাজত্বের ইতিহাসে স্বর্গদেব শিবসিংহের আমল থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজো-পাঠ, বিবাহ ইত্যাদিতে বঙ্গীয় রীতিনীতির চল,বিশেষ করে শাক্ত ধর্মের সার্বিক প্রসারণ।সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাটারও।রানি ফুলেশ্বরী,রানি অম্বিকা ও রানি সর্বেশ্বরীর(১৭২২-১৭৪৪)আমলে এই প্রসারণ আরও বেড়ে যায়।( প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে,রানি ফুলেশ্বরীরই পৃষ্ঠপোষকতায় ও পর্বতীয়া গোঁসাইর তত্ত্বাবধানে আহোম সাম্রাজ্যে প্রথম উদযাপিত হয়েছিল দুর্গোৎসব।) বাংলা রীতিনীতির ছায়াসঙ্গী হয়ে বাংলা ভাষার এই ক্রম-প্রচলন স্বাভাবিক সমাজতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার পথ ধরেই হয়েছে। জোর করে ঢুকে পড়েনি। স্বর্গদেব যেখানে উন্নত শিক্ষা ও ধর্মাচরণের জন্য বঙ্গদেশের পণ্ডিত ও ন্যায়বাগীশদের দ্বারস্থ হয়েছেন সেখানে তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ওই ছায়ার মতোই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষারও অনুপ্রবেশ ঘটেছে।এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে তো রোধ করা যায়নি।

কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য ওরফে পর্বতীয়া গোঁসাই এখানে এসে প্রথমেই যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটা হল ভাষা। তাই পৌরোহিত্য-কর্মের সুবিধের জন্য স্বর্গদেবের সম্মতিক্রমে, নিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন তিনি তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদেরও অর্থাৎ আরও বঙ্গজ শাক্ত ব্রাহ্মণ।তাঁদের তিনি পাণ্ডা হিসেবে কামাখ্যা মায়ের পূজা-পাঠের কর্তৃত্ব বণ্টন করে দিয়েছিলেন। আহোম সাম্রাজ্যের তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যকুল ও রাজন্যবর্গও তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিল।আহোম স্বর্গদেবদের কোষাগার ও অধিকৃত ভূ-সম্পদ থেকেতাঁদের সম্মানার্থে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল আর্থিক সহায়তা ও ভূ-সম্পত্তি। দৈনন্দিন পূজা ও তাঁদের ভরণপোষণের খরচ তো বহন করত রাজপরিবার।আহোম ব্রাহ্মণ্যকুলেরও কিছু অনুদান থাকত।তাঁরা পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর সহ-পূজারীদের নিত্য যজমান হয়ে উঠেছিল। স্বর্গদেব শিবসিংহ ও তাঁর তিন রানির(বিশেষ করে ফুলেশ্বরী) রাজত্বের কাল থেকে ধীরে ধীরে নীলাচল পর্বতে বাংলা ঘরানার চল চালু হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি তখন তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা ওই ঘরানা ও প্রতিপত্তি বজায় রাখতে বৈবাহিক সূত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন বঙ্গদেশের সঙ্গে।যজমানেরও অনুসন্ধান করছিলেন সেখানে।

পরবর্তী কালে স্বর্গদেব রাজেশ্বর সিংহের(১৭৫১—১৭৬৯) আমলে পর্বতীয়া গোঁসাই অর্থাৎ কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্রের দিকের একজন নাতি অসমে এসেছিলেন। ওই ব্যক্তি সম্পর্কে কৃষ্ণরামের নাতি ছিলেন বলে এখানে তিনি নাতি গোঁসাই নামে পরিচিত হন।স্বর্গদেব রাজেশ্বর সিংহ তাঁরও শরণ নিয়েছিলেন। এবং কিছু ভূ-সম্পত্তি দান করে পাণ্ডুর পাণ্ডুনাথ মন্দিরের দায়িত্ব তাঁর ওপর সঁপে দিয়েছিলেন।কিন্তু নীলাচল পর্বতে প্রবেশাধিকার পাননি। পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর বংশধরেরা নাতি গোঁসাইকে তাঁদের সমকক্ষ বলে স্বীকার করে নেননি।প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাই অর্থাৎ কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যের পরবর্তী বংশধরের অর্থাৎ বংশানুক্রমিকভাবে হওয়া পরবর্তী(নবম বংশধর) পর্বতীয়া গোঁসাইর একজন প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য গত শতকের চল্লিশের দশকের বিশিষ্ট বুরঞ্জিবিদ (ইতিহাসকার) সর্বানন্দরাজকুমারকে লেখা এক পত্রে জানিয়েছিলেন, ‘...স্বর্গদেব রাজেশ্বর সিংহ মহারাজা পর্বতীয়া গোস্বামীর দীক্ষিত শিষ্য। নাতি গোস্বামী হইতে কোনো মহারাজাই দীক্ষিত হন নাই...।নাতি গোস্বামী কামাখ্যা পাহাড়ে অনুমতি পান নাই। কামাখ্যার কোন দেবালয়ের বিধি-ব্যবস্থার ভারার্পণ হয় নাই। পর্বতীয়া গোস্বামীর মস্তকোপরি চন্দ্রতাপ থাকিবে কিন্তু নাতি গোস্বামীর তাহা থাকিবে না...’।[২৫/১/৪৬ তারিখে লেখা # সূত্র :সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”,পৃষ্ঠা :৪৪২] এ ছাড়া পরবর্তী আহোম রাজারাও যে কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য অর্থাৎ প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর পরবর্তী বংশধরদের অনুকূলে ছিলেন এবং নিয়মিত ভূ -সম্পত্তি দান করতেন তারও উল্লেখ পাওয়া যায় ছোটো পর্বতীয়া গোঁসাই চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের চিঠিতে : ‘...স্বর্গদেব স্বর্গীয় শিবসিংহ মহারাজ, স্বর্গদেব স্বর্গীয় প্রমত্তসিংহ মহারাজ, স্বর্গদেব স্বর্গীয় রাজেশ্বরসিংহ মহারাজ ইঁহারা সকলই শক্তি উপাসক ও পর্বতীয়া গোস্বামীর দীক্ষিত শিষ্য, এইরূপ জ্ঞাতঃ আছি।...পর্বতীয়া গোস্বামীকে একসময়ে একযোগে সমুদয় ভূ-সম্পত্তি মাত্র একজন মহারাজা দত্ত্বা সম্পত্তি নহে। এক এক জন রাজা দীক্ষা গ্রহণাদি কোনও কাজ উপলক্ষে এইসব সম্পত্তি পর্যায়ক্রমে দান করেছিলেন। বর্তমানে এইসব প্রমাণ পাওয়া দুরূহ। আমি যথেষ্ট সন্ধানে এরূপ মাত্র ২খানা তাম্রলিপি সংগ্রহ করিতে পেরেছিলাম। ১খানা স্বর্গদেব স্বর্গীয় প্রমত্তসিংহ মহারাজা কর্তৃক স্বর্গীয় রামানন্দ বিদ্যালঙ্কার [স্বর্গীয় কৃষ্ণরাম ন্যায়বাগীশের পুত্র] মহাশয়কে ১৬৬৯ শকের মাঘ মাসে , ২খানা স্বর্গদেব স্বর্গীয় রাজেশ্বরসিংহ মহারাজ কর্তৃক উক্ত বিদ্যালঙ্কার মহাশয়কে ১৬৮৭ শকের কার্ত্তিক মাসে ভূ-সম্পত্তি দানের তাম্রলিপি...’।[২৫/১/৪৬ তারিখে লেখা # সূত্র : সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”, পৃষ্ঠা : ৪৩৮] এ-ভাবেই পরবর্তী পর্বতীয়া গোঁসাইরা(তাঁদের অধীনস্থ পাণ্ডারাও)বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বর্গদেবের কাছ থেকে বা ক্ষমতাশালী রাজন্যবর্গের কাছ থেকে ধর্মীয় কর্ম উপলক্ষে বা দীক্ষাকালে উপহারস্বরূপ পেয়েছিলেন প্রচুর ভূ-সম্পত্তি।এবং স্বর্গদেবদের আদেশ অনুযায়ী এইসব ভূ-সম্পত্তি পর্বতীয়া গোঁসাইয়ের বংশধর ও পাণ্ডারা পুরুষানুক্রমে ভোগ করে গেছেন।

তো, ওপরের প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য লিখিত পত্রাংশ দু’টি প্রমাণ করে যে, আহোম রাজবংশ সহ তৎকালীন আহোম ব্রাহ্মণ্যকুল ও অন্যান্য অনুগামীদের ওপর পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর পরবর্তী বংশধরদের প্রতিপত্তি ও প্রভাব অটুট ছিল।তাঁরা যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতেন বাংলাকেই। ধর্ম-কেন্দ্রিক যোগাযোগও হতো বাংলাতেই।(পর্বতীয়া গোঁসাইয়ের নবম বংশধর প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যর আগের বংশধরদের লেখা বাংলার কোনও দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। ওগুলি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।)

নীলাচলের এই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থেকে গেল আহোম সাম্রাজ্যের শেষ স্বাধীন রাজা স্বর্গদেব চন্দ্রকান্ত সিংহের শাসনকাল(১৮১০—১৮২৪)অবধিও।যদিও এরপর ইংরেজদের অধীনে পরাধীন আহোম রাজ্যের(কিছু অংশ)রাজা হয়েছিলেন পুরন্দর সিংহ(১৮৩২--?)।এর পরে-পরেই গুঞ্জরণ উঠতে শুরু করল আহোম ব্রাহ্মণ্যকুল ও অন্যান্য অব্রাহ্মণ(তৎকালীন সময়ে এদের বলা হত শূদ্র।) প্রজাদের মধ্যে , যারা শিক্ষিত ও প্রাদেশিকতা বোধে সচেতন হয়ে উঠছিল, এই বলে যে, নীলাচল পর্বতের পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর সহ-পূজারীরা কেন বাঙালি হয়ে রইলেন? প্রশ্নটা স্বাভাবিক।এ গুঞ্জরণ মৃদু ভাবে হলেও শেষ দিকের কোনও স্বর্গদেবের সময়েও যে ওঠেনি তা হলফ করে বলা যায় না।তবে সেটা চাপা পড়ে গেছে পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর সহ-পূজারীদের প্রতি স্বর্গদেবের অর্থাৎ রাজপরিবারের অতিরিক্ত ভক্তি ও আনুগত্যের ফলে।তবে পর্বতীয়া গোঁসাই ও তাঁর পরবর্তী বংশধরদের এই প্রতিপত্তি ও প্রভাব যে খুব মসৃণ ছিল তা নয়। কারণ, তাঁরা তখনও স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি বা গুরুত্ব দেননি।অথচ, কনৌজ থেকে আসা পণ্ডিত-গোঁসাইয়ের বংশধরেরা অসমিয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই, অব্রাহ্মণ আহোম ও মায়ামরিয়া আহোমরা বিষয়টি কখনোই খোলা মনে মেনে নিতে পারেনি।ওরা ভেবেছিল পর্বতীয়া গোঁসাইরা আহোম ভাষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারী।

তো,আহোম রাজারা তাঁদের নিজস্ব আহোম ধর্ম ত্যাগ করে এই বিরুদ্ধাচারী(ওদের ভাবনায়)পর্বতীয়া গোঁসাইদেরই দেওয়া শাক্ত ধর্ম দীক্ষায় আশ্রিত ছিলেন বলেও ভেতরে ভেতর এদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল একটা চাপা ক্ষোভ।ওইসব অব্রাহ্মণ ও মায়ামরিয়া আহোমরা ছিল নিজ ধর্মের প্রতি অত্যধিক অনুগত ও জাত্যাভিমানী। স্বর্গদেবদের এই শাক্ত ধর্মের প্রতি আস্থাবোধ ও পর্বতীয়া গোঁসাইদের প্রতি একদেশদর্শীতার কারণে ব্রাহ্মণ্য বা দেববংশী আহোম এবং মায়ামরিয়া ও অব্রাহ্মণ আহোমদের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল রেষারেষি।যদিও পরবর্তীকালে প্রয়াত স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের কনিষ্ঠ পুত্র স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহ(১৭৬৯—১৭৮০) পর্বতীয়া গোঁসাইদের কাছ থেকে আর দীক্ষা নেননি।তবে তিনি বঙ্গীয় শাক্ত ধর্মের প্রতিই আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় তাঁকে অতি মাত্রায় মর্মাহত করেছিল। এবিষয়ে বুরঞ্জি থেকে যা পাওয়া যায় সেটা হলো, স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহের গায়ের রং ছিল কালো। তিনি যে স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের পুত্র হতে পারেন, তৎকালীন সময়ে, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারত না। এই একই কারণে পর্বতীয়া গোঁসাইও তাঁকে সেভাবে সমাদর করতেন না । দীক্ষা দিতেও ততটা উৎসাহী ছিলেন না।সে-কারণে স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহ অত্যন্ত অভিমানী হয়ে বঙ্গদেশ থেকে রমানন্দ ভট্টাচার্য(মতান্তরে আচার্য) নামে এক শাক্ত-পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁর শরণ নিয়েছিলেন।তাঁকেও ভু-সম্পত্তি ইত্যাদি দান করে নিজের রাজ্যে সংস্থাপন দিয়েছিলেন তিনি। ইনিও ন-গোঁসাই নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন সেখানে।(ওই সময় তাঁকে ভট্টাচার্য-গোঁসাই নামেও ডাকা হত।)তিনি নীলাচলের প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন কিনা জানা যায় না।তবে এটা জানা যায়, স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহের পরবর্তী স্বর্গদেবরা এই ন-গোঁসাইর নয়ত তাঁর বংশধরদের কাছে থেকেই দীক্ষা নিয়েছিলেন।মতান্তরে জানা যায়, এই সময়ে কনৌজ থেকেও শাক্ত-ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল।এঁদেরও বলা হত ন-গোঁসাই।স্বর্গদেবরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এঁদের অধিষ্ঠিত করতেন। সুতরাং এতেই বোঝা যায়, এই ন-গোঁসাইরাও ছিলেন স্বর্গদেবদের আশ্রিত।উপহার হিসেবে পেতেন ভূ-সম্পত্তি। হয়েছিলেন স্বর্গদেবদের মনোনীত শাক্ত সত্রের অধিকারী।এবং এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে,রুদ্রসিংহ ও লক্ষ্মীসিংহ পরবর্তী স্বর্গদেবরা শাক্ত ধর্মেই অটল ছিলেন।যদিও লক্ষ্মীসিংহ পরবর্তী স্বর্গদেবরা সরাসরি পর্বতীয়া গোঁসাইদের শিষ্য ছিলেন না। তথাপিও, পর্বতীয়া গোঁসাইদের প্রতি কখনো অবিচার করেননি তাঁরা। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও বরাদ্দকৃত রাজ-সাহায্যটুকু দিয়ে গেছেন।তবুও ওই অসহিষ্ণুতাজনিত ধর্মীয় বিভেদের কারণে স্বর্গদেবদের সঙ্গে মায়ামরিয়া-আহোম ও অব্রাহ্মণ আহোমদের(শূদ্র-মহন্তদের) রেষারেষি থেকেই গেল। ক্রমে এই রেষারেষি হয়ে উঠেছিল হিংসামূলক বা প্রতিশোধমূলক এবং পরিশেষে হয়ে উঠেছিল রাজ্য অধিকার বা ক্ষমতা লাভের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ। তবে এই বিদ্রোহজনিত রোষের আঁচ স্বর্গদেবরা নীলাচলে পড়তে দেননি। এ-ছাড়া নীলাচলের প্রবেশপথগুলো ছিল তখন অতি দুর্গম।যদিও পর্বতীয়া গোঁসাইর কোনও এক প্রশিষ্য স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহের(অথবা গৌরীনাথ সিংহের) নির্দেশে শিবসাগরে জয়সাগরের পাড়ে অবস্থিত কোনও এক শাক্তসত্র পরিচালনায় নিয়ত ছিলেন।সেখানে তিনি মায়ামরিয়া বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এবং কোনক্রমে প্রাণে বেঁচেছিলেন।

স্বর্গদেব লক্ষ্মীসিংহের রাজত্বকাল থেকে এই রেষারেষির প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং কালক্রমে বিদ্রোহের আকার নেয়।অসমের ইতিহাসের পাতায় এই বিদ্রোহ মায়ামরিয়া বিদ্রোহ নামেই খ্যাত।এই বিদ্রোহ আহোম সাম্রাজ্যের ইতিহাসে চারবার হয়েছিল।এর ফলে ওই সময়ের শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী আহোমদের কোনো কোনো গোষ্ঠী নাকি বিদ্রোহী দলের চাপে পড়ে শাক্ত ধর্মের অধীন থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন।এবং ওই প্রবণতা ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকল আহোম সাম্রাজ্যের শেষ রাজার রাজত্বকাল অবধি। এরপরেও এই প্রবণতা প্রাক-স্বাধীনতার কাল অবধি অক্ষুণ্ণ ছিল। এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বতীয়া গোঁসাই প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যর(তাঁকে ডাকা হতো ‘সরুজনা’ পর্বতীয়া গোঁসাই বলে, অর্থাৎ ছোটো পর্বতীয়া গোঁসাই।)গত শতকের চল্লিশের দশকের বিশিষ্ট বুরঞ্জিবিদ(ইতিহাসকার)সর্বানন্দ রাজকুমারকে লেখা একটি চিঠি প্রণিধান যোগ্য-- ‘... শুনিতে পাই আহোম বংশীয় কোন কোন ভদ্রলোক এক্ষণে নিজেকে হিন্দুজাতি স্বীকারে ইচ্ছুক নহেন;অবশ্যে ইহার সত্যাসত্য আমি অবগত নাহি এবং এইরূপ বর্তমান কোন রাজনৈতিক কৌশল বিশেষ এইরূপ জ্ঞান হয়; আমি রাজনীতি কখনও চর্চা ও চিন্তা করি নাই। যে জাতি শৌর্যে বীর্যে এবং হিন্দুর আচার-ব্যবহার, সেবা-পূজায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিয়াছিলেন, আজ তাহাদের এরূপ অবসাদ শক্তি উপাসনার অভাবই মাত্র পরিলক্ষিত হয় ব্যতীত বলিবার অপর কিছু পাই না। শক্তিময়ীর সন্তান আহম পূর্বপুরুষ দিগের আচরণ ও কীর্তিকাহিনী ভুলিলে জাতির অপমৃত্যু ঘটাইবে বলিয়া ভয় হয়। শক্তি উপাসনার সমস্ত গুণ ও শক্তি এই জাতীতে বিদ্যমান, তাহা বিস্মরণ হওয়া তদ্রুপ আচরণে অবহেলা শক্তিমানের প্রমাণ হয় না। অপর আসমীয়া কাহারো ঠাট্টা বিদ্রুপে আহমের অতুলনীয় কীর্তি ম্লান হতে পারে না। আজও যাহার কীর্তি আসামের সর্বত্র বিদ্যমান থাকিয়া সাক্ষ্য দিতেছে। আজও আসামের অসমীয়া জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যাঁহার প্রদত্ত সম্মানে সম্মানিত , যাঁহার প্রদত্ত দানে ধনবান, যাঁহার প্রদত্ত দানে আসামের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তবধি দেব-দেবালয়ে শঙ্খ-ঘণ্টা নিনাদিত হইয়া , শত কণ্ঠের মন্ত্রে শত ভক্তের আহ্বায়নে বিশ্ব জননীর নিয়ত পূজা হইতেছে। সেই জাতির জ্ঞান চক্ষু সম্পন্ন কেহ কি অভাবে নিজ জাতি বা উপাস্য অস্বীকার করিতে পারে?রাজকুমার! অতি ক্ষুদ্র আমি বুঝিতেই পারি না।’ [২৫/১/৪৬ তারিখে লেখা # সূত্র : সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”,পৃষ্ঠা : ৪৬৯]

প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের উল্লেখিত চিঠিটিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আহোম রাজতন্ত্রে একটা উথাল-পাথাল উঠেছিল বেশ কয়েক দশক জুড়ে।শূদ্র ও মায়ামরিয়া ধর্ম এবং ন-গোঁসাই ও পর্বতীয়া গোঁসাইদের শাক্ত ধর্মকে নিয়ে সনাতনপন্থী আহোম ও শাক্ত ধর্মাবলম্বী আহোমদের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল কূটকচালি। এবং পরে সেটা রূপ নিয়েছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিদ্রোহে।এ-রকম হতে হতে আহোম সাম্রাজ্যের শেষের দিকে পর্বতীয়া গোঁসাই ও ন-গোঁসাই অর্থাৎ শাক্ত ধর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছিল।

এবং সঙ্গে সঙ্গে পর্বতীয়া গোঁসাইরা কেন তখনো বাঙালি হয়ে রইলেন(তত দিনে ন-গোঁসাইরা সব অসমিয়া হয়ে গেছে)এই প্রশ্নটি এবার আস্তে আস্তে উচ্চকিত হতে থাকল।কেনই বা তাঁরা তখনো পর্যন্ত তাঁদের বিবাহসূত্রটি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বজায় রেখেছেন সে-প্রশ্নটিও উত্তাল হয়ে উঠেছিল।এ-প্রসঙ্গে প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের আরেকটি চিঠি কি বলে দেখুন, ‘...পর্বতীয়া গোস্বামী হইতে আহম রাজা দীক্ষিত হওয়ার পরে , রাজক্ষমতাপন্ন অনেক ও অনেক উচ্চকুলদ্ভব ব্রাহ্মণ পর্বতীয়া গোস্বামীকে গুরুত্বে বরণ করেছিলেন। এই রূপে বেশী সংখ্যক ব্রাহ্মণ পরিবার সহ ধর্মসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় আসামে পর্বতীয়া গোস্বামী দিগের বিবাহাদি কাজে প্রধানতঃ অল্পসংখ্যক সহ প্রতিবন্ধক উপস্থিত হয়। অল্পসংখ্যক পরিবারে পর্যায়ক্রমে বিবাহাদি কাজধারা বাহ্যিকভাবে চলিতে পারে না,শাস্ত্রীয় বিচারে প্রতিবন্ধক জন্মে, অপরাপর কারণও কিছু আছে।এই কারণে আসামে পর্বতীয়া গোস্বামীদের অনেক কিছু থাকলেও বিবাহাদি কাজের জন্য বঙ্গসমাজের সহিত যোগসূত্র বজায় রাখতে হইয়াছে।বর্তমান সময়ের ন্যায় সেই সময়ে প্রাদেশিকতা ভাবের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না, বরং সর্বপ্রকারে সংকীর্ণতা পরিহারই শ্রেষ্ঠত্ব লাভের উপায় গণ্য হইত।...উল্লিখিত কারণে পর্বতীয়া গোস্বামী অসমীয়া হইতে প্রতিবন্ধক পাইয়াছিলেন।ইহাতে আহম মহারাজার কলঙ্ক কেন প্রকাশিত হইবে?...যাঁহাদের রাজত্ব সময়ে রাজ্যের সর্বত্র যাতায়তের রাস্তা, জলাশয়, দেব-দেবালয় ও সত্র সঙ্গ স্থাপন, সেবা-পূজার ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত সমস্ত কিছু বিধিবদ্ধ হয়েছিল, গুণানুসারে গুণীদিগকে সম্মানিত করা হয়েছিল, সেরূপ সময়ে তদ্রুপ গুণান্বিত রাজদণ্ডধর মহাপুরুষ পর্বতীয়া গোস্বামীর বসবাসের পক্ষে সমস্ত প্রকারে বিধি ব্যবস্থা করার পর তাহাদের বিবাহাদির সুব্যবস্থা, যাহা ভবিষ্যতে বিপন্ন না হয় তদ্রুপ লক্ষ্য করেই এই ব্যবস্থা রেখেছিলেন। বরং আমি তাঁহাদের বিশেষ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও সূক্ষ্ম বিবেচনা শক্তিরই পরিচয় পাই।’[১৫/১/৪৬ তারিখে লেখা # সূত্র : সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”, পৃষ্ঠা : ৪২৭]

‘এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও সূক্ষ্ম বিবেচনা শক্তি’র বিপরীত প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন রাজন্যবিরোধী গোষ্ঠী আহোমদের মধ্যে।কী সেই প্রতিক্রিয়া গত শতকের চল্লিশের দশকের একজন বিশিষ্ট বুরঞ্জিবিদ(ইতিহাসকার)সর্বানন্দ রাজকুমার মহাশয়ের কলমে তা প্রতিফলিত হয়েছে, ‘স্বর্গদেব সকলে করি দিয়া এই সুব্যবস্থার ফলত পর্বতীয়া গোঁসাইর বংশধরসকলে বঙ্গদেশর ব্রাহ্মণর লগত বৈবাহিক সম্বন্ধত আবদ্ধ হৈ অসমলৈ বঙ্গদেশর ব্রাহ্মণ আমদানি করিবলৈ সুবিধা পায় আরু সেই সুবিধার লগত রাজদত্তা ভূ-সম্পত্তিও জীয়ারীর লগত যৌতুকত দি বঙ্গদেশর ব্রাহ্মণর অবস্থা টনকীয়াল করে । পর্বতীয়া গোঁসাইর দরে এই সকলেও অসমর অন্নরে প্রতিপালিত হৈ বঙালী হৈ আছে।’[ সূত্র : সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”, পৃষ্ঠা : ৪২৮]

রাজকুমার মহাশয়ের কথাগুলো রূঢ় ও বিদ্বেষপূর্ণ শোনালেও কিছুটা তো সত্য।স্বর্গদেবদের বা আহোম রাজন্যকুলের বা দীক্ষিত ব্রাহ্মণ্যকুলের কাছ থেকে পাওয়া সুব্যবস্থা ও দান ইত্যাদি তাঁরা পুরো মাত্রায় ভোগ করে গেছেন। মা কামাখ্যা বা অন্য কোনও শাক্ত দেবদেবীর পুজোপাঠ,যজমানবৃত্তি,দীক্ষাদান বা বৈবাহিক-পৌরোহিত্যজনিত ধর্মীয় কাজ ইত্যাদি পারত্রিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতিমূলক (রাজন্যকুলদের যা বিশ্বাস) কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ তৎকালীন আহোম ও অসমিয়া সমাজের জন্য করেছিলেন কিনা কোনও বুরঞ্জিতে পাওয়া যায় না।(যদিও তাঁরা ওই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কাজকর্মের মাধ্যমেই এই সমাজ-সংসারের কল্যাণ খুঁজেছিলেন।) তাঁদের বাঙালিয়ানাও বজায় রেখেছিলেন সঠিক ভাবে।(এটা কোনও দোষের হতে পারে না!) পরবর্তীকালের অশান্ত সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, অসমের অন্নে প্রতিপালিত হতে হলে যে, বাঙালির বাঙালিত্ব ঘোচাতে হয়(বিদ্রূপাত্মক অর্থে)সে-বোধ তখনো তাঁদের জাগেনি। তদানীন্তন আহোম রাজা,রাজন্যবর্গ ও দীক্ষিত ব্রাহ্মণকুল প্রাদেশিকতায়(সংকীর্ণ অর্থে)বা উগ্র জাতীয়তাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন না বলেই হয়তো তাঁদের চেতনায় ঐ চাপ ছিল না।

সে যা হোক, এরপর এলো ব্রিটিশ আমল । অসম চলে এলো ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার(বেঙ্গল প্রেসিদেন্সির)অধীনে।চাকরি-সূত্রে ব্রিটিশের সঙ্গে আবার অসমে আসা শুরু হল বাঙালির।ব্রিটিশের দৌলতে যোগাযোগ ব্যবস্থার রাস্তাও খুলে গেল বিভিন্ন দিক দিয়ে। এর ফলে নীলাচলের পর্বতীয়া গোঁসাইদের কামাখ্যাধামে শুরু হয়ে গেল বহিরাগত(যারা এখানে ব্রিটিশ সরকারের কর্মী হিসেবে এসেছিলেন এবং যারা বঙ্গদেশ থেকে পুণ্যার্জনের জন্য আসতেন) শাক্তবিশ্বাসী পুণ্যার্থীদেরনিয়মিত আগমন।(এর আগে আহোম রাজ-পরিবার,রাজন্যবর্গ ও শাক্তপন্থী আহোম ব্রাহ্মণরা ছাড়া আর কেউ কামাখ্যাধামে আসত না।) এবং তাঁরা বেশিরভাগই হয় গিয়েছিলেন পর্বতীয়া গোঁসাইদের নিত্য যজমান।কোনও রকম দ্বিধা না রেখেই বলা যায়,এঁরা সবাই বাঙালি।এঁদের সঙ্গে পূজার্চনাদির ব্যাপারে কথোপকথনে বা ভাবের আদান-প্রদানে পর্বতীয়া গোঁসাইদের সুবিধেই হয়ে গিয়েছিল।এঁদের দেওয়া দান-দক্ষিণাই তখন পর্বতীয়া গোঁসাইদের একমাত্র আয় ছিল। কেন না আহোম সাম্রাজ্যের পতনের পর আহোম রাজাদের বা আহোম রাজন্যবর্গের তরফ থেকে যে আর্থিক সহযোগটি পাওয়া যেত সেটি ক্রমশ কমে আসতে শুরু করেছিল।যদিও আহোম মহারাজাদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ভূ-সম্পত্তি তাঁরা পুরুষানুক্রমেই ভোগ করে আসছিলেন এবং এখনো আসছেন।

ভারত-বিভাগ এবং স্বাধীনতার পর ক্রমশ বেড়ে গেল অসমে বাঙালিদের আগমন।যোগাযোগ ব্যবস্থারও আরও উন্নতি হলো। বেড়ে গেল কামাখ্যাধামে পুণ্যার্থীর ভিড়ও।এবং এইসব পুণ্যার্থীদের ছিল একজন করে বাঁধা পাণ্ডা। পাণ্ডা মানে পর্বতীয়া গোঁসাইদের শিষ্য বা প্রশিষ্য।(প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা প্রয়োজন, ন-গোঁসাইদের শিষ্য-প্রশিষ্যরাও কামাখ্যার পাণ্ডা ছিলেন।যদিও পর্বতীয়া গোঁসাইদের তুলনায়সংখ্যায় অতি কম।তাঁরা পর্বতীয়া গোঁসাইদেরই অনুবর্তী ছিলেন।)

মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা। মাঝে-মধ্যেই আমাদের বাড়িতে আসতেন এক সাধুপুরুষ। কপালে থাকত লাল ফোঁটা। পরনে কখনো কখনো থাকত লাল শালু কাপড়ের ফতুয়া,কখনো সাদা কাপড়ের।সঙ্গে কলাপাতার মোড়কে নিয়ে আসতেন কামাখ্যাবাড়ির বলির প্রসাদ।মা সাষ্টাঙ্গে তাঁকে প্রণাম করতেন।আমাকেও বলতেন প্রণাম করতে।ভয়ে ভয়ে গিয়ে করতাম। তিনি আমাদের বাড়ির বারান্দার ছায়ায় গিয়ে একটু বসতেন। কত রকমের কথা বলতেন মা কামাখ্যা বা কামাখ্যামন্দিরকে কেন্দ্র করে। সবই বলতেন বাংলায়।মা পীড়াপীড়ি করতেন চা বা একটু জল-বাতাসা খেতে। কিন্তু তিনি কিছুই খেতে চাইতেন না।একটু বাদেই প্রণামীটা নিয়ে চলে যেতেন। যাওয়ার সময় বলে যেতেন কামাখ্যা মায়ের শরণ নিতে । তাহলে নাকি সব কাজেই সুফল পাওয়া যায়।পরে মায়ের কাছে জেনেছি , ওই সাধু পুরুষই কামাখ্যার পাণ্ডা, নাম ছিল শম্ভুনাথ। বাবা বলতেন শম্ভুপাণ্ডা।আমার মা ওই বলির প্রসাদ পেয়াজ-রসুন ছাড়া রাঁধতেন। আমরা পাত পেড়ে খেতাম।

কোনও এক শুভদিনে বা ছুটির দিনে বাবা আমাদের প্রায়ই নিয়ে যেতেন কামাখ্যাবাড়ি। সকাল-সকাল চান করে খালি পেটে পাণ্ডুর(গুয়াহাটির একটি অঞ্চল) অরুণা সিনেমা-হলের পেছন দিকের পথ ধরে হাঁটা শুরু করতাম।তারপর নীলাচল পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা পাথরের দীর্ঘ এবড়ো-খেবড়ো সিঁড়ি ডিঙিয়ে(তখনো সড়কপথ চালু হয়নি।) হাঁপাতে হাঁপাতে চলে যেতাম মন্দির প্রাঙ্গণে।সেখানে পৌঁছেই খোঁজ করতাম ওই আমাদের বাঁধা পাণ্ডা শম্ভুনাথ মহাশয়কে। পেয়েও যেতাম। তিনিই আমাদের মায়ের দর্শণাঞ্জলি থেকে শুরু করে মন্দির প্রদক্ষীণ সব করিয়ে দিতেন। তখন এখনকার মতো ভিড় হতো না বা লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হতো না। ওই পাণ্ডার ওপর নির্ভর করে থাকলেই সব হয়ে যেত। দর্শন শেষেশম্ভুনাথ মহাশয় আমাদের নিয়ে যেতেন তাঁর ডেরায়। সেখানে আমরা সবাই বিশ্রাম নিতাম আর সকালের উপোষ ভাঙতাম। শম্ভুনাথ মহাশয়ের পত্নী আমাদের সরষের তেলে লুচি ভাজা করে খাওয়াতেন। বিশ্রাম শেষে ফেরার সময় বাবা শম্ভুনাথ মহাশয়কে তাঁর প্রাপ্য প্রণামীটুকু দিয়ে প্রণাম করতেন। বাবার দেখাদেখি আমরাও করতাম।তখন মন্দিরের সব পাণ্ডারা বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলতেন পরিষ্কার বাংলাতেই। দর্শনার্থীদের মধ্যে তো থাকতেন আশি ভাগ বাঙালিই।

অবশ্য স্বাধীনোত্তর কাল থেকেই নীলাচলের চালচিত্রটা পাল্টাতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে...।গত শতকের সত্তরের দশক থেকে অসমে ক্রমশ বেড়ে গিয়েছিল প্রাদেশিকতার ঝাঁজ। সে আঁচ এসে পড়েছিল নীলাচলের পর্বতীয়া গোঁসাইদের নব প্রজন্মের মধ্যেও।পর্বতীয়া গোঁসাইদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনযাত্রাও বদলে গেছে ধাপে ধাপে তখন থেকেই।ওরা অসমিয়া শিখেছেন,পরিস্কার অসমিয়া বলতে পারেন। যদিও মাতৃভাষা বাংলাটি তাঁরা ভোলেনেনি তখনো।চর্চায় থাকতেন।বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন।সুন্দর শান্তিপুরী বাংলায়। সম্প্রতি দেখা করতে গিয়েছিলাম আদি পর্বতীয়া গোঁসাই অর্থাৎ কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যের দশম বংশধর প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পত্নী সাধনা ভট্টাচার্য এবং একাদশ বংশধর শ্রীপিনাকী ভট্টাচার্যের সঙ্গে।সাধনা ভট্টাচার্যের বয়স বর্তমানে আশি। তাঁর আদিবাড়ি নদীয়া শান্তিপুর।ছিলেন গৃহবধূ। সুন্দর মিষ্টি বাংলায় কথা বললেন। জানালেন, তাঁর শ্বশুরমশাই অর্থাৎ প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাইর নবম বশধর প্রয়াত চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যকে নিয়ে নানান স্মৃতিকথা।পিনাকী ভট্টাচার্য,বর্তমানে যিনি একজন প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেক্ট(স্থপতি),কামাখ্যায় পুজো-পাঠের পেশায় যাননি। তিনি আমার সঙ্গে সুন্দর বাংলাতেই কথা বললেন।অসমিয়াও জানেন।তিনি জানালেন, কামাখ্যার প্রথম পর্বতীয়া গোঁসাই অর্থাৎ কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যের দশম বংশধর পর্যন্ত সবাই বাংলা মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছেন।একাদশ বংশধর অর্থাৎ তিনি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র ছিলেন।তবে বাংলাটা তিনি শিখেছেন বাড়িতে। বলতে পারেন,অতটা ভালো লিখতে পারেন না।বিয়ে করেছেন স্থানীয় বাঙালি ব্রাহ্মণ মেয়ে।নীলাচলের নয়।তার একমাত্র সন্তান অভিরূপ ভট্টাচার্য,যে বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে রাজ্যের বাইরে, সে-ও ভালো বাংলা ও অসমিয়া বলতে পারে।সাধনা ভট্টাচার্য ও পিনাকী ভট্টাচার্য উভয়েরই বর্তমান বাসস্থান গুয়াহাটি শহরের উলুবারিতে।

তবে নীলাচল অর্থাৎ কামখ্যাধামের বর্তমান ছবিটা একেবারেই অন্য রকম। যেন খোল –নলচে পাল্টে গেছে। ভেতর ও বাইরের রাজনৈতিক চাপে পর্বতীয়া গোঁসাইর অন্যান্য বংশধর ও পাণ্ডাদের মধ্যে প্রকাশ্যে বাংলা বলার চলটা উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।নতুন প্রজন্মের পাণ্ডারা তো অসমিয়াতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি।অনেকেই নিজস্ব সম্প্রদায়ের বাইরে গিয়ে অসমিয়া ব্রাহ্মণ মেয়ে বিয়ে করছেন।অতি প্রয়োজনে দর্শনার্থীদের সঙ্গে হিন্দিতে নয়তো ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন ওরা।বাংলাটা ভুলেই যাচ্ছেন প্রায়। শুধু তাই নয়,এই প্রজন্মে বাঁধা পাণ্ডার চলও প্রায় নেই-ই।যজমানবৃত্তির প্রশ্নই ওঠে না।এখন নীলাচলে প্রতিদিনই দর্শনার্থীর বিশাল লাইন পড়ে।পাণ্ডারা হিমসিম খান।শুধু বাংলা বা বাঙালি নয়, ভারতবর্ষের নানান প্রান্ত থেকে আসেন দর্শনার্থীরা।আয় হয় পাহাড়-প্রমাণ।

..........................................................................................

তথ্যসূত্র :

১। সর্বানন্দ রাজকুমার প্রণীত “ইতিহাসে সোঁয়রা ছশটা বছর”।।বরুয়া প্রিন্টিং হাউস, যোরহাট—১

২। Sir Edward Gait প্রণীত A history of Assam ।। থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যানড কোম্পানি, কলকাতা--১

৩। ডঃ লক্ষ্মী দেবী প্রণীত “অসম দেশর বুরঞ্জী”।। এলবিএস পাব্লিকেশন,গুয়াহাটি--১

৪। সাধনা ভট্টাচার্য ও পিনাকী ভট্টাচার্যের কাছ থেকে পাওয়া কিছু মৌখিক তথ্য।


Writer’s address :

Kumar Ajit Dutta, F/4 Madhavsankar Housing Complex,Pandavnagar,Boripara,Pandu,Guwahati 781012 (assam) Mob 9435307169

....................