মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ২৪

আমার পাপেই উশকে উঠুক মহেশ্বরের প্রলয় পিনাক

সর্বনাশের সীমায় সবাই যায় যদি তো শেষ হয়ে যাক

- শঙ্খ ঘোষ

# চব্বিশ

দেচমা লক্ষ্য করেছে যে, গরব সাধারণতঃ তার প্রেমিকার ছোটোবড়ো সমস্ত ইচ্ছাপূরণের জন্য উদগ্রীব থাকে। দুর্ধর্ষ এক ডাকাত সর্দার, দেচমার স্বপ্নপুরুষের কাছে এই গুরুত্ব দেচমা মনে মনে খুব উপভোগ করে। যদিও নিজের ব্যবহারে এই উপভোগের ব্যপারটা গরবকে বুঝতে দিতে চায় না। কিন্তু ওরা কবে পরিক্রমায় যাবে, খ্যাং তিসে থেকে ফেরার জন্য কবে রওয়ানা হবে, দেচমার এই প্রশ্নের জবাব গরব দেয়নি। এই এড়িয়ে যাওয়া তাঁকে অবাক করে।

একদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলে গরব কোথাও বেরিয়ে পড়ে। দেচমা এবং ওর সঙ্গীরা ভাবে, গরব হয়তো নিজের ও ডাকাত দলের সকলের পাপস্খলনের জন্যে এবং ভাবী অভিযানগুলির জন্যে আশীর্বাদ চেয়ে কোনও গোপন ধর্মীয় আচার পালন করছে। ওদের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শুকনো খাবার মজুত রয়েছে। তাছাড়া যাযাবরদের কাছ থেকে প্রতিদিন টাটকা জমানো দুধ আর ৎসো মাফামের ঢেউয়ে ভেসে আসা তাজা মাছ। তিব্বতিদের ভাড়ারে যথেষ্ট খাবার থাকলে তারা আর কিছু নিয়ে চিন্তা করে না। তাই দেচমা ক্রমে মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠলেও অন্য দুই সঙ্গী ধৈর্য হারায় না। দেচমা অনুভব করে, কয়েকমাস ধরে তীব্র আশ্লেষে লাগাতর রাতের পর রাত জাগা আর মাঝে লাহসায় কয়েকদিন বিশ্রামকে ছেড়ে দিলে প্রায় প্রত্যেকদিন সারাদিন ঘোড়ায় চড়ার ফলে একটা শিথিলতাও যেন গ্রাস করেছে গরবকে। চলনে বলনে কাউকে সে তা টের পেতে না দিলেও দেচমা ঠিক টের পায়। খ্যাং তিসের পাদদেশে এই তারচেন পৌঁছনোর পর প্রথমরাত ছেড়ে দিলে সে একটিবারের জন্যেও দেচমাকে বুকে টেনে নেয়নি। প্রথমরাতে বুকে জড়িয়ে শুয়েছিল। তারপর থেকে পাশাপাশি শুয়েও এক শরীর অবশ করা আলস্যে গা - হাত - পা ছেড়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে ওঠে। তারপর আর ঘুম আসতে চায় না, এক অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে গ্রাস করে।– কেন?

সেদিন কাউকে না বলে গরব ঘোড়া চালিয়ে পৌঁছে যায় লাংগাক - এর কাছে। দোংগলের কাছে শুনেছে , এই হ্রদ থেকে সাতলেজ বা শতদ্রু নদীর জন্ম। পশ্চিমদিকের হস্তীমুখ বা লাংচেন খাম্বার থেকে এর শুরু। এই হ্রদেই নাকি লুকিয়ে আছে কুবেরের ভাণ্ডার। এখানকার বালিতে এখনও স্বর্ণভস্ম পাওয়া যায়। এই ভস্মে তিব্বতিরা কখনও হাত দেয় না। একবার এখানকার যাযাবররা এই হ্রদ থেকে একটা সোনার পাথর দলাই লামাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে, এই স্বর্গীয় সম্পদে মানুষের অধিকার নেই। তারপর সেই বিশাল পাথরটাকে আবার ৎসো লাংগাকের মাটির নীচে ডুবিয়ে রাখা হয়। এখানেও কয়েকটি রাজহাঁস দেখল গরব। তখনই দলাই লামার কথা মনে পড়ায় মন খারাপ লাগে। না জানি প্রভূ আবার কোথায় জন্ম নেবেন! সে আবার ঘোড়ায় বসে তারচেন ফিরে আসে।

যাযাবরদের কাছ থেকে এসে ৎসোণ্ডু তিনটে লোহার কড়াই ভাড়া নিয়েছে। আর কিনেছে কয়েক বোঝা লাকড়ি ও কয়েক বস্তা কাঠকয়লা। সেগুলি জ্বালিয়ে দিনরাত ওদের তিনটে তাঁবুকে গরম রাখে। সেদিন রাতে এমনি ঘুম ভেঙে গেলে ওই কড়াইয়ে জ্বলতে থাকা ধিকিধিকি আগুনের সামান্য আলোয় গরব দেখে যে দেচমা কম্বলের নীচে ছটফট করছে। এমন ছটফট যেন সে কারও সঙ্গে যুঝছে।

গরব সচেতন হয়ে ওকে ডাকার আগেই সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। গরব ভাবে, বাজে স্বপ্ন দেখছে হয়তো। সে দেচমার গায়ে একটা হাত রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করে।

কিন্তু শেষরাতে আবার দেচমার আর্ত চিৎকার ও ছটফটানিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। এবার সে অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করতে থাকে, গো গোঁ শব্দ করতে থাকে। গরব তাড়াতাড়ি তার কম্বলে ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, দেচমা...দেচমা... কী হল সোনা , কী হলো তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?

দেচমা আধো ঘুমে বলে, তুমি আমাকে আগলাচ্ছ না কেন? ওকে যেতে দেখেছ?

— কাকে? কার কথা বলছ? গরবের ঝাঁকুনিতে দেচমা এবার পুরো জেগে উঠে জিজ্ঞেস করে, কী বললাম আমি?

গরব বলে, ছটফট করছিলে, চিৎকার করে উঠেছিলে, তারপর কিন্তু বিড়বিড় করছিলে, তোমার শরীর খারাপ? তুমি তো ভিতু মেয়ে নও!... হয়তো বদহজম হয়েছে।

দেচমা বলে, কী জানি কী হয়েছে!

গরব ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে, আবার ঘুমিয়ে পড়ো!

দেচমা বাধ্য মেয়ের মতন কম্বলে মুখ ঢেকে বলে, তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফিরে চলো, আমার ভাল লাগছে না!

তারপর দেচমা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। গরবও দেচমার কাছ ঘেঁষে কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ওকে জড়িয়ে ধরে না। সে যেন কিছুর অপেক্ষায়, কিছু জানতে চায়। কিন্তু সে রাতে আর তেমন কিছু ঘটে না। সে-ও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে সে দেচমাকে বলে, ৎসোণ্ডু আর গোরিংকে বলছি যাযাবরদের সঙ্গে কথা বলে খচ্চর, ঘোড়াগুলির যত্নের ব্যবস্থা করতে। আগামীকালই আমরা খ্যাং তিসে প্রদক্ষিণে যাব।

সেদিনই নানারঙের মহোৎসবের মাধ্যমে নীই-গের পর আকাশের আলোগুলি যখন ফিকে হচ্ছিল তাঁবু থেকে সামান্য দূরে একটি পাথরে হেলান দিয়ে বসে খ্যাং তিসের পাদদেশে অন্ধকার নামছে দেখে আজ রাতে দেচমা কী করবে তাই ভাবছিল গরব। তখনই সে হঠাৎ নিজের চারিদিকে একটি অদৃশ্য শক্তির চাপ অনুভব করে। প্রবল শক্তিশালী কিছু একটা যেন তার চারপাশে জমাট হয়ে জোর করে ওকে চেপে ধরে ওর মুখ দিয়ে কিছু ঢোকাতে চায়। অথচ দিনান্তের আলোয় সে তখনও সামনের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সে একা, দৃশ্যমান কোনও কিছু তাকে স্পর্শ করেনি, কিন্তু একটা তীব্র চাপ ওকে যেন চ্যাপটা করে দেবে। এমন সময় কোনও তিব্বতি পুরুষের যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া হত, গরবও তেমনি এক হ্যাঁচকায় আলখাল্লার কোমরবন্ধ থেকে খুকরি বের করে শূন্যে বনবন করে ঘোরায়। আর এতেই কাজ হয়। তার চারপাশের চাপটা সরে যায়।

বুকভরে শ্বাস নিয়ে সে তাঁবুর দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু মনে হয়, অদৃশ্য কিছু একটাও তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। আর একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘুরে খুব জোরে খুকরি চালনা করে আরেকবার নিজেকে মুক্ত করে। সেভাবে আশপাশের এলাকায় শিকারে ব্যস্ত কোনও দৈত্য নিশ্চয়ই ওর আর দেচমার ক্ষতি করার জন্যে পেছনে পড়েছে। ওদের মতন পাপীদেরকে এই দৈত্যর হাত থেকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা কি করবেন দৈত্য - দানোদের মনিব এই খ্যাং তিসের দেবতা! যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে ফিরতে হবে।

গরব ভাবে, বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়িয়ে ওরা ওই ভয়ানক অশরীরীর বিছানো ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। পরদিন ভোরেই ফেরার জন্য রওয়ানা হতে হবে। কিন্তু তাঁবুতে ফিরে সে দেচমা কিংবা দুই সঙ্গীকে এ ব্যাপারে কিছুই বলবে না! ফেরার ব্যাপারে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করতে চায় না। তিব্বতি বিশ্বাস অনুযায়ী শুধু শব্দ করে বললেই অশরীরীরা শুনতে পায়। কারও মনের কথা ওরা বুঝতে পারে না!

এদিকে গোরিং, ৎসোণ্ডু আর দেচমা পরদিন সকালে উঠে খ্যাং তিসে প্রদক্ষিণের জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। তাদেরকে না জানিয়েও কেমন করে ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবে গরব। সেদিন রাতের গরম চা ও ৎসাম্পা বিস্বাদ ঠেকে। খ্যাং তিসে প্রদক্ষিণ না করে সরাসরি ফিরে গেলে ৎসোণ্ডু, গোরিং এবং তাদের মাধ্যমে দলের অন্য সদস্যদের মনে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে না তো?

কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।

মাঝরাতের দিকে হঠাৎ ভীষণ ঠাণ্ডায় ঘুম ভেঙে যায়। গরব কম্বল থেকে মুখ বের করে দেখে তাঁবুর পর্দাটি অর্ধেক খুলে গিয়ে পতপত করে উড়ছে। সেই ফাঁক দিয়ে তাঁবুর ভেতরে চাঁদের আলো ঢুকছে। তাছাড়া কড়াইয়ের বিকিধিকি আগুনের আভার মিলিত আলো-আঁধারিতে গরব এক নগ্ন পুরুষের আকৃতি দেখতে পায়। এক নাগা সন্ন্যাসী, সারা শরীরে ছাই ভস্মমাখা, তাঁর ঠোঁট দেচমার ঠোঁট চেপে ধরে আছে।

গরব তৎক্ষণাৎ হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু তার আগেই ওই অবধূত দ্রুত পালিয়ে যায়। তাঁবুর দরজার পর্দাটা একবার ফাঁক হয়ে আবার বন্ধ হতে দেখে গরব নিজেও ছুটে তাঁবুর বাইরে বেরোয়। কিন্তু বাইরে জ্যোৎস্নাধৌত তুষারাবৃত চারপাশে কোনও কিছুই দেখতে পায় না। সে তবুও হাতে খুকরি বাগিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁবুর চারপাশে কয়েকবার দ্রুত পরিক্রমা করে। গোরিং আর ৎসোণ্ডুর তাঁবু থেকে দু' জনের নাকের ডাক শোনা যায়। ওরা ঘুমোচ্ছে। গরব অনুভব করে, অদৃশ্য কিছু শুধু দেচমা ও গরবকেই বারবার আক্রমণ করছে। রূপে অরূপে ভয় দেখাতে চাইছে। তাঁবুতে ঢুকে দেখে দেচমা অকাতরে ঘুমোচ্ছ। কিন্তু গরবের চোখে আর ঘুম আসে না। খুকরি বাটটা হাতে চেপে ধরে থেকে ছটফট করতে করতে রাত কাটে। ভোরে দেচমার ঘুম ভাঙলে গরব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে, ঘুম ভাল হয়েছে? দেচমা নীরবে মাথা নাড়ে। গরব জিজ্ঞেস করে, আজ কোনও স্বপ্ন দেখনি? অনেকসময় ঈশ্বর খুশি হয়ে তীর্থযাত্রীদের নানা স্বপ্ন দেখান!

দেচমা মাথা নেড়ে বলে, না!

কিন্তু তার গলা কাঁপে। তার মানে কি সে কিছু লুকোচ্ছে? গরব তাকে আর কোনও প্রশ্ন করে না। সে নিশ্চিত যে সে কোনও স্বপ্ন দেখেনি । নিজের চোখে ওই ছাইভস্ম মাখা দাড়িগোঁফহীন সন্ন্যাসীকে চুমু খেতে আর তারপর তার হুঙ্কার শুনে পালিয়ে যেতে দেখেছে। না হলে গরব উঠে পেছন পেছন ধাওয়া করবে কেন?

এই আজব হানাদার কে? সে কী সেই দৈত্যেরই মায়ারূপ যার প্রবল চাপ সে গত সন্ধ্যায় অনুভব করেছে। নাকি কোনও সত্যিকারের সন্ন্যাসী তার মায়ায় জাদুতে অদৃশ্য হয়ে ওদেরকে কোনও অজানা লীলার নিমিত্ত করে তুলছে? যাই হোক না কেন, গরব নিশ্চিত যে অদৃশ্য আগন্তুক দেচমার সৌন্দর্যে অভিভূত এবং তাকে ভোগ করতে চায়। এক্ষেত্রে দেচমা কতটা অসহায় তা সে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করে। তাছাড়া ঘুমের মধ্যে দেচমার সেই ছটফটানি, প্রথম রাতের কাতর গোঙানি, আর আধোঘুমে সেই প্রশ্ন, আমাকে আগলাচ্ছ না কেন, ওকে যেতে দেখেছ?

তার মানে দেচমা বারবার এই বিভীষিকার শিকার হয়েই এখান থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার অনুরোধ করেছে। কিন্তু সে গরবকে সব খুলে বলছে না কেন? অশরীরী সন্ন্যাসী যখন ওকে চুমু খাচ্ছিল ও কি একদমই টের পায়নি? এটা কেমন করে সম্ভব?

গরব না জানি কেন ওর চোখে দেখা ঘটনাপ্রবাহকে একদমই মেনে নিতে পারছিল না। তার চোয়াল শক্ত হয়। সে এর শেষ দেখতে চায়। সেজন্যই এক যাযাবর যুবককে ওদের ঘোড়াগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে খ্যাং তিসে প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়ে। কিছুটা এগিয়েই ওরা পায় ঝর্নার মতন একটি স্রোতধারা। দু ’ ধারের বরফ তখনও সম্পূর্ণ গলেনি। এই স্রোতধারার নাম লা - ৎচু। ঝোরাটির পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পেমা ফুক নামক একটা জায়গায় হাল্কা কাঠের সেতু পার হতেই একতলা একটা বাড়ির নাম নীয়াংরি গুম্ফা। খ্যাং তিসে পরিক্রমার পথে এটাই প্রথম গুম্ফা। এই ধরনের আরও চারটে গুম্ফা কৈলাসের চারদিকে রয়েছে। গুম্ফার কাছে যেতেই দু ' জন কচি লামা বেরিয়ে এসে ওদের শুভেচ্ছা জানায়। ওরাও হেসে তাদের অভিবাদন জানিয়ে লা - ৎচুকে ডানদিকে রেখে পাহাড়ে উঠতে থাকে।

পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যই এই যে কাছে গেলেই তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে যায়। ত্রয়োদশ দলাই লামার কাছে গিয়েও গরবের এমনি অনুভব হয়েছিল। দূর থেকে যে বিশাল ব্যাপ্ত সুন্দর রূপ চোখে পড়ে কাছে গেলে সেই বিরাটের অংশমাত্র চোখে পড়ে। সেই বিরাট আরও হাজার গুণ বিরাট হয়ে অভিযাত্রীকে করে তোলে আরও ছোট। খ্যাং তিসের পাদপীঠে চলতে গিয়ে ওরা যেন ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে। সেখান থেকে খ্যাং তিসের চূড়া দেখা যায় না। ঠিক যেমন মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে মন্দিরের চূড়া দেখা যায় না। অবশ্য বাঁদিকের অন্য কয়েকটি তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়। সেই বরফ সবে গলতে শুরু করেছে। ছোটো ছোটো অসংখ্য ঝিরঝিরে ঝর্নাধারা মাঝে মধ্যে একসঙ্গে মিলে তৈরি করেছে অসংখ্য খরস্রোতা । এ অঞ্চলে কোনও গাছপালা নেই কিন্তু পাথর আর বরফের লুকোচুরিতে সৃষ্টি হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক মায়াজগৎ। চলার কষ্ট আছে কিন্তু এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে সেই কষ্ট পুষিয়ে যাচ্ছে। নদীর ধার ধরে ওরা যতটা দ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে এগোচ্ছে।

অনেকক্ষণ হাঁটার পর আরও একটা গাছের গুঁড়িপাতা সেতু পার হলে আরেকটি বাড়ির দরজার সামনে ওরা দেখে তিব্বতি লিপিতে লেখা দিরাফুক গুম্ফা, উচ্চতা ১৬ , ২০০ ফিট। এখান থেকে ঠিক মাথার উপর রুপোলি গম্বুজের মতন খ্যাং তিসের চূড়া দেখা যায়। দিরাফুক গুম্ফায় ঢুকে ওরা ভগবান মূর্তির পাশাপাশি দাঁড় করানো খ্যাং তিসের ভগবান দেমচোগ আর ভগবতী দোরজে ফাগমোর মূর্তির পায়ে প্রণাম করে। গরবের মায়ের বর্ণনার সঙ্গে দেমচোগের মূর্তির মিল দেখে সে ভাবে, তাহলে কি দেমচোগই তার বাবা? এটা কেমন করে সম্ভব? তাহলে এখানে এসে সে আর দেচমা কেন বারবার এই বিভীষিকার শিকার হচ্ছে? ছাইভস্ম মাখা দাড়িগোঁফহীন সন্ন্যাসীর চুমুর রহস্যই বা কী?

ভগবান দেমচোগ আর ভগবতী দোরজে ফাগমোর মন্দিরের সামনের বারান্দায় বসে ওরা কাধের ঝোলা থেকে বের করে দুপুরের খাবার খায়। খেতে খেতে দেখে গুম্ফার দেওয়ালের তাকে সারি সারি বই ও ছাপাখানার সরঞ্জাম। ছাপাখানা বলতে সবই হাতে ছাপার উপকরণ -- কাঠ , কালি ও ভারী কাগজে ঠাসা। প্রত্যেকটা বইয়ের সামনে নাম লেখা কাপড় ঝুলছে। অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী ও যবয়ং – এর মূর্তিগুলোর কাঁধে অসংখ্য কাথার চাপে মুখগুলো প্রায় ঢাকা পড়েছে। প্রদীপটাকে দেখে মনে হয় হাজার বছরের পুরনো। মন্দিরের প্রতিটি থামের গায়ে ঝুলছে অতি সুক্ষ্ম কারুকাজ করা তাংখা। তার অধিকাংশই খ্যাং তিসে ও ৎসো মাফামের বিভিন্ন কল্পিত রূপ; মণ্ডলা আর দেমচোগ এর মহিমা গাঁথা। একজন সুঠাম সদ্যযুবক লামা অদেরকে বলে যে, দিরাফুক থেকে একটি রাস্তা লা নদীর ধার দিয়ে উত্তরে সিন্ধু নদীর উৎসের দিকে কারাকোরামে পৌঁছে গেছে। এটাই লাদাখ যাওয়ার পথ। আর অন্য রাস্তাটি খ্যাং তিসে পরিক্রমা করে তারচেনে ফিরেছে। ওরা বাঁদিকের পরিক্রমার পথে চড়াই চড়তে থাকে। চারিদিকে বরফের রাজত্ব। পায়ের নীচের বরফ শক্ত পাথরের মতন। চাইলেও দ্রুত চলা যায় না। জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয়। ওরা নিজেদের মধ্যে কোনও কথা না বলে একাগ্রচিত্তে দেখে দেখে পা ফেলে একসময় ১৮, ৬০০ ফুট উঁচু দোলমা-লায় পৌঁছায়। নেতেন পাহাড়ের উপর এই দোলমা-লা-ই পরিক্রমার সর্বোচ্চ পথ। ততক্ষণে সূর্যদেব পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। দোলমা লার ডানদিকে গৌরীকুণ্ড। সামনে ৎসো মাফাম ও ৎসো লাংগাক। এই নেতেন পাহাড়কে নাকি হিন্দু শিবভক্তরা শিবের ষাঁড় বা নন্দী পাহাড় বলে। তিব্বতি ভাষায় এটি ইয়েলাক জুং। গৌরীকুণ্ডে কোন নদী এসে পড়েনি আর সেই কুণ্ড থেকে কোনও নদী শুরু হয়নি। পাহাড়ের বরফগলা জল নীল হয়ে আছে।

দোলমা-লা থেকে পথ শুধু নীচের দিকে নেমেছে বলে এবার ওদের চলার গতি একটু বাড়ে। যদিও সতর্ক হয়ে চলতে হচ্ছে। বরফের পথে পা পিছলে গেলেই সর্বনাশ। অনেক নীচে গড়িয়ে পড়ে মৃত্যু অবধারিত। একটু পরেই ঝোং নদীর জলের স্রোতের শব্দ তরঙ্গে ওদের চলার নতুন ছন্দ আসে। সেখানে একটা যাযাবরদের তাঁবু দেখে ওরা অবাক। তিনটি বাচ্চা ওদেরকে দেখে বেরিয়ে এসে জিভ বের করে পথের মাঝে দাঁড়ায়। গরব ওদের মাথায় হাত দিয়ে বেরিয়ে এসে আদর করতে গেলে ওরা গরব – দেচমা, গোরিং ও ৎসোণ্ডুর হাত ধরে টেনে ওদের তাঁবুতে নিয়ে যায়। ওদের অভিভাবকরা এসে সাটাঙ্গে প্রণাম করে। ওদের তাঁবুর ভেতর বিচুলির কয়েকটা গদি আর প্রচুর উল। ওরা প্রায় জলের দরে পশমের পোশাক বিক্রি করতে চায়। গরবরা কোনও আগ্রহ না দেখালে ওই বাচ্চাগুলির মা কয়েকটা কৌটো খুলে দেচমাকে কিছু রঙিন পাথর দেখাতে থাকে। গরব ওদেরকে বলে, এসব কিছুই আমাদের দরকার নেই। গরম দুধ বা চা খাওয়ালে তা নিতে পারি। ভদ্রমহিলা তখন তাঁবুর মাঝামাঝি রাখা একটা লোহার কড়াইয়ের উপর জ্বলতে থাকা কাঠকয়লার আগুনে গরম করে তাদেরকে চারবাটি দুধ এনে দেয়।

ওরা দুধ খেয়ে আবার ঝোং নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্তের আগেই পৌঁছে যায় জুথুলফুক গুম্ফায়। কিন্তু সেখানে তারা আর দাঁড়ায় না। দ্রুত পা চালিয়ে সন্ধে নাগাদ তারচেনের তাঁবুতে ফেরে। যাযাবর ছেলেটি তখন দুই তাঁবুতে দু’টো আর ভারবাহী খচ্চর ও ঘোড়াগুলির অস্থায়ী আস্তাবলে একটি লোহার কড়াইয়ে কাঠকয়লা আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ক্লান্তিতে বেশি করে ৎসাম্পা ও চা খেয়ে ওরা যে যার মতন কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে নিঃসাড়ে ঘুমোয় সারারাত। সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফেরার পর দেচমা জিজ্ঞেস করে, কবে ফিরব আমরা, আর ভাল লাগছে না এখানে!

ওর কথা শুনে গরব টানটান হয়। দেচমার কণ্ঠস্বরে এই আকুলতা ওকে স্পর্শ করে। সে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে, কাল রাতেও কি কোনও কষ্ট হয়েছে ?

দেচমা চোখ নামিয়ে বলে, না, কিন্তু এখানে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এটুকু বলেই হাঁপাতে থাকে সে। ওর মুখের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে ঠোঁটের কাছটা বেশ ফোলা ফোলা লাগে গরবের। তার সঙ্গে চোখে দেখা বিভীষিকা মিশিয়ে চোয়াল শক্ত হয় তার। ঘুমের মধ্যে দেচমা কেমন ছটফট করে প্রতিরোধ করে তা গরব নিজের চোখে দেখেছে। অথচ জেগে উঠে দেচমা এমন চুপ থাকে যেন কিছুই হয়নি! কেন? ভয়ে? নাকি সে ওই দানবীয় যৌনতা থেকে আনন্দ পেতে শুরু করেছে? একথা মনে আসতেই তার মাথায় রাগ চড়ে যায়। মাথায় দস্যুসর্দার জেগে ওঠে।

দেচমার বানানো মাখন-চায়ের মগে চুমুক দিয়ে আবার হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে। তার জন্মবৃত্তান্ত শোনাতে গিয়ে মা এক অলৌকিক বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন যা সে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মা ভুল বলেননি। সত্যিই কি এই পবিত্র পর্বতের পাদদেশে মহিলা তীর্থযাত্রীরা এমনি ভিন্ন জগতের অলৌকিক কিছুর সহসা আক্রমণের শিকার হন?

একথা ভেবে ওর রাগের সঙ্গে অন্য একটা অনুভূতি মিশে যায়, এই রহস্য উন্মোচনের ইচ্ছে আর তার সঙ্গে গরবের জন্মদাতার কী সম্পর্ক রয়েছে তা জানা। পাশাপাশি ওই অশরীরী প্রেমিককে ধরার জন্য, নিজের জন্মরহস্য জানার জন্য দেচমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে ভেবে ভীষণ গ্লানি হয়। কিন্তু সে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সন্ধ্যায় ওরা তাঁবুর বাইরে পাহাড়ের আড়ালে তিনটি বড় পাথরের ফাঁকে যাযাবর ছেলেটির এনে দেওয়া শুকনো ডালপালা গুজে আগুন ধরিয়ে ৎসাম্পা আর চা করে খায়। খাওয়ার পর দেচমা তাঁবুতে চলে যায়। গোরিং আর ৎসোণ্ডু জ্বলন্ত ডালপালার আগুন লোহার কড়াইয়ে তুলে দিলে গরব ওই বিশাল কড়াই দু’হাতে ধরে ধীরে ধীরে তাঁবুর দিকে যায়। খ্যাং তিসের পাদদেশে তখন নীলাভ রাত্রির চাদর নেমে আসছে। অবশ্য তখনও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গরব তাঁবুর সামনে এসে উত্তপ্ত কড়াইটাকে মাটিতে রেখে তাঁবুর পর্দা উঠিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায়। পরশু রাতে দেখা সেই নাগা সন্ন্যাসী ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে। দেচমা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিস্ফারিত চোখ, নির্বাক নিশ্চল মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে, যেন এক অমোঘ অপেক্ষায়। ভয়ে তার চেহারা মৃতের মতন ফ্যাকাশে। সাধু ওর একহাত বাড়িয়ে দেচমার কাঁধে ধরে, অন্য হাত দিয়ে বাহুতে ধরে ওকে বুকে টেনে নেয়। সেই মুহুর্তে গরবের সমস্ত ঔৎসুক্য আর তদন্তের আগ্রহ ফুরিয়ে যায়। সে হুঙ্কার দিয়ে ওই ঘৃণ্য সাধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সন্ন্যাসী ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। পাণ্ডুবর্ণ চেহারা, আয়ত ক্রুদ্ধ চোখ। আর চোখের পলক ফেলার আগেই সন্ন্যাসী যেন উড়ে এসে ওর পৈশাচিক ঠোঁট চেপে ধরে গরবের মুখে। তারপর জোরে শুষে নিতে চায় ওর জিহ্বা। গরব ছটফট করতে থাকে, প্রাণপণে ধাক্কা দিয়ে ওই দানবীয় শক্তিকে সরাতে চায়। কিন্তু ওর হাত দুটি শক্তভাবে ধরে রেখেছে ওই প্রবল শক্তি। ক্রমে তার দানবীয় শোষণের মাত্রা বাড়তে থাকে; যেন প্রাণবায়ুটাই শুষে নেবে!

তবুও সে প্রাণপণে লড়তে থাকে, এক এক পা করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। ওর মুখ খোলা নেই বলে সঙ্গীদেরও ডাকতে পারে না। কিন্তু ওর পায়ে লেগে দু’ টি কাচের বোতলে ঠোকাঠুকি লেগে ভেঙে গেলে, সেই শব্দে গোরিং আগুনের কাছ থেকে এগিয়ে আসে। কী হল সর্দারের?

সে ছুটে গিয়ে দেখে দেচমা মাটিতে পড়ে অচেতন প্রায়, গরব ছটফট করছে, কাউকে মারতে চাইছে, কিন্তু কাকে তা সে বুঝতে পারে না। অথচ গরব কথাও বলতে পারছে না, চোখ দুটি বিস্ফারিত, ঠোঁট খোলা, জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। সে গোঁ-গোঁ শব্দ করছে। গোরিং চিৎকার করে ৎসোণ্ডুকে ডাকে। কিন্তু ওরা দু’ জন কাছে আসার আগেই ওই দানবীয় শক্তি গরবকে ছেড়ে যায়। দেচমা ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।

গরবের সঙ্গীদেরকে কোনও ব্যাখ্যা দিতে হয় না। ওরা তৎক্ষণাৎ ওই ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা তৈরি করে নেয়। ওদের বিশ্বাস এই এলাকায় অনেক অশরীরী রয়েছে আর তাদের মধ্যে কোনওটা ওদের সর্দার আর তার প্রেমিকাকে মারতে এসেছিল। তখুনি প্রত্যাশিত নির্দেশ দেয় গরব, চল, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাব।

সঙ্গীরা সমস্বরে জবাব দেয়, অবশ্যই!

ওরা যাযাবরদের থেকে কেনা অবশিষ্ট কাঠগুলি জড়ো করে বড় করে একটা আগুন জ্বালায়। সেই আলোয় সবকিছু গুছিয়ে তাঁবু গুটিয়ে ভালভাবে বেঁধে খচ্চরগুলির পিঠে চাপায়। গরব দেচমাকে শুশ্রুষা করে একবাটি গরম দুধ খাইয়ে ফেরার জন্য তৈরি করে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওরা উত্তর পথে বেরিয়ে পড়ে। সবার আগে খোলা খুকরি হাতে গরব, তার পেছনে দেচমা ও ভারবাহী খচ্চর দু’ টি এবং পেছনে গোরিং ও ৎসোণ্ডু। ওরা সবাই সশব্দে ‘ওম মণিপদ্মে হুম, ওম্ মণিপদ্মে হুম’ বলতে বলতে ঘোড়া চালায়। পাহাড়ি পথে চাইলেও খুব দ্রুত চলা যায় না। তবুও শুক্লপক্ষের নবমীর চাঁদের আলোয় পথ ভালভাবেই দেখা যায়। সারারাত ঘোড়া চালিয়ে ওরা ভোরে যেখানে পৌঁছায় সেই খরস্রোতার ধারে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করে। সারাদিন সারারাত ও তার পরের দিন এমনি মাঝে মধ্যে দু’ দণ্ড কোনও নদীর ধারে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চা ও ৎসাম্পা খেয়ে ওরা দ্রুত ওই খ্যাং তিসে থেকে যতটা দূরে সম্ভব পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করে । দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় ওরা আবার একগুচ্ছ যাযাবরদের তাঁবু দেখতে পেয়ে সেখানে রাত কাটানোর কথা ভাবে। প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি তাঁবু আর কয়েক’শ চারপেয়ে জীব দেখে ওদের মনে সাহস জাগে। গরব দেচমা ও দুই সঙ্গীকে সতর্ক করে ওরা কেউ যেন এই যাযাবরদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে নিজেদের ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা না বলে!

একথা শুনলে যাযাবররা হয়তো ভাববে ওদেরকে তাড়া করে পৈশাচিক শক্তি ওদের ডেরাতেও আক্রমণ হানতে পারে! সেক্ষেত্রে ভয়ে ওদেরকে তাড়িয়েও দিতে পারে!


ক্রমশ ...