বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে দ্বিতীয় খণ্ড # ৬ষ্ঠ পর্ব

...এই প্রেতলোক ভাঙতে তো হবে স্বপ্নের হলাহলে/ সে সূর্যোদয়ে তুমিই তো ফুল ! – বিষ্ণু দে

গরব আর অপেক্ষা করতে পারছে না। সে শুধু মায়া ভেবে রামের কথা ভুলে যেতে পারছে না। পারবে কি? রাম এখন কোথায়? সে কি কোথাও ধ্যানমগ্ন ?

হঠাৎ মনে পড়ে অনগের কথা। অনগ পাশের গ্রামের সেই যুবকটির কথা বলেছিল যে প্রায়ই মঠে আসতো। সে একদিন মঠাধ্যক্ষের কাছে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ নিতে, তাঁকে ঈশ্বরের মার খাওয়াতে পুজো ভন্ডুল করতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন মঠাধ্যক্ষ চলে আসায় সে মূর্তির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। আর তখনই সে একটি গোপন কামরা দেখতে পায়। গরব ভাবে, সত্যিই কি এমন কোনও গোপন কামরা রয়েছে? এটা সম্ভব! তান্ত্রিক লামারাও এমনি নিভৃত কক্ষে কোনও কোনও দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদন করে যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। তাহলে রামকে সেখানে বন্দি করে রাখার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি। একথা ভাবতেই ওর পেটে মোচড় দেয়। বন তান্ত্রিকরা তো বলিও দেয়! মঠাধ্যক্ষ এবার সো সা লিং-এর দেবতাকে খুশি করার জন্যে রামকেও গোপন কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে না তো? একথা মনে হওয়ার পর গরব আর স্থির থাকতে পারে না। সে ছটফট করতে থাকে। মনে মনে ভাবে, রাতে মঠের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরই রামকে খুঁজতে বেরুবে। রাতের খাবার খাওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সঞ্চয় করা সমস্ত খাবার একসঙ্গে বেঁধে সে আলখাল্লার ভেতর বেঁধে নেয়। আর গুঁজে নেয় ওর ছুরিটা। বন হাসপাতালে আনার পর ওর পোশাক ছাড়ানোর সময় অনগ এটি সরিয়ে রেখেছিল। পরে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ায় ছুরিটা ওকে দিয়ে গেছিল। এই দুটো জিনিস ছাড়া গরবের আর কিছুই নেওয়ার নেই। কুঁজো থেকে দু-ঢোক জল খেয়ে সে এবার আলখাল্লার কোমরবন্ধনী শক্ত করে বাঁধে, যেমনটি সে প্রতিটি অভিযানে যাওয়ার আগে বাঁধতো ঘোড়ায় চড়ার আগের মুহূর্তে। গরব কামরার দরজা খুলে সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়ে। মঠ এখন নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমিয়ে কাদা। তবু সাবধানের মার নেই। সে হামাগুড়ি দিয়ে সারিবদ্ধ কামরাগুলির সামনে দিয়ে মন্দিরের দিকে এগুতে থাকে। নিজের ছায়াও যাতে কারও সন্দেহ উদ্রেক না করে সেজন্যে এভাবে হামাগুড়ি দিয়েই সে মন্দির পর্যন্ত যায়। গরব জানে, রাতে মন্দিরের দরজাগুলিও বন্ধ থাকে। সেজন্যে সে মন্দিরের ডানপাশ দিয়ে এগোয়। সেখানে, মন্দিরের দেওয়াল আর প্রাচীরের মাঝের সরু অপ্রশস্ত পরিসরে ঢুকে পড়ে। জানালাগুলি খুললে এই পথ দিয়ে মন্দিরে আলো ঢুকতে পারে। জানালাগুলি মেঝে থেকে খুব একটা উপরে নয়। কাচের বদলে সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো। এমনি একটা জানালা খুলে গরব খুব সহজেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মন্দিরে ঢুকে পড়ে। অনগের বর্ণনার কথা মাথায় রেখে সে বিগ্রহের বাঁপাশে সংকীর্ণ পরিসরে যায়। সেখানে একটি প্রদীপ মিটিমিটি করে জলছে। সম্ভবতঃ সেই কৃষক ছেলেটি এখানেই লুকিয়ে ছিল। অল্প আলোয় পাথরের থামের সঙ্গে আটকানো একটি বড় দরজা দেখে চমকে ওঠে গরব। দরজাটা মোটা লোহার খিল দিয়ে আটকানো। কাঠাম ও দরজার পাল্লার নানা স্থানে ভারী আংটায় ঝুলছে কয়েকটি তালা। সেগুলি ভেঙে দরজা খোলার প্রশ্নই ওঠে না। গরবের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি হিমস্রোত বয়ে যায়। তার মানে সত্যি সত্যি গোপন কক্ষ রয়েছে। এখন ওই ঘরে যাওয়াটাই সমস্যা। গরব মূর্তিটাকে ভালভাবে দেখে। এর উপরের দিকে মন্দিরের সিলিঙের ঠিক নিচে প্রাচীন কাঠের দেওয়ালের পটির ফাঁক দিয়ে একটি নিভু নিভু আলোর আভাস পাওয়া যায়। তার মানে, মূল বিগ্রহের ঠিক পেছনেই কি সেই গুপ্ত কুঠুরি? নাকি মাঝে কোনও দেওয়াল রয়েছে? ভারী দরজায় লাগানো একাধিক তালা ও খিলের সতর্কতা দেখে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই ঠিক বলে মনে হয়। অবশ্য যেসব রক্ষাকারী দেবতার বিশালকায় মূর্তি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলির প্রতি ভয় বা সম্ভ্রমই বনদেরকে কোনওরকম অপবিত্রকরণ বা চুরির উদ্যোগ থেকে দূরে রাখবে - এই ভাবনা মাথায় রাখলে মূর্তি ছাড়া অন্য দেওয়াল না-ও থাকতে পারে। গরবও ভয় পাচ্ছিল। দুরুদুরু বুকে সে দেওয়ালের খাজ ও মূর্তির বেদীতে পা রেখে চড়তে থাকে। একসময় পতন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মূর্তির হাঁটুতেও পা ঠেকাতে হয়। এভাবেই সে অতিকষ্টে মূর্তির মাথার উপর ডানা ছড়ানো বৃহৎ গরুড় পাখির ভাস্কর্যের কাছে পৌছে যায়। গরুড়ের ডানার দু' পাশে দুটি বৃহৎ হাঁ করা ড্রাগনের ভাস্কর্য। চারিদিক দেখে গরব এবার কোমরবন্ধনীর সঙ্গে গোঁজা ওর ধারালো ছুরিটি বের করে হাতে নেয়। গরুড় পাখির একটি ডানার সরু প্রান্ত সে ওই ধারালো ছুরির দুই পোচে কেটে সিলিং থেকে আলাদা করে। তাতে ভাস্কর্যের শরীর থেকে পাখিটা একদিকে ঝুলে পড়ে। এটি কাগজের মণ্ড জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। কিন্তু ধাতব আংটা দিয়ে জোড়া লাগানো। গরব সিলিং থেকে উন্মুক্ত ডানাটি ধরে বারবার নাড়াতে থাকলে কিছুক্ষণ পরই মটমট শব্দে দ্বিতীয় ডানাটি ভেঙে যায়। বিশাল পাখিটা মূর্তির গায়ে পড়ে ঝুলতে থাকে। পাখির শরীর দিয়ে আড়াল করা ফোকরটি হাঁ হয়ে যায়। ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে মূর্তির পেছনে সত্যিই কোনও দেওয়াল নেই। তবে দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পাশাপাশি দু'হাত মেলে দাঁড়াতে যতটা জায়গা প্রয়োজন প্রায় সেই দূরত্বে পাহাড়ের প্রাকৃতিক দেওয়াল। মাঝের অপ্রশস্ত কক্ষে টেবিলের উপর রাখা একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। পাশেই রাখা কয়েক বাটি পুজোর প্রসাদ। কিন্তু সেই কক্ষের কোথাও কি রাম আছে? সে কিছুই দেখতে পায় না। ওই কক্ষে নামার আগে মনে সামান্য দ্বিধা জাগে। সে কি ভুল করছে? সকাল হতেই বনরা ওর মন্দিরে অনধিকার প্রবেশ আর ভাস্কর্য নষ্ট করার ব্যাপারটি জেনে যাবে। নিজের জীবন বাঁচাতে এখুনি তাড়াতাড়ি ফিরে দেওয়াল টপকে পালানো উচিত। এটাই সবচাইতে বিচক্ষণ কাজ হবে। কিন্তু রামকে ওরা কোথায় বন্দি করে রেখেছে? এই পরাজয়ের গ্লানি সে কেমন করে মেনে নেবে? ছোটো কামরাটির দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে পাহাড়ের দেওয়ালের পাশেই এক জায়গায় অন্ধকার স্তুপের মতন কিছু একটা দেখতে পায়। ওর বুকের রক্ত চলকে ওঠে। রাম নয় তো? পিছমোড়া করে বেঁধে অজ্ঞাত বা মৃত অবস্থায় ফেলে রাখা? সে আর কিছু না ভেবে তার দুপাশের দুটি ড্রাগনকে জাপটে ধরে ফোকর দিয়ে প্রথমে পা গলায়। তারপর ধীরে ধীরে পুরো শরীরটাই গলিয়ে দিয়ে মুর্তির পেছনে নেমে পড়ে।

কাপড়ের স্তুপে আলতো লাথি মেরে দেখে সেখানে কেউ নেই। গরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তার মানে রামকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা রয়েছে। কিন্তু সে তাকে কোথায় খুঁজবে?

অনেক পর্দা, ব্যানার আর ছেঁড়া কাপড়ের স্তুপে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক ইতস্তত হাতড়াতে গিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় হোঁচট খায়। শক্ত কিছুতে হোঁচট খাওয়ায় বুড়ো আঙুলে ব্যথা করে। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসায় সে সতর্ক হয়। চোখে জল চলে আসে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে পা দিয়ে কাপড়গুলি সরাতেই মেঝেতে একটা ধাতব ঢাকনা দেখতে পায়। একটি লোহার খিল দিয়ে ওঠা মেঝের সঙ্গে এমনভাবে আটকানো যাতে নিচে থেকে ধাক্কা দিয়ে খোলা না যায়!

এটি কি কোনও ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষ নাকি এই দুর্গম হাসপাতালের কল্যাণকারী ভূমিকার পেছনে লুকোনো কোনও অপরাধ সংগঠনের অশুভ স্থান? একটি ভয়ংকর আবিস্কারের ভয়ে গরব শিহরিত হয়। সে খিলটাকে গলিয়ে বের করে ঢাকনাটা খোলে। তখন সে একজন মানুষ দাঁড়ানোর মতন একটি গভীর গর্ত দেখতে পায়। আর ওই গর্তের ভেতর থেকে তাজা বাতাস ভেতরে ঢুকতে থাকায় ওর সাহস বাড়ে। তার মানে এখান দিয়ে বাইরে বেরুনোর কোনও পথ রয়েছে। সেখানে কী রয়েছে? আরও কিছু বাসস্থানের ব্যবস্থা? মঠের একটি গুপ্ত অংশ? এই পথই কি গরবের সামনে রামের সন্দেহ করা রহস্যের আগল খুলবে?

গরবের এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। বনরা জেগে ওঠার আগেই তাকে সো সা লিং ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। সে যদি রামকে খুঁজে না-ও পায় তবুও আশপাশের গ্রামের মানুষদের বনদের সম্পর্কে সতর্ক করে যেতে পারবে। সেটাই তার নৈতিক দায়িত্ব। গরব অনগের কাছে শুনেছে যে গ্রামবাসীরা যথারীতি বনদের সন্দেহ করে যে ওরা অশুভ ও ক্ষতিকর প্রেতবিদ্যায় পারদর্শী। সেজন্যে ওই হিন্দু সন্ন্যাসীকে খুঁজে বের করতে গ্রামবাসীরা গরবের সহায়ক হতে পারে। অবশ্য সে এখনও নিজেই তাকে ভোরের আগে খুঁজে বের করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী। এই গুপ্তপথ খুঁজে পাওয়া তার আশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো এই পথেই ওরা রামকে নিয়ে গেছে, স্বেচ্ছায় বা জোর করে যেভাবেই হোক না কেন!

সে প্রসাদ রাখা টেবিলটা থেকে ছোট্ট প্রদীপটি হাতে নিয়ে গর্তের ভেতর ঝুঁকে দেখে এবড়ো খেবড়ো কিছু সিঁড়ি ওই গর্ত থেকে একটা সুড়ঙ্গ পথে পাহাড়ের গা বেয়ে বেরিয়ে গেছে।

গরব বিনা দ্বিধায় ওই প্রদীপটা হাতে নিয়ে গর্তে নেমে পড়ে। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথে কিছুটা এগিয়েই বুঝতে পারে - এই সতর্কতার প্রয়োজন ছিল না। সুড়ঙ্গ পথ দীর্ঘ নয়। একটি অপ্রশস্ত মালভূমিতে পা রাখার আগেই সে প্রদীপটি নিভিয়ে দেয়। দু' পাশে উতুঙ্গ দুটি পাহাড় চুড়ো। এই পাহাড় দুটির খাড়া ঢাল নিচে গ্রামের কাছাকাছি পরস্পরের শরীর ছুঁয়েছে। গরব ভাল করে অন্ধকারে চোখ সওয়ানোর আগেই ভাসমান মেঘেরা আকাশের তারার আলো ঢেকে দেওয়ায় হঠাৎই ঘুরঘুটি অন্ধকারে গরব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে বুক ভরে প্রশ্বাস নেয়। সে জানে, যত জোরে প্রশ্বাস নেবে ততই তার চোখের ক্ষমতা বাড়বে। রাতের পর রাত বিস্তীর্ণ হিমশীতল মালভূমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘোড়া চালানোর সময় এভাবেই সে চোখের দীপ্তি বাড়াত। ক্রমে হিংস্র বনবিড়ালের মতন রাতের আধারে সব দেখতে পেত ওর চোখ| এমনকি পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা কোনও পাকদণ্ডী, ছাগল ভেড়ার চলার পথও সে ঠাহর করতে পারতো। এতদিন পর আবার সে অভ্যাস কাজে লাগায় গরব। সে পাহাড়ের গায়ে মানুষের কাটা সিড়ি দেখতে পায়। ভাল করে তাকিয়ে বোঝে এই সিঁড়ি অনেক অনেক বছর আগে কাটা, কয়েক যুগ, কয়েকশো, এমনকি হাজার বছরও হতে পারে কারণ কাটা পাথর সব জায়গাতেই আবার নিজের প্রাকৃতিক রঙ ফিরে পেয়েছে। পাথরের ফাটলে দুব্বাঘাস আর আগাছা জন্ম নিয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে ওই সিঁড়ি এমনভাবে উঠে গেছে যে একটু দূরে এগুলেই পেছন থেকে কেউ আর দেখতে পাবে না।

গরব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে সেই সিঁড়ি বেয়ে অনেকক্ষণ চলার পর একটি বিশাল পাথরের চাইয়ের পেছনে চলে আসে। সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাটি থেকে একটি লালচে আলোর আভা বেরুতে দেখে। তাহলে কি গন্তব্যের কাছাকাছি পৌছে গেছে?

ওই পথ দিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে সে একটি গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়। ওই জায়গাটা একটি ছোট্ট মালভূমির মতন। বর্ষায় পাহাড়ের জল এই মালভূমি হয়ে খাদে গড়িয়ে পড়লে নিশ্চয়ই একটি ঋতুকালীন জলপ্রপাতের জন্ম হয়। এই মালভূমিটি তিনদিক পাহাড় ঘেরা। পাহাড়ের গায়ে সারি দিয়ে বেশকিছু ঘর। ছোট্ট মালভূমির মাঝামাঝি নির্মিত তেমনি একটি ঘরের মুখে রাখা সম্ভবত একটি বড় কেরোসিন লণ্ঠনের আলো। চারপাশে পাথরের থামের উপর পাকা ছাদ। সে দূর থেকে ওই আলো দেখে এগিয়ে যায়।

তাহলে মঠের বাইরে বন সন্ন্যাসীদের ৎশ্যাম খ্যাংস রয়েছে। একান্তে সাধনা করার উপযোগী এরকম গোপন আস্তানা থাকার সম্ভাবনার কথা রাম ওকে বলেছে। অধিকাংশ বৌদ্ধমঠগুলিতেও শীর্ষস্থানীয় লামাদের সাধনার জন্য এমনি একান্ত নির্জন উপাসনাগৃহ থাকে। কিন্তু সেগুলির অবস্থান অন্যদের কাছে গোপন বা লুকোনো থাকে না। অন্যরা সবাই সম্ভ্রমে সেগুলিকে দূর থেকে প্রণাম করে এবং এড়িয়ে চলে। জনসমক্ষে সেগুলি লুকোনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার বিপরীতে এগুলি সাধারণ মানুষের সামনে সমস্ত বৈষয়িক স্বার্থের উর্ধ্বে মনকে আধাত্ম জগতে নিয়ে যেতে হলে কেমন কৃচ্ছসাধন করতে হয়, নীরবে সাধনা করতে হয় সে সম্পর্কে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, সমীহ তৈরি করে। একই কারণে সো সা লিং-এর বনদের এই নিভৃতচারণা নিয়ে গরবের মনে কোনও রকম শ্রদ্ধা কিম্বা সমীহ জাগে না। বরঞ্চ মনে হয় নৈতিক বিচ্যুতিসম্পন্ন কিছু মানুষ এখানে শয়তানের সাধনা করে, প্রেতিনীর সঙ্গে সঙ্গম করে। এরাই কি রামকে কয়েদ করেছে?

উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় গরবের সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। সে নিজেকে সংযত রেখে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে চলে পা টিপে টিপে।

চেতনার সমস্ত দরজা জানালা খুলেও এখানে ঠিক কতজন বন সাধক থাকে সে ব্যাপারে গরব নিশ্চিত হতে পারে না। সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, একা তো! ওদের সংখ্যা ও শক্তি না জেনে লড়াই শুরু করার ঝুঁকি নেবে কি? সে ভাবে , এরকম কিছু করার আগে যে পথে এসেছে সেটা ছাড়া কোথা দিয়ে এখান থেকে বেরুনো যায় তা খুঁজে বের করতে হবে। গরব তাই ছোট্ট মালভূমিটার দিকে না গিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করে। একটু চড়ে সে ওই বনদের আস্তানার ঠিক বিপরীতে একটি প্রাকৃতিক দেওয়াল ও গভীর খাদ দেখতে পায়। অন্ধকারে ওদিক দিয়ে পালানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

সে ধীরে ধীরে দুই ঢালের সম্ভাব্য মিলনরেখার দিকে এগোয়। কিন্তু সে অচিরেই বুঝতে পারে এরকম কোনও মিলনরেখাই নেই - দুইয়ের মাঝে রয়েছে একটি গভীর ফাটল। অগত্যা সে ক্ষুদে মালভূমি থেকে উঠে আসা একটি সরু পায়ে চলা পথ অনুসরণ করে । বেশি দূর এগুতে হয় না । এই পথটা একটি ঘোড়ার জিনের আকারের উচু টিবি মতন স্থানের কাছে পেীছে যায়। ঢিবির গায়ে পাথরের দেওয়ালে একটি দরজা। ওরা যদি রামকে এই ছোট্ট মালভূমিতেই এনে থাকে তাহলে পালানোর কোনও পথ সে নির্ঘাৎ খুঁজে পায়নি। একথা ভেবে গরবের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়।

তার মানে রাম আছে, এখানেই কোথাও অন্তরীণ অবস্থায় আছে। তাকে খুঁজে পেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। অনেক বন মিলে আক্রমণ করলে সে পালানোর পথ পাবে না। রামকে উদ্ধারের তো প্রশ্নই ওঠে না!

সে বোঝে যে সে নিজেইআপাতত একটি ফাঁদে পড়ে গেছে। এখানে পথও পিচ্ছিল। বনবিড়ালের মতন পদক্ষেপে কিছুটা পিছিয়ে সে পা টিপে টিপে দুই ঢালের মাঝের গভীর ফাটলের থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে অন্যদিকে এগিয়ে যায়।

একটা মোড় ঘোরার পর একটি শৈলান্তরীপ - এ পেীছোয়। সেখানে একটি গুহার মুখের সামনে পাথর দিয়ে গেঁথে একটি নিচু দেওয়াল তৈরি হয়েছে। এটি কি আরেকটি সাধনাস্থল? এখানে কি কোনও সন্ন্যাসী থাকেন? ওই পাথর দিয়ে গাঁথা দেওয়ালের সামনে না এলে সে ঠাহর করতে পারতো না যে এটি কোনও প্রাকৃতিক দেওয়াল নয়। এখানে যে একটি গুহা আছে আর তার মুখে দরজা বসানো সেটাও সে টের পেত না। প্রতি মুহূর্তে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে গরব।

সে আরও তটস্থ হয়। এখুনি যদি ওই গুহা থেকে কয়েকজন বেরিয়ে আসে? পর্বতবেষ্টিত ক্ষুদ্র মালভূমি ও তার চাইতে অনেক ছোটো শৈলান্তরীপের মাঝে এই মুহূর্তে নিজেকে বড় অসহায় লাগে।

তখনই একটি মৃদু গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায় গরব। নিস্তব্ধ রাতের পরিবেশে কান পেতে ওই কাতর গোঙানির শব্দ শুনে গরবের বুকে রক্ত চলকে ওঠে। – রাম?

গরব এদিক ওদিক তাকায়। এখানে কি কোনও পাহারাদার রয়েছে? কেউ কি ওকে লক্ষ্য করছে, অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়তে পারে! গরব মনে মনে প্রতি আক্রমণের জন্যে তৈরি থাকে। উৎকর্ণ থেকে গোঙানির শব্দ বোঝার চেষ্টা করে। . . . . আর পারছিনা! . . . রক্ষা করো . . . বাঁচাও . . . .বাঁচাও . . .দয়া করো . . . .দয়া করো। . . . দয়া . . .!

গরব রামের আওয়াজ চিনতে পারে। সে কোনওদিনই ভাল তিব্বতি বলতে পারে না। ভারতীয় উচ্চারণে আধো আধো তিব্বতি উচ্চারণে এই আর্তনাদ এখানে রাম ছাড়া আর কে করবে? সে এখন কার সঙ্গে কথা বলছে? কার কাছে দয়া ভিক্ষা করছে? পা টিপে টিপে গুহার মুখে পৌছে সে একটি ভারী লোহার দরজা ঠাহর করতে পারে। সেই দরজায় মোটা লোহার রড দিয়ে খিল আঁটা। এছাড়া দরজা থেকে একটা রড ছিটকিনি পাথরের দেওয়ালে আটকে তার সঙ্গে ভারী তালা ঝোলানো। তার মানে কেউ বা কারা রামকে ভেতরে আটকে চলে গেছে। মন্দিরের গুহ্যদ্বারের সেই লোহার খিল ও তালা আর এই গুহার খিল ও তালা একই রকম। গরব বুঝতে পারে এগুলি যতটা বাইরে থেকে আসা অবাঞ্ছিত কাউকে প্রতিহত করার জন্য, তার চাইতে বেশি করে ভেতরে বন্দি কেউ যাতে পালাতে না পারে! তার মানে এটি একটি বন্দিশালা। এর ভেতরে রাম একা অথবা আরও বন্দিদের সঙ্গে রয়েছে!

গরব নিজের মুখটাকে গুহার দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে নিচুস্বরে বলে, রাম, রাম, আমি গরব, তোমাকে নিতে এসেছি, আমি গরব!

মুহুর্তের জন্য গোঙানির আওয়াজ থামে। চারপাশে নিঝুম নিস্তব্ধতা, গরব যেন নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়। গরব আবার বলে, রাম, আমি গ - র – ব!

এবার ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, গরব, আমাকে বাঁচাও, বাঁ - চা - ও!

কিন্তু গরব ওকে কেমন করে বাঁচাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে ভাবে, কোনও বড় পাথর খুঁজে এনে তালাটা প্রথমে ভাঙতে হবে। কিন্তু এতে যে মারাত্মক শব্দ হবে তাতে আশপাশে যদি কেউ প্রহরায় থাকে, এমনকি এই রাতের নিস্তব্ধতা চিরে দূরবর্তী বনদের কানেও সেই শব্দ পৌছুবে।

তখনই ভেতর থেকে রাম বলে, গরব, তুমি তালা ভাঙার চেষ্টা করো না। এভাবে ঢুকতে পারবে না। ধরা পড়ে যাবে! বরঞ্চ কোনও আড়াল দেখে লুকিয়ে পড়ো। এক্ষুণি মঠাধ্যক্ষ আসবে। সে রোজ রাতে আসে, আর ভোর অবধি থাকে . . .একা . . একা . . সে এসে দরজা খুলবে!... লুকোও, দ্রুত, আগে নিচেকে বাঁচাও!

----ঠিক আছে রাম, আমি লুকোচ্ছি, তুমি চিন্তা করোনা, আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব, যাবোই।


চলবে ...