শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,দ্বিতীয় অধ্যায়, ২ পর্ব

ক্ষতই হল সেই স্থান যেখান দিয়ে তোমার মধ্যে আলো প্রবেশ করে। - রুমি

# বত্রিশ

সম্ভবতঃএত বেশি মদ খাওয়ার ফলে সেই অকুতোভয় গ্রামীন যুবকের আওয়াজ জড়িয়ে গেছিল । সে কথা বলতে বলতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিলো । তবুও সে বাড়ি যেতে চাইছিলো । আমি ওকে ধরে ধরে অনেক কষ্টে বাড়ি পৌঁছে দিই !

এটুকু বলে অনগ চুপ করে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। ওর গালদুটি আগের থেকে বেশি লাল হয়ে উঠতে থাকে। গরব জিজ্ঞেস করে, কী হল তোমার?

অনগ একবার চারপাশে তাকিয়ে ঢোক গেলে। তার চোখ আরও লাল হয়, জলে ভরে আসে। সে ফিসফিস করে বলে, - গ্রামের ছেলেটি আমাকে বলছিলো, আমি ওকে ধরে ধরে অনেক কষ্টে বাড়ি পৌঁছে দিই! কিন্তু পরদিনই সেই অকুতোভয় ছেলেটি পাশের গ্রামে যাওয়ার পথে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে মারা যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যু । এই ঘটনায় গ্রামের সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। সবাই হা। সে কিন্তু খুব ভাল ঘোড়া চালাতো ! একটি শীর্ণকায় প্রায় শুকনো নদীর বুকে ছড়ানো পাথরে ওর ও ঘোড়াটির মৃতদেহ পাওয়া যায়। উভয়েরই মাথার খুলি ফেটে গেছিল!

বলতে বলতে ছেলেটির চোখ জলে ভরে আসে। সে একটু থেমে ধরা গলায় বলে, অপ্রত্যাশিত,ভাবা যায় না। বেচারা হয়তো পাগল হয়ে গেছিল! ঈশ্বরের সঙ্গে যেমন মজা করার চেষ্টা করাও উচিত না – সো সা লিং - এর বন ডাক্তারদের সঙ্গেও না!

সে আবার একটু থেমে বলে, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে অনগ, বয়সেও নবীন, সাবধানে থেকো ।

তখনই খামারবাড়ির একটি খুরবানী গাছের ডালে বসে একটি কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে, অন্য একটি কাকও ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে কা কা করে উঠলে ছেলেটি নিচুস্বরে বলে, এই কথাগুলি আর কাউকে বলার প্রয়োজন নেই!

কিন্তু কিছুদিন পরই গরবের সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অনগ আজ তাকে এই কাহিনি শোনায়। গরবও সেই কৃষক ছেলেটির সঙ্গে একমত – ঈশ্বরের সঙ্গে মজা করা উচিত নয়, ঈশ্বরের আরাধনা যারা করেন তাদের সঙ্গেও নয়! বলতে বলতে তার মনে একটা হাহাকার জেগে ওঠে! সে নিজেও তো লাহসায় মহামহিম ত্রয়োদশ দলাই লামার সঙ্গে ছলনা করার ফল ভোগ করছে। দেচমার মৃত্যুরজন্যে কি সে নিজে দায়ী নয়? সে মনে মনে যত দ্রুত সম্ভব একজন ভবিষ্যদ্রষ্টার সঙ্গে কথা বলার আকুতি অনুভব করে। মঠাধ্যক্ষ নিশ্চয়ই মহাজ্ঞানী; প্রায় ঈশ্বরের সমকক্ষ -- তার শরণাপন্ন হলে নিশ্চয়ই কোনও অমোঘ প্রত্যাদেশ পাওয়া যাবে। গরব বুঝতে পারবে এরপর তার কী করা উচিত। সে অনগকে বলে, আমি মঠাধ্যক্ষের কাছে যেতে চাই!

অনগ ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবে! তার চোখের মণি নড়াচড়া করে। সে দ্বিধাগ্রস্ত আওয়াজে বলে, মামার সঙ্গে কথা বলো !

তারপর নিচুস্বরে বলে, তবে বলার আগে দু’বার ভেবে দেখ, আ-আমারও এই মঠাধ্যক্ষকে বিপজ্জনক মানুষ বলে মনে হয়, আমি কোনওদিন তার কাছে যেতে চাই না, ভয় করে, তার দিকে তাকাতেও চাই না!

একটু থেমে অনগ আবার বলে, এই মঠে বেশিদিন থাকবো না, ডাক্তারও হবো না, মামা যাই বলুক না কেন !

গরব ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,- কোথায় যেতে চাও?

অনগ একটু ভেবে অনুনয়ের স্বরে বলে,- তুমি সুস্থ হয়ে যখন সো সা লিং ছাড়বে, আমিও তোমার সঙ্গে যেতে চাই!

গরব হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,- আমার সঙ্গে গিয়ে তুমি কী করবে? ভেড়া, মোষ ও ছাগল পালবে ? আমার কিছু নেই, সব লুণ্ঠিত !

  • কিভাবে ?
  • ডাকাতরা নিয়ে গেছে?
  • হ্যাঁ, আমার কাছে ওরা ডাকাতই।
  • তুমি কখনও বলোনি কিভাবে এত মারাত্মকভাবে জখম হলে,কারা তোমাকে গুলি করেছে?
  • গরব মুচকি হেসে বলে, তুমিও তো আমাকে বলোনি যে আমি দেশের ঠিক কোন প্রান্তে রয়েছি ! নাকি দেশের বাইরে, এই বনদের কথা আমি আগে তো শুনিনি!
  • মামা আমাকে বলতে মানা করেছে !
  • তাহলে ?

গরব একদৃষ্টে অনগের চোখে তাকিয়ে থাকে । অনগ ইতস্তত করে । তারপর আওয়াজ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে,- এই পাহাড়ের দক্ষিণে প্রথম পর্বতমালার পেছনে প্রবাহিত হয় মহান গিয়ামোনুচ বা স্যালুয়েন নদী। তোমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিলাম, আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে তো?

গরব মুচকি হেসে বলে,- দেখি, আমি ভাববো, কিন্তু তার আগে একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। আমি মঠাধ্যক্ষকে ভয় পাই না!

সেদিন বিকেলে গরব মিগমারকে নিজের ইচ্ছের কথা জানায়। মিগমার একটু ভেবে বলেন,-। দেখবো, তুমি আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাও!

অনগ ওকে মঠাধ্যক্ষ সম্পর্কে যা যা বলেছে সেসব নিজের কাছেই রাখে গরব। শুধু নিজের ভাগ্য জানার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এখানে সময় মন্থর গতিতে চলে। সেজন্যে বিছানায় শুয়ে থাকলে ছাদে পরস্পরকে ধাওয়া করতে থাকা টিকটিকিদের নিবিড়ভাবে দেখে গরব। দেওয়ালে কোনও শিকার ধরতে ওদের তৎপরতা দেখে বাঁচার প্রেরণা সংগ্রহ করে সে। শুধু অনগ খাবার ও পানীয় দিতে এলে ওর সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলে বেশ ভাল লাগে। আজকাল গরবের কাধের ক্ষতে মলম লাগানোর দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছে অনগই। ক্ষতটাও ধীরে ধীরে শুকিয়ে উঠেছে।

কয়েকদিন পর মিগমার এসে ওকে বলে হাসপাতালের কামরা থেকে ওকে এখন দ্বিতীয় বেষ্টনীর একটি ঘরে গিয়ে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারপর একদিন শুভলগ্নে মঠাধ্যক্ষ ওর জন্যে সো সা লিং-এর অভিভাবক দেবতার কাছ থেকে দৈববাণী শোনার ব্যবস্থা করবে। এই ব্যবস্থা গরবের ভাল লাগে না, কিন্তু দৈববাণী শোনার প্রবল ইচ্ছা ওকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে। সেদিন বিকেলে অনগ খাবার নিয়ে এলে গরব তাকে মিগমারের ব্যবস্থার কথা জানায়। শুনে অনগের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে কপালে হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে বলে,- অহো ! আমার ভাল লাগছে না!

তারপর ফিসফিস করে বলে,- তোমাকে আগেই বলেছি, মঠাধ্যক্ষের থাবায় পড়ো না, এখন কী হবে? গরব ম্লান হেসে বলে,- কী হবে, আমি তো এটাই চেয়েছিলাম, তুমি তো ওকে নিজের চোখে দেখোই নি, অন্যের কথা শুনে কাউকে বিচার করা উচিত নয়!

অনগ বলে, -ঠিক, কিন্তু আমার মন না জানি কেন কু গাইছে, এতদিন তোমাকে বলিনি, আমার মামাকেও আর বিশ্বাস করি না। তোমার ঘোড়া দুটি তোমাকে না জানিয়ে বিক্রি করে দেওয়া আমার ভাল লাগেনি, সেদিন শুনলাম মামা ওর এক সহকর্মী ডাক্তারকে বলছেন যে তুমি একজন আকর্ষক ব্যক্তি, কৌতুহল-উদ্দীপক বিষয়। সেই থেকে ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কার জন্যে তুমি আকর্ষক ব্যক্তি? কিসের জন্য? আর এখন শুনলাম তোমাকে দ্বিতীয় বেষ্টনীতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা। আমার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল! তুমি কী ভেবেছ?

অনগের কথা শুনে গরবের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। প্রথমত তার প্রিয় ঘোড়া নাগপো বেঁচে আছে শুনে আনন্দ আর তাকে বিক্রি করে দেওয়ার খবর শুনে খুব রাগ হয়। তার প্রেমিকা দেচমার ঘোড়াটিকেও বিক্রি করে দিলো ওরা। কেন? ওদের কী মতলব? ঘোড়া বিক্রি করে দিয়েছে অথচ মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছে ! সেজন্যেই তো তার দ্বিতীয় বেষ্টনীতে যাওয়া ! গরব আবার ভাবে, ওরা আমার জীবন বাচিয়েছে, কিন্তু ঘোড়া বেচে দিয়েছে ! চাইলেও ঘোড়া দুটি আর ফিরে পাবো না, তাই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে দ্বিতীয় বেষ্টনীতে গিয়ে ভবিষ্যতের মোকাবিলা করা। সে চোয়াল শক্ত করে বলে,

– যাবো!

– ঠিক আছে! অনগ একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বলে, - তুমি মরবে,আমাকেও তাহলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেখছি ! না, এখুনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমিও যাচ্ছি ! বলতেবলতেওর চোখ ছলছলকরে ওঠে।

এবার গরবের অবাক হওয়ার পালা। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে অনগ চাপাস্বরে বলে, পরশু আমি একজন বয়স্ক মঠবাসীর সঙ্গে দূরের কোনও অঞ্চল থেকে রূপো আনতে যাচ্ছি ! তার ঘোড়ার জিনের পাশে বাঁধা থলিতে থাকবে রৌপ্যখণ্ডগুলি। আর আমার ঘোড়ার থলিতে থাকবে মাখন, শুকনো মাংস, জল আর ৎসাম্পা। আমরা একটা অরণ্যের পথ ধরে ফিরবো। শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আমি বয়স্ক মানুষটিকেই আগে ঘোড়া চালাতে বলবো। তাকেঅনুসরণ করতে করতে হঠাৎই বলবো, -মামাবাবু, আপনার ঘোড়াটা খোড়াচ্ছে,ওটার বাঁ পায়ে কী হয়েছে? ওর নালে পাথরকুচি ঢুকেছে নাকি? আপনি নামুন, পরীক্ষা করে দেখি ! পশুটার পায়ে ভীষণ লেগেছে নিশ্চয়ই ! আমি জানি তিনি বিশ্বাস করবেন, ঘোড়া থেকে নেমে আসবেন। আর যখনই তিনি নামবেন, আমি লাফিয়ে ওর ঘোড়ার পিঠে চাপবো, আমার ঘোড়ার লাগাম নিজের হাতেই বেঁধে নিয়ে দ্রুত পালাব . . দেখি কেমন করে ধরেন আমাকে!

– তুমি রূপো নিয়ে পালাতে চাও?

– ঠিকই বুঝেছ!

– আর তারপর ?

– যা করার করবো, আমি তো আর বোকা নই!

  • আর তোমাদের বিগ্রহ আর মঠাধ্যক্ষ? তোমার মামা?
  • জাহান্নামে যাক, আমার শুধু তোমাকে নিয়ে চিন্তা, তুমি এখন ওদের জালে ফাসছো, কী যে হবে কে জানে !

একটু থেমে সে আবার বলে, -ওদের সঙ্গে আমার মনের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, খুব দ্রুত আমার সঙ্গে ওদের শারীরিক দূরত্বও বাড়িয়ে যেতে থাকবো। তারপর অনেক দুরে গিয়ে কোনও গুণী লামাকে ধরবো। তাকে বলবো যে একজন শয়তান বন আমাকে অভিশাপ দিয়েছে ! একথা শুনলে যে কোনও লামাই আমাকে সুরক্ষা দেবেন।

গরব হেসে বলে, ডাকাতরাই এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। তুমি আমাকে দশ বছর আগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছ!

একথা বলেই গরব নিজেকে লাগাম টানে। চুপ হয়ে যায়। কিন্তু বুদ্ধিমান অনগ যা বোঝার তা বুঝে যায়। সে লাজুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, যা ভেবেছি, তুমি কি . . . ?

– হ্যাঁ, ঠিক, আমি ডাকাত ছিলাম, পরের দিকে দলের নেতা ! আমার শরীরে যে বুলেট ছিল তা চীনা সৈনিকদের বন্দুক নিঃ সৃত!

অনগ হাঁ হয়ে যায়। তারপর বিস্ফারিত চোখে ফিসফিসিয়ে বলে, -ডা-কা-ত–স-র্দা-র! উরিব্বাস! ওহ! মিলে গেছে গুরু ! শুরু থেকেই মনে হতো, তুমি অন্যরকম!

অনগের ফিসফিসানিতেও উত্তেজনা। সে আবার ফিসফিসিয়ে বলে,-ডাকাত সর্দার, অ-সা-ধা-র-ণ! তুমি আমাকে দলে নেবে? ডাকাতির সময় সঙ্গে নেবে? কথা দাও!

গরব চোয়াল শক্ত করে বলে,- আমি আর ডাকাতি করবো না বলে ঠিক করেছি অনগ ! আমার অনেক দুঃখ ! মন ভেঙে গেছে ! যে মেয়েটিকে আমার হৃদয় আর আত্মা ভালবেসেছে, সে মৃত, আমি প্রায় নিশ্চিত ! সে জন্যেই আমি কোনও ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কাছে যেতে চাই ! ওর ঘোড়ার পা পিছলে ডুবে যাচ্ছিল, আমি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে ওকে বাঁচাতে ছুটছিলাম, তখনই কাঁধে গুলি লাগে !

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গরব আবার বলে, চেষ্টা করেও ওকে বাঁচাতে পারিনি, তলিয়ে গেছে!– ওহ! একজন মহিলা!

অনগ হাল্কা আওয়াজে বলে, খুবই দুঃখের কথা!

একটু থেমে সে জিভ দিয়ে চুকচক শব্দ করে বলে, অবশ্যই দুঃখের কথা, কিন্তু তুমি এই দুঃখ কাটিয়ে উঠবে সর্দার, অনেক সুন্দরীকে পাবে !

– আমার অনুভূতি তুমি বুঝবেনা অনগ; আমার অন্য কেউ নেই! শুধু ছিল অত্যন্ত প্রিয় ঘোড়া নাগপো আর প্রেমিকা দেচমা!

গরবের আওয়াজে একটা হাহাকারের অনুভূতি অনগকে ছুঁয়ে যায়। সে গরবকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলে, তুমি কে তা জানার পর থেকে তোমাকে নিয়ে আমার যে অস্বস্তি হচ্ছিল সেটা আর নেই। তুমি জাননা, আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তোমার সাহস ও বীরত্ব নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে, তুমি আমাদের স্বপ্নের দস্যসর্দার, আমি নিশ্চিতবুড়ো বন মঠাধ্যক্ষের যত অলৌকিক ক্ষমতাই থাকুক না কেন তিনি একজন জাগস্পা ডাকাত সর্দারের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না!

অনগ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমাদের আবার দেখা হবে! তুমি সতর্ক থেক, চলো, আমরা এক সঙ্গে প্রবল কামনা করি, আমাদের আবার দেখা হবেই!

ওর কথা শুনে গরবের চোখে জল চলে আসে। সে হেসে ছলছল চোখে অনগের গালে আলতো চড় মেরে বলে, আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে কামনা করছি!

ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়। আলিঙ্গনাবস্থাতেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে দু'জনে মনে মনে এই কামনার কথা উচ্চারণ করে,- আবার দেখা হবে, হবেই!

তারপর অনগ ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তখনই গরবকে চমকে দিয়ে ঘরের দেওয়ালে পরস্পরকে ধাওয়া করতে থাকা টিকটিকি দুটি হঠাৎ ওর মাথায় ও কাঁধে আছড়ে পড়ে মেঝেতে পড়ে ছুটে পালায়। এই অতর্কিত পতনে গরবের বুক আশঙ্কায় দুরুদুরু করে। কি জানি কী হয়, কি জানি হয়!

অনগ চলে গেলেও তার কামনা ও প্রত্যয়, গরবের মানসিক শক্তির প্রতি তার আস্থা গরবকে আরও সাহসী করে তোলে।

# দ্বিতীয় বেষ্টনী

মোটা মোটা পাথরের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত উঁচু দেওয়ালের এক প্রান্তে বানানো ছোটো লোহার দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মাথা নিচু করে ঢুকতে হলেও গরব দ্বিতীয় বেষ্টনীতে পা রাখে গেরিলা যোদ্ধার মতন সন্তর্পণে চোখ কান খোলা রেখে। এখানেও বাইরের হাসপাতাল বাড়িটার মতন আকারেরই আরেকটি ধূসররঙা পাথরের দালান বাড়ি। তৃতীয়ার চাঁদের মতন মন্দির। অর্ধগোলাকার উঠোনের পেছন দিকে খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটি ছোটো মন্দির। মন্দিরটি আটপৌরে গড়নের। এর সাদামাটা কারুকার্যহীন স্থাপত্যে ভয় জাগানোর মতন কিছু নেই, কিন্তু রয়েছে একটি আচ্ছন্ন করা অনুজ্জ্বল বিষন্নতার ভার। এই মন্দিরটি আবার যেন কেমন করে গরবের মনে হতাশা সৃষ্টি করে। এবার ওকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই ঘরের ভেতর দিয়ে আরেকটি ঘরে যাওয়া যায়। ওই ঘরের দরজা থাকলেও তাতে কোনও পাল্লা নেই। সেই ঘরে একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী থাকেন। গরব তার ঘরে গিয়ে বসলেও তিনি কোনও সাড়া দেন না। কোনও কথা বলা তো দুরের কথা, মরা মাছের মতন শুকনো ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকেন। যেন গরবের কোনও অস্বস্তিই তিনি টের পাচ্ছেন না।

যে গরব ঘোড়ার পিঠে চেপে বিস্তৃত মালভূমির প্রাকৃতিক বৈচিত্রে দাপিয়ে অভ্যস্ত, সে এই অলস মন্থর পরিবেশে অস্বস্তি অনুভব করে। হাসপাতালে যত না একঘেয়ে লাগতো, এখানে তার থেকে অনেক বেশি। হাসপাতালে প্রতিদিন ওর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হচ্ছিলো, জোর ও উদ্যম ফিরে আসছিলো । সে খোলা হাওয়ায় দৌড়ঝাপ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহে দ্বিতীয় বেষ্টনীতে এসে ক্রমে জবুথবু হয়ে পড়ার উপক্রম।

এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়! একথা ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমুতে যায় সে। তখন পর্যন্ত বৃদ্ধ প্রতিবেশী ওর সঙ্গে একটি কথা বলেনি। পরদিন, তার পর দিন, পরবর্তী সপ্তাহ গড়িয়ে তৃতীয় সপ্তাহেও সে কথা বলার মতন কাউকে পেলনা। গরব কী ভুল সিদ্ধান্ত নিলো! এক যুবা সন্ন্যাসী ওকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যেত। কিন্তু সে-ও এই কাজটি নিঃশব্দে করতো । গরব তবু ওকে নানা প্রশ্ন করে যেত। নবীন সন্ন্যাসী মুচকি হেসে নিজের হাত বন্ধ ঠোঁটের সামনে রেখে ইশারায় বোঝাতে যে ওকে কোনও কথা বলতে মানা করা হয়েছে। ডাক্তার মিগমারেরও কোনও দেখা নেই। এ কেমন অসভ্যতা। ওরা কি এভাবে সুকৌশলে গরবের মনোবল ভেঙে দিতে চায়?

গরব মাঝে মধ্যে উঠোনে পায়চারি করে অথবা মন্দিরের দিকে হাঁটে, কিন্তু মঠের সেবাইতরা বিনা বাক্যব্যয়ে শুধুমাত্র অঙ্গভঙ্গীতে ওকে সেই কুঠুরিতে থাকতে বলে দেয়। এভাবে দিনের পর দিন একা থেকে থেকে প্রাক্তন ডাকাতসর্দার গরব পাগল হয়ে পড়ছিলো। অনগের সাহচর্যে ও সেবায় যে শক্তি সে ফিরে পেয়েছিল তা যেন ধীরে ধীরে আবার হারিয়ে ফেলছিল। রাতে এখন আগের থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা লাগে তার। কড়াই ভরা কাঠকয়লা জ্বালিয়ে আগুনে হাত পা সেঁকতে থাকে সকাল সন্ধ্যে। সেই কাঠকয়লার ধিকিধিকি আগুনের দিকে তাকিয়ে দেচমার কথা ভাবে, নাগপোর কথা ভাবে। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কথা ভেবে মনে মনে হাত কামড়ায়। অবশেষে একদিন সকালে আগুনে হাত সেঁকতে সেঁকতে সে ভাবে যে সেদিন রাতের আঁধারেই পালাবে! দূরবর্তী কোনও গ্রামের লামার কাছে পৌছুতে হবে।

এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ। কেমন করে পালাবে সেই ছক কষতে উঠোনে বেরিয়ে সে চারপাশের সবকিছু নিবিড়ভাবে দেখতে থাকে। আর সেদিনই তাকে অবাক করে দিয়ে মিগমার আবার আসেন।

তিনি বলেন, আমি এখানে ছিলাম না!

গরব কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,- অনগ কোথায়?

মিগমার বলেন,- সে ছুটিতে বাড়ি গেছে, কিছুদিন পরই ফিরবে!

গরব ডাক্তারবাবুর চোখের দিকে তাকিয়েছিল। লোকটা কেমন অবলীলায় ডাহা মিথ্যে কথা বলছে! মিগমারও বোধহয় গরবের চোখ দেখে বুঝতে পারে যে সে কথাটা বিশ্বাস করেনি। তিনি চোখ নামিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলেন, যাই হোক, মঠাধ্যক্ষ কাল তোমাকে সময় দিয়েছেন! তৈরি থেক!

তারপর আর কোনও কথা না বলেই তিনি চলে যান। তিনি কি সন্দেহ করেছেন যে গরব অনগের পালানোর ব্যাপারটা জানে! তাহলে তাকে চেপে ধরলেন না কেন? ডাক্তার মিগমারকেও অনগ শেষ দিকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কেন? কিসের ভয়?

গরৰ বুক ভরে শ্বাস নেয়। – যাই হোকনা কেন, অবশেষে! অবশেষে সেই দিন আসছে যখন গরব জানতে পারবে দেচমার কথা। কোনও অলৌকিক হাতের ছোঁয়ায় সে মৃত্যুকে এড়াতে পারলো কি না! তার নিজের বেঁচে থাকার কোনও প্রয়োজন আছে কি না!