শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১৮

১৮

পূর্বপুরুষের পিণ্ডদানের চাল এবং বামুনকে দান-দক্ষিণার জোগাড় করতে গিয়ে পকেট থেকে দেড় কুড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। বাকি দশ টাকা ছিল,বাড়ির চাল, সরষের তেল কিনতে গিয়ে আরও অর্ধেক বেরিয়ে গেল।রসেশ্বর পুনরায় কপর্দকহীন হল। এদিকে মাখনীর জ্বর কমাতো দূরের কথা দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল। রোগীর পথ্যের নামে ভাতের মাড় এবং মাঝে মধ্যে কেবল জল মেশানো দুধ। সেটাও মাখনী খেতে চায় না। তিন দিনের মাথায় মাখনীর অবস্থা দেখে রসেশ্বর বুঝতে পারল যে মেয়েটির বাঁচার আর আশা নেই। রসেশ্বরের স্ত্রীও হয়তো সে কথা বুঝতে পেরেছিল। রোগী মেয়ের কাছে পাথরের মূর্তির মতো বসে সে স্থির অপলক দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। রসেশ্বর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল-‘মেয়ের মুখের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলেই কি সে সুস্থ হয়ে উঠবে? একবার ডাক্তার দেখাব নাকি?’ স্ত্রী কোনো উত্তর দিল না।রসেশ্বর ডাক্তার আনার কথা বলছে কিন্তু ডাক্তার আনার জন্য তার হাতে একটি পয়সাও নেই। কিছু একটা মনে মনে ভেবে জীবনে যে কাজটি করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঠিক সেই কাজটাই করবে বলে সেই মুহূর্তেই ঠিক করল। হালের গরু জোড়ার একটা গরু মাত্র ছয় কুড়ি টাকায় সে গ্রামের ভদ্রকান্তকে বিক্রি করে দিল। ভদ্রকান্তের বাড়িতে গরুটা রেখে বাড়িতে ফিরে আসার সময় হঠাৎ অনুভব করল যে একটা বিরাট ভূমিকম্পে পৃথিবীটা টলমল করে কাঁপতে শুরু করেছে। তার চোখের সামনে আকাশটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো। স্থির হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে এবার মাটিতে হুমরি খেয়ে পড়ল। চারপাশে পৃথিবীটা ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো একটা ভীষণ গর্জন সে তার কানের পাশে শুনতে পেল।মাটিতে মুখ গুঁজে চোখ বুজে পড়ে চোখ থাকার সময় রসেশ্বরের মনে হল এটাই বোধহয় মহাপ্রলয়। পৃথিবীর শেষ দিন নিশ্চয় উপস্থিত হয়েছে। সে মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করল।এই মুহূর্তে যদি পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায়, ভূমিকম্পে ফেটে ছিন্নভিন্ন হওয়া বসুমতি যদি তাকে নিজের বুকে টেনে নেয়, তাহলে তার চেয়ে সুখের কথা নিশ্চয় আর কিছু হতে পারে না। নিজের জীবন্ত সমাধির জন্য সে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু এক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর কম্পন বন্ধ হয়ে গেল। কান স্তব্ধ হয়ে যাওয়া গর্জন গুলিও স্বাভাবিক হয়ে এল। রসেশ্বর মাটি থেকে মুখ তুলেতাকিয়ে দেখল পৃথিবীটা সম্পূর্ণ একই রয়েছে। সে পুরোপুরি বেঁচে আছে। সে উঠে দাড়িয়ে পুনরায় বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ঘরে ঢুকেস্নান করে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। ডাক্তারের বাড়ি তার বাড়ি থেকে ছয় মাইল দূরে।ডাক্তারখানায় গিয়েও শান্তি পেল না।ডাক্তার নাকি তিন মাস আগেই বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে। কার্যালয়ে নতুন কোনো ডাক্তার আসেনি। রসেশ্বর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। নিশ্চিত মৃত্যুর ক্ষণ গুনতে থাকা মেয়েটির কাছে এখন খালি হাতে সে কীভাবে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হয়ে রসেশ্বর কম্পাউণ্ডারকেইঅনুরোধ করল তাকে একবার গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে হবে।কম্পাউণ্ডারের সঙ্গে দরদাম হল। তাকে ১৫ টাকা দিতে হবে। আর ইনজেকশনের দাম হিসেবে আলাদা ভাবে পাঁচ টাকা। হালের গরু বিক্রি করে পাওয়া টাকা নিয়ে রসেশ্বর নিজেকে লাখপতি বলে মনে করছিল।বিনা বাক্য ব্যয়ে সে কম্পাউণ্ডারের কথায় রাজি হয়ে গেল। কম্পাউণ্ডার মাখনীকে কী ইনজেকশন দিল তা কম্পাউণ্ডার আর ভগবানই জানেন। কিন্তু সেদিনপ্রায় মধ্যরাতে মাখনীর সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণার অবসান হল। মৃত্যুর কোলে সে চিরশান্তি লাভ করল।