বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মা, লেখক ​অরবিন্দ রাজখোয়া

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস

[ লেখক পরিচিতি -১৯৮২ সনে অসমের লক্ষ্মীমপুরে অরবিন্দ রাজখোয়ার জন্ম হয়।ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।২০০৫ সনে উত্তর লক্ষ্মীমপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন।প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘খেলপথারত কানাইকান্ত আরু অন্যান্য’,কাকৈ হাবির ভূত আরু অন্যান্য। ]

ফিফথ সেমিস্টারের ক্লাসটা শেষ করার পর থেকেই মনটা ভালো যাচ্ছে না।অজয় পেয়ারা গাছটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল –তুই শুনছিস কি?আজ আমার মা আসবে। মা।একটু পরেই এসে যাবে।তারপরে তার মা এল।গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। অজয়ের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল।সে ভাবল দুষ্ট পরীরা আজ তার প্রতি প্রসন্ন হয়েছে।

অলক মাথা তুলে নি।আজ তাকে গল্পটা শেষ করতেই হবে।বিএ ক্লাসে গল্প বোঝানো বড় সহজ কথা নয়।ছেলে-মেয়েদের চোখের দ্দিকে না তাকিয়ে ক্লাসে কথা বলার আমার অভ্যাস নেই।এভাবে আসলে কথা বলাই যায় না।অলক এখনও মাথা তুলে তাকায়নি।চোখের দিকে তাকিয়ে না বললে কথাগুলি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে না।তাছাড়া বলতে থাকা কথাগুলি কে বুঝেছে কে বুঝেনি সেটাও চোখের দিকে না তাকালে অনুমান করা যায়না।এদের সবাই গল্প পড়েছে।একেবারে নতুন কথা বোঝাতে ভালো।গল্প নিজে পড়ে অনুভব করার জিনিস।এই গল্পটাও সবাই বাড়িতে পড়েচে।পড়তে বলাও হয়েছে।অভ্যাসবশতঃ আমি শ্রেণিকক্ষে্র ডানদিক থেকে বাঁদিকে এবং বাঁদিক থেকে ডানদিকে পায়চারি করলাম।ওরিয়েন্টেশন কোর্সে আমাদের বারবার বোঝানো হয়,শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য থার্ড ডিগ্রির ব্যবহার করলে চলবে না। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীকে কৌশলের সাহায্যে তাদের অজান্তে মনটাকে ঘুরিয়ে আনতে হবে।তা না করে কেবল ধমকির দ্বারা ক্লাসরুম চালাতে গেলে সেটা আর ক্লাসরুম হয়ে থাকেনা।

ভাবলাম,কি করা যায়।আমি অন্যসময়েও পায়চারি করি,ছেলেমেয়েদের একবার কথাগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে নেবার সুযোগ দিই।তাই আজ দুবার বেশি করে পায়চারি করলাম যদিও তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না।আজ প্রত্যেকের মুখগুলি মনে মনে লক্ষ্য করলাম।প্রত্যেকেই মানে ত্রিশজনের ক্লাসে আজ মাত্র নয় জন বসে আছে। পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই।ক্লাসগুলি প্রায় না হওয়ার মতোই।আমার বিভাগের এই ফিফথ সেমিস্টারের ক্লাসগুলি হচ্ছে।বাকিরা কয়েকদিন আগে থেকেই কলেজে আসছে না।ভেবেছিলাম বাকি থাকা পড়াটা আজকেই শেষ করে ফেলব।

চারপাশ নির্জন।ত্রিশজনের ক্লাসরুমটিতে নয় জন ছাত্র ছাত্রী।কমন রূমেও কেউ নেই।দরজা জানালা খোলার দায়িত্বে থাকা হীরেণ স্যার আটটার সময় সে সব করে পরীক্ষার ডিউটিতে লেগে পড়েন।শীত আসছে।তাই ফ্যানগুলি বন্ধ রয়েছে।আমি কথা বলছি,নির্জনতা ভেদ করে শব্দগুলি যেন বড় বেশি দূর যেতে চাইছে না।কার্তিক মাসের দুপুরবেলা।উদাস উদাস একটা ভাব চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।সর্বত্র।

অজয়ের সেই ভার বইতে না পারা আনন্দের কথা বুঝতে পারার মতো ঘরে কয়েকজন মানুষ ছিলেন।তার পিতা ছিল,ঘর দেখাশোনা করার জন্য দুজন মানুষ,একজন রাঁধুনি।প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসে।তার মুখের একটা হাসির জন্য সবাই কত যে কষ্ট করে।কিন্তু সে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের খবরটা দেবার জন্য একটা পেয়ারা গাছের নিচে দৌড়ে গেল।পেয়ারা গাছটা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবেনা বলে সে জানে,কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়াহীনতার মধ্যে অজয় যা অনুভব করবে,অযুত প্রতিক্রিয়াতেও তা পাওয়া যায় না।

গুজরাটি গল্পকার ধীরু বহন পেটেলের ‘মা’গল্পটি পাঠ্যক্রমে নতুন করে দেওয়া হয়েছে।সঙ্গে একই চেতনার একটা হিন্দি গল্পও।মা এবং সন্তানের সম্পর্কের বিচিত্রতা তুলনার মধ্য দিয়ে অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই গল্পদুটি রাখা হয়েছে।‘মা’গল্পটি আমি কাল মাত্র পড়েছি।কমন রুমে কেউ ছিলনা।আমি গল্পটা পড়েছিলাম।প্রতিদিন ভাবি,ক্লাসের কথাগুলি বাড়িতে ভালো করে পড়ে রেডি হয়ে থাকি।পারলে নোটবুকে দরকারি কথাগুলি লিখে এনে একটা পূর্বপরিকল্পিত লেকচার দেবার কথাও প্রায়ই ভাবি।সেটা আর হয়ে উঠে না।কেন হয় না তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।মোট কথা প্রতিদিন ক্লাসে যাবার আগের মুহূর্তে দ্রুততার সঙ্গে কিছু সময় কিছু একটা দেখে নিয়ে তাকে কৌশলের সাহায্যে বিধৃত করাটাই নিয়ম হয়ে গেছে।

মা কিন্তু আজ নয়,কালই পড়েচি।অজয়ের মায়ের তার বাবার বন্ধুর সঙ্গে পরকীয়া প্রেম ছিল।অজয়ের সাত বছর বয়সে সেই পুরুষের সঙ্গে মা পালিয়ে গিয়েছিল।রাত গেল।অজয় তখন ঘুমিয়েছিল।পরের দিন ঘুম থেকে উঠার পরে অজয়কে বাড়ির প্রত্যেকেই অনেক আদর করেছে,যত্ন করেছে।যা কিছুটা আশ্চর্যজনক এবং অস্বাভাবিক ছিল।কোনোদিনই তার খবর না রাখা বাবাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।কেবল মায়ের ঘরটি খালি।বাবা কৈফিয়ত দিলেন মা নাকি দূরে মাসির বাড়িতে গিয়েছে।অজয় কি বাবার সঙ্গে থাকতে পারবে?অজয় বলল,পারব।কিন্তু পরের মুহূর্তেই বলল,আমরাও কি মাসির বাড়িতে চলে যেতে পারিনা?বাবা উত্তর খুঁজে পেলেন না।

এবার আমি বসলাম।চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে গল্পটার পাতা উল্টালাম।পেয়ারা গাছের নিচে আমরা অজয়কে ছেড়ে এসেছিলাম।মায়ের আগমনের আভাস হিসেবে সে বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ শুনেছিল।

সাত বছরের ছোট শিশুটির ছোট্ট বুকটা আনন্দে উথলে উঠা আমরা সবাই অনুভব করতে চেষ্টা করলাম।বীথিকা,জুরি,জেসমিন,বিনন্দ,পয়োভরা,বিপ্লব প্রত্যেকেই আমার কথাটা অনুভব করার জন্য আমার মুখের দিকে তাকাল।অজয়ের প্রাপ্তির আনন্দে সবার চোখ উজ্জল দেখলাম। সেই উজ্জলতার মধ্যে জলকণার সন্ধান পেলাম।পয়োভরার চোখের চঞ্চলতা ক্রমশ দুই কোণ দিয়ে নেমে এসেছে।সে তা লুকোনোর চেষ্টা করল। শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দ্দেবার বছরে ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের রাজকিশোর রায়ের ‘বিয়ের মুকুট’নামে একটি গল্প পড়িয়েছিলাম।রায় ছিলেন উড়িষ্যার গল্পকার।বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দেবার সময় বাড়ির সদস্যদের মনেজ দুঃখ বেদ্দনার অকৃপণ প্রকাশ ছিল তাতে। আমি গল্পটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।বর্ণনার মাধ্যমে একটা অসমিয়া পরিবার ক্লাসরুমে উঠিয়ে এনেছিলাম।একসময় বন্তি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল।অরুণ,রাজীবদের চোখও ভিজে উঠেছিল।আমার ও। আমি কথা বলে যাচ্ছিলাম।এরকম পরিস্থিতিতে কথা বলা ছেড়ে দিলে অস্বস্তির কারণ হতে পারে বলে বুঝেছিলাম।কিন্তু ক্লাসটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে পারছিলাম না।এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের হঠাৎ ফেলে রেখে একদিন্ বরা স্যারকে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে।সেদিন আমিও তাই করেছিলাম।বন্তির কান্না আমাকে কমনরুম পর্যন্ত তাড়া করে এসেছিল।

ঢুকেই টেবিলের একপাশে ব্যাগটা রেখেছিল।অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা শব্দও হয়েছিল।ব্যাগগল্পটা শেষ করতে হবে।এখন অজয় মায়ের কাছে দৌড়ে যাবে।বাড়ির সামনে গাড়ি রাখার শব্দটা সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে।ঘরে ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে।পরিস্থিতিটা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই সহজে অনুভব করতে পারে।

কাল গল্পটি পড়ার সময় পাশে যে কেউ ছিল না,কথাটায় প্রথমে গুরুত্ব দিইনি।শেষ করে যখন নিশ্চূপ হয়ে বসে থাকার জন্য নির্জন পরিবেশটা লাভ করেছিলাম তখনই পাশে কেউ না থাকলেও যে এতটা স্বস্তি পাওয়া যায় তা অনুভব করেছিলাম।বাড়ি গিয়ে ওকে গল্পটা পড়ে শোনালাম।

ক্লাসে টাও ভারী ছিল।সেখানে কয়েকটা বই ছিল।তার মধ্যে দুটি বিশ্বকোষ।গত কয়েকটি সপ্তাহে কিছু নতুন কথা পড়িয়েছিলাম। সে সবের সহজলভ্য রেফারেন্স বুক নেই। যে সমস্ত বইয়ে কিছু কিছু কথা আছে,সেইসবের দাম অনেক।ছাত্রছাত্রীদের এত সামর্থও নেই যে কিনে নেবে। কিছু বই দুষ্প্রাপ্য। গত দুদিন ঘরের আলমারিতে খুঁজে খুঁজে এই কয়েকটি বই খুঁজে এনেছে। দরকারি পৃষ্ঠাগুলি ফোটোস্টাট করে নিতে পারবে।

কখনো ভাবি,এসমস্ত যে করছি,অযথা শ্রম বাড়িয়ে চলেছি। আমাদের অগ্রজ বেশিরভাগ শিক্ষকই কেবল ক্লাসরুমে ছাত্র ছাত্রীর কথা ভাবে।বাইরে তারা এক একজন নিশ্চিন্ত চাকরিজীবী। তাঁদের অনুকরণ করে তাঁদের অজানিত প্রভাবে কখনো নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করি। কিছুদিন চেষ্টা করলে পারব বলে মনে হয়। আমাদের কর্তব্যের খতিয়ান নেবার কেউ নেই। পাব্লিকের কুনজর আমাদের ওপরে পরার সম্ভাবনাও নেই।

কেবল কিছু বিরল মুহূর্তে নিজের কাছেই লজ্জাবোধ হয়। ওরিয়েন্টেশন কোর্সে বিজয়ান না কোন স্যার যেন বলেছিল,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করার পরে কখনও কোনো বই না পড়াটাই হল কলেজ শিক্ষকের মূল চরিত্র। স্যারের কটাক্ষের বিরুদ্ধে সাহস করার প্রতিবাদ কারও চ্ছিল না। কখনও যদি একই ক্লাসের জন্য বাড়িতে কয়েকঘ্ন্টা হোম ওয়ার্ক করি,তখন বিজ্যান স্যারের কথা মনে পড়ে।

ব্যাগটা এমনিই ভালো করে উলটে পালটে দেখলাম।একটা কোণে ইঁদুর দাঁত বসিয়েছে,সেইকোণটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।এবার কোণটা আরও ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলাম।কোনো কারণ ছাড়াই ব্যাগটা নেড়েচেড়ে থাকা এই মুহূর্তে ঠিক বলে মনে হচ্ছে না।কথাটা মনে পড়ায় হাতটা সরিয়ে এনে অজয়কে খুঁজতে লাগলাম।বাঁ হাতের তর্জনি আঙ্গুলটা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার মধ্যে ঢুকেই ছিল।

বাড়ির সামনের দীর্ঘ রাস্তাটা দৌড়াতে দৌ্ড়াতে অজয় মায়ের কাছে এগিয়ে গেল।আবেগ,অভিমানে ভরা তার মুখ।মায়ের মাসির বাড়িতা যাওয়ার দুই বছর হয়ে গেছে।তার কোনো খবর নেয়নি।সে কত চিঠি লিখে বাবার কাছে পোস্ট করার জন্য দিয়েছে।মা কোনো চিঠির উত্তর দিল না।সাধারণ একটা কথায় তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে মা চলে গিয়েছিল।একদিন সে একটা শাড়ি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলায় তার মা তাকে বলেছিল,এই ধরনের খারাপ কাজ করলে সে একদ্দিন কোথাও চলে যাবেন।সত্যি সত্যিই চলে গেলেন।অজয় সঙ্কল্প করেছে সে কখনও আর মা পছন্দ না করা কাজ করবে না।

কাল ও ফুঁপিয়ে কাঁদল।অনেকদিন পরে মানুষটা আশ মিটিয়ে চোখের জল ফেলল। একটা গল্পের পাঠও যে এত কষ্টকর হতে পারে আমিও বুঝলাম।আমার ছয় বছরের ছেলেটি জিজ্ঞেস করল,মা তুমি দেখছি কাঁদছ?ও বলল ,তোমার মতো একটা বাচ্চার কথা পড়ছিলাম বাবা,তার মা কোথায় চলে গিয়েছিল?

ও বলেনি আমিও বলিনি।গল্পটা পড়ার সময় আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আমাদের সম্পর্কীয় এক দাদার ছয় বছরের ছেলে দিকু।বৌ্দির মৃত্যু হয়েছিল।ঘটনাটার পরে দ্দিকু মাস দুয়েক আমাদের বাড়িতে ছিল।দিনের বেলাটা প্রত্যেকের সহানুভূতি পূর্ণ স্নেহ ভালোবাসার মধ্যে খেলাধুলো করে সন্ধেবেলা সে মায়ের খোঁজ খবর করেছিল।আমি বলেছিলাম,তোমার মায়ের বড় অসুখ,ভালো হওয়ার জন্য অনেক দূরের হাসপাতালে গিয়েছে।দিকু হাতজোর করে চোখদুটি বুজে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল,আমার মাকে তাড়াতাড়ি ভালো করে দাও ভগবান।

আমি এগিয়ে গেলাম।আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে বীথিকা,জুরিরা এগিয়ে গেল বলে মনে হল।কেবল জথর হয়ে রইল অলক।সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পরিবেশটা অবজ্ঞা করে গেল।

অজয় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল।সে ভাবল মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদবে,কাঁদতেই থাকবে।অনেকক্ষণ অজয় মাকে না ডেকে থাকবে।ফুশলাতে ফুশলাতে মা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।কিন্তু সেইসব কিছুই ঘটল না।মা অজয়কে ব্লল,সাবধানে আসবে অজয়,তোমার বোন ব্যথা পাবে। তখনই অজয় দেখতে পেল মায়ের কোলে একটি ছোটো শিশু।অজয়ের সামনে মা শিশুটিকে খুব মমতার সঙ্গে ঘুম পাড়াল।একটা সময়ে ঘরটা শান্ত হয়ে পড়ল।বাবা মনের সমস্ত অশান্তি ঢেকে রেখে মাকে ভেতরে নিয়ে গেল।তখন অজয় কারও কাছে ছিল না। ব্যস্ত হয়ে পড়া মানুষগুলির কাছে থেকে দূরে সরে গিয়ে সে পেয়ারা গাছটাকে জড়িয়ে ধরেছিল।সে কাঁদছিল।কাঁদছিলই।কথা বলছিল না,কেবল কাঁদছিলই।

বোঝানোর মতো আমার কোনো কিছুই ছিল না।ধীরু বহন পেটেল সব বুঝিয়ে রেখেছিল।নয়টি ছেলেমেয়েয় আটটিই সেই তখনকার ববন্তিকে অনুসরণ করেছিল।এই সময়ে কিছু বোঝানো মানে রস বিনষ্ট করা।

বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।রেজিস্টার বইটা বইগুলির সঙ্গে বাঁ হাতে নিয়ে ব্যাগটা ডানহাতে তুলে ধ্রলাম।ওজনটা যেন বেড়ে গেছে।ত্রিশটা ছেলে মেয়ের ত্রিশটারই মুখগুলি মনে পড়ছিল,যখন এই সবের পাতা উলটাতে উলটাতে দরকারি পৃষ্ঠাগুলিতে কাগজের টুকরো ভরিয়ে চিহ্ন রেখেছিলাম।ভেবেছিলাম ওদের বলব,বই ফটোস্ট্যাট করার সময় সবসময় ডিক্লেরাশন পেজটা সঙ্গে ফোটোস্টাট করা উচিত।আর তোমরা একসঙ্গে সবার জন্য ফোটোস্টাট করবে,বারবার মেশিনে ঢোকালে বড় বইয়ের বাইণ্ডিং নষ্ট হয়ে যায়।এইসব বই না খেয়ে থেকে জোগাড় করেছিলাম জান?আজ একুশটা সিটই খালি থাকল।কারণটা জিজ্ঞেস করায় কেউ একজন অস্ফুট স্বরে বলেছিল,বাজারে অনেক গাইড বই বেরিয়ে গেছে স্যার,সব পেপারেরই বেরিয়ে গেছে,দামও বেশি নয়।

ব্যাগটা এনে কমন রুমের টেবিলে রাখলাম।ওদের নয়জনকে আজকের জন্য ব্যাগটা দিয়ে পাঠাতে হবে।বাকিরাও পেলে ভালো ছিল।

কাল আমাদের ইনি সঙ্গের কয়েকজনকে ফোন করে বলেছে,খুব ভালো একটা গল্প পড়লাম জানেন।এত সরল অথচ শক্তিশালি।ইনি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন।তাই সমালোচকের মতো বললেন,আজকাল অসমিয়া গল্পগুলি পড়াই যায় না,কেবল তত্ত্ব এবং বাদ। গল্প,না প্রবন্ধ না কবিতা বোঝাই যায় না।এগুলি হল গ্লপ।পড়বে বুঝেছ।বেশ কয়েকজন গল্পটির খোঁজ ক্রল।ইনি ফোটোস্টাট করে দেবেন বলে জানালেন।একজনকে ফোনে গল্পটা বলল।ওপাশের আগ্রহ দেখে ইনি অনেকক্ষণ ধরে বলে গেলেন।ফোন কাটার আগে মন্তব্য করতে শুনলাম।ছোটো ছেলে হলেও তার ও তো মান অভিমান রয়েছে।যেখানে তার কোম্ল আবেগ রয়েছে,সেখানে সে জোর করে ভালোবাসা চাইবে নাকি?

আজও কমন রুমে কেউ ছিল না।টক টক শব্দ করে কেবল দেওয়াল ঘড়িটা চলছে।টক টক শব্দটা নির্জনতা বাড়িয়ে চলেছে।একুশটা মুখ পুনরায় মনে পড়ল।ওদের পরীক্ষায় নাম্বার পাওয়া এবং কথাগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করা দুটিই সম্পূর্ণ পৃ্থক ব্যাপার।কিন্তু এভাবে আমি ভাবলে তো হবে না।

একটা ফোন এসেছে।ভাইব্রেশনে রাখা ফোনটির স্ক্রিনে দেখতে পাওয়া নাম্বারটা কিছুটা পরিচিত।

‘হ্যালো?’

‘স্যার,আমি অলক বলছি।‘

‘হ্যাঁ,বল। তুমি তো কিছুক্ষণ আগে ক্লাসেই ছিলে?’

‘হ্যাঁ,স্যার।ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি হোস্টেলে চলে এসেছি।

‘তাই নাকি?বল কেন ফোন করেছিলে?’

স্যার,আজকের ক্লাসে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন নাকি?

তুমিতো অন্যসময় এভাবে থাক না।

‘হ্যাঁ,স্যার থাকি না।আজকের আচরণের জন্য কিছু মনে করবেন না স্যার।অজয়ের বয়সেও আমার মা ও মাসির বাড়ি গিয়েছিল।বাবা প্রতিদিনই আসবে আসবে বলতেন।মা কিন্তু এল না স্যার।কখন ও আসবে না বলে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বড়ো হওয়ার পরে জানতে পেরেছিলাম।‘

অলক ফোনটা কেটে দিল।

ধীরু বহন পেটেলের একটা কল্পিত চেহারা আমার মনে পড়ল।

কমন রুমে কেউ না থাকাটা যে কত প্রয়োজনীয় কথা হতে পারে আজ পুনরায় অনুভব করলাম।

----------