আজ ১২ এপ্রিল কবি সুধীর দত্তের জন্মদিন। অন্যদেশের পাঠকদের জন্য রইল কবির কবিতা ও একটি সাক্ষাৎকার। কবি সুধীর দত্তকে অন্যদেশ পরিবার জানায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।
স্বগতোক্তি ও একটি বিলাপ
(উৎসর্গ : সূফী তাপসী রাবেয়া বসরী)
৫.
প্রণাম হে বাক
জলদ আপনার চরণ। অনুর্বর এই ভূমি।
শস্যবতী হোক চারদিকের বালুকণা।
তাঁর অপর নাম ভালোবাসা।
কোথাও মধু ও দুধের সরোবর নেই।
নেই শত বসন্তের উদ্যান আর নীলচক্ষু হুরিদের পীনোন্নত স্তন।
আমি জানি সেই সব প্রস্রবনের কথা
যা তিনি গোপন রেখেছেন মানুষের কাছে।
আমাকে কিছু জল ও আগুন দাও।
আমি নিভিয়ে দেবো নিরন্তর জ্বলতে থাকা
দোজখের আগুন,
আর পুড়িয়ে দেবো স্বর্গের বাগান।
ভয় ভালোবাসাকে হত্যা করে।
পারিতোষিকের জন্য
ক্ষুধার্ত চোখের সামনে বেহস্তের কোন দরজাই খোলা থাকে না।
হে মানবপুত্রগণ
নিরন্তর যুদ্ধ ঘোষণা করো নিজেদের বিরুদ্ধে।
আল্লাহ্ জিহাদিদের ভালোবাসেন।
হ্লাদিনী
আমি তো এখনও জেগে শত শরতের পর
পিতামহ যখন গেলেন।
বার বার কায়ব্যূহ রচনা করেছি;
কল্প যায়, চতুর্যগ, সহস্র অগনন।
ইতিহাস কতটুকু জানে?
বড়জোর ইনকা মায়া ব্যবিলন মেসোপটেমিয়া।
জানে লুপ্ত অবশেষ
চাঁচর বালির চড়া, সিন্ধু অববাহিকার নীচে ---
এবার গুটিয়ে নেব যেভাবে ছেড়েছি দীর্ঘ সুতো,
যেভাবে বিতত ব্রহ্মপথ।
পিছনে তাকিয়ে দেখি ছায়া
আদিগন্ত আশ্চর্য আহ্লাদী এক মায়া।
তারস্বরে বলে উঠলে, না---
'না'এক অতল শূন্য,
কে জানত নির্বাণ হেন চতুষ্কোটি-বিনির্মুক্ত হাঁ।
তুমি এলে বস্তু পায় ভর।
আর যাওয়া হল না, তাই
এক পাদে হেঁটে যাচ্ছি কিন্ডারগার্টেন।
শুরু হবে শিশুকাল,বলাকার মতো
তোমার ডানার ওম, মায়া কাচে
কবিতার বস্তু ও বিভ্রম
ইহকাল পরকালও নেই
নির্বাসনে যেতে হবে, দণ্ড হাতে তোমার ভ্রূকুটি
কে উপক্ষা করতে পারে ? কবি ছাড়া
প্রতিস্পর্দ্ধী আর কোন ঈশ্বর
তোমাকে অখণ্ড ভেঙে গড়বে ফের? উক্তি ও উপমা ---
খোলে না ভিতর-সিঁড়ি, হিরণ্ময় পাত্রে তার মুখ
ঢেকে রাখে, বাইরে হা হা রব, আয়ুষ্কাল
বয়ে যায়, বৃক্ষ ইব স্তব্ধ সেই দিবি
আরো দূর, আরো দূর, সরে যেতে যেতে
কবিকে বিমূঢ করে
মধ্যমায়, চকিতে উদ্ভাসে, যেন তার
নির্মাণ ব্যতীত কোন ইহকাল, পরকালও নেই।
সুধীর দত্তের একটি সাক্ষাৎকার
বাংলা কবিতার এক ব্যতিক্রমী স্বর কবি সুধীর দত্তের জন্ম ১৯৫১ সালে। অন্য ধারার পাঠকের স্বীকৃতি ও সমাদর পেয়েছে তাঁর একাধিক বই। ছক-ভাঙা এই কবিকে এবার কুর্ণিশ জানানো হয়েছে আনন্দ পুরস্কার সম্মানে। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অরুণাভ রাহারায়
প্রঃ যে ধরনের কবিতা পড়তে সাধারণ পাঠক পছন্দ করেন আপনি সেই ধরণের কবিতা লেখেন না। আপনার চলার পথ আলাদা।
উঃ আমি কিন্তু ‘পথ’ বেছে নিয়ে লিখতে আসিনি। ছোটবেলায় কবিতা পড়তাম। কবিতার একটা পরম্পরাজ্ঞান আমার বধের মধ্যে ছিল। আমার ধারণা এই ঐতিহ্য ও ইতিহাসবোধের মধ্যে দাঁড়িয়েই আমার কবিতা নিজস্ব ভাষামুদ্রা তৈরি করে নেয়। আমার আত্মার স্পন্দনই আমার কবিতা।আমি যে জীবনযাপন কবি বা যে ভাবনাবৃত্তে থাকি আমার কবিতাকে তারই উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করি। তাতে যদি আমার কবিতা স্বতন্ত্র হয় তো স্বতন্ত্র, নাহলে নয়।
প্রঃ আপনি লেখালিখি শুরু করেছিলেন ৭০ দশকে। কিন্তু আপনার প্রথম বই ‘ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। এতদিন পর বই প্রকাশের কারণ কী?
উঃ কারণ, আমি বহুপ্রসূ নই। প্রথমপর্বে যে কবিতাগুলো লিখেছিলাম, তাকে অগ্রজরা মান্যতা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হত, কবিতাগুলো মুদ্রণযোগ্য হলেও, ওগুলো ঠিক গ্রন্থনযোগ্য নয়। সেখানে একটা আবেগের প্রাবল্য ছিল। আর এই প্রবণতা যতক্ষণ না প্রজ্ঞাশাসিত হচ্ছে, ততক্ষণ এর মধ্যে তারল্য থেকেই যাবে। আর কবিতার ক্ষত্রে আমি চিরকাল তারল্য বিরধী। পরে আমার মনে হয়েছে, এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে একটু শাসন করা দরকার। সেই সময়ের অনেক লেখাই রিরাইট করি। তাই আমার ‘কবিতা সংগ্রহে’ সংকলিত হওয়ার সময় ‘ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া’ বইয়ের অনেক কবিতাই পাল্টে পাল্টে যায়।
প্রঃ আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই আমিকেন্দ্রিক…
উঃ দ্যাখো, কবিতা হল কবির আত্মখননের ইতিহাস, আত্মবিকাশের ইতিহাস। খনন যে হচ্ছে, টা তো শুধু ভাটিক্যাল নয়, তা হরাইজেন্টালও বটে। তাই পঞ্চাশের দশকের কবিদের কবিতায় যে আত্মজৈবনিকতা, এটা কিন্তু সেইরকম ‘আমি’ নয়। এই আমিটা সমষ্টি আমি-র দিকে ধাবিত। সেখানে পুরাণ প্রসঙ্গও এসেছে।পুরাণ হচ্ছে একটা সমবেত স্মৃতির উত্তরাধিকার। একটা সাময়িক নির্জ্ঞানের সঙ্গে বক্তি যুক্ত হলেই আত্মজৈবনিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তখন সেই আমিটি একটা বিরাট আমি-র অংশ হয়ে ওঠে। এবং আমার কবিতার ধাবনটা সেই দিকেই।
প্রঃ তারপর আবার দীর্ঘদিন বাদে, ১৯৯৪-এ বেরোয় আপনার দ্বিতীয় বই…
কবির ভাববিশ্বে বিচিত্র আসে।অভিজ্ঞতার বিস্তার হয়। নতুন মড়কে ধরবার জন্য ভাষা বাঁক নিতে থাকে বিভিন্ন সময়। ‘ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া’র সঙ্গে ‘আরশি টাওয়ার’এর কবিতাগুলোর কোনও মিল নেই। সেটাই তো হওয়া উচিৎ। নদী যেমন আপন খেয়ালে বয়ে চলে, আমার কবিতাজীবনও সেভাবেই নিজস্ব বাঁক খুঁজে নিয়েছে।
আরেকটা কথা, আমি দীর্ঘদিন বাঁকুড়ায় বসবাস করেছি। সেখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্টেট ছিলাম। বাঁকুড়ার মাটির যে রুক্ষ-লাবণ্য— তা অজান্তেই আমার কবিতায় ঢুকে পড়েছে হয়তোবা।
প্রঃ আপনি তো ‘সংবেদ’ পত্রিকার সম্পাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময়কার কটা কিছু বলুন
উঃ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘সংবেদ’ প্রকাশ করতাম। প্রধান সম্পাদক ছিলেন শরৎ সুনীল নন্দী। সহ-সম্পাদক ছিলাম আমি আর রামচন্দ্র প্রামাণিক। অনেকে সেই কাগজে লিখতেন। ‘কবি ও কবিতা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গীতা চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত লিখতেন। সাহিত্যগুণে ‘সংবেদ’ এতই উচ্চতা ছিল যে, কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতার ট্যাক্সট বুক’।প্রথম জীবনে আমার সিংহভাগ লেখাই সংবেদে প্রকাশিত হয়।
প্রঃ ‘তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’ বইটির জন্য আপনি এবছর আনন্দ পুরস্কার পাচ্ছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
উঃ এই প্রাপ্তিটা শুধু আমার নয়, আমি মনে করছি, এই পুরস্কার সমস্ত সৎ, সাহসী এবং আপসহীন কবিতা সাধকের। আমরা যারা কলরোল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে কবিতাকে পুজো হিসেবে গ্রহণ করেছি— এটা তাঁদেরই জয় বলতে পারো। আমি শুধু প্রতিনিধি হয়ে এই পুরস্কার গ্রহণ করবো।