শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১৬

১৬

মানুষের বিপদ কখনও একা আসে না। ঘরে ঢুকেই রসেশ্বর দেখল ওদের মাখনী নামের তৃতীয় মেয়েটি জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে, আর তার মা মাথায় জল ঢালতে ঢালতে কাঁদছে। ঘরটি সম্পূর্ণ অন্ধকার। পয়সার অভাবে আজ কয়েকদিন ধরে কেরোসিন তেল আনতে পারেনি। বিষে বিষক্ষয়ের মতো মেয়েটির মরণাপন্ন অবস্থা রসেশ্বরের মন থেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সমস্ত ভয় এবং দুশ্চিন্তা দূর করে দিল। মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে সে দেখল জ্বরের তাপে তার সমস্ত শরীর জ্বলছে। আগের দিন থেকেই মাখনের শরীরটা ভালো নেই বলে সারাদিন খ্যানখ্যান করছিল। দুপুরবেলা রসেশ্বর কেরানিবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় মেয়েটি বিছানা থেকে না উঠে শুয়েছিল। তার সর্দি জ্বরের মতো কিছু একটা হয়েছে ভেবে রসেশ্বর খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন মেয়েটির এই শোচনীয় অবস্থা দেখে তার মনে ভীষণ ভয় হল। তার প্রথম চিন্তা হল ঘরটাকে কীভাবে সামান্য আলোকিত করা যায়। ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হয়ে চলা গোধূলির অন্ধকার আসন্ন মৃত্যুর বিভীষিকার মতো তার দেহ অবশ করে তুলতে লাগল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে প্রদীপটা খুঁজে বের করে সে পাশের বাড়ির ডম্বরুদের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল। ডম্বরুদের বাড়িতে অন্যকে দেবার মত কেরোসিন তেল ছিল না। তবুও রসেশ্বরের বিপদের কথা শুনে তাদের ব্যবহৃত একটা জ্বলন্ত প্রদীপ ডম্বরুর মা রসেশ্বরকে দিয়ে দিল। আর তিনিও রসেশ্বরের সঙ্গে মাখনীকে দেখতে এলেন। বুড়ি মাখনীর জ্বরে লাল হয়ে ওঠা মুখটা দেখে মন্তব্য করলেন-‘ তুই এখন কী করবি বলে ভেবেছিস? ডাক্তারের কথা যদি ভেবে থাকিস তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হবে না। ওর তেমন কিছু হয় নি। অশুভ হাওয়া লেগেছে। গতবছর গিরিধরের ছোট ছেলেটির এভাবে অশুভ হাওয়া লেগেছিল। আমাদের কারও কথা না শুনে এক কুড়ি টাকা খরচ করে ডাক্তার নিয়ে এল।ডাক্তার বলল- ‘প্যারাটাইফয়েড হয়েছে’। রাতের বেলা ইনজেকশন দিলেন। ভোরবেলা ছেলেটির মৃত্যু হল। আজকাল মানুষ কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে দৌড়ে যায়। তার ফল ও হাতে হাতে পেল। মাখনীর মা তুই একটা কাজ কর স্নান করে এসে ওই দেবতার উদ্দেশ্যে পুজো দে । কোনো চিন্তা করিস না সকালের দিকে মাখনি ভালো হয়ে যাবে।’ বুড়ি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আর ও কিছু শলা পরামর্শ দিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। ডম্বরুর মা বেরিয়ে যাবার পরে রসেশ্বর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল আমি কিন্তু ডাক্তার আনাটাই ভালো বলে মনে করছি তুই কি বলিস কাকিমা শুধু গিরিধরের ছেলেটির কথা বলেছে কিন্তু ভদ্রেশ্বরের স্ত্রীর কথা বলেনি। গত আষাঢ় মাসে তার যখন অসুখ করেছিল প্রত্যেকেই কোনো অপদেবতা ভর করেছে বলে ডাক্তার আনতে নিষেধ করেছিল। অপদেবতার দোষ খণ্ডানোর জন্য ওরা নয় জন ভকতকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াল পানিরাম বৈদ্য জন্ডিস হয়েছে ভেবে তিনদিন ধরে তাকে শ‍্যাওড়া পাতা দিয়ে ঝা়ঁড়ফুক করল। এসব কিছুতেই কিছু কাজ না হওয়ায় ডাক্তার এসে রোগিকে ছয়টি ইনজেকশন দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রোগি ভালো হয়ে গেল। ডাক্তারের মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা আমি নিজের চোখে দেখেছি। ভাগ্য ভালো যে এই বিপদের সময় আমার হাতে কুড়িটা টাকা আছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারকে নিয়ে আসছি।

রসেশ্বরের স্ত্রী বলল-‘ দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি এত ছটফট কর না তো। ডাক্তার অন্য সমস্ত কিছু ভালো করতে পারলেও অপদেবতায় পাওয়া রোগিকে কখন ও ভালো করতে পারে না। তুমি কিছুক্ষণ মেয়েটির কাছে বস আমি স্নান করে এসে দেবতাদের উদ্দেশ্যে পুজোর আয়োজন করছি। রসেশ্বরকে আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে কুয়োর পাড়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। রসেশ্বর মেয়ের মাথায় জল ঢালতে ঢালতে ওমা মাখনী একটু জল খাবে? কথা বল, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করতে লাগল। রসেশ্বরের কথার উত্তরে মাখনী সামান্য চেতনা লাভ করে পুনরায় নানা রকম প্রলাপ বকতে লাগল। মেয়ের অবস্থা দেখে রসেশ্বরের পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কাতর স্বরে ভগবানের নাম জপ করতে লাগল। ইতিমধ্যে স্ত্রী স্নান করে এসে দেবতাদের উদ্দেশ্যে পুজো দিয়ে ভোগের ব্যবস্থা করল।

বাড়িতে এহেন বিপদ দেখে বাকি ছেলেমেয়েরা এতক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় চুপ করে শুয়ে ছিল একটু সুযোগ পেয়ে ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল মা আজ ভাত রাঁধবি না রসেশ্বরের স্ত্রী এতক্ষন ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিল।

ওদের কথা শুনে সে বলল,আজ আর কোথায় ভাত রাঁধব পোনা, দুপুরের রান্না করা ভাত মাখনীও খায়নি, আমিও খাইনি। সেগুলি তোরা সবাই ভাগ করে খেয়ে নে।

ভাত খাবার আশা একেবারে বাদ দিয়েছিল এখন দুপুরে ভাত খাওয়ার কথা শুনে ওরা হতাশ হওয়া তো দূরের কথা আনন্দে প্রত্যেকেই লাফ মেরে উঠল। বিছানা থেকে ওঠে পোনা নামে সাত বছরের ছেলেটি বলল আমাদের কিছুক্ষণের জন্য প্রদীপটা দাও ওরা প্রদীপটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। শোবার ঘর অন্ধকার হয়ে পড়ল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে মাখনীর কাতর গোঙ্গানি রসেশ্বর এবং স্ত্রীর অন্তরে হাজার শেলের মতো বিঁধতে লাগল। গভীর নীরবতার মধ্যে মাখনীর বুকের ধপ ধপ শব্দটাও ওদের কানে পরল কিন্তু ওদের মনে হল ওটা যেন মাখনীর বুকের শব্দ নয়- ধীর কিন্তু নিশ্চিত গতিতে একপা একপা করে এগিয়ে আসা মৃত্যুর পায়ের শব্দ- ভয়ে ওদের শরীর হিম হয়ে যাবার উপক্রম হল।

ভয়াবহ নীরবতাটুকু দূর করার জন্য রসেশ্বরের স্ত্রী এবার বলে উঠল- ‘গতকাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটির পেটে কিছুই পড়েনি। রসেশ্বর যান্ত্রিকভাবে প্রশ্ন করল-‘কেন, আজ দুপুরবেলা ও ভাত খায়নি?’

স্ত্রী রাগের সঙ্গে উত্তর দিল-‘ তুমিও বেশ ভালো মানুষ। কী বললাম শোনোনি? কাল রাতে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে না বলে সেই যে বিকেলে বিছানা নিল আজ তো তুমি নিজেই দেখতে পেলে তুমি দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবার সময় ও বিছানায় পরে ছিল। আমরা কেউ লক্ষ্য করিনি যে ওর তখন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল। তুমি চলে যাবার পরে আমি ঘরের সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে ওকে ভাত খাবার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি মেয়েটি তখন জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ভাত খাবার মতো ও সময় পেল কখন?’

‘হে হরি’- রসেশ্বর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। এই ছোট্ট মেয়েটি কাল রাত থেকে আজ রাত পর্যন্ত কিছুই মুখে দেয় নি। অন্য কিছু হোক বা না হোক ক্ষুধা আর জ্বর তাকে বেশি করে কাবু করে ফেলেছে। জোর করে ওকে কিছু না খাওয়ালে কীভাবে চলবে?’ ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে ছেলে মেয়েদের ঝগড়া এবং কান্নার শব্দ ভেসে এল। দুজন মানুষের ভাত ওদের পাঁচ জন ছেলে-মেয়েকে ভাগ করে খেতে হচ্ছে। তরকারির নামে আছে কেবল জল এবং নুন দিয়ে সিদ্ধ করা একমুঠো ঢেঁকি শাক। তারই ভাগাভাগি নিয়ে ওদের মধ্যে মারপিট আরম্ভ হয়ে গেছে। মইনি নামের ছোট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠছে-‘মা, ওমা পোনা সমস্ত তরকারিটা খেয়ে ফেলেছে। আমাকে একটুও দেয়নি।’

রসেশ্বরের স্ত্রী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ পরে সে বলল অসুস্থ মেয়ের মুখে দেবার মতো আমার রক্ত ছাড়া ঘরে আর কোনো জিনিস আছে কি? ছেলে মেয়েরা কুকুরের মতো টানাহেঁচড়া কামড়াকামড়ি করে ভাতটুকু খেয়ে শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে ওরা ঘুমিয়ে পড়ল। এবং রসেশ্বর এবং স্ত্রী অসুস্থ মেয়ের কাছে বসে বসে পাহারা দিতে লাগল। কেরোসিন তেলের প্রদীপ কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে হঠাৎ করে নিভে গেল। ঘরের ভেতরে যত অন্ধকার মনের ভেতরে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি অন্ধকার নিয়ে রসেশ্বর আর স্ত্রী ভোর হওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল।