শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে - পর্ব-৭

‘বিধাতা আসল জিনিস সৃষ্টি করেছেন বাজে জিনিসকে লালন করবার জন্য। তিনি সম্মান দেন ফলের আঁটিকে, ভালবাসা দেন ফলের শাঁসকে। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাত. নকল তীর্থযাত্রী

দীর্ঘ দু’মাস হাসপাতালে শুয়ে থেকে পাঁজরের হাড় জোড়া লেগেছে পানচুকের। ছুটি পেয়েই সে সার্জেন্ট আলোক মিত্রের কাছে বইটি নিতে যায়। আলোক বইটা সম্পূর্ণ পড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয়বারও পড়া হয়ে গেছে। সে তাই বইটা পানচুককে দিয়ে দেয়। পড়া না হলেও দিয়ে দিতে হতো। পরদিন সকালেই পানচুক তার গ্রামে ফিরে যাবে। আবার হয়তো মাস তিনেক পর ফিরবে। আবহাওয়া ভাল থাকলে আলোকও দু’দিন পর হেলিকপ্টারে লেহ্ ফিরবে। সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্ততঃপক্ষে ২০-২২ দিনের ছুটিতে আগরতলা যেতে চায়। অনেকদিন হয়ে গেছে অন্তরা-তোড়া, বাবা-মা আর অঞ্জনাকে দেখেনি সে। এই বই পানচুকের পারিবারিক সম্পত্তি। তার ঠাকুর্দা আর ঠাকুরমার প্রেমকথা লেখা রয়েছে যে। আলোকের মনে পড়ে সেই প্রেমিক দম্পত্তির দীর্ঘযাত্রার কথা। লহাসাগামী সেই নকল তীর্থযাত্রী দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল যে হাসিমুখ যুবকটি, তার ছোটবেলা ছিল বেশ কষ্টের। তার জন্মবৃত্তান্তও রহস্যাবৃত। তার মা ছিল এক ধনী কৃষকের ক্রীতদাসী। কিন্তু তার বাবা যে ঠিক কে ছিল সেই হদিশ এমনকি তার মা-ও ঠিকভাবে দিতে পারেনি।

সেই ধনী গৃহস্থের নাম লাগস্পা। ক্রমবর্ধমান ধন সম্পদ ও প্রতিপত্তি নিয়ে সে যথেষ্ট সুখী ছিল। কিন্তু অন্যদিকে তার স্ত্রীর কোনও সন্তানাদি না থাকায় একটা হতাশা তাকে কুরে কুরে খেত। অথচ যে যখন বলেছে তার পরামর্শ মেনে নানা দেবতার পায়ে অনেক মূল্যবান অর্ঘ্য চড়িয়েছে, গোম্পাগুলিতে উপঢৌকন পাঠিয়েছে, গরীব দুঃখীদের খোলা হাতে দান করেছে। অবশেষে এক ভ্রাম্যমান ভিক্ষু তাকে উপদেশ দেয় সস্ত্রীক পবিত্র খ্যাং তিসে পর্বতে যেতে। এই ভিক্ষুর কথায় এত প্রত্যয় ছিল যে লাগস্পাও বিশ্বাস করতে শুরু করে একবার খ্যাং তিসে ঘুরে এলে নিশ্চয়ই তার মনোকামনা পূর্ণ হবে। এই খ্যাং তিসে দর্শনে প্রতিবছর হিমালয় পেরিয়ে অসংখ্য ভারতীয় পুণ্যার্থী দল বেঁধে তিব্বতে আসে। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের মতন ঘটনাও এই পুণ্যার্থী দলকে থামাতে পারেনি। ভারতীয়রা খ্যাং তিসেকে বলে কৈলাস পর্বত। এই পর্বতের পাদদেশে রয়েছে পুণ্যতোয়া মান সরোবর বা মানস। অসংখ্য পরিযায়ী পাখি, সোনালী ও সাদা রাজহাঁস আর সারস সেখানে জলকেলি করে, পদ্মবনে লুকোচুরি খেলে। যদিও ওদের হোর কাঁঝে অঞ্চল থেকে খ্যাং তিসে অনেক দূরে, তিব্বতের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাত্রা করতে হবে। লাগস্পার স্ত্রী চসডন এই প্রস্তাবে খুব খুশি হয়। লাগস্পা এই যাত্রার জন্য তার তিন জন শক্তপোক্ত ভৃত্যকে বেছে নেন। চসডনের দেখাশোনার জন্যে সঙ্গে নেওয়া হয় দাসী নিয়ার্কিকে।

তারপর প্রায় তিনমাস ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘ যাত্রা। খ্যাং তিসে পৌঁছে একদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম। তারপর সেই পর্বতের বন্ধুর পথে পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে তারা সমস্ত দেবস্থানে পুজো দেয়। একেকবার পর্বত পরিক্রমায় তাদের দু’তিন দিন লেগে যায়। পর্বতগাত্রের নানা গুহায় তারা রাত কাটায়। ওই গুহাগুলিতে নাকি দেবতারা থাকেন, আর থাকেন তপস্যারত সন্ন্যাসীরা। লাগস্পা ও চসডন ভাবতো যে এই দেবতা কিম্বা ত্রিকালদর্শী সন্ন্যাসীদের মধ্যে কেউ নিশ্চয়ই একদিন ওদের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে বর দেবে। তারা একটি পুত্র সন্তান চায়। তাদের ভৃত্যরা তিনজনই ছিল সন্তানের জনক আর নিয়ার্কি অবিবাহিতা। তারাও মনিবের পুত্রকামনায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লক্ষবার ‘ওম মণিপদ্মে হুম’ জপ করতে করতে সঙ্গে আনা অসংখ্য ধূপকাঠি আর মোমবাতি জ্বালিয়ে পবিত্র গুহাগুলিতে ঘুরে বেড়ায়, অনেক রাত কাটায়। কিন্তু কোনও দেবতা কিম্বা সন্ন্যাসী ওদেরকে বর দেয় না। এদিকে তাদের সঙ্গে আনা রসদ ফুরিয়ে আসছে, এতটা দীর্ঘপথ ফিরতেও হবে। অবশেষে লাগস্পা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু তার এই হতাশা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাঝপথেই চসডন তাকে জানায় যে সে এবার নিঃসন্দেহে মা হতে চলেছে। এই খবর শুনে লাগস্পা ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। রাতে তার স্ত্রীকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের জন্য আরও বিস্ময় যে অপেক্ষা করে ছিল কে জানতো! বন্ধুর পথে চলতে চলতে কয়েকদিন পর চসডন লাগস্পাকে নিয়ার্কির মা হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায়। একথা শুনে লাগস্পার মাথায় হাত।

খ্যাং তিসের গুহায় লাগস্পা চসডনকে বেশ কয়েকবার কাছে টেনে নিয়েছে। চসডনের পা ভারী হয়েছে প্রাকৃতিক কারণে। কিন্তু নিয়ার্কির ব্যাপারটা যে বিস্ময়কর। তিনজন ভৃত্যই সৎ এবং বিশ্বাসযোগ্য। তারা কেউ নিয়ার্কির সঙ্গে কিছু করেনি বলে সাফ জানিয়ে দেয়। নিয়ার্কিও কাউকে দায়ী করে না। তাহলে?

চসডন ও লাগস্পার জেরার মুখে নিয়ার্কি এক অদ্ভুত গল্প শোনায়। একদিন রাতে সে মনিবের কল্যাণ কামনায় ‘ওম মণিপদ্মে হুম্’ জপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ পর সে জানে না, কারও হাতের স্পর্শে তার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে দেখে যে তার পাশে শুয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে খ্যাং তিসের ঈশ্বর কৈলাসপতি শিব। প্রদীপের নিভু নিভু আলোয় ওই প্রবল শীতে সারা গায়ে কোনও বস্ত্র নেই। শুধু কোমরে বাঘের ছাল। চেহারা চাঁদের মতন ফ্যাকাশে আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। নিয়ার্কি ভয় ও ভক্তিতে অবশ হয়ে যায়। সে ছুটে পালানোর কথা এমনকি চিৎকার করার কথাও ভাবতে পারেনি। ঈশ্বরকে প্রতিহত করার শক্তি কার আছে?

লাগস্পা এমনিতে ধর্মপ্রাণ এবং সরল বিশ্বাসী। জ্যোতির্ময় ঈশ্বর যদি তার স্ত্রী কিম্বা তাকে স্বপ্নে বা জাগরণে দেখা দিয়ে আশীর্বাদ করতো সেটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো। কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে ঈশ্বর খামোখা নিয়ার্কির মতন এক কুমারীর সঙ্গে শারীরিক মিলন কেন ঘটালো সে কথা তার মাথায় ঢুকছিল না। যিনি ঈশ্বর, একটি কুমারীকে গর্ভবতী করার আগে তিনি দু’বার ভাববেন না? এটা সত্যি যে ধর্মগ্রন্থে এ ধরণের কিছু পৌরাণিক জন্মবৃত্তান্তের কথা লেখা রয়েছে, কিন্তু সেগুলি তো অনেক অনেককাল আগের কথা। এহেন অলৌকিক ঘটনা শুধু তাদের দাসী নিয়ার্কির সঙ্গেই কেন ঘটবে?

নিয়ার্কি এত অপাপবিদ্ধ ভাল মেয়ে যে তার কথা অবিশ্বাস করারও কোনও উপায় নেই। তবে হিন্দু দেবাদিদেব মহাদেবের স্থানে কোনও বাঘছাল পরিহিত নাগা সন্ন্যাসীও এই কর্ম করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ হয়। লাগস্পা খ্যাং তিসে পরিক্রমার পথে এমন কয়েকজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে দেখেছে যারা খালি গায়ে ছাইভস্ম মেখে কোমরে চিতাবাঘের ছাল পরে তপস্যা করে, কিম্বা এমনি কমণ্ডুল হাতে নিয়ে পর্বত পরিক্রমা করতে থাকে। মুখেও ভস্ম মাখে বলে তাদের চেহারাও চাঁদের মতন ফ্যাকাশে। কেউ ওদের কাউকে একান্ত দেখে সাক্ষাৎ শিব ভেবে ভ্রম করতেই পারে। সরলমতি নিয়ার্কিও নিশ্চয়ই তেমনি কোনও ভণ্ডকে দেখেছে। সে খ্যাং তিসেতে তপস্যা করতে এসেও কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এমনি অনেক ভণ্ডই হয়তো এক গুহা থেকে আরেক গুহায় ঘুরে বেড়ায়, পশুপাখি মেরে ঝলসে খায় আর এ ধরণের কুকর্ম করে।

কিন্তু নিয়ার্কিকে এই সম্ভাব্য বাস্তব কে বোঝাবে? তাহলে সে যে শিশুসুলভ স্বপ্নের পবিত্র ভাবনা লালন করছে তার জায়গায় লজ্জা ও পাপবোধ সরল মেয়েটির জীবন দুর্বিসহ করে তুলবে। ধর্মপ্রাণ লাগস্পা ও চসডন তাই হাসিমুখে নিয়ার্কির ভাবী সন্তানের অলৌকিক পিতৃত্বকে মেনে নেয়। লাগস্পা তার যাত্রাসঙ্গী তিন ভৃত্যকেও নিভৃতে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে। তারা যেন গ্রামে ফিরে গিয়ে বলে খ্যাং তিসে যাওয়ার পথে নিয়ার্কির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই তার স্বামী মারা গেছে। ভৃত্যরা ওর গা ছুঁয়ে শপথ নেয়। কিন্তু ওরা মনে মনে ভাবে যে, নিয়ার্কির গর্ভের সন্তানটি নির্ঘাত তাদের মনিবেরই।তিনি হয়তো সন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নিশ্চিত হতে নিজের স্ত্রী এবং পরিচারিকা দু’জনকেই গর্ভবতী করে ফেলেছেন। চসডন নিয়ার্কিকে সাবধান করে যাতে সে গ্রামে ফিরে কাউকে অলৌকিক সন্তান প্রাপ্তির কথা না বলে।

নিয়ার্কি গ্রামে ফিরে প্রতিবেশিনীদের প্রশ্নের মুখে মনিবের শেখানো বিয়ের অব্যবহিত পরই স্বামীর মৃত্যুর গল্প বলে। কিন্তু সে বানিয়ে গল্প বলায় পারদর্শী ছিল না। তাই প্রতিবেশিনীরাও ওই তিন ভৃত্যের মতন ভেবে নেয় যে নিয়ার্কির গর্ভে লালিত হচ্ছে লাগস্পারই সন্তান।

বাড়ি ফেরার কয়েকমাস পরই প্রথমে চসডন ও তারপর নিয়ার্কির বাচ্চা হয়। দু’টো ছেলে। লাগস্পা নিয়ার্কির সন্তানের নাম রাখে ‘গরব’, আর মনে মনে তাকে আশীর্বাদ করে যাতে সে সারাজীবন আনন্দে থাকে।

গরবের শৈশবকে একরকম ঘটনাহীন বলা যায়। মনিবের ছেলের সমবয়সী হওয়ায় ওর খেলার সঙ্গী, একটু বড় হলে সহপাঠী। তিব্বতের সমস্ত সম্পন্ন মানুষ যা করে লাগস্পাও তেমনি ওদেরকে ধর্মগ্রন্থ পড়ে নীতি-শিক্ষা দেওয়ার জন্যে একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করে। নীতি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি অক্ষর জ্ঞান এবং পুজো পদ্ধতিও শেখান। গরব মনিবের ছেলের থেকে বয়সে কয়েকদিনের ছোট হলেও ওর থেকে অনেক আগেই গড়গড় করে পড়তে, লিখতে এবং হিসেব রাখতে শিখে যায়। চেহারায়, স্বাস্থ্য এবং শক্তিতেও সে এগিয়ে থাকে। লাগস্পা একদিন গৃহশিক্ষকের কাছে ছেলেদের পড়াশুনোর অগ্রগতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি গরবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ; ওর বুদ্ধির প্রশংসা করেন।

সামান্য দাসীর ছেলে ওর নিজের ছেলের থেকে এভাবে সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা লাগস্পার ভাল লাগে না। সে পরদিন থেকেই গরবের পড়া বন্ধ করিয়ে তাকে মাঠের কাজে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু গরব ততদিনে গৃহশিক্ষক যা যা শেখাতে পারেন প্রায় সবই রপ্ত করে নিয়েছে। মাঠের কাজেও তার কোনও অসুবিধে হয় না। ছোটবেলা থেকেই সে একগুঁয়ে, জেদি এবং প্রচণ্ড অহংকারী।

দাসীর ছেলেকে লাগস্পা ক্রমে ভৃত্যে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু গরব মাঠের কাজেও পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং কর্তৃত্ব করতে শুরু করে।

সে তার মাকে বেশ কয়েকবার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। নিয়ার্কি প্রতিবারই একই জবাব দেয়, - তোর বাবা তুই পেটে থাকতেই মারা গেছে। কিন্তু কৈশোরে প্রতিবেশীদের কারও কারও মন্তব্য শুনে এবং শুরুতে ওর প্রতি লাগস্পার একটা অপত্য স্নেহ টের পেয়ে সে একবার মাকে বলে, তুমি বিধবা নও, এটা মিথ্যে। আমি শুনেছি লাগস্পাই আমার বাবা, তুমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর আমি তারই ছেলে। তাহলে আমরা কেন চাকরদের জন্য নির্দিষ্ট কুড়ে ঘরে থাকি, বাবার প্রথম স্ত্রী ও আমার ভাইয়ের সঙ্গে একই বাড়িতে কেন থাকি না?

বেচারা নিয়ার্কি গরবের এই প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আর মিথ্যে চেপে রাখতে পারে না। সে কেঁদে ফেলে। অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে পবিত্র পর্বতের পাদদেশে নিজের জীবনের অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বলে। সে বলে, তুই মনিবের ছেলে নোস, এই বাড়ি, ও বিষয় সম্পতির উপরও তোর কোনও অধিকার নেই। তবে তোর বাবা আমাদের দয়ালু মনিব থেকেও অনেক মহান এবং শক্তিশালী; তিনি কৈলাসপতি ঈশ্বর।

মায়ের কথা শুনে গরব হতভম্ব। মায়ের কান্নার ভাষা থেকে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে সে লাগস্পার সন্তান নয়। কিন্তু সে যে স্বয়ং ঈশ্বরের ঔরসজাত- তা-ও বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। সে ভাবে, মায়ের নিশ্চয়ই মাথায় ছিট রয়েছে, শান্ত এবং মিতভাষী বলে বোঝা যায় না। নিশ্চয়ই কোনও ভ্রম তার জন্মকে রহস্যবৃত করে রেখেছে। কোনওদিন যদি মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে, তাহলেই তার জন্মের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য কোনও তথ্য পাওয়া সম্ভব।

কিন্তু তার আঠারো বছর বয়সেই মা মারা যায়। অন্ত্যোষ্টির পরদিনই গরব সোজা গিয়ে লাগস্পার ঘরে ঢোকে। তারপর তার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, সত্যি করে বলুন তো আমি আপনার সন্তান কিনা? লোকে যা বলে সবই মিথ্যে?

লাগস্পা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকে। গরব বলে, যদি মিথ্যে না হয় তাহলে আমাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করুণ, আমি আপনার চাকর হয়ে থাকতে চাই না?

গরবের এই ঔদ্ধত্য লাগস্পাকে আহত করে। সে নিজেকে সামলে কঠিন আওয়াজে বলে, না, তুই আমার ছেলে নোস। তোর মা কি কখনও এমন কথা বলেছে যে, সে আমার বউ, কিম্বা তুই আমার ঔরসজাত? গরব কেমন দমে গিয়ে বলে, না, মা আগে বলতো আমার বাবা মরে গেছে। তারপর একদিন চেপে ধরাতে কেঁদে কেটে বলে, আমি নাকি হিন্দু দেবতা শিবের সন্তান। এসব কথা আমি কেমন করে বিশ্বাস করি? সে বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। ওর লাল আয়ত চোখ দুটি, সুঠাম শরীর আর কান্না লাগস্পাকে নরম করে দেয়। সে বলে, তোর মা যদি গল্পও বলে থাকে, সেটাই তার জীবনের পরম সত্য; সে তাই বিশ্বাস করতো। তুই যদি বেশি বাস্তববাদী হয়ে অবিশ্বাস করিস বা মা সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবিস, তাহলে ওর স্মৃতির প্রতি অবিচার করবি, পাপ করবি।

লাগস্পা উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বলে, তুই এখন বড়ো হয়েছিস, সব কথা খুলে বলা যায়, বলা উচিত ও। তাহলে শোন –

লাগস্পা ওর খাটে বসে গরবকে তাদের খ্যাং তিসে যাত্রার কথা বিস্তারিত বলে। এবং গরবের পিতৃত্ব সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণার কথাও বলে। সে বলে, খ্যাং তিসে পরিক্রমার পথে এমন কয়েকজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে দেখেছি, তাঁরা ওই কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও খালি গায়ে ছাইভস্ম মেখে কোমরে চিতাবাঘের ছাল পরে তপস্যা করে কিংবা তেমনি ক্মন্ডলু হাতে নিয়ে পর্বত পরিক্রমা করতে থাকে। মুখেও ভস্ম মাখে বলে তাঁদের চেহারাও চাঁদের মতন ফ্যাকাশে। কেউ ওদের একান্তে দেখে হিন্দু দেবতা মহাদেব ভাবতেই পারে! তোর মা, সরলমতি নিয়ার্কিও হয়তো তেমন কোনও ভণ্ডকে দেখেছে যে পবিত্র খ্যাং তিসেতে তপস্যা করতে এসেও কামনা – বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। অনেক ভণ্ডই হয়তো এক গুহা থেকে আরেক গুহায় ঘুরে বেড়ায়, পশু-পাখি মেরে ঝলসে খায় আর সুযোগ পেলে এ ধরনের কুকর্ম করে!

ওর কথা শেষ হলে কিছুক্ষণ দু’জনেই থম মেরে বসে থাকে। সারারাতের ছারপোকার কামড়ের জ্বালা তখন বাইরের চামড়া ছেড়ে সমগ্র অস্তিত্বে ছেয়ে যায়। গরবের চোখ দু’টি টকটকে লাল হয়ে পড়ে। চেহারা দেখে বোঝা যায় যে তার ভেতরে ঝড় উঠেছে। লাগস্পা তা অনুভব করে কিছুক্ষণ সময় নেয়। তারপর ধীরে ধীরে নরম স্বরে বলে, তোর মা নিস্পাপ, ভালো মেয়ে, তোর লালন-পালনে কোনও ত্রুটি রাখিনি, ভবিষ্যতেও রাখবো না। কিন্তু তোর মা মুক্ত মানুষ ছিল না। তার মা বাবা কিম্বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমা যেমন আমার পূর্বপুরুষদের দাস ছিল, তেমনি সে-ও আমাদের দাসী ছিল। মাথা থেকে আজেবাজে চিন্তাগুলি ঝেড়ে ফেল। তুই চাইলেই অন্য কোথাও চলে যেতে পারিস না। এই বাড়িতেই থাকবি, আর যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হবে তা খুশিমনে পালন করবি।

একটু হেসে গলা ঝেড়ে আবার বলে, সুন্দরী মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দিয়ে দেব। সন্তানসন্ততি নিয়ে সুখে সংসার করবি! তোর বা তোর বংশধরদের খাওয়া পরার কোনও অভাব হবে না। বুড়ো বয়সেও থাকার জায়গা পাবি।

মনিবের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত গরব তার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর প্রথামাফিক সম্মানসূচক সম্বোধন না করেই দরজা খুলে ওই ঘর থেকে চলে যায়। খড়ের গাদা থেকে একবোঝা খড় নামিয়ে নিয়ে গিয়ে আস্তাবলে ঢোকে। ঘোড়াগুলিকে খড় খেতে দিয়ে ভালোভাবে ওদের পরিষ্কার করে দিতে থাকে। দুপুরে রান্নাঘর থেকে গরম ভাতের মাড় এলে তাতে মাখন মিশিয়ে তার প্রিয় ঘোড়াগুলিকে খেতে দেয়। তারপর গিয়ে পুকুরের শীতল জলে ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করে। কনকনে ঠান্ডায় তার দাঁতি লাগার উপক্রম হলে উঠে আসে। কিন্তু কোনওমতেই তার গায়ের জ্বালা কমে না। সে তাক থেকে পুরোনো খাতা নামিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় একটি চিঠি লিখতে শুরু করে।

লাগস্পা মনে মনে ভাবে, ছেলেটা দুর্বিনীত হয়ে পড়েছে। ওর ভেতরের ঝড়টা থামুক, কালই আর একবার ওকে ডেকে স্নেহ মিশিয়ে কথা বলতে হবে, তাতেও কাজ না হলে গ্রামের মানুষের সামনে কয়েক ঘা চাবুক কষাতে হবে। পরদিন সকালেই তা করতে হবে, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।

কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লাগস্পা তার শোওয়ার ঘরের দরজার সামনে একটা চিরকূট পড়ে থাকতে দেখে। হাতে তুলে নিয়ে বোঝে এটা গরবের লেখা চিঠি। সে লিখেছে, আকু লাগস্পা, আমার চিন্তা-ভাবনা আপনার থেকে আলাদা। আমার পক্ষে আপনার ছত্রছায়ায় থেকে আজীবন গোলামি করা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, প্রত্যেক কাজের পারিশ্রমিক থাকা উচিত। আপনার কাছে শুনলাম, আমার মা, দিদা, দাদুরা বংশপরম্পরায় আপনার পরিবারের সেবা করে আসছেন। বিনিময়ে আপনারা তাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান দিয়েছেন; কিন্তু কোনও পারিশ্রমিক কিম্বা স্বাধীনতা তাদের দেননি। আমাকেও আপনি এতদিন লালনপালন করেছেন। আমিও আপনি যখন যা করতে বলেছেন নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেছি। এখন আমি এই বংশপরম্পরায় সেবার পারিশ্রমিক হিসেবে যা পাওয়া উচিত তার এক সহস্রাংশ (বা তার থেকেও কম) আপনার থেকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার আস্তাবলের সবচাইতে তেজি ঘোড়াটি আর জিনের থলে ভর্তি শুকনো খাবার। আগামীকাল সূর্য ওঠার আগেই আমি অনেক দূরে চলে যাবো, তারপর আরও আরও দূরে। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।

সত্যি সত্যি সারারাত কনকনে শীতে লাগাতার ঘোড়া চালিয়ে সে ভোরের আগেই কৈশোরের গ্রাম ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে অনেক দূর এগিয়ে যায়। সূর্যোদয়ের পর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা কমে। বাতাস প্রাণবন্ত হয়। গরবের মনে ক্রমে একটি জোরালো আনন্দ, এক অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় পুলক জেগে ওঠে।

-সে এখন মুক্ত। সমস্ত দুরূহ গাধার খাটনি থেকে মুক্তি, অন্যের আদেশে কলের পুতুলের মতন চলা থেকে মুক্তি। সে একবার ঘোড়া থেকে নেমে বুক ভরে তাজা বাতাস নেয়। এই বাতাস তাকে আনন্দে মাতোয়ারা করে তোলে। সে ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে মুখমণ্ডলে চুমু দিতে থাকে। তারপর আবার ওটার পিঠে চেপে চারপাশে প্রকৃতির দিকে একজন বিজয়ীর দৃষ্টিতে তাকায়। ঘোড়াটি তার অনুমতি ছাড়াই দুলকি চালে চলতে শুরু করে। বাতাস সতর্ক করে, সা-ন-ধা-ন। কৈ-লা-শ-পু-ত্র-জ-য়-যা-ত্রা-য় চ-লে-ছে-ন।