বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,পর্ব -৩

লেখক পরিচিতি ঃ শ্যামল ভট্টাচার্য , আশির গোড়া থেকেই ত্রিপুরার একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার রূপে উঠে আসেন । ক্রমশ ত্রিপুরার গণ্ডি ছাপিয়ে সর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরেন তাঁর স্বভাবজাত প্রতিভার স্বপ্রকাশে । একাধিক ভাষাবিদ কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য ভারতীয় কথা সাহিত্যে সহজেই নিজের আসন পাকা করে নেন । উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ –‘চিলতে দাগ’, ‘ফুলমতির বসন্তকাল’,জামিছলঙ’,’ভারোং পাখির নাচ’,’Paisley’ এবং আকাশে ওড়ার গল্প’। তাঁর অনন্য উপন্যাস ‘বুখারি’র জন্য ২০১৫ সালে ‘ত্রিবেণী সাহিত্য আকাদেমি’, জলন্ধর কর্তৃক ‘অমৃতা প্রীতম সম্মান’-এ ভূষিত হয়েছেন । ‘লোদ্রভার কাছাকাছি’ উপন্যাসের জন্য ২০১০ সালে তিনি লাভ করেন ‘পশ্চিম বংগ বাংলা আকাদেমি পুরষ্কার’ । পাঞ্জাবী কথাসাহিত্যিক মোহন ভাণ্ডারির ,’মুন দী আঁখ’-এর অনুবাদ’কুমারী হরিণীর চোখ’( ২০০৭ ) অনুবাদ করে ২০১১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার লাভ করেন । অনুবাদ করেছেন একাধিক ভাষা থেকে । ‘মহাসত্যের বিপরীতে’ – চলছে তিব্বতিদের অস্তিত্বের সংকট ও জীবন যুদ্ধের সুদীর্ঘ লড়াই এর উপর ভিত্তি করে তিন প্রজন্ম নিয়ে এপিক উপন্যাস ...

সিনদোংমার অভিসার

প্রত্যেক সম্পর্ক মানুষের জীবনে ভিন্ন মাত্রাবহ। ঘাসের উপর বিছানো কম্বলে এবারের সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলনের অভিজ্ঞতা এতই অভিনব যে দলপতি অবাক হয়ে যায়। যৌনতা মানুষকে এত আনন্দ দিতে পারে। অকুতোভয় ডাকাত সর্দার অনুভব করে, এতদিন শুধু সে একটি স্বাস্থ্যবান ঘোড়া যেমন ঘোটকির সঙ্গে গমন করে ততটাই সরলভাবে কিছুক্ষণ শরীর সঞ্চালন করে একসময় গমকে গমকে বীর্যস্খলন করে থামাকেই যৌনতা বলে জানতো। সে কখনও কোনও মহিলাকে জোর করে পেতে চায়নি। ওর পেশীবহুল শরীর দেখে আকৃষ্ট হয়ে যে মহিলাই তাকে চেয়েছে প্রত্যেকেই অন্যের বউ। সেসব গোপন অভিসারে যৌনমিলনে তাদের ভূমিকাও নিছকই পশুর মতন জৈবিক। প্রত্যেকেই প্রায় একইভাবে পা ফাঁক করে ওকে টেনে নিত। তাদের কারও স্মৃতিই দলপতিকে দীর্ঘদিন তাড়া করেনি।

কিন্তু এই মেয়েটি আলাদা। ওর স্পর্শে জাদু, সমস্ত অস্তিত্বে এক অভূতপূর্ব আনন্দ ওকে অসাড় করে দেয়। অতীতের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে নসাৎ করে দেওয়া একটি অনুভূতি, প্রথমবার হঠাৎ ছোরাবিদ্ধ হওয়ার মতন যন্ত্রণায় সঙ্গিনীকে ককিয়ে উঠতে দেখে সে কেমন দম হারিয়ে ফেলে। যন্ত্রণায় খামচে ধরায় ওর দুই বাহুতে জ্বালা করতে থাকে। সে তখন একটি হিংস্র পশুর মতন উতুঙ্গ উথ্থানে আর ইন্দ্রিয়সুখে কাতর উদ্বিগ্ন দোলাচলে। এই দোলাচলই এই প্রথম ওর মনে কেমন একটি দয়ালু প্রাণীর জন্ম দেয়। ক্রমে সেই প্রাণীটাই পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতন ডানা ছড়িয়ে তার সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে নেয়। ক্রমে সেই পক্ষীরাজের শরীরই ওর শরীর, পক্ষীরাজের মাথাটাই তার মাথা, সমস্ত অনুভূতিই পক্ষীরাজের মতন ডানা ঝাপটে সদ্য আবিষ্কৃত এক পরীর চারপাশে উড়তে থাকে। কিন্তু একবারের জন্যও ছুঁয়ে ফেলে না। সে কী পাগল হয়ে গেছে ?

ধীরে ধীরে সে নিজেকে সামলায়, কিন্তু দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মেয়েটির দিকে। তাঁবুর আড়ালকে অগ্রাহ্য করে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার গায়ে। এ যেন জ্যোৎস্নায় স্নান করতে থাকা এক অপার্থিব নারী।

তিব্বতীরা বিশ্বাস করে সিনদোংমা নামে রাক্ষসীরা ইন্দ্রিয়সুখ পাওয়ার জন্য সুন্দরী মেয়ে সেজে সুপুরুষ যুবকদের বশ করে একসময় স্বমূর্তি ধারণ করে তাদের খেয়ে ফেলে। কিন্তু দলপতি অত্যন্ত বাস্তববাদী ও অকেতোভয়। সিনদোংমার কথা মনে হওয়ায় সে হেসে ফেলে। জিজ্ঞেস করে, - তোর নাম কী?

তীর্থযাত্রী মেয়েটি জবাব দেয়, - দেচমা, আনন্দদায়িনী।

-বাঃ, যেমন নাম তেমন কাম, তুই সত্যিই কামিনী, এর আগে কাউকে এমন আনন্দ দিয়েছিস?

মেয়েটি হেসে ফিসফিস করে বলে, - তুই একটা গাধা। আমাকে ফাটিয়ে রক্তাক্ত হলি, বুঝতে পারলি না যে আমি.....।

দলপতি বোঝে দেচমা সত্যি কথা বলছে, নিজের আবেগকে সামলাতে গিয়ে এমন প্রগলভ উচ্চারণ তাকে লজ্জা দেয়। সে সহজ হওয়ার জন্য বলে, আমার নামও গরব। গরব মানে গর্ব, সত্যিকারের আনন্দ।

দেচমা দু’হাত বাড়িয়ে গরবের গলা জড়িয়ে ধরে। ওর ঠোঁটে চুমু খায়। - এত শিহরণ জাগে শরীরে যে গায়ের রোম সব সোজা দাঁড়িয়ে যায়। গরব দেচমার কপালে, গালে, থুতনি ও গলায় চুমু খায়। তারপর দেচমার কানে ফিসফিস করে বলে, আমাদের দু’জনের নামে অদ্ভুত মিল।

দেচমা তেমনি ফিসফিস করে বলে, এমনি আদর করো, তারপর ধীরে ধীরে ধীরে....

গরব ওর ইশারা বুঝতে পারে। তার সারা শরীরে আলতো চুম্বনে চুম্বনে দেচমাকে পাগল করে তুলতে তুলতে নিজেও প্রচন্ড হয়ে ওঠে। তবুও সন্তর্পণ ধীরে ধীরে উপগত হয়। ধীরে ধীরে ওদের মিলনে এক অশ্রুতপূর্ব জলতরঙ্গ বেজে ওঠে। সেই মূর্ছনায় জেগে ওঠে অদ্ভুত ছন্দ। লজ্জায় তাঁবুর আড়ালে চলে যায় চাঁদ। দু’জনেই এক নতুন আনন্দে পরস্পরকে উপভোগ করতে থাকে প্রায় শেষরাত পর্যন্ত।

পরদিন সকাল থেকে ডাকাতরা লুট করা পশু আর অন্যান্য জিনিসপত্রের তালিকা তৈরি করতে শুরু করে। চারপাশে কোনও মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। তবুও পঞ্চাশজন ডাকাত প্রায় নিঃশব্দে এই তালিকা তৈরি করতে থাকে। তালিকা তৈরি হলে সবকিছু পঞ্চাশজনের মধ্যে ভাগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাশাপাশি জিনিস ও গয়নাগাটি বিক্রি করে ওরা টাকা ভাগ করে নিতে পারবে সেগুলিরও আলাদা তালিকা তৈরি হয়। নগদ টাকা সবাইকে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। কোন্ জিনিসটা কোন্ বাজারে বা শহরে বিক্রি করলে বেশি মূল্য পাওয়া যাবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়। এই ডাকাতরা কেউই দু’বেলা পেটভরে না খেতে পাওয়া গরিব ঘরের ছেলে নয়। এদের কারও নিজস্ব খেতখামার জমি জিরেত রয়েছে, কারও রয়েছে কয়েকশো ভেড়া। ডাকাতি এদের নেশা। আগেকার রাজাদের সাম্বাৎসরিক শিকারে যাওয়া বা সাম্রাজ্যবৃদ্ধির জন্য যুদ্ধে যাওয়ার মতনই কিছুদিন পর পর ওরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে এ ধরণের অভিযানে বেরোয়। নাহলে সমাজে সাহসি পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি কেমন করে পাবে?

এই বীরদের প্রায় প্রত্যেকেরই উঁচু পাহাড়ে নিজস্ব ডেরা রয়েছে। কারও আবার উপত্যকায় দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত রয়েছে। কিন্তু তিব্বতের অধিকাংশ ক্ষেতই একফসলি। সেই ফসল গুদামজাত করার পর যুবকদের তেমন কিছুই করার থাকে না। মহিলারা সন্তান লালনপালন আর বয়স্করা ধর্মকর্মের মাধ্যমে নিজেদের পাপস্খালন এবং পরজন্মের জন্য পুণ্যসঞ্চয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ডানপিটে যুবকরা এরকম অভিযান উপভোগ করে। লুটের মাল উপরি পাওনা। লুটের শস্য তাদের পারিবারিক শস্যভান্ডারে যুক্ত হয়, পশুগুলি বাড়ির অন্য পশুদের সঙ্গে মিশে যায়। আবার কখনও এসব কিছু দূরবর্তী কোনও বাজারে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে।

এবারের লুটে রয়েছে মহার্ঘ চিনাংশুক, রুপোর বাসনপত্র আর সোনা ও রুপোর অলঙ্কার। এগুলি কোনওটাই তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার জিনিস নয়। এগুলিকে কোনও ছোটখাট বাজারে বিক্রিও করা যাবে না। কদাচিৎ খদ্দের পেলেও যথাযথ দাম পাওয়া মুস্কিল। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের কানে গেলে ওরা জিনিসগুলির উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। উৎস খুঁজে না পাওয়া অব্দি জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করে দেবে। সেজন্য যেতে হবে দূরবর্তী কোনও বাণিজ্যকেন্দ্রে।

আলোচনা চলতে থাকে। সারাদিন মিষ্টি রোদে গোণার কাজ শেষ করে বিকেলের পড়ন্ত রোদে ওরা আলোচনায় বসেছিল। বাক্-বিতণ্ডায় বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। মাঝরাত অব্দি সবাইকে খুশি করার মতন সমাধান বেরোয় না। সবাই হাই তুলতে শুরু করায় গরব আলোচনা পরের দিনের জন্য মুলতবি রেখে উঠে দাঁড়ায়। একজন সহায়ককে বলে, আমাকে ওখানে দু’মগ চা দিয়ে যাস্।

সে নিজের তাঁবুর দিকে ইঙ্গিত করে। দুপুর থেকে দেচমা ওখানে একা রয়েছে। এতক্ষণ ব্যস্ত থাকায় ওর কাছে একবারও যেতে পারেনি। আদৌ কোনও দানাপানি ওর পেটে পড়েছে কিনা, কে জানে !

গরব নিজের ঘোড়ার পেটে ঝোলানো থলে থেকে কয়েক টুকরো রোদে শুকানো মাংস নিয়ে দেচমার কাছে পৌঁছে যায়। তাঁবুর এককোণে মোমবাতি জ্বেলে অন্য কোণে বিছানো কম্বলের উপর উপুড় শুয়ে পা নাচাচ্ছিল সে। গরব ঢুকে গলাখাকারি দিলে সে উঠে বসে। তখনই সহায়ক দু’মগ গরম চা, দু’বাটি ৎস্যাম্পা দিয়ে যায়। গরব একবাটি করে চা, ৎস্যাম্পা আর দু’টুকরো শুকনো মাংস দেচমার দিকে এগিয়ে দেয়। মাংসের টুকরোগুলি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, পেট ভরে খেয়ে নে। দেচমার ক্ষুধার্ত চেহারা স্মিত হাসিতে প্রস্ফুটিত হয়। খাওয়ার মতন প্রাত্যহিক ও পরিচিত বিষয় ওকে স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। গরব জিজ্ঞেস করে, ভাল আছো? দেচমা, ইতিবাচক মাথা নাড়ে। কুহকিনী দৃষ্টিতে তাকায়। গরব হেসে বলে, তোমাকে বাক্যবাগীশ বলা চলে না, এখন কী করবে ভেবেছো? তোমার তীর্থযাত্রী দলের নাগাল তো আর পাবে না। দেশে ফিরবে কেমন করে? দেচমা চুপ। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। গরব আবার প্রশ্ন করে, যেখানে তোমাদের থামিয়েছিলাম সেখান থেকে কতদূর তোমার দেশ? ক’দিন পশুর পিঠে চড়ে ওখানে পৌঁছেছিলে? তোমার বাবা-মা জীবিত? এখন নিশ্চয়ই ওদের জন্য কষ্ট হচ্ছে? ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে?

মেয়েটি ওর কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কথা শুনছিল, আর চাকুম চুকুম করে মাংস খাচ্ছিল। এবার সে বেশ আদুরে গলায় জবাব দেয়, না তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।

ওর কথা গরবের অস্তিত্বে রিনরিন করে বেজে ওঠে।

গরব হেসে ফেলে। মেয়েটি অন্যরকম জবা দিলেও বরঞ্চ ওকে বিব্রত করতো। বাস্তব এটাই যে আপাতত ওর সঙ্গে থাকা ছাড়া ওর জন্যে অন্য কোনও পথই খোলা নেই। গরব বলে, তাই ভাল। নাহলে এই বিশাল শ্যাং থ্যাং-এ না খেতে পেয়ে মরতে হবে।

যদিও আক্ষরিক অর্থে শ্যাং থ্যাং বলতে উত্তরের মালভূমিকে বোঝায় কিন্তু তিব্বতিরা এ ধরনের যে কোনও জনবসতিহীনশন ও ঘাসের বনকেও শ্যাং থ্যাং বলে। একথা বলার পরও দেচমাকে চুপ থাকতে দেখে গরব আবার জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন আমার সঙ্গে থাকতে চাও? তুমি কি আমার বউ না প্রেমিকা?

- আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, প্রায়ই দেখি।

- হ্যাঁ, একথা তুমি গতকালও বলেছ, আশ্চর্য। এর আগে কোনওদিন আমাদের দেখাই হয়নি। একটু থেমে গরব আবার জিজ্ঞেস করে, - কেমন স্বপ্ন? ঘুমের মধ্যে, না দিবা স্বপ্ন?

- ঘুমের মধ্যে, আবার কখনও জেগেও-

বলতে বলতে দেচমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে চোখ বড় বড় করে বলে, - আমি দেখি, তুমি নির্জন এলাকা দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছ, একা, জিনের উপর সোজা হয়ে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতে দেখতে এগোচ্ছ। ওই দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুকে আমি কোনওদিন দেখতে পাইনি, চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি। অবশ্য আমার বেশি লক্ষ্য ছিল তোমার উপরই। আমি কোনও এক অজানা আকর্ষণে তোমার দিকে ছুটে যেতে চাই, কিন্তু পারি না। তারপর একসময় কোনও কিছু আমাকে শূন্যে তুলে ধরে হাওয়ায় ভাসিয়ে তোমার সামনে ঘোড়ায় বসিয়ে দেয়। আর তুমি ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে শ্যাং থ্যাং-এর শুষ্ক তৃণভূমির বুক চিরে এগিয়ে যেতে থাক। কখনও কেউ এসে আমার সঙ্গে কথা বললে সেই দৃশ্য আর দেখতে পাই না। তারপর নিজেকে ভীষণ একা একা আর রিক্ত বলে মনে হয়, যেন আমার শরীর বা অস্তিত্বের কোনও অংশ ওই ঘোড়ার পিঠে চেপে দিগন্তের দিকে চলে গেছে।

গরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, - তোমাকে তুলে নিয়ে আমি কোথায় যাই?

- আমার জানা কোনও গন্তব্যের দিকে তুমি যাও না, শুধু আমার মুখে দমকা হাওয়ার ঝাপটা লাগে, ঘোড়ার ক্ষুরের চাপে ছোট ছোট নুড়ি পাথর পেছনে ছিটকে যেতে দেখি। পাহাড়, সরোবর আমাদের দু’পাশে আসে আর আমরা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই। আমার পিঠে তোমার আলখাল্লা ভেদ করে তোমার শরীরের উত্তাপ, নিতম্বে তোমার বলিষ্ঠ দৃঢ় চাপের ছন্দ আমাকে ভিজিয়ে দিতে থাকে, আর আমাদের দু’জনের সম্মিলিত ধুকপুকানি....

এসব শুনতে শুনতে গরবের মনে কেমন এক আশ্চর্য অনুভূতি হয় সেভাবে, মেয়েটি কি সরল, নিজের ব্যক্তিগত দুর্বলতার কথা অবলীলায় বলে দিচ্ছে। এই অন্তরঙ্গতা গরবকে মুগ্ধ করে। সেবলে, - আমি একা, এখনও বিয়ে করিনি, চাইলে আমার হতে পারো, ....অন্ততঃপক্ষে কিছুদিনের জন্যে। গ্রামে আমার বাড়ি নেই। কিন্তু বড় তাঁবু, একপাল পশু, সেগুলিকে দেখাশোনার জন্যও লোক রয়েছে। এখান থেকে পাঁচ-ছ’দিন ঘোড়া চালিয়ে আমার গ্রামে পৌঁছুবো।

- পাঁচ থেকে ছ’দিন, মাত্র পাঁচ-ছয়দিন, তারপর?

- তারপর আর কী, কিছুদিন বিশ্রাম। তুমি আমার তাঁবুতে থাকবে; তুমি তো আর কিছুই চাও না – শুধুই আমাকে –

গরবের মনে হয় ওর জবাবে দেচমা খুশি হয়নি। কী চায় মেয়েটা? সে বলে, - পর্যাপ্ত খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, কোনও কাজ করতে হবে না, ঘরের কাজও না।

- দেচমা এবার বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, - আমাদের বাড়িতেও পর্যাপ্ত খাবার ছিল, চাকরবাকর ছিল, আমাকে কখনও কুটো ভেঙে দু’টো করতে হয়নি।

- সত্যি! তুমি তো দেখছি বেশ বড় ঘরের মেয়ে, তোমার বাবা কে?

- মারা গেছে।

- মা?

- মা মামার সঙ্গে থাকে। মায়ের অনেক জমিজিরেত আছে, তার থেকে কিছুটা বন্ধক দিয়ে যে টাকা পেয়েছে তা ব্যবসায় খাটিয়েছে। ব্যবসায় লাভ হলে আবার জমি ছাড়িয়ে নিয়েছে, মা একজন সফল ব্যবসায়ী।

- তোমার মামা কী করে?

- মামাও ব্যবসায়ী, দোকান আছে।

- কোথায়?

- দিরগিতে।

গরবের মনে সন্দেহ জাগে। সে জেরা করার ভঙ্গিতে বলে, কিন্তু তুমি যে তীর্থয্ত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছিলে তারা তো দিরগি থেকে আসছিল না, তারা তো মঙ্গোলিয়ান, তারা আলাচান প্রদেশের তাকৌরে এলাকার মানুষ।

- তুমি ওদের সঙ্গে কোথা থেকে আসছিলে?

- ওদের সঙ্গে পথে দেখা।

- কোথায়? ওদের যাত্রা পথে তুমি কেমন করে এলে?

- আমি সওদাগরদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম।

- সওদাগরদের সঙ্গে? গরব অবিশ্বাসের স্বরে প্রশ্ন করে, তোমার মাআর মামা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একা যেতে দিল? কোথায় যাচ্ছিলে?

- ঘর থেকে পালিয়েছিলাম।

- কেন?

- তোমার খোঁজে – একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। দিরগি থেকে অনেকটা দূরে ওদের সঙ্গে দেখা হয়। ওদেরকে বানিয়ে গল্প বলি যে আমার ভিক্ষুনি দিদির সাথে লথসা যাচ্ছিলাম, পথে দিদি মারা গেছে, তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে আমি একাই লথসা যেতে চাই, যাতে এই যাত্রার পুণ্যফল দিদিকে পরজন্মে সুখে রাখে। একথা শুনে ওরা আমাকে একটা খচ্চর দেয়। সেই খচ্চরে চেপে ওদের সঙ্গে যেতে যেতে আমি চারদিকে তাকিয়ে শুধু তোমাকে খুঁজতে থাকি – জানতাম, একদিন পাবোই।

একটু থেমে দেচমা আবার বলে, ওদের সঙ্গে কিছুদিন চলার পরই একদিন ওরা আমাকে কু-প্রস্তাব দেয়। যতদিন লথসা না পৌঁছাই একেকদিন রাতে একেকজনের তাঁবুতে শুতে বলে। একথা শুনে আমি সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারেই পালাই। ওদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে একটি গিরিখাত পাই। অনেক কষ্টে গিরিখাতে নেমে পড়ে নিজের ইজ্জত বাঁচাই। সারারাত বিচ্ছু আর বিষধর সাপের ভয়ে নিদ্রাহীন কাটাই। পরদিন সকালেও খাদের মধ্যেই পাহাড়ের কোটরে লুকিয়ে থাকি। ভাগ্যিস লুকিয়ে ছিলাম। পরদিন সকালে সত্যি সত্যি কয়েকজন সওদাগর খাদের মধ্যে নেমে আসে। ওরা আমাকে খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে একসময় ফিরে যায়। আমার সম্বল বলতে ছিল পিঠের পুটুলিতে বাঁধা কয়েক কেজি ৎসাম্পা। একজায়গায় ছোট্ট একটা ঝর্ণা পেয়ে সেই জলে গুলে ৎসাম্পা খাই। পেট ভরে জল খাই। ওই সওদাগররা ততক্ষণে নিশ্চয়ই অনেক দূর চলে গেছে। আমি আবার তোমাকে পাওয়ার প্রতীক্ষায় পথ চলতে থাকি। কোথায় কোনদিকে গেলে তোমাকে পাবো জানতাম না। কিন্তু জানতাম যে একদিন নিশ্চয়ই তোমাকে পাবো। সেজন্য হাঁটতে থাকি যেদিকে দু’চোখ যায়। একটু দেচমা বলে,

- এক জায়গায় পথের পাশে তৌমাসের পাতা দেখে মাটি খুঁড়ে তৌমাস বের করে পরিষ্কার করে খাই। আরেক জায়গায় একটি জলাভূমি পেয়ে শৈবাল সংগ্রহ করে খাই। আর তারপরই একদিন লথসাগামী তীর্থযাত্রীদের দলটিকে পাই। তাদের কাছেও আমি দিদি মারা যাওয়ার গল্পটি শোনাই। এরা তুলনায় অনেক সহজ-সরল মানুষ। এরা আমার কথা সহজেই বিশ্বাস করে আমাকে সঙ্গে নেয়। খাবার ও খচ্চর দেয়। আর এভাবেই আমি অবশেষে তোমাকে পেয়ে যাই।

গরব ভাবে, মেয়েটির গল্পে কতটা জল রয়েছে, কে জানে! সে হয়তো আদ্যোপান্ত মিথ্যে কথাই বলে যাচ্ছে। কিন্তু গরব তাঁর নতুন বান্ধবীকে নিজের অবিশ্বাসের কথা বলতে পারে না। মেয়েটি যদি বুঝে যায় যে, গরব তার কথা বিশ্বাস করছে না, তাহলে রেগে যাবে, গরব আর তার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারবে না। অবশ্য মেয়েটি যদি তার বাড়ির কথা আর সঠিক পরিচয় না জানাতে চায়, গরব ওকে জোর করবে না। বরঞ্চ এ সম্পর্কে অজ্ঞতা তাকে অনেকটা হাল্কা রাখে। মেয়েটির বাড়ির লোক যদি প্রভাবশালী কেউ হয় এবং একদিন তার সঙ্গে খুঁজে পায় সেক্ষেত্রেও গরব কোনও মতেই দায়ী থাকবে না। বরঞ্চ সঠিক পরিচয় জানালে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার দায়িত্ব বর্তায়।

- ওকে চুপ থাকতে দেখে দেচমা জিজ্ঞেস করে, - তুমি বাড়ি ফিরে কি করবে?

- কী আবার, একজন সাধারণ ডোকপার মতন পশুপালন আর অন্যান্য ব্যবসা।

- ব্যবসা? গতকাল যে ধরণের ব্যবসার কাজ করেছো, সেরকম? গরব হেসে বলে, হ্যাঁ, সেরকমই, তুমি তো সবই দেখেছ, কী আর বলবো, আমি জাগসপা সর্দার; এতে তো তোমার ভয়ের কিছু নেই, তুমি তো –

- হ্যাঁ, আমি তোমার ভক্ত। দেচমা ফিসফিস করে বলে। তারপর চোখ বড় বড় করে বলে, সেই গিরিখাতের আড়াল থেকে হঠাৎ শূন্যে একহাত উঁচিয়ে তুমি যখন ঘোড়ার পিঠে তীর্থযাত্রীদের দিকে এগিয়ে আসছিলে তোমাকে পশুর দলে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘের মতন সুন্দর লাগছিল, এরকম দৃশ্য আমি স্বপ্নেও দেখিনি, ভয়ংকর সুন্দর। এরপর থেকে এমন ব্যবসায় যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? কি গো, যাবে তো?

- তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ডাকাতি? এমন কথা কখনও শুনেছ যে কোনও জাগসপা কোনও মহিলাকে নিয়ে ডাকাতি করতে গেছে! এটা পুরোপুরি সাহসী ছেলেদের কাজ। মেয়ের থাকবে বাড়িতে। এখান থেকে দিন পাঁচেক ঘোড়া চালিয়ে গেলেই আমার গ্রাম। পছন্দ হয়ে থাকলে তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারো – আজীবন। আর তা না হলে অন্য কাউকে বেছে নিতে পারো!

গরব, দু’হাত ছড়িয়ে এই পাহাড়ের পেছনে বিপুলায়তন তিব্বতের বিস্তীর্ণ মালভূমির বিশালতাকে ইঙ্গিত করে অবজ্ঞামিশ্রিত শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করে।

দেচমা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, প্রশ্নই ওঠে না। আমি ভয় পাই না, আর ফুলুটসিদের মতন এত সহজে ক্লান্তও হই না। পাঁচদিন তো খুবই কম। এত কষ্ট সহ্য করে, এতদিন ধরে এত খোঁজার পর অবশেষে তোমাকে পেয়েছি, এখন আর কোনওদিন তোমার কাছ ছাড়া হতে চাই না। আমি তোমার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে সফর করতে চাই, দূরে, অনেক দূরদেশে দিনের পর দিন, সপ্তাহ, মাসের পর মাস এমনি পাশাপাশি সফর করে যেতে চাই আজীবন। তারপর গতকালের মতন কোনওখানে তাঁবু খাটিয়ে শুকনো মাংস আর ৎসাম্পা খেয়ে রাত্রিবাস।

কথাগুলি বলতে বলতে দেচমার স্বর নিচু হয়ে যায়। সে কোনও সম্মোহিত মানুষের মতন প্রলম্বিত উচ্চারণে ক্রমে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে। স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে ঘোড়ায় বসে মাইলের পর মাইল দিনরাত সপ্তাহ মাস বছরকাল চলতে থাকে, চলতেই থাকে।

দেচমার গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া আর এক অদ্ভুত মায়াবি উচ্চারণের সঙ্গে গরবের গতরাতের মিলন অভিজ্ঞতার টাটকা স্মৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ক্রমে দেচমার স্বপ্নদৃশ্যগুলি গরবও দেখতে শুরু করে। তার দৃশ্যে একটু পরিবর্তন, দেচমা তার পেছনে বসে জাপটে ধরে থাকে আর সে বিস্তৃত ঊষর মালভূমির বুকে ঘোড়া চালিয়ে যেতে থাকে। গরব ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়ে দেচমার আগ্রহ নেই। দেচমা ছাড়া গরবও আর কিছু ভাবতে পারে না। সে মেঘহীন মুক্ত আকাশে নিকটবর্তী তারাদের আলোয় তাঁবু খাঁটিয়ে পরস্পরকে বারবার পাওয়ার কথা ভাবে। দেচমার সান্নিধ্য নিয়ে এই কাম ভাবনা থেকে তার হাত ও পায়ের আঙুলগুলিতে এক অদ্ভুত জ্বলুনি শুরু হয়।

গরব অনুভব করে, এই পরমসুখদায়িনী কন্যাকে নিয়ে ওর গ্রামের তাঁবুতে তোলা, প্রতিবেশি পশুপালক নিজের সহায়ক ও অনুগামীদের দৃষ্টির লেহনের মধ্যে এখুনি নিয়ে গেলে তার অভিসার অসম্পূর্ণ থাকবে। সেভাবে, গ্রামের তাঁবুতে নিয়ে গেলে এই দেচমাকে যদি ফিরে না পাই? ওর কথা যদি সত্য হয়, মেয়েটি স্বপ্নের নায়ককে কাছে পেতে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। হয়তো বাড়ির মানুষ ওকে ঘরে বন্দি করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই পরমাসুন্দরী মেয়েটি, ছদ্মবেশী রাক্ষুসী কিম্বা পরীও হতে পারে যে শুধু মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে থাকতে ভালবাসে। পরীই হবে।

গরব বিড়বিড় করতে শুরু করে, দেচমা দেচমা আনন্দদায়িনী। ওর আওয়াজ শুনলে বর্ণনার অসাধারণ দৃশ্যগুলি দেখা যায়। অবলীলায় জীবিত প্রেমিককেও স্বপ্নে ঢুকিয়ে নিতে পারে মেয়েটি। তরপর এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ঘোড়া চালিয়ে ছুটে চলা আর রাতের পর রাত পরস্পরকে নিবিড়ভাবে পাওয়া। গরবের মনের আজন্ম বাউণ্ডুলে সত্তা দেচমার কথা শুনে পক্ষীরাজের পিঠে চেপে মহা উৎসাহে উড়তে শুরু করে। সে এই স্বপ্নের ভবিষ্যতকে বাস্তবে পেতে চায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমার সঙ্গীরা অপেক্ষা করছে, ওদের সঙ্গে অনেক কথা বাকি রয়েছে। তারপরই দ্রুত তোমার কাছে ফিরবো।

দেচমার গালে একটি গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে গরব বেরিয়ে যায়। দেচমা ওর চলার পথে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে


চলবে ...

প্রছদ ছবি , ইন্টারনেট