শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

রাসবিহারী বসু ছিলেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’এর প্রতিষ্ঠাতা

রাসবিহারী বসু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদের একজন অন্যতম বিপ্লবী। বাঘা যতীনের মতো একজন মহাবিপ্লবী। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারা জীবন বিভিন্ন দেশে হতে অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ ও বিপ্লবী কর্মী তৈরীর কর্মযজ্ঞে নিয়েজিত ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ছিলেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’এর প্রতিষ্ঠাতা।

ভারতের বাইরে জাপানে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্ণর জেনারেল এবং ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা হামলা করে মারার প্রচেষ্টার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া গদর ষড়যন্ত্রের সাথেও তিনি ছিলেন। ভারতের সেনাবাহিনীতে বিপ্লবীদের অনুপ্রবেশ করিয়ে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সমগ্র ভারতব্যাপী একটি বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন।

রাসবিহারী বসুর জন্ম ১৮৮০ সালের ২৫ মে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। বাবা বিনোদবিহারী বসু। তিনি ছিলেন ভারত সরকারের প্রেসে একেজন উচ্চ পদস্হ কর্মচারী। তিনি বর্ধমান থেকে চন্দননগরে বসবাস করতেন আর চাকরি করতেন সিমলায়। এজন্য তাকে ছয় মাস কলকাতা ও ছয় মাস সিমলায় থাকতে হতো। তিনি ছিলেন মানবদরদী ও সমাজহিতৈষী প্রকৃতির মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের নানাভাবে তিনি সহযোগিতা করতেন।

পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু রাসবিহারী বসুর শৈশবে পড়াশুনার প্রতি তার মনোযোগ ছিল না বললেই চলে। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তার অনুরাগ ছিল। ভারতবর্ষে শুধু ফার্সী ভাষা শিখলে চলিবে না, তাই তার পিতা তাকে কলিকাতা মটন স্কুলে। এই স্কুলে পড়াশুনাকালে তিনি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, খেলাদুলা, ব্যায়াম করা আগ্রহের সাথে নেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। স্কুলে পড়াশুনাকালে চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের (দেশমাতৃকার তরে জীবন উৎসর্গ করা) সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়েজিত করার সিদান্ত নেন।

১৯০৮ সালে বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্লচাকী বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পর মানিকতলা মুরারীপুকুর উদ্যানে খানাতল্লাসি চালায়। এসময় পুলিশ রাসবিহারীর হাতে লেখা দু’টি চিঠি পায়। ওই বছর রাসবিহারী বসুকে “আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ” মামলায় গ্রেফতার করে বেশ কিছুদিন কারাগার রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ওই সময় শশীভূষণ রায় চৌধুরী নামে এক দেশপ্রেমিক ডেরাডুনে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাসবিহারীর বিপদ দেখে নিজের চাকরিটি তাকে দিয়ে ডেরাডুনে পাঠিয়ে দেন। ডেরাডুনে শিক্ষকতা করার সময় রাসবিহারী বসু বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে ছুটি পেলেই তিনি চন্দনগরে চলে আসতেন। আর এই চন্দননগরেই তার সশস্ত্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল।

বছর দেড়েক শিক্ষকতা করার পর তিনি ডেরাডুনে বন বিভাগের গবেষণাগারে কেরানির চাকরি নেন। ১৯১০ সালে তিনি বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। এসময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা এবং হুগলি জেলার চন্দননগর। চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকান্ড, আগ্নেয়াস্ত্রের লেনদেন এবং বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বাইরে তাঁর বেশবাস সরকারি চাকরিজীবী ভদ্রলোকের মতো হলেও গোপনে তিনি ব্রিটিশদের নিদ্রাহরণকারী ভয়ানক বিপ্লবী ছিলেন। বিপ্লবী লালা হরদয়াল গোলাবারুদ সংগ্রহ এবং বোমা তৈরির কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। হরদয়াল আমেরিকায় পলাতক হবার পর এইসব দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু।

১৯১১ সাল। ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লির দরবারে ঘোষণা করেন, ১৯১২ সালে ভারতের সমস্ত প্রভাবশালী ও বিত্ত্ববান ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি শেভাযাত্রা করবেন। ঘোষণা অনুযায়ী সবাই হস্তি, অশ্ব, উষ্ট্র আমদানি করে প্রস্তুতি নেয়। ১৯১২ সালের শীত কাল। পূর্ব ঘোষণানুযায়ী বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ সস্ত্রীক হস্তি, অশ্ব, উষ্ট্র পরিবৃত সেনাবাহিনী ও রাজন্যবর্গ এবং প্রভাবশালী ও বিত্ত্ববান ব্যক্তিদের নিয়ে কুইন্স গার্ডেন হয়ে চাদনীচক দিয়ে দেওয়ান-ই-আমের দিকে যাচ্ছেন। রাজ্যের সকল মানুষ এই শোভাযাত্রা দেখছেন। সেই সময়, পূর্ব পরিকল্লনানুযায়ী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পাঠানো ষোড়শী ছদ্মবেশী একটি বালিকা লীলাবতী বড়লাটকে মারা জন্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল বাংক ভবনে বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছে। সূরম্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল বাংক ভবনের তৃতীয় তলায় অগনিত মহিলারাও শোভাযাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষমান। লীলাবতী চাদর গায়ে মহিলাদের মাঝে মিশে গেলেন। ইতোমধ্যে শোভাযাত্রা চলে প্রায় ভবনের কাছে চলে আসছে।

সম্মুখের আরেকটি ভবনে রাসবিহারী সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং লীলাবতীকে বোমা মারা ইঙ্গিত প্রদানের অপেক্ষায় রয়েছেন। লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর কমান্ডের অপেক্ষায়। এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে জিজ্ঞেস করছে “তেরি নাম ক্যা বহিনী? লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “মেরী নাম লীলাবতী। ততক্ষণে শোভাযাত্রা ভবনের একেবারে নিকটবর্তী এসে গেছে। রাসবিহারী মহিলাদের দৃষ্ট শোভাযাত্র অথবা তার দিকে ফেরানোর জন্য জোরে বলে উঠলো, বড় আজব, সামনে দেখ বাহিনী। মহিলারা অন্যদিকে চাওয়া মাত্র তিনি লীলাবতীকে ইঙ্গিতে কমান্ড করলেন। লীলাবতী সাথে সাথে বড়লাট লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করল। প্রচন্ড শব্দ। সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। পুলিশ আততায়ীকে ধরার জন্য খুজছে। রাসবিহারী বসন্তকুমার বিশ্বাসকে লীলাবতীর বেশ পরিবর্তন করে নিজের সাথে নিয়ে ডেরাডুনে চলে গেলেন। ভাগ্যক্রমে বড়লাট বেচে গেলেন, মারা গেল তার একজন চোকিদার (রাজদরবারের পেয়াদা)।

এই ঘটনার পর ব্রিটিশ পুলিশ এলোপাথাড়ি গ্র্রেফতার অভিযান চালায়। পুলিশ যাতে রাসবিহারী সন্দেহ না করে সে জন্য ডেরাডুনে গিয়ে বড়লাটের উপর বোমা হামলা প্রতি নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

কিন্তু দিল্লী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। কয়েক মাস পর বসন্ত বিশ্বাসসহ ১০ জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। ১৯১৫ সালের ১১ মে ব্রিটিশ সরকার এই মামলায় বসন্ত বিশ্বাসসহ ৩ জনকে অবৈধভাবে গোলাবারুদ বহনের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।

এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে মূল পরিকল্পক রাসবিহারী বসুকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ তাঁর মাথার মূল্য ১২ হাজার রুপী পুরস্কার স্বরূপ ঘোষণা করে। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হলে পরে পুরস্কারের অর্থের সঙ্গে আরও ৫ হাজার রুপী যোগ করা হয়। কিন্তু বিপ্লবী রাসবিহারীকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি এই ঘটনার পর বারাণসী (বেনারস) শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি বাইরে বেরুতে পারতেন না। কেননা তাঁর ছবিসহ পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সর্বত্র। ইতিমধ্যে পুলিশি তৎপরতা দেখা দেয় চন্দননগরে রাসবিহারী বসুর খোঁজে।

দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ-হত্যা পরিকল্পনা ছিল বিপ্লবীদের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের পদক্ষেপ কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় সুযোগ তাঁরা খুঁজে পেলেন লাহোরে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গুপ্তদলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯১৩ সালে রাসবিহারী বসু পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন গর্ডনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। এজন্য চন্দননগরে হতে কয়েকটি বোমা আনেন। ১৩ মে লাহোরের লরেন্স পার্কে গর্ডন সাহেবের আসার কথা ছিল। রাসবিহারী বসন্তগুপ্ত নামক এক বালককে এই হত্যায় নিয়েজিত করেন। ওই দিন সন্ধার সময় বসন্তগুপ্ত লরেন্স পার্কে সভামঞ্চস্থলের কাছের রাস্তায় একটি বোমা রেখে আসেন। কিন্তু বোমাটি গর্ডন সাহেব চলে যাওয়ার পর বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তিনি বেচে যান। এতে মারা যায় রাম নামক একব্যক্তি।

লাহোরে এই ঘটনার পর পুলিশের নজরদারী আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। বারাণসীও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ওই বছর রাসবিহারী সন্ন্যাসীর বেশে তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাশী চলে যান। সেই সময় শচীন্দ্রনাথ স্যানাল কাশীতে ঢাকা অনুশীলন সমিতির একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দিল্লি ও লাহোর ষড়যন্ত্র্রের পর ব্রিটিশ অনুশীলন সমিতিকে নিষিদ্ধ করে। যার কারণে শচীন্দ্রনাথ স্যানাল অনুশীলন সমিতির নাম পরিবর্তন করে “ছাত্র-যুব সঙ্ঘ” নামকরণ করেন। রাসবিহারী কাশীতে এসে এই ছাত্র-যুব সঙ্ঘ-এর সাথে যুক্ত হন এবং এক পর্যায়ে এই সঙ্ঘের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। তিনি এই সঙ্ঘের সদস্যদের অস্ত্র চালানো ও বোম নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি কাশীতে থাকাকালীন সময়ে দিনে বের হতেন না। তিনি নানা নামে নানা পরিচয়ে চলাফেরা করতেন। এসময় তিনি সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেন্দ্র সেন নামে অমৃতবাজার পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন।

কাশীতে বিষ্ণুগনেশ পিঙ্গলু নামে মুম্বাই প্রদেশের দুই মারাঠী দেশপ্রেমিক ও বিনায়ক রাও কাপলের সাথে রাসবিহারীর পরিচয় ঘটে। যারা আমেরিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন। তারা রাসবিহারী বসুকে জানান, ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে গদর পার্টির কয়েকজন শিখের সাথে ভারতে আসেন। তারা আরো জানান, গদার পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্র্রোহের জন্য ভারতে এসেছেন। বিদ্রোহ শুরু হলে আরো ২০ হাজার ভারতে আসবে। আমরাও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতে এসে তার সাথে যোগাযোগ করেন। বিনায়ক রাও ভালো বাংলা ও ইংরেজী বলতে পারতেন। রাসবিহারী তাদের দুজনকে পেয়ে খুশি হন এবং তাদেরকে কাজে লাগান। রাসবিহারী বসু বিনায়ক রাও বাংলাদেশে, পিঙ্গলুকে পাঞ্জাবে এবং সত্যেন্দ্রনাথকে কলকাতায় পাঠান। তারা সকলে বিপ্লবী কাজের ফাকে ফাকে “৪ হাজার বাঙ্গালী বিদ্রোহ করার জন্য আমেরিকা থেকে ভারতে আসনে” এই কথা প্রচার করতেন।

১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করেন রাসবিহারী বসুসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। গোপনে গোপনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী ছাত্র-যুব সঙ্ঘের একটি সভা করে দলের সভ্যদেরকে “দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করার প্রস্তুতি নিতে বলেন”। তিনি সমগ্র্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি শচীন্দ্রণাথ স্যানালের সহযোগীতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের “জাতীয় অভ্যূত্থানের” জন্য অনুপ্রাণিত করে তাদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।

১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত। কিন্তু পরে ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তন করে ১৯ ফেব্রুয়ারি করা হয়। কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি পুলিশ জেনেছে বলে ২ দিন আগিয়ে আনা হয়। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অধীর অপেক্ষায়। রাসবিহারী এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে। অবাঙালি বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদানের সময়টুকুর প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্রোহের ঠিক ৪ দিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় এই রামশরণ দাস লোকটি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে যেখানে যেখানে সম্ভব দেশীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। দ্রুত সমস্ত লাহোরব্যাপী এই ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়।

এটাই ঐতিহাসিক ‘লাহোর ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতায় অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। মামলায় ২৩ জনের ফাসি ও ৪৫ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। এই মামলার রাজসাক্ষী “মূলা সিং বলেছিলেন, অমৃতসরে রাসবিহারী বসুর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি সকলকে বিদ্রোহ করতে বলেন এবং স্বাধীন ভারতের পতাকার পরিকল্পনা দেন। উক্ত পতাকাটি হবে _লোহিত, সবুজ ও নীল। লোহিত রংয়ের মাধ্যমে হিন্দুদের ভাব, সবুজ রংয়ের মাধ্যমে শিখদের বীরত্বের ভাব ও নীল দিয়ে মুসলমানের ভাব পরিষ্ফুটিত হবে”।

এই সময় তিনি কাশী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর চন্দননগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে খুব সর্তকতার সাথে ঘুরে ঘুরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পুলিশের চোখকে ফাকি দিতে তিনি কখনো নারী বেশে, কখনো দারোয়ান, কাজের লোক, সন্ন্যাসি বেশে চলাফেরা করতেন। তিনি এমনভাবে চলতেন যাতে কেউ কোন ধরনের সন্দেহ না করতে পারে। এরপর সশস্ত্র বিপ্লবকে সফল করার উদ্দেশ্যে বেছে নেন জাপান দেশটিকে।

১৯১৫ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীর বেশে কলকাতাগামী ট্রেনে জাপানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্টেশনে তার ছবিসহ পোস্টার লাগানো। রাসবিহারী বসু তাঁর ছবি দেখে কিছুটা বিব্রত। নানা কৌশল অবলম্বন করে রাসবিহারী বসু ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে জাপানে পৌঁছেন। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবিশীর্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন এরকম সংবাদ প্রকাশিত হলে পরে সেটা দেখে রাসবিহারী বসু জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এবং রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে (মতান্তরে আত্মীয়) পি.এন.ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) নাম ধরে জাপানে বসবাস শুরু করেন।

রাসবিহারী বসু জাপানে ড.সান-ইয়াৎ সেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ড.সান-ইয়াতের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি আকাসাকা শহরের রেইনানজাকাস্থ ‘গেনয়োশা’ গুপ্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংস্থার পরিচালক তোয়ামা মিৎসুরুর (১৮৫৫-১৯৪৪) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য সহযোগিতা করার আবেদন জানান। সেদিন থেকে ড.সান-ইয়াৎ সেন এবং প্যান্-এশিয়ানিজমের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা তোয়ামা মিৎসুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। গুরু তোয়ামা এই বিপ্লবীকে জাপানে আশ্রয় এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি এসময় ‘কোকুরিউকাই’ এর প্রধান পরিচালক কুজো য়োশিহিসা ও প্রধান কর্মকর্তা উচিদাকে রিয়োহেইক-এর সাথে পরিচিত হন। এই বিপ্লবীদ্বয় তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেন। সেদিন থেকে জাপান তথা বিদেশে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।

জাপানে আসার ৮ মাস পর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবের পুরোধা লালা লাজপৎ রায় আমেরিকা যাওয়ার পথে জাপানে উপস্থিত হন। টোকিওর অন্যতম প্রধান বৃহৎ বাণিজ্যনগর হিসেবে খ্যাত ‘উয়েনো’ এর বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যে ৬ টার সময়। প্রধান বক্তা লালা রাজপৎ রায় উপস্থিত অতিথিদের কাছে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে জাপানের সহযোগিতা এবং এশিয়াবাসীর হাত দিয়ে এশিয়া মহাদেশকে গড়ে তোলার আহবান জানান। এরপর রাসবিহারীর ও তার সহযোগী হেরাম্বলালের উপর নেমে আসে খাড়া বিপদ। অনুষ্ঠানে জাপানস্থ ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ৪ জন চরকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা দুজনের আসল পরিচয় খুঁজে পেয়ে ব্রিটিশ দূতাবাসকে অবহিত করে। পরের দিনই রাষ্ট্রদূতের বিশেষ দূত জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে অনুরোধ জানায় যে, দুজন ভারতীয় বিপথগামী তরুণ শত্রু শক্তি জার্মানীর সাহায্যে ভারতের জনসাধাণরকে বিদ্রোহী করে তুলছে। সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করছে। তাঁরা জাপান-বৃটিশ মৈত্রী সম্পর্কেরও শত্রু। সুতরাং তাঁদেরকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করো।

এই আবেদনের প্রেক্ষিতে জাপানি কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী দুজনকে ৫ দিনের মধ্যে জাপানত্যাগের আদেশ দেয়। বিপ্লবীরা যেন জানতেনই এমন ঘটনা ঘটবে এবং তাঁদেরকে রক্ষা করার জন্য প্রভাবশালী জাপানিরাও রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ ছিল নির্ধারিত শেষ সময়সীমা তাও লঙ্ঘন করে জাপানেই তাঁরা থেকে যান ফলে জারি হয় জাপান সরকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

জাপানে রাসবিহারী বসু তোয়ামা মিৎসুরুর তত্ত্বাবধানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকের বড় কন্যা সোমা তোশিকোকে বিয়ে করেন। তাদের পরিবারে একটি মাত্র ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর স্ত্রী তোশিকো বসু একই রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভোগে মারা যান (১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ মাত্র ২৬ বছর বয়সে)। ওই বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করা আর সেইসঙ্গে অক্লান্তভাবে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে চলেছেন তিনি।

১৯২৬ সালের ১ আগস্ট মাসে নাগাসাকি শহরে রাজনৈতিক দল সেইয়ুকাই প্রধান সাংসদ ইমাজাতো জুনতারো এর উদ্যোগে প্রথম এশিয়া জাতিগোষ্ঠী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে রাসবিহারী বসু উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন জাপানে এশিয়ার শীর্ষনেতাদের প্রথম সম্মিলন হিসেবে পরিচিত।

১৯৩২ সালে ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন ব্রিটিশদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠছে। এই আন্দোলনে জাপান প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, জাপান-চীন প্রবাসী হেরাম্বলাল গুপ্ত, রাজামহেন্দ্র প্রতাপ এবং আমেরিকা-ক্যানাডা প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠিত গদর পার্টির সক্রিয় কর্মতৎপরতা ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের প্রধান প্রেরণাদাতা। কাজেই সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পলাতক বিপ্লবী বিশেষ করে রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্তকে গ্রেপ্তার করা যায়। রাসবিহারী বসু জাপানে বিয়ে করে জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ফলে সে সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যান।

১৯৩৭ সালে রাসবিহারী বসু কর্তৃক প্রতিষ্টিত ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ। তৎকালীন সময়ে রাসবিহারী বসু ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সশস্ত্র বিপ্লব বা অস্ত্র ব্যবহার ছাড়া ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা যাবে না। তাই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।

১৯৩৯ সালে রাসবিহারী বসু সাংহাইয়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে যান। তখন রাসবিহারী হেরাম্বলালকে বলেন যে, ‘ভারতের স্বাধীনতা যে করেই হোক ভারতীয়দের শক্তিবলে অর্জন করতে হবে। স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষ জাপানিদের দখলে চলে গেলে এই আন্দোলন সম্পূর্ণই পন্ডশ্রম হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে একটি শুভ সংবাদ আছে, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু এখন জার্মানীতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। জাপান প্রবাসী ভারতীয় সহকর্মীরা তাঁকে জাপানে আহবান করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। এই বিষয়ে আমি সমর্থন দিয়েছি, তুমি কি বলো?’ এই প্রশ্নের জবাবে হেরাম্বলাল তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, ‘আমি অবশ্যই রাজি।

১৯৪১ সালে বহু বছরের পরাধীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাসবিহারী বসু বিশ্বস্ত এম.এন রায়কে মাঞ্চুরিয়াতে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ভারতীয়দেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। একই সময়ে হেরাম্বলালও একই কর্মকান্ড সমাপ্ত করেন সাংহইয়ে, হংকঙে।

হংকং দখলের পর টোকিও তেৎসুদো হোটেলে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিও, য়োকোহামা, ওসাকা, কোবে, নাগাসাকি প্রভৃতি জায়গায় বসবাসরত ৭০ জনেরও বেশি ভারতীয় জড়ো হয়ে ‘ভারতীয় স্বাধীনতা লীগে’র মহাসভা আহবান এবং লীগের পতাকা উত্তোলন করেন।

১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিওতে ‘ভারতীয় স্বাধীনতা লীগে’র আয়োজনে একটি মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শিরোনাম ছিল: ‘আমেরিকা-বৃটেন ধ্বংস করো।’ সম্মেলনের পর রাসবিহারী বসু রাজকীয় সেনা বাহিনীর দপ্তরে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের উপায় হিসেবে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ জানান কর্তৃপক্ষকে। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অনুমতিক্রমে জাপানি সেনাবাহিনীর ছোট্ট একটি ইউনিট হিসেবে হেরাম্বলালকে তার প্রধান করে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা হয়, যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৩,০০০।

১৯৪৩ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ সকালে সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর আগমনের আগে রাসবিহারী বসু ব্যাংকক সম্মেলন শেষে প্রধান সেনা দপ্তরের মেজর জেনারেল আরিয়োশিকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না, বয়সও হয়েছে। নেতৃত্ব দেবার মতো শারীরিক অবস্থাও আমার নেই। জার্মানী প্রবাসী সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে আমন্ত্রণের অনুরোধ করতে চাই।’

উত্তরে আরিয়োশি অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলেন, ‘সরাসরি জিজ্ঞেস করছি, যদি সুভাষ বসুকে জাপানে আমন্ত্রণ জানানো হয় আর তাঁকে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে প্রবাসীরা সম্মতি দেন তাহলে আপনার বর্তমান অবস্থান কি হবে?’

রাসবিহারী বসু দ্রুত এবং খুব সহজে উত্তর দেন, ‘সুভাষচন্দ্র বসু যদি প্রেসিডেন্ট হতে সম্মত হন, তাহলে তাঁর নিচে আমি সানন্দে কাজ করবো।’ রাসবিহারী বসুর এই সরল স্বীকারোক্তিতে শুধু আরিয়োশি নন, আশ্চর্য হয়েছিলেন মেজর ফুজিওয়ারা, এফ-কিকান ইউনিট প্রধান ইওয়াকুরো হিদেও প্রমুখ। জার্মানী থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাকে আনার ব্যবস্থা করেন রাসবিহারী বসু।

সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম তিনি পূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যাপারে জার্মানী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হয় জার্মানী সামরিক সরকার। তারপর তাঁকে জাপানে নিয়ে আসা হয় এক মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লব অনস্বীকার্যতা রাসবিহারী বসুর মতো একই মনোভাব পোষণ করতেন সুভাষ চন্দ্র বসু।

১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট রাসবিহারী বসু দাঁড়িয়ে আজকের সভায় একজন চমৎকার নতুন অতিথি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেইসঙ্গে লীগের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নিজের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি সকলকে অবহিত করেন যে, ইতিমধ্যে টোকিওতে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং তিনি দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে বর্তমান পদ তাঁর পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান। এই কথা বলার পর সভার সকল নেতৃবৃন্দ এবং সদস্য প্রাণবন্ত করতালি দিয়ে সুভাষ বসুকে স্বাগত জানায়। প্রবাসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বমান্য সম্মানিত পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার কারণে রাসবিহারী বসু তখন তাঁকে ‘নেতাজি’ উপাধি ঘোষণা করেন। নেতাজি রাসবিহারী বসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুঘন্টাব্যাপী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।

এ সম্মেলনে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। বস্তুত ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনে রাসবিহারি বসুর অবদান অপরিসীম। পরে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হন। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন রাসবিহারি বসু।

১৯৪৪ সালের ২১ মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপি ছড়িয় পড়ে। তখন রাসবিহারি বসু খুবই আনন্দিত হন। কিন্তু ১৯৪৫ সালের শুরুতে জাপান আজাদ হিন্দ ফৌজ-কে যে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা প্রত্যাখান করে নেয়। মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ রাসবিহারী বসু এই খবর শুনে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি টোকিওর নিজগৃহে মারা যান।

তথ্যসূত্র :

১। বাংলার পাচ স্মরণীয় বিপ্লবী: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন-কলকাতা। প্রকাশকাল ৫ জানুয়ার ২০০৮ সাল।

২। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯ সাল।

৩। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়/ রাখী চট্টপাধ্যায়, কলকাতা। প্রকাশকাল মে ২০০৫ সাল।

৫। অগ্নি বিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত এবং ভারতের স্বাধীনতা: প্রবীর বিকাশ সরকার, উইকলি বেঙ্গলী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, প্রকাশকাল ২০০৯-২০১০ সাল।

সংগৃহীত