শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে তৃতীয় খণ্ড # দশম পর্ব

‘ক্ষুদে লিখিত অক্ষরগুলি/ অসংখ্য অশ্রুবিন্দুতে মুছে গেছে/ না লেখা স্মৃতিদের/ কখনও এভাবে মেটানো যায় না!’ - ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)

গরব নিশ্চিত, এই গল্প এখন তার নিজের স্বপ্নেও ঢুকে পড়বে।একদিন সে যখন গুরু দর্দজি মিগ্যুরের সামনে বসেছিল, তিনি কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই জিজ্ঞেস করেন, কখনও কি এমন হয়েছে যে, তুই কিছু ধরার চেষ্টা করেছিস অথচ তা তোর আঙুল গলে গেছে, তুই যখন ভাবছিলি ধরে ফেলেছিস, সেই মুহূর্তেই হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে?

প্রশ্নটা শুনে তার সারা শরীরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে যায়।

গরব এক মুহূর্ত হাতড়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, একবার...একটা কুকুর খরস্রোতা নদীর জলে ভেসে যাচ্ছিল, আপ্রাণ সাঁতরানোর চেষ্টা করছিলো, সাঁতরে সাঁতরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলো! আমি তখন সদ্যকিশোর, জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়েছিলাম, শুকনো ডালপালা কেটে বোঝা বেঁধে মাথায় নিয়ে ফিরছিলাম। নদীর পাড়ে এসে ওই দৃশ্য দেখে আমি আঙরাখার দড়ি খুলে কাঠের বোঝার সঙ্গে শক্ত করে পেচিঁয়ে বেঁধে বোঝাটাকে জলে ছুঁড়ে মারলাম। আমি ভেবেছিলাম কুকুরটি সেই বোঝা দেখে ওটার উপর উঠে বসবে, আর আমি দড়ি ধরে টেনে ধীরে ধীরে ওটাকে পাড়ে তুলবো!

হলও তাই। জলের মধ্যে ওই লাকড়ির বোঝাটাকে দেখে কুকুরটি হাঁকুপাকু করে বোঝার উপর উঠে বসে। আমি ওকে পাড়ের দিকে টেনে আনতে থাকি। মনে আনন্দ জাগে যে আমি ওটার প্রাণ বাঁচিয়েছি! কিন্তু হঠাৎ স্রোতের ধাক্কায় লাকড়ির বোঝাটা জলের মধ্যে একবার আবর্তিত হলে কুকুরটি পা পিছলে পড়ে যায়, আর আমার সামনেই প্রবল স্রোতে ভেসে যায়--

বলতে বলতে গরবের গলা আবেগে বুজে আসে ! সন্ন্যাসী তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে। ওর কথা শুনেও তিনি চুপ...অভিব্যক্তিহীন! তিনি কী বলতে চান? সে নিজে দেচমার কথা কেন চেপে গেল? এতে গুরু কুপিত হবেন না তো? কিন্তু তখুনি গুরু চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ায় গরব বুঝতে পারে যে সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত তার আর কিছুই করার নেই। সে পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে পানীয় জল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে।

পথে যেতে যেতে গুরুর কথা ভাবে। ডোকপা বার্তাবাহকদের কাছে এই পবিত্র পাহাড় অ্যামনে ম্যাৎচেনের ভূগর্ভস্থ পবিত্র স্বর্ণভাণ্ডার লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে আসা দুই বিদেশির কথা শোনার পর থেকে কয়েকদিন ধরেই তিনি নিজের গুহায় অন্তরীণ হয়ে পুজো ও জপতপে ব্যস্ত।

গরব নিজের গুহার বাইরে একটি গাছের গোড়ায় রাখা পাথরের উপর বসে। গাছে হেলান দিয়ে একের পর এক গ্রন্থ পড়ে, যথাসম্ভব প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞাকে সফল করে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। এখন তার হাতে মহাকবি ক্ষেমঙ্কর রচিত ‘বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা’। খ্রিস্টিয় একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কাশ্মীরের মহারাজ অনন্তদেবের রাজত্বকালে মহাকবি ক্ষেমঙ্করের লেখা এরকম বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ, অনুসৃত রচনা, কাব্যতত্ত্ব ও ছন্দতত্ত্ব ও নীতিগ্রন্থের পুঁথি পোতালার গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল। মহান পঞ্চম দলাই লামা এগুলি নিয়মিত পড়তেন এবং সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ৬ষ্ঠ দলাই লামা ৎসাংইয়াং গ্যাৎসোর সঙ্গেও এগুলির সম্পর্ক ছিল আবেগের। সেজন্যেই তিনি হয়তো লিখেছেন, ‘ক্ষুদে লিখিত অক্ষরগুলি/ অসংখ্য অশ্রুবিন্দুতে মুছে গেছে/ না লেখা স্মৃতিদের/ কখনও এভাবে মেটানো যায় না!’

তাঁর এই আবেগ প্রত্যেক পুনর্জন্মে দলাই লামাদের মনে সঞ্চারিত হয়েছে। ত্রয়োদশ দলাই লামা আধুনিক ইউরোপ থেকে আধুনিক মুদ্রনযন্ত্র আনিয়েছিলেন। পরে কয়েকজন আগ্রহী লামাকে সঙ্গে নিয়ে অনেক তিব্বতি গ্রন্থের পাশাপাশি ক্ষেমঙ্করের এইসব ধ্রুপদী কৃতি সম্পাদনা করে নিজস্ব মুদ্রনযন্ত্রে বই হিসেবে ছাপিয়েছিলেন। যেমন, বৃহৎকথামঞ্জরী, ভারতমঞ্জরী, রামায়ণমঞ্জরী, পবন পঞ্চাশিক, সুবৃত্তিতিলক, বিনয়বতী, লাবণ্যবতী, মুনিমতমীমাংসা, নীতিলতা, অবদানকল্পলতা, অবসরসার, ললিতরত্নমালা, মুক্তাবলী, বাৎস্যায়নসূত্রসার, ঔচিত্যবিচারচর্চা, পদ্যকাদম্বরী, শশীবংশমহাকাব্য, দেশোপদেশ, নর্মমালা, চিত্রভারতনাটক, কঙ্কজানকী, অমৃততরঙ্গমহাকাব্য, চতুর্বর্গসংগ্রহ, কবিকন্ঠাভরণ, দর্পদলন, কলাবিলাস, সময়মাতৃকা, সেব্যসেবকোপদেশ, দশাবতারচরিত ও কারুচর্যাশতক। ‘বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা’ র ভূমিকায় ত্রয়োদশ দলাই লামা লিখেছেন, শাক্যশ্রী নামে এক কাশ্মীরী পণ্ডিত এই গ্রন্থের একটি পুঁথি তিব্বতের লামা কুন-দ্গাহ রগিয়াল মৎশানকে ১২০২ খ্রিস্টাব্দে উপহার দিয়েছিলেন। এর প্রায় সত্তর বছর পরে গ্রন্থটির তিব্বতি অনুবাদ করেন সন-তন-লোচাব।

গুরু দর্দজি মিগ্যুর অন্যান্য অনেক বইয়ের সঙ্গে এই বইটি উপহার পেয়েছেন। এই বইয়ে রয়েছে ১০৮টি পল্লব বা অধ্যায়। বেশ কিছুদিন ধরেই বইটি পড়ছে গরব। এর ৬৮তম অধ্যায় ‘পদ্মাবত্যবদান’-এ সে পড়ে, ফুলের নির্যাস দিয়ে তেল তৈরি করলে ফুলের সুরভি যেমন তেলের মধ্যে লীন হয়ে যায় পূর্বের শুভ ও অশুভ কর্ম তেমন প্রাণীগণে সংশ্লিষ্ট হয়ে ফল ভোগ করার জন্য সংস্কাররূপ বাসনা নিহিত করে যায়। বুদ্ধ বজ্রাসনে বসে বজ্রসম কঠিন সমাধিতে ছয় বছর কাটিয়ে উজ্জ্বল জ্ঞানলাভ করে যখন নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়ান, তখন ভিক্ষুগণ তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানায়। এক ভিক্ষু বলেন, হে ভগবান! আপনার বিরহে সন্তপ্তা যশোধরা আপনার নিহিত গর্ভ ছয়বছর পরে প্রসব করেছেন।

গরব চমকে ওঠে, ছয় বছর? সে চোখ কচলে দেখে, না, ঠিকই লিখেছে !

সেই ভিক্ষু বলেন, কিভাবে এই শিশুর জন্ম হল, সন্দেহ করে আপনার পিতা শুদ্ধোধন ক্রোধে যশোধরাকে কুলটা আখ্যা দিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড আদেশ করেন। রাজাজ্ঞায় তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু তখন আপনি শৈশবে যেমন দেখতে ছিলেন, প্রায় তেমনই দেখতে আপনার শিশুপুত্র বাহুলককে ভালভাবে দেখে রাজা বুঝতে পারেন যে তিনি ভুল করছেন। তবু তিনি যশোধরার সাজা মকুব করার আগে একটি অমানবিক পরীক্ষা নিলেন। আপনার ব্যায়াম শিলার উপর শিশু বাহুলককে রেখে শিলাটি জলে ছুঁড়ে ফেললেন। তাঁর সত্যযাচনে শিলা জলে ভেসে উঠলো। পতিব্রতা ও পবিত্র যশোধরার কোন কর্মের ফলে এরকম দুঃখ, অপমান ও সন্তাপ ভুগতে হল?

বুদ্ধ নির্বিকার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি ধীরে বলেন, যশোধরার দুঃখের কারণও তাঁর পূর্বজন্মের ফল, পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন মহামুনি শাণ্ডিল্যের প্রস্রাব পান করে গর্ভবতী হওয়া মৃগীসম্ভূতা কন্যা পদ্মাবতী। তিনি এতই অপাপবিদ্ধা ছিলেন যে যেখানেই পা রাখতেন, সেখানেই পদ্ম ফুটতো। কিন্তু তাঁর আগের জন্মে কন্যকাবস্থায় নিজের খেলার পদ্মটি একজন প্রত্যেকবুদ্ধকে দিয়েছিলেন এবং লোভের বশে তা আবার নিয়ে শোভার বিচার করে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বালিকাসুলভ চপলতায় একবার দান করা বস্তু হরণ করার পরিণাম ফলেই পদ্মাবতীকে বধ্যভূমিতে যেতে হয়েছিল। সেই পদ্মাবতীই অধুনা যশোধরা, সেজন্যে তাকেও বধ্যভূমিতে পা রাখতে হয়েছে।

গরব ভাবে, আমিও কি কোনও পূর্বজন্মের ফল ভুগছি? গুরু দর্দজি মিগ্যুর কি তা টের পেয়ে গেছেন? নাহলে তিনি এমন প্রশ্ন করলেন কেন? গুরুকে নিজের কষ্টের কথা মন খুলে না বলতে পারার জন্যে গরবের আফশোস হয়।

গুরু তাঁকে আগে একদিন বলেছিলেন, একমাত্র প্রজ্ঞাই পারে কর্মফলকে কিছুটা বদলাতে, আর প্রজ্ঞায় পৌঁছুতে ব্যক্তিকে অনেক জ্ঞান আহরণ করতে হয়। গরব এখন সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। সেই চেষ্টা প্রতিদিনের প্রতিজ্ঞাকে আরও জোরালো করতে থাকে।

তত দিনে জনমানসে আরও ভয় বাড়িয়ে ওই বিদেশি খননকারীদের দলটি অ্যামনে ম্যাৎচেনের পাদদেশে চলতে চলতে ক্রমে সন্ন্যাসীর গুহার কাছাকাছি চলে আসে। একদিন সন্ধ্যায় তাঁরা ওখানে তাঁবু গেড়ে ক্যাম্প করে।

পরদিন দলের নেতা নীল চোখ সাহেব সবাইকে একদিন বিশ্রাম দিয়ে বলে, আগামীকাল তোমাদের নিয়ে পশুশিকারে বেরুবো! যারা বন্দুক চালাতে পারো তারা শিকার করবে, আর বাকিরা বিস্কুটের খালি টিন বাজিয়ে প্রাণীদের তাড়াবে! এখানে আসার পথে আমি দূর থেকে কিছু ছাগল আর মখপোল হরিণ দেখেছি!

ওর কথা শুনে ভাষা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত চাকররা প্রমাদ গোনে। মঙ্গোলিয়ান মালবাহকরা স্থানীয় ডোকপাদের কাছে শুনেছে যে মহান সন্ন্যাসী দর্দজি মিগ্যুর অ্যামনে ম্যাৎচেনের এদিকেই কোনও গুহায় থাকেন। এই পবিত্র অঞ্চলের সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ তাঁর স্নেহাশ্রিত ও পবিত্র। এই এলাকায় ভুলেও কোনও প্রাণীহত্যা মহাপাপ। মহান সন্ন্যাসীর কোপে পড়লে প্রত্যেকের ইহজীবন তো বটেই, পরজন্মও অভিশপ্ত হয়ে পড়বে। এই বিষয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করে যে তাঁরা সোনালি চুল সাহেবকে তাঁদের ভয় ও অনিচ্ছার কথা বুঝিয়ে বলবে। সে তিব্বতি জানে। সে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি বুঝে নিজের ভাষায় নীল চোখ সাহেবকে এই পাপকাজ থেকে নিরত করতে পারবে!

সকালে ঝর্ণা থেকে ঘড়া ভরে খাওয়ার জল আনতে গিয়ে গরব পাহাড়ের ঢালে একসঙ্গে বেশকিছু তাঁবু আর কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলতে থাকা একজন বিদেশিকে দেখে সতর্ক হয়। ফিরে এসে সে তাড়াতাড়ি পাহাড়ে চড়ে গুরুর কাছে যায়। তখনও গুহার দরজা বন্ধ। গরবের আর তর সয় না। গুহার দরজার বাইরে থেকেই গুরুকে এই ক্যাম্পের ব্যাপারে জানায়।

গুরু বলেন, তুই এখুনি গিয়ে দ্যাখ ওরা কী করছে! চাকরদের জিজ্ঞেস করে জেনে আয় যে ওদের মতলব কী?

গরব হেঁটে যেতে যেতে মনে মনে ভাবে, গুরু দর্দজী ঠিকই টের পেয়ে গেছেন - তাঁদের মতলব কী! তবুও গরবকে পাঠানোর মধ্যে রয়েছে অদূর ভবিষ্যতের আশু অমঙ্গলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কোনও গূঢ় পদক্ষেপ।

মঙ্গোলিয়ান চাকররা যখন সোনালি চুল সাহেবের সঙ্গে তাঁদের ভয় ও অনিচ্ছার কথা বলার জন্যে একসঙ্গে তাঁবু থেকে বেরিয়েছে ঠিক তখনই গরব ওদের কাছে পৌঁছে যায়। তখনই হঠাৎ মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। নিজের দীর্ঘ ছায়া দেখে গরবের না জানি কেন আত্মবিশ্বাস বাড়ে।সবাই ওকে দেখে একরকম চমকে ওঠে। এই সৌম্যকান্তি সুঠাম যুবকটি কে? কোথা থেকে এসেছে?

গরব ওদের চোখের ভাষা আন্দাজ করে স্মিত হেসে বলে, নমস্কার! আমি পর্যটক নই, ওই পাহাড়ের গুহায় মহান সন্ন্যাসী গুরু দর্দজি ম্যাৎচেনের সঙ্গে থাকি! তোমরা হয়তো তাঁর কথা শুনেছ!

ওরা মাথা নেড়ে হাতজোড় করে জানায় যে পথে নানা জায়গায় পশুপালকদের অনেকের কাছেই তাঁরা মহান গুরুর নানা অলৌকিক কীর্তির কথা শুনেছে। ওরা যে সেই মহাত্মার গুহার পাদদেশেই তাঁবু গেড়েছে সে ব্যাপারে তাঁদের কোনও ধারণা ছিল না! ওরা প্রত্যেকেই গরবের সামনে নতজানু হয়ে গুরুদর্শনের আর্জি জানায়।

গরব বলে, গত কয়েকসপ্তাহ ধরে তিনি গুহায় অন্তরীণ, আমি নিজেই তাঁর দর্শন পাই না, তবে দরজার বাইরে থেকে তোমাদের তাঁবু খাটানোর খবর দিলে তিনি সাড়া দিয়েছেন। তোমরাও গিয়ে গুহার বাইরে সিঁড়িতে কপাল ঠেকিয়ে আসতে পারো! তিনি ভেতর থেকে তোমাদের আশীর্বাদ করবেন, আবার তোমাদের ভাগ্য ভাল থাকলে বেরিয়ে দেখাও করতে পারেন! কিন্তু আমি জানতে এসেছি তোমরা কোথা থেকে এসেছ এবং কোথায় যাচ্ছ? তোমাদের উদ্দেশ্য কী? দূরের গ্রাম থেকে শিষ্যরা এসে জানিয়ে গেছে যে তোমাদের দলের নেতা দুই বিদেশি সাহেব?

তিব্বতি জানা দুই মঙ্গোলিয়ান চাকর তখন গরবকে বলে যে তাঁরাই ওই দুই বিদেশি সাহেবের কথা পশুপালকদের জানিয়েছে। ওদের সঠিক উদ্দেশ্য তাঁরা জানে না! ডোকপা বার্তাবাহকরা যা বলেছে তাঁর বেশি ওরাও আর কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু এখানে আসার পর ওরা একটা নতুন বিপত্তির মুখে পড়েছে; নীল চোখ সাহেব আগামীকাল ওদেরকে নিয়ে মখপোল আর ছাগল শিকারে বেরুতে চায়।

একথা শুনে গরব শিউরে উঠে বলে, তোমরা কোনভাবেই ওর সঙ্গ দিও না! প্রভু দর্দজি মিগ্যুর কোনও পশুখাদ্য খান না, প্রবল শীতেও কোনও পশমবস্ত্র পরেন না! প্রবল শীতে বন্য পশুদের খাদ্য সংগ্রহে অসুবিধা হলে ওরা তাঁর গুহার সামনে নেমে আসে। তিনি তখন নিজের হাতে ওদের জন্য জমিয়ে রাখা খাবার খাওয়ান। তাছাড়া নিজের ভাণ্ডার থেকে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পাহাড়ের নানা গুহায় ঢুকে ঢুকে শ্লথ হয়ে পড়া প্রাণীদের নিজের হাতে খাওয়ান, এমনকি বন্য ভালুকরাও তাঁর স্নেহের পরশ পায়। এই পর্বতের সমস্ত ভূতপ্রেত তাঁর বশে। কাজেই তাঁর আশ্রিত কোনও প্রাণীর গায়ে যদি তোমাদের কারণে আঁচড়টিও লাগে, তোমরা অভিশপ্ত হবে!

গরবের কথা শুনে মঙ্গোলিয়ান চাকরদের শিকারের অনিচ্ছা আরও প্রবল হয়। ওরা বলে, সোনালি চুল সাহেবটি তিব্বতি জানে, আমরা যাচ্ছি তাকে অনুরোধ করতে যাতে তিনি নীল চোখ সাহেবকে নিজের ভাষায় বুঝিয়ে বলেন!

গরব ভাবে, সোনালি চুল সাহেবের কাছে আমারও যাওয়া উচিত! সে বলে, চলো আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই!

সোনালি চুল সাহেব তখন ওর তাঁবুর সামনে নরম রোদে গাঢ় সবুজ ঘাসে বসে সিগারেট খেতে খেতে চারপাশের প্রকৃতি দেখছিলো। হঠাৎই সমস্ত চাকরদের দলবদ্ধ হয়ে ওর দিকে আসতে দেখে সে অবাক হয়। এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখেনি, তাই মুচকি হেসে তিব্বতি জানা দুই চাকরকে ওদের এভাবে আসার কারণ জিজ্ঞেস করে।

এই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে উৎসাহিত হয়ে তারা প্রাণখুলে নিজেদের কথা বলে। পবিত্র পর্বতে শিকারের পরিণাম কী হতে পারে সে সম্পর্কে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানায়। অবশেষে বলে, আমরা এসব চাই না, আপনি নীল চোখ সাহেবকে বোঝান!

সোনালি চুল সাহেব আবার হেসে বলে, ঠিক আছে, আমি বলবো, কিন্তু এতে মনে হয় না তোমাদের কর্তা শিকারের সিদ্ধান্ত বদলাবেন! ওর মাথায় যখন ভূত চেপেছে, নরকের সমস্ত শয়তানরা এসেও তাকে থামাতে পারবে না! আচ্ছা ইনি কে? এঁকে তো আমি আগে কখনও দেখিনি!

- ইনি মহান সন্ন্যাসী দর্দজি মিগ্যুরের শিষ্য। দয়ার অবতার এই সন্ন্যাসী পর্বতবাসী সমস্ত প্রাণীর রক্ষক, প্রবল শীতে তিনি বন্য পশুদের আহার জোগান, এমনকি বন্য ভালুককেও নিজের হাতে খাওয়ান!

ওদের কথা শুনে গরব অবাক হয়ে যায়। সে নিজে গুরু সম্পর্কে এত কিছু জানে না! ওরা নিশ্চয়ই ডোকপাদের কাছে এসব জেনেছে!

সাহেব বলে, খুব ভাল, সন্ন্যাসীর শিষ্য, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, চলে যেও না! তার আগে আমি ওদের অনুরোধ সম্পর্কে দলনেতাকে জানিয়ে আসি!


চলবে ...