শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১১

(এগারো)

আঘাতের প্রথম যন্ত্রণাটুকু কাটিয়ে ওঠার পরই রসেশ্বরের স্ত্রী কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করল। মাত্র পঁচিশ টাকার জন্য যদি মানুষটা আত্মঘাতী হতে চলেছে এবং সঙ্গে পরিবারের সবাইকে কেটে শেষ করবে বলে ঠিক করেছে তাহলে আজ দিনটার জন্য সেই পঁচিশ টাকার মূল্য নিশ্চয়ই পঁচিশ কোটি টাকার সমান, তার ওপরই নির্ভর করছে একটি পরিবারের জীবন। আর একথাও ঠিক যে পঁচিশ টাকা তাকে একাই জোগাড় করতে হবে, স্বামী জোগাড় করতে পারলে সকালের ব্রাহ্ম মুহূর্তে তিনি মুখে এই ধরনের কথা উচ্চারণ করতেন না। পঁচিশ টাকার সন্ধানে সে মনে মনে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে বেড়াতে লাগল। বিক্রি করার মতো বাড়িতে এমন কোনো জিনিস নেই যার বিনিময়ে সে পঁচিশ টাকা পেতে পারে।বাড়িতে যদিও বা একটা এন্ডির কাপড় ছিল সেটাও কবেই স্বামী নিয়ে মন্ডল কে উপহার দিয়েছেন। গাভীটাও কবেই বিক্রি হয়ে গেছে। দা দিয়ে কাটতে আসা মানুষের সামনে দৌড়ে পালানোর জন্য চেষ্টা করা মানুষকে যেমন সম্ভবপর সমস্ত আশ্রয়ের কথা চোখের পলকে চিন্তা করতে হয় তেমনই সেও চিন্তা করে থাকার সময় হঠাৎ তার মনে পড়ল যে গ্রামের সর্বেশ্বর গ্রামপ্রধানের ঘরে বা কালিনাথ মৌজাদারের ঘরে প্রায়ই রাখাল ছেলে বা ঘরের ছোটখাট কাজ করার জন্য ছেলের দরকার হয়। সোনাকে যদি সে কোনো একটি বাড়িতে চাকর হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে পারে তাহলে অগ্রিম হিসেবে পঁচিশ টাকা পাওয়া অসম্ভব হবে না। এতক্ষণ ধরে তার মন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার মত অবকাশ পেল। খুব স্পষ্টভাবে নয়- ক্লান্ত মানুষ পা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে হাঁটার মতো সে ও অবসন্ন মনে এই চিন্তাকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পরের বাড়ির চাকর রূপে সোনার রূপটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। গরিবের ঘরের ছেলে যদিও বড় ছেলে হিসেবে তারা সোনাকে পরম আদরের মধ্য দিয়ে বড় করেছে। ওদের জীবনের সমস্ত স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। অন্যের চোখে সে লাঙ্গল ধরতে পারার মতো লায়েক হয়েছে যদিও তার চোখে সে এখনও শিশু হয়েই রয়েছে। রাতে ঘুমের মধ্যে এখনও ভাই-বোনদের দূরে ঠেলে দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমোনোর আশা রাখে। তাছাড়া পড়াশোনার প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ। তার ছোট্ট প্রাণটি হয়তো স্বপ্ন দেখে যে পারলে কিছুটা পড়াশোনা করে অন্তত বাবার জীবনটা একটু ভালো এবং অন্য রকম করতে চেষ্টা করবে। সেই ছেলেকে সে কোন সাহসে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে লোকের বাড়িতে চাকর রাখবে? লোকের বাড়িতে সে অষ্টপ্রহর গালিগালাজ খাবে,এঁটো খাওয়ার দৃশ্য তার চোখের সামনে কীভাবে দেখতে পারবে? কথাগুলো ভেবে ভেবে নিজের অজান্তেই তার দুই চোখ ফেটে জলের ধারা বইতে লাগল। চোখের জল মোছার সে কোনো চেষ্টাই করল না। কিন্তু সে অবশেষে ঠিক করল যে সোনাকে পরের বাড়িতে চাকর রেখে পঁচিশ টাকা যোগাড় করার চেয়ে পুরো পরিবারটা আত্মঘাতী হওয়া বেশি ভালো।

কিন্তু আত্মঘাতী হওয়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা নিশ্চয়ই করে দেখতে হবে। সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে একটি আলোর বিন্দুর খোঁজে সে ব্যাকুলভাবে চারপাশে দেখতে লাগল। সারারাত স্বামী অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করে ছটফট করছিল,ওদের বাঁশের মাচার বিছানাটা রসেশ্বরের ছটফটানিতে সারারাত শব্দ করছিল। কিন্তু এখন সে মরা মানুষের মতো নিথর হয়ে পড়েছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সমস্যা স্ত্রীর কাঁধে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে জেগে উঠবে। এবং উঠেই এসে প্রথম প্রশ্ন করবেঃটাকা পঁচিশটা জোগাড়ের কোনো ব্যবস্থা হয়েছে কি? সে যদি হয়নি বলে উত্তর দেয় তাহলে আজ তার সর্বনাশ। স্বামী তাকে মেরে আজ আধমরা করে ফেলবে। দীর্ঘকাল ধরে রসেশ্বরের সঙ্গে ঘর করে সে সাতটি ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়েছে। স্বামী কোন অবস্থায় কীভাবে আচরণ করবে সে কথাটা আগেই বলে দিতে পারে। রসেশ্বর যখনই কোনো একটি সমস্যার সমাধান করতে পারে না বা সংসারের যুদ্ধে তাঁর হেরে যাবার মতো অবস্থা হয়, তখনই সে কিছু একটা অজুহাত বের করে স্ত্রীকে মারধর করে, সংসারের উপরে সমস্ত আক্রোশ সে স্ত্রীর উপরে মেটায়। স্ত্রীকে ভালোবাসে না, তাকে দেখতে পারে না তা কিন্তু নয়। রসেশ্বর কোনোদিন মুখ ফুটে না বললেও স্ত্রী তার প্রতিটি রক্তকণায় অনুভব করে যে সেই রসেশ্বরের জীবনের সর্বস্ব। একটি শিশু যেমন মায়ের উপর নির্ভরশীল,রসেশ্বরও তেমনই স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। গ্রামের মহিলারা বলে-‘আমার ছেলে দুষ্টু, আমাকে কাটে আমাকে মারে, আমাকে করে তুষ্ট। রসেশ্বরের স্ত্রী ও স্বামীর বিষয়ে সেই একই কথা বলতে পারে। সাত ছেলে-মেয়ের মা হওয়ার সময় থেকে (ওদের বিয়ের কত বছর হল সে বলতে পারে না, সেই সমস্ত নামতার হিসেব সে বুঝতে পারে না) সেই একটা কথা লক্ষ্য করেছে যে যেদিন সে দিনের বেলা স্ত্রীকে বেশি মারপিট করে সেদিন রাতে সে বিছানায় নিজের জায়গা ছেড়ে স্ত্রীর শরীরের কাছে আশ্রয় নেয়। আর মুখে প্রকাশ করতে না পারা অনুতাপ, ক্ষমা প্রার্থনা, এবং প্রেম সমস্ত শরীরের ভাষা দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। সে সমস্ত কিছুই বুঝতে পারে কিন্তু তা বলে কি সে খড়ি দিয়ে পেটানো যন্ত্রণার কথা অস্বীকার করতে পারে? রাগ উঠলে মানুষটা এতটা পাগল হয়ে যায় যে সে মানুষকে মারছে না জন্তু জানোয়ারকে মারছে সে কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়। আজ তো মানুষটা সম্পূর্ণ একটা অন্য মূর্তি ধারণ করেছে। পঁচিশ টাকা যোগাড় করতে না পারলে তিনি নাকি আত্মঘাতী হবেন, স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদেরও কেটে শেষ করে রেখে যাবেন। নিজেকে বা অন্যকে কিছু করুক বা না করুক তাকে যে আজ এমনিতে ছেড়ে দেবে না সে কথা ঠিক। সংসারের বিরুদ্ধে সমস্ত আক্রোশ এবং অভিযোগের সে প্রতিশোধ নেবে স্ত্রীর ওপরে।

বিছানা থেকে উঠে যাবার আগেই তাকে একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। উঠে গিয়ে সংসারের কাজে একবার ঢুকে গেলে সে আর চিন্তা করার সময় পাবে না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার আরেকটি সমাধানের কথা মনে পড়ল। প্রশ্নটি যখন জীবন মরণের প্রশ্ন, তখন ওদের বাড়িটাকে কারও কাছে বন্ধক রাখলে কেমন হয়? ভিটেটা বন্ধকে রাখলে কম করেও নিশ্চয় ১০০ টাকা পাওয়া যাবে। ওদের মামলা পঁচিশ টাকাতেই নিশ্চয় নিষ্পত্তি হবে না। আজ অন্য কোনো উপায়ে পঁচিশ টাকা জোগাড় করতে পারলেও আরও এক সপ্তাহ বা একমাস পরে নিশ্চয় আরও টাকার প্রয়োজন হবে। তখন কোথা থেকে টাকা আসবে? বাড়িটাকে বন্ধকে রাখার কথা কিছু সময় চিন্তা করে তার পরিণাম গুলি সে ভাবতে লাগল। মামলায় যদি তারা জিতে যায় তাহলে ছয়মাস বা এক বছরের মধ্যে কিছু একটা উপায় করে বাড়িটা বন্ধক থেকে খালাস করে আনতে পারবে। কিন্তু মামলায় যদি তারা হেরে যায় তখন গোটা পরিবারটাই গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। এখন আর কিছু না হলেও ছেলে মেয়েদের মাথার উপরে ঘরের ছাদ রয়েছে কিন্তু ভিটেটা বন্ধকে রাখলে ছেলে মেয়েদের মুক্ত আকাশের নিচে জন্তু জানোয়ারের মত রেখে যেতে হবে। দৃশ্যটা কল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে আবার তার চোখ ফেটে জলের ধারা নেমে এল। এবার কাপড়ের আঁচলে চোখের জল মুছে সে পাশ ফিরে নতুন একটি উপায়ের কথা চিন্তা করতে লাগল।

তার শেষ উপায় এখনও যে নেই তা নয়। কিন্তু এতক্ষণ সেই উপায়টা তার মনের নিচে জোর করে চাপা দিয়ে রেখেছিল। তার সেই শেষ উপায় বা শেষ অবলম্বনটা হল তাকে বিয়ের সময় দেওয়া একটি কানপাশা। তার দুঃখী মা বাবা বিয়ের সময় আরও যে দুই এক পদ অলংকার দিয়েছিল সেই সব কবেই বিক্রি করে এবং বন্ধকে দিয়ে শেষ হয়েছে। মাত্র এই কানপাশা জোড়া বাক্সের একেবারে নিচে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে না খেয়ে মরতে হলেও সে এই দুটি কখনও বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না। সে যে একদিন যুবতি ছিল, সে যে একদিন হোমের পাশে কন্যা হয়ে বসে ছিল, তার চোখে ছিল ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন, সেই সমস্ত কিছুর একমাত্র শেষ স্মৃতি হল এই কানপাশা জোড়া। তা শুধুমাত্র সোনা নয়,তা তার জীবনের সবচেয়ে মধুর কয়েকটি সোনালী মুহূর্ত। পঁচিশটা টাকা জোগাড় করার উপায় খুঁজে এতক্ষণ ধরে ত্রিভুবন তল্লাশ করে বেড়ালেও ইচ্ছা করেই সে কানপাশা জোড়ার কথা ভুলেছিল বা ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অবশেষে সে হার মানল। অবশেষে সে বুঝতে পারল যে তার জীবনের সবচেয়ে মধুর এবং সবচেয়ে পবিত্র জিনিসটা নিজের করে রাখার মতো তার কোনো শক্তি নেই, কোনো অধিকার নেই।

নিজের শরীরটাকে অন্য কারও শব দেহের মতো ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে সে বিছানা থেকে উঠে গেল।


ক্রমশ ...