শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১৫

পনেরো

সর্বেশ্বর গ্রাম প্রধানের সঙ্গে অনেক আলোচনার শেষে সোনার বেতন মাসে পনেরো টাকা ঠিক করা হল। রসেশ্বর গ্রামপ্রধানের হাতে-পায়ে ধরে তা থেকে ষাট টাকা অগ্রিম বলে চেয়ে নিল। টাকা গুলি হাতে আসার পরেই রসেশ্বরের প্রথম চিন্তা হল কেরানি বাবুকে কীভাবে তুষ্ট করা যায়? তার মনের দৃঢ় ধারণা যে কেরানি বাবু তার উপরে রাগ করে থাকলে তার মামলার ফল ভালো হওয়ার কোনো আশা নেই।

দুই দিন কেবল সেই কথা চিন্তা করে সে অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হল। কুড়িটা টাকা খরচা করে সে কয়েক কেজি জুহা চাল এবং কিছুটা দুধ জোগাড় করল। তারপরের দিন রবিবার দুপুর বেলা ঈশ্বরের নাম নিয়ে সে কেরানি বাবুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।রবিবার বলে কেরানি বাবু দুপুরবেলা ভাত খেয়ে উঠে রোদে বসে ছিল।রসেশ্বরক দেখার সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ আর বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ দেখা দিল। কিন্তু পরের মুহূর্তে তার জন্য নিয়ে আসা উপহার গুলির দিকে চোখ যেতেই নিমেষের মধ্যে তার মুখের ভাব পরিবর্তিত হল। কিন্তু তথাপি বাইরে কৃত্রিম ক্রোধ দেখিয়ে বলে উঠলেন- ‘কীহে অফিসে করা অপমানে মন ভরল না? এখন বাড়িতে কথা শোনাতে এসেছ নাকি?রসেশ্বর উপহার গুলি কেরানি বাবুর পায়ের কাছে রেখে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করে কাতর কণ্ঠে বললেন-‘ আমি অত্যন্ত মূর্খ মানুষ, না জেনে আপনার কাছে অনেক অপরাধ করেছি। সেটা নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন। এখন আমার পাঁচটি ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করুন’।

কেরানি চিৎকার করে ভেতর থেকে একটি ছেলেকে ডেকে রসেশ্বর আনা উপহার গুলি ভিতরে নিয়ে যাবার ইঙ্গিত করলেন। তারপর রসেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ তোমরা কথা গুলি নিজেও বোঝ না, অন্যেরা বুঝিয়ে দিলেও বুঝতে চাওনা। তোমার মামলার দিন মাঘমাসের আগে পরার কোনো আশা ছিল না। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাকিমের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে কার্তিক মাসে দিনটা ফেললাম। কিন্তু তুমি তার জন্য আমাকে কোথায় ধন্যবাদ দেবে তা না এতগুলো লোকের সামনে আমাকে অপমান করলে। যাক এখন যা হবার হয়ে গেছে, তোমার মামলা যাতে ভালো হয় তার জন্য আমি নিশ্চয় চেষ্টা করব। তবে মামলা বললেই টাকার খেলা বুঝেছ? জলে নামলে যেমন শরীর ভিজবেই মামলা করলেও টাকা খরচ হবে। আমি জানতে পেরেছি সনাতন শর্মা বড় উকিলের ব্যবস্থা করেছে। তুমি একজন উকিলের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আসা-যাওয়ার খরচ নিয়ে উকিলের জন্য কমকরেও আড়াই কুড়ি টাকার ব্যবস্থা করে রাখবে। বেশি বড় উকিলের দিকে নজর দিও না। এই সমস্ত ছোটখাট মামলার জন্য ভোলা শর্মাই যথেষ্ট। আর ভালো দেখে তিনজন সাক্ষী জোগাড় করবে। সেই জমিতে যে তুমি বাপ দাদার আমল থেকে চাষবাস করে আসছে আর কখনও কাউকে আধিতে চাষ করতে দাওনি সেকথা গ্রামের জনাতিনেক মানুষ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে। আগে কখনও মামলা-মোকদ্দমা করনি তাই নাও জানতে পার। সেই জন্য এখনই বলে রাখি সাক্ষী বোধহয় আসা-যাওয়ার খরচ হিসেবে তোমার কাছ থেকে কিছু টাকা দাবি করবে। সেই সমস্ত খরচের জন্য আগে থেকেই তৈরি থাকবে। তুমি এখন যাও। কেউ যদি তোমাকে আমার বাড়িতে দেখে ফেলে তাহলে নানা ধরনের কথা বলবে। আমি তোমার মামলার দিন সবার চেয়ে আগে বের করে দেব। তুমি চিন্তা কর না।’

কেরানি বাবুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় রসেশ্বরের শরীর মন হালকা হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। প্রত্যেকবারই সে ভাবে যে এবার বোধহয় তার সমস্যার কিছু একটা সমাধান হবে। কলিকালের দেবতা স্বরূপ হাকিম, মন্ডল,কেরানির উদ্দেশ্যে এত কাঠ খড় পুড়িয়েছে যে সে ভেবেছিল মনে মনে যা ভেবেছে,যে রকম বিচার চেয়েছে, তা নিশ্চয়ই পাবে। কিন্তু প্রত্যেকবারই সে দেখে যে পুজোর ভাগ পাওয়ার দেবতার সংখ্যা নতুন নতুন করে বের হচ্ছে। মনে মনে সে একটা হিসেব করতে লাগল।- উকিলকে দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা,উকিলের খোঁজে শহরে যাওয়া আসা করলে কমপক্ষে দশ টাকা খরচ হবে, তিনজন সাক্ষীকে জোগাড় করতে হলে প্রতি জনের পাঁচ টাকা করে হলেও পনেরো টাকা। নাই নাই করে হলেও আরও পঁয়ষট্টি টাকার দরকার। সর্বেশ্বর গ্রাম প্রধানের কাছে সোনাকে রেখে পাওয়া ষাট টাকার কুড়ি টাকা খরচ হয়ে গেছে। বাকি থাকল চল্লিশ টাকা। মামলার দিন পড়তে পড়তে বাড়ির এটা ওটা খরচে আরও কত টাকা বেরিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। তার মানে আরও এক সপ্তাহ।দশ দিনের ভেতরে তাকে কমপক্ষে আরও আড়াই কুড়ি টাকা জোগাড় করতেই হবে।…রসেশ্বর অনুভব করে যে এই কথাটা যদি সে আরও কিছু সময় চিন্তা করতে থাকে তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে অথবা মূর্ছিত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়বে। কিছুক্ষণ সে টাকার কথা চিন্তা না করে অন্য কিছু চিন্তায় নিজের মনটাকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করল। সে অতীতের কথা, তার শৈশবের কথা, বাবার কথা মনে করার চেষ্টা করল। হঠাৎ বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। শৈশবে সে কীভাবে সঙ্গীদের সঙ্গে ঝগড়া করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে বাবাকে জড়িয়ে ধরত ঠিক তেমন করেই সেই মুহূর্তে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু পরের মুহূর্তে সেই স্মৃতি এবং কল্পনার জগত থেকে কঠিন বাস্তবের বুকে ফিরে এল। আর নিজের ভীষন নিঃসঙ্গতা এবং অসহায়ত্বের কথা মনে পড়ায় চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল। গলা পর্যন্ত উঠে আসা কান্নাটা সজোরে দমন করে মনটাকে অন্য কিছুর দিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। আজ তার চারপাশে কেবল দুঃখ কিন্তু জীবনে সুখের মুখ সে কি কখনও দেখেছিল? মধুর স্মৃতির সন্ধানে তার মন সমস্ত অতীত জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াল। জীবনে কখনও সুখ পায়নি সেটা নিশ্চয়ই সত্য নয়, মেঘের বুক ভেদ করে সূর্য উঁকি দেওয়ার মতো সুখ এবং আনন্দে রঙ্গিন আলো তার জীবনটাকেও ক্ষণিকের জন্য হলেও আলোকিত করে তুলেছিল।

তার মনে পড়ল বিয়ের প্রথম কয়েকটি বছরের কথা। সেই সময়ে তার সংসার খুবই ছোট ছিল। বছরজুড়ে খেয়ে পড়ার মতো চাষবাস হত। তার যুবতী স্ত্রী ও যৌবনের উদ্যমতা এবং প্রাণ-প্রাচুর্যে তার জীবনে আনন্দের আলোড়ন তুলেছিল। সেই সময়ের প্রতিটি স্মৃতি মনে অত্যন্ত মধুর যেন অনুভব হল। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মধুর স্মৃতি হল ধান রোপনের সময় এবং স্ত্রীর সঙ্গে মাঠে এক সঙ্গে কাটানো সময়টুকু। স্বামীর মন নতুন করে বিয়ে করে আনা নব বধূকে সব সময় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাবে পেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সেই সময়ে রসেশ্বরের মা জীবিত ছিলেন এবং শাশুড়ির উপস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী দিনের বেলায় ঘনিষ্ঠ হওয়া বা প্রেমলাপ করা দূরের কথা চোখের দিকে তাকানোটাও ছিল একটি অপরাধ। কিন্তু ধানের বীজ রোপন করা ওদের মধ্যে এনে দিয়েছিল সুবর্ণ সুযোগ। স্ত্রী এক মুঠো ভাত খেয়ে ধান বোনার জন্য সারাদিনের জন্য মাঠে চলে যায়। রসেশ্বর ঘরের কাজকর্ম করে দুপুরবেলা খাবার খেয়ে উঠে ধানের আঁটি মুঠো বেঁধে আনার জন্য মাঠে যায়। সঙ্গে স্ত্রী। মাঠে খাবার জন্য ঝুলিয়ে নিয়ে যায় কয়েকটি বাতাবি লেবু। ধানের চারা লাগানোর মাঝেমধ্যে একবার উঠে দাঁড়িয়ে স্ত্রী স্বামীর আসার অপেক্ষায় থাকে। সুন্দর একটা গামছা মাথায় বেঁধে বাতাবিলেবু গুলি কাঁধে ঝুলিয়ে মাঠের দিকে আসতে থাকা স্বামীর মূর্তিটা দূর থেকে দেখা মাত্র তাঁর মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। স্বামী আসার সঙ্গে সঙ্গে দুজনে বসে পড়ে আর বাতাবি লেবু খেতে খেতে অনেকক্ষণ ধরে গল্পগুজব করে। কেবল রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে গভীর নীরবতার মধ্যে বিছানায় পাওয়া স্ত্রীকে রসেশ্বর অগ্রহায়ণ মাসের মুক্ত আকাশের নিচে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে আবিষ্কার করে। রোদে জ্বলজ্বল করতে থাকা তার যুবতি মুখটা পাকা ধানের গন্ধে চারপাশ আমোদিত হয়ে উঠা স্ত্রীর দেহটা রসেশ্বরের মনে নতুন মাদকতার সৃষ্টি করে। বেশ কিছু সময় অতীতের সেই সোনালী জগতে রসেশ্বর স্বপ্নাবিষ্ট মানুষের মতো বিচরণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে তার নাক থেকে স্ত্রীর শরীরের গন্ধ নাই হয়ে যায়। কিন্তু তখনও লেগে থাকে পাকা ধানের গন্ধ, ঘাস এবং কাদার গন্ধ, পাখির গন্ধ,অগ্রহায়ণ মাসের বিকেলের রোদের গন্ধ। কৃষকের জীবন একদিন শেষ হয়ে যায় কিন্তু রক্ত জল করে সৃষ্টি করা মাঠের শস্য এনে ঘরের ভাঁড়ার ভরিয়ে তোলার নেশা কোনোদিন শেষ হয়না। চোখের সামনে সোনালী ধানের ছবি নিয়ে রসেশ্বর স্বপ্নাবিষ্ট মানুষের মতো বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। আর কয়েকদিন পরেই ধান বোনার সময় হবে, গ্রামের আকাশ বাতাস পাকা ধানের গন্ধে আমোদিত হয়ে উঠবে। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ধানের আঁটিলি করা ঝর ঝর শব্দ রসেশ্বরের কানে এল, কী মধুর সেই শব্দ, কী মধুর,কী মধুর…

হঠাৎ রসেশ্বরের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

বাড়ির সামনে পৌঁছেই রসেশ্বর শুনতে পেল স্ত্রী ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।ক্ষণিকের জন্য রসেশ্বরের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। পরের মুহূর্তে সে বাড়ির ভেতরের দিকে দৌড়ে গেল।