বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

শাড়িকথন

সংগীতা দাশগুপ্ত রায় , সুলেখিকা, গল্পকার ।

5f8bdc08d919c.jpg

লিনেন বেনারসি


দেশ থেকে বহু দূরে বসে মেরিল স্ট্রীপের আউট অফ অ্যাফ্রিকা দেখছিলাম।
মেরিল আফ্রিকার এক প্রান্তিক স্টেশনে ট্রেন থেকে নামছেন, আফ্রিকান আদিবাসী ফারা আদেন, গৃহভৃত্য তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করছে তখনই মেরিলের পিছন দিয়ে হেঁটে যায় দুটি মহিলা, নীল শাড়ি পরনে। আমার চোখ তখনও মেরিলের ওপর। তাঁর স্বামী আসেনি নিতে, পাঠিয়ে দিয়েছে আদিবাসী আফ্রিকান চাকরটিকে। হতভম্ব এবং আশাহত মেরিল পায়ে পায়ে স্টেশন থেকে বেরোবেন এবং আবারও তাঁর ঠিক সামনেই এক মহিলা, কালচে মেরুন ছাপা শাড়িটি পরে গায়ে আঁচল টানা, হেঁটে বেরিয়ে গেল। ভুল দেখলাম কি? তখুনি পজ্‌ করি , আবার পিছিয়ে যাই, আবারো দেখি। না তো! ঠিকই দেখেছি।
১৯১৩ সালের পটভূমিকায় ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকার এক রেলওয়ে স্টেশনে শাড়ি পরা তিনজন মেয়েকে দেখে কেমন অবাক লাগে। দু তিনবার ফিরে ফিরে দেখার পরে মনে হয় শেষের জনের শাড়িটি ভারি চেনা যেন। আসলে কিচ্ছু চেনা নয়। অমন মনে হয়। শাড়ি মানেই নিজের ঘর, শাড়ি মানেই মা, শাড়ি মানেই যেন জড়িয়ে রাখা আষ্টেপৃষ্ঠে।

5f8bdbc967c3d.jpg

কাঞ্জিভরম


“জেঠামশাই, একটা আলতারঙা পাড়ের ধনেখালি শাড়ি রাখবেন আমার জন্য। মাইনে হলে নিয়ে যাব” বলে যেত ছোটমাষ্টারমামু।
আমার দাদুর দোকানখানি ছিল আমাদের বারবাড়ির বৈঠকখানায়। তিন দেওয়াল ঘিরে আমকাঠের তাক, তাতে গোছা গোছা আটপৌরে তাঁত, ছাপা শাড়ি, আর কিছু ধুতি চাদর ফতুয়া, ছোটদের ফ্রক। দাদু রেলের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গ্রামে ফিরে এই দোকানটি করেছিলেন। মূলধন ছিল পেনসনের টাকাকটা আর মূলমন্ত্র ছিল নিজের গাঁয়ের মানুষকে কম দামে ভাল আর টেকসই জামাকাপড় পরানো।

5f8bdc6ab67f7.jpg

মাহেশ্বরী

ছোটমাষ্টারমামুর মাকে কেমন দেখতে আমরা জানতাম না, কিন্তু দাদুর পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জন্য শাড়ি দেখতাম, বাছতাম। আমার মনে হত ভারি শরীরে গোলগাল একজন দিদু এই শাড়িখানা পরবেন

অষ্টমীতে । সকালে উঠে স্নান করে ভিজে চুল এলিয়ে শাড়িখানা পরে মামুকে জিজ্ঞেস করবেন “দেখ দেখি, তোর দেওয়া শাড়ি খানা পরলাম। কেমন দেখাচ্ছে?”

মামু বলত, এইটা, এই যে ফুল আর পাতার নকশা, এটা ভাল লাগবে বেশি, না ঐ কল্কাটা?

দাদু বলতেন তোমার যা পছন্দ সেটাই জানবে বেশি মানাবে।
মামু চার পাঁচটি শাড়ির মধ্যে একটি তুলে নিত। আর নিত একটা নরম ছাপা।

মা হয়ত তখন ভিতর থেকে দাদুর চা নিয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। মাষ্টারমামু হেসে বলত “কবে এলে দিদি? কতদিন থাকবে?”

দুচার কথার পর মামু দুখানা শাড়ি কিনে উঠে যেত। আমি দাদুর হাতে হাতে বাকি শাড়ি তুলে রাখতাম সেই আমকাঠের দেওয়াল জোড়া তাকগুলিতে।
মাষ্টারমামু আমাদের গ্রামের স্কুলের মাষ্টার। গ্রামেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। খালি স্কুলের লম্বা ছুটিতেই তাঁর বাড়ি যাওয়া। সে গল্প আমি দাদুর তক্তাপোষের শীতলপাটিতে শুয়ে শুয়ে শুনতাম। হাবড়ার পৈতৃক বাড়িতে তাঁর মা বাবা থাকেন। ছোট বোন আছে একটি। তাঁর কথাও বলত মামু দাদুর কাছে কিন্তু তার জন্য শাড়ি কিনত না মামু। বলত বোন বড় বড় ফুলছাপের শাড়ি চায়। কখনও বলত প্রকাশ প্রিন্ট নামে একধরণের প্রিন্টেড কোটা শাড়ি না কি পাওয়া যায়, সেইই চেয়েছে।

কোটা শাড়ি, প্রিন্টেড, মাও কিনত হাতিবাগান থেকে। প্রিন্টেড কোটায় একবার মা ভারি সুন্দর ক্রস স্টিচের এমব্রয়ডারি করেছিল। ফুলপাতার বর্ডার ধরে সুতোর কাজ। যে দেখে সেই ভাবে মা বুঝি অমনই কিনেছে শাড়িখানা। সেই হাতের কাজের ছোঁয়াতে শাড়িটাই যেন অমূল্য হয়ে গেল সেবার।


5f8bdcdd24ce0.jpg

তসর জারি

দাদুর গ্রামের ছোট্ট দোকানের খরিদ্দার সব মেঠো গ্রাম্য বউই বেশি। গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে বউরা তো বর্ধমান থেকে বা কলকাতা থেকে আনা শাড়িই পরত।

আমি দেখে দেখে শিখেছিলাম, গ্রামের অপেক্ষাকৃত গরীব ঘরের বউরা চায় চড়া রঙের টেকসই শাড়ি। পুকুরের পাটে আছড়ে কেচে রোদ্দুরে মেলে দিলেও যেন শাড়ির রং দুদিনে ম্যাড়ম্যাড়ে না হয়ে যায়, সে কারণেই চড়া রং। আর টেকসই তো লাগবেই। হাতে গুনে বছরে দুটো শাড়ি হলেও তো অনেক। তাই যত টেকসই মোটা কাপড়, ততই ভাল। আমার আর্মহার্স্ট স্ট্রীটে বড় হয়ে ওঠা শহুরে দিদু বলতেন গাঁয়ের মানুষ পৌষের ভোরেও গায়ে ঐ আঁচলটি বেশ করে জড়িয়ে গোয়াল ঝাঁট দেয়। সৌখিন কাপড় তাদের চলবে কেন?

যদিও আমার ছোটবেলায় সৌখিন কাপড় বলতে ছিল সিল্ক, জর্জেট, বাংলাদেশি জামদানী, শিফন, কাঞ্জিভরম, বেনারসী। তখন তাঁত মানেই ছিল যেন আটপৌরে।

আজকাল অবশ্য তাঁতও বুঝি আটপৌরে নয়। চার হাজারি, পাঁচ হাজারি তাঁতের শাড়ি কিনি যখন এখন, তখন আমার দাদুর সেই আমকাঠের তাকে সাজানো শাড়িগুলোকে মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই মাষ্টারমামুকে যাঁর কিনে নিয়ে যাওয়া শাড়ি তাঁর মায়ের পছন্দ হত কিনা সে কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও।

এখন আমি এমন কত শাড়ি কিনি যেসব শাড়ির নাম নিজের ছেলেবেলায় শুনিনি, মায়ের কাছেও দেখিনি আগে। রঙে, চমকে এবং দামে সে সব শাড়িই আক্ষরিক অর্থেই বহুমূল্য। সৌখিন শাড়ি কিনতে যখন দোকানে যাই, রকমারি শাড়ি দেখি।

5f8c63f353268.jpg

তসর

লিনেন বেনারসী, জারদৌসি কী জর্জেট পার্সি গারা শাড়ি কিনি, যা বছরে একবার পুজোর দিনে পরি, ভাবি উৎসব কই আর, এই যা পুজোর দিনকটাই। বছরের এক দুটো দিন দামী সে সব শাড়িকে রোদ খাওয়াই যত্নে, তুলে রাখি ছোট পুটলিতে নিমপাতা আর মথ বল সমেত আবার আলমারিতে, আর মনে মনে ভাবি আমার শাড়ি পরার বেলা আসার আগেই দাদু যদি চলে না যেতেন তাহলে আমিও কখনও কোনো পুজোয় আমার দাদামশাইয়ের দোকানের তাকের এক দুটি শাড়ি নিজের কাছে যত্নে রাখতাম নিশ্চয়ই ।