মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৯

রবিগানের তিন কিংবদন্তী :দেবব্রত – কণিকা – সুচিত্রা

গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি । কত দীক্ষিত শিল্পীর গায়নশৈলীতে রবিগানের অমৃত ধারায় অবগাহন করছি । প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর গান গেয়ে চলেছেন । তবুও রবীন্দ্রগানের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি এ গানের তিন কংবদন্তীর কথা না বলা হয় । নিশ্চিতভাবের এই তিন কংবদন্তী হলেন দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র । এই পর্বে তাঁদের কথা ।

দেবব্রত বিশ্বাস

দেবব্রত বিশ্বাস কি শুধুমাত্র একজন প্রথিতযশা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ছিলেন ? আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত ভাবেই ‘না’ । তিনি ছিলেন আরো কিছু । দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনটাই সংগ্রাম । তাঁর দূরারোগ্য ব্যাধি হাপানির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন , কিন্তু সেটা গৌণ । মুখ্য হল প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে তাঁর জীবনভর সংগ্রাম । শৈশবে ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে গোঁড়া হিন্দুদের কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রণার বিরুদ্ধে নীরব সংগ্রাম,যৌবনে গণচেতনা জাগ্রত করার আহ্বানে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম, আর জীবনের উপান্তে পৌছে তাঁর গান গাওয়া বন্ধ করে দেবার বিরুদ্ধে সংগ্রাম । হয়তো থেমে গেছে। কিন্তু আপোষ করেননি ।

দেবব্রত বিশ্বাস প্রথাগত ভাবে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেননি বা শান্তিনিকেতন থেকেও রবীন্দ্রগানের পাঠ গ্রহণ করেননি । অথচ রবীন্দ্রগানে ছিল তার অনায়াস অধিকার । তিনি যত রবীন্দ্রগান গেয়েছেন প্রায় সমপরিমান অন্যগানও গেয়েছেন । কিন্তু রবীন্দ্রগানে তাঁর গায়কীর গুনে আমাদের অন্তরে এক নবতর উপলব্ধির সন্ধান দিয়েছিলেন । কবে থেকে তিনি গান গাওয়া শুরু করেছিলেন তা তিনি নিজেও মনে করতে পারেননি । তাঁর নিজের কথায় “ গান গাইছি তো গাইছি । ছোটবেলার দিনগুলি থেকে শুরু করে শুধু গান শুনেছি আর গেয়েছি”।

পূর্ববঙ্গের এক গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারে দেবব্রত’র জন্ম । তিনি বলতেন “রবীন্দ্রগানের জন্ম ব্রাহ্মসমাজে, আমার জন্মও ব্রাহ্ম পরিবারে, সুতরাং রবীন্দ্রগান আমার ভাই”। ব্রাহ্ম পরিবারে উপাসনার জন্য গান গাওয়া ছিল আবশ্যিক , তাই মায়ের কোলে চড়েই তাঁর গান গাওয়ার প্রথম পাঠ । এই ব্রাহ্ম সমাজের এক প্রার্থনা সভায় রবীন্দ্রনাথকে গান শোনানোর দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস ।এবং কি আশ্চর্য ! রবীন্দ্রগানের জগতে তিনি যখন অগণন মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় লোকপ্রিয়তার তুঙ্গে তখনই রবীন্দ্রগানের জগতে তিনি ব্রাত্য হয়ে গেলেন । তাঁর নিজের কথায় “আমি জন্মেছিলাম ম্লেচ্ছ হয়ে – শেষ জীবনে রবীন্দ্র সঙ্গীত জগতে হয়ে গেলাম হরিজন” ।

দেবব্রতর পিতামহ কালীকিশোর বিশ্বাস ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার ইটনা গ্রামে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন । গোঁড়া হিন্দুরা তাঁকে একঘরে করে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছিল । বরিশালে মাতুলালয়ে দেবব্রতর জন্ম । শৈশবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর হিন্দু সহপাঠিরা তাঁকে ম্লেচ্ছ বলতো । ১৯২৭ এ কিশোরগঞ্জে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি হলেন এবং সেখান থেকে ইন্টার মিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে । এই সময় সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ – সুরকার হিমাংশু দত্ত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ সেনগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয় । কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনা সভা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত গান করতেন ।

১৯৩৪এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করে হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে চাকুরী জীবন শুরু করলেন । প্রথম একবছর বিনা বেতনে চাকরী, পরের বছর থেকে পঞ্চাশ টাকা মাসিক বেতনের স্থায়ী চাকুরী । হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স পরে ‘ভারতীয় জীবিন বীমা নিগম’ এ রূপান্তরিত হয়, সেখান থেকেই ১৯৭১ সালে ষাট বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন ।

দেবব্রত তাঁর আত্মকথন ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “আমার সারা জীবন কেটে গিয়েছে কেরাণীগিরি করে, এরই মধ্যে কয়েকটি বৎসর গণচেতনা উদবুদ্ধ করার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নানা ধরনের দেশাত্মবোধক গা্ন করে আর বাকি সময় আমার ব্যাধির সঙ্গে সংগ্রাম করে” ।

আজীবন অকৃতদার দেবব্রত ১৯৩৯ সালে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন । পার্টি তখন বে-আইনী । শুধু যুক্ত হওয়া নয়, সক্রীয় সদস্য । সেকালের প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্বিক ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চিন্মোহন স্নেহানবিশ ছিলেন তাঁর সহকর্মী , সেই সূত্রেই তাঁর কম্যুনিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা । গণনাট্য সঙ্ঘে তখন উদয় শঙ্কর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, শম্ভূ মিত্র, তৃপ্তী ভাদুড়ী(মিত্র), বিজন ভট্টাচার্য, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ – বাংলা সংস্কৃতির সে এক জোয়ারের কাল । মাঠে ময়দানে, সভা সমিতিতে দেবব্রত সুকান্ত, সলিল চৌধুরীর গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইছেন । ১৯৪৯এ পার্টি যখন বে-আইনী , নেতৃত্ব আত্মগোপনে – দেবব্রতর ওপর দায়িত্ব বর্তালো সঙ্গীতানুষ্ঠান করে অর্থ সংগ্রহের । হেমন্ত ও সুচিত্রার শযোগিতায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য প্রদর্শণীর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন । ১৯৫৩তে ভারতের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি চিনে গেলেন গা্ন গাইতে , চিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন ‘অন্তরঙ্গ চিন’ গ্রন্থে । আবার সেই দেবব্রতই ১৯৬২’র পর নিজেকে বাঁয়ের রাস্তা থেকে গুটিয়ে নিলেন । তার মানে তিনি ‘দক্ষিণ পন্থী’ হয়ে গেলেন তা কিন্তু নয় , বলা ভালো নিজেকে গুটিয়ে নিলেন – তাঁর নিজের কথায় “থেমে যেতে হ’লো” । কেন তিনি সরে গেলেন সে অন্য প্রসংগ । ষাটের দশক থেকেই কম্যুনিষ্ট পার্টির মধ্যে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে এবং অবশেষে কম্যুনিষ্ট পার্টি দু টুকরো হয়ে যায় , যার অনিবার্য প্রভাব পড়ে সামাজিক সংগঠনগুলিতেও । কর্মক্ষেত্রে যে ইউনিয়নের সক্রীয় কর্মী ছিলেন সেটিও বিভেদের শিকার হ’ল , সেখান থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন দেবব্রত । পার্টি ও ইউনিয়ন্রের বিভাজনে এতোটাই আহত হয়েছিলেন যে অবসরের পর ইউনিয়নের সকর্মীরা তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা দেবার প্রস্তাব করলে তিনি তা গ্রহণ করতে অসম্মত হন । তাঁর আত্মকথন ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন ...... প্রায় উনিশ- কুড়ি বৎসর বেশ বাঁদিকে হেলে কেটে যাচ্ছিল । পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমার মনে রাজনীতির ব্যাপারে কি রকম জানি একটু সংশয়ের উদয় হয়েছিল । হঠাৎ ১৯৬২তে দেখলাম বাঁদিকে নিদারুণ অগ্নিকান্ড – পরস্পর বিরোধ ও বিদ্বেষের আগুন । ভীষণ দমে গেলাম । ...... বহু বৎসর অভ্যাসের ফলে আমার মনতাও বাঁয়ে হেলে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই মনটাকে অন্য কোন ধরণের নতুন পথে চলতে বা নতুন পথ ধরতে রাজী করাতে পারলামনা”। দেবব্রত থেমে গেলেন । এ একরকম থাম, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া । কিন্তু অন্য দিকে তাঁকে থামানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল ।

রবীন্দ্রগানের ভুবনে তাঁর অনায়াস গতিকে থামিয়ে দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে । মায়ের কোলে চড়ে তাঁর গান গাওয়ার শুরু । বাবা, মা দুজনেই ব্রহ্ম সংগীত গাইতেন । রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম সঙ্গীত ছাড়াও ছাত্র জীবনে হিমাংশু দত্ত, শচীন দেব বর্মণ, সায়গল প্রমুখের অনেক গানও ছাত্রজীবনে গাইতেন । রবীন্দ্রনাথের গা্ন রেকর্ডে গাওয়ার আগে নজরুল ইসলামের কথায় ও সুরে দুটি গান তিনি রেকর্ডে গেয়েছিলেন । সেই সময় (১৯৩৫-৩৬) কয়েকটি ছায়াছবিতেও গান গেয়েছিলেন । গ্রামোফোন রেকর্ডে তিনি প্রথম রবীন্দ্রগান গাইলেন ১৯৩৯ এ কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে ‘হিংশায় উন্মত্ত পৃথ্বি’ ও ‘সঙ্কোচের বিহবলতা’। বলা যেতে পারে শুরু থেকেই তাঁর গানকে থামিয়ে দেবার অবাক করা প্রয়াস শুরু হয়েছিল । সেই সময়ে বিদেশী গ্রামোফোন কোম্পানীই ছিল রেকর্ড প্রকাশের বনেদি প্রতিষ্ঠান ও একচেটিয়া অধিকারী , তারা ‘হিজ মাষ্টার্স ভয়েস’ এবং ‘কলম্বিয়া’ এই দুটি লেবেলে গান রেকর্ড ও প্রচার করতো । পরে ‘হিন্দুস্থা্ন, ‘সেনোলা’ এই রকম দু একটি দেশীয় রেকর্ড কোম্পানী হয় । ১৯৩৯ এ প্রথম রেকর্ড বেরোবার পর হিস মাস্টার্স ভয়েস থেকে তাঁর আরো ১০/১২টি গান প্রকাশিত হয় । এর পর ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ কোম্পানী তাঁকে আধুনিক গান গাইবার আবদার করে, কারণ রবীন্দ্রনাথের গান নাকি তেমন চলছেনা বাজারে । প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন দেবব্রত বিশ্বাস ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ থেকে গান করাই বন্ধ করে দিলেন । অর্থের জন্য তিনি গান গাইতেন না, গান গাইতেন প্রাণের আনন্দে । রেকর্ড করা বন্ধ হলেও গান গাওয়াকেতো থামানো যায়না ! গনাট্য সঙ্ঘের হয়ে রবীন্দ্রগান, সলিল চৌধুরী, সুকান্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান নিয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন গ্রামে গঞ্জে, মাঠে ময়দানে ।

ইতিমধ্যে দেশীয় দু একটি রেকর্ড কোম্পানীর পত্তন হয়েছে । ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ থেকে গান রেকর্ড করা বন্ধ হবার দশ বছর পর হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীর মালিক চন্ডীচরণ সাহা তাঁকে রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করার অনুরোধ করেন ১৯৬০এ । পরের বছর রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ । দশ বছর রেকর্ড করা বন্ধ থাকার পর ১৯৬১তে হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে তাঁর প্রথম গান ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ এবং ‘যেতে যেতে একলা পথে’ প্রকাশিত হল – প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠলো গান দুটি । বাঙালি যেন রবীন্দ্রগানকে নতুন করে আবিস্কার করলো । ১৯৬১তে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে রবীন্দ্রগানের মহাপ্লাবনে দেবব্রত বিশ্বাস উঠে গেলেন জনপ্রিয়তার উত্তুঙ্গ শিখরে । এবং কি আশ্চর্য ঠিক তখনই হয়তো তাঁর জনপ্রিয়তার কারণেই দেবব্রতকে থামিয়ে দেবার প্রয়াস আবারও গতি পেয়ে গেলো ।

মার্চ ১৯৬৪তে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি তাঁর চারটি গান রেকর্ড করার অনুমতি দিলনা, অভিযোগ, তাঁর গানে যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহারের আধিক্য । এরপর মাঝেমধ্যে দুএকটি গান অনুমোদন পেয়েছিল, কিন্তু আবার ১৯৬৯এ দুটি গানের অনুমোদন দিলনা । বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পত্র বিনিময় হয়েছিল এই বিষয়ে । তিতি বিরক্ত দেবব্রত রবীন্দ্রগান রেকর্ড করাই বন্ধ করে দিলেন । দুই বাংলার আগণিত সঙ্গীতপ্রেমী তীব্র প্রতিবাদ করলেন, তাঁকে রবীন্দ্রগান থেকে সরে না আসার জন্য কাতর প্রার্থনা জানালেন, কিন্তু রবীন্দ্রগানের প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের সঙ্গে কোন আপোষ করতে সম্মত হলেন না দেবব্রত । তাঁরআত্মকথন ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ গ্রন্থে লিখে গেছেন “আমি আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে পারিনি” ।

মায়ের কোলে চড়ে যার রবীন্দ্রগান গাওয়া শুরু তিনি জীবনের শেষ দশটা বছর রবীন্দ্রনাথের গা্ন – গাইলেন না - গাইতে দেওয়া হ’লনা । এই যন্ত্রণা তো আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় , কিন্তু আমরা এই উপলব্ধিতে পৌছে যাই যে দেবব্রত বিশ্বাস শুধুমাত্র রবীন্দ্রগানের অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন না , ছিলেন এক ঋজু মেরুদন্ডের প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ঋষিতুল্য মানুষ ।

বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি নামক প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের কাছে তিনি যতই ‘হরিজন’ হয়ে থাকুন না কেন, সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে, মননে দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রগানের ‘মহাজন’ হয়েই থাকবেন চিরকাল – যতদিন বাঙালি তার সুখে-দুঃখে রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে, গাইবে ।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন পরিক্রমার সবটা জুড়েই রবীন্দ্রনাথ, তাঁর গান আর শান্তি নিকেতন । শৈশব – ছয় বছর বয়স থেকেই বড় হয়েছেন শান্তি নিকেতনে্র আবহে রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায় । পিতৃদত্ত নাম অণিমা । রবীন্দ্রনাথ নামটি বদলে দিয়ে রাখলেন কণিকা । কণিকা লিখেছেন, “ফলে সারাজীবন শুধু তার কথা, তাঁরই সুর নয়, তাঁর দেওয়া নামটাও আমি বয়ে নিয়ে চলেছি” । পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কর্মী, মাতা অনিলা দেবী শান্তিনিকেতনের আশ্রম জননী । তাদের আগের প্রজন্মের সঙ্গেও ছিল শান্তিনিকেতনের নিবিড় বন্ধন । কণিকার দাদামশাই রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা ও অর্থ বিভাগের দায়িত্বে ।

১৯৩৭এ হিন্দুস্থান রেকর্ডে প্রথম গান গাইলেন ১৩ বছর বয়সে । রবীন্দ্র-গান নয় – আধুনিক বাংলা গান । কাকার সঙ্গে কলকাতা এসেছিলেন । কাকা নিয়ে গিয়েছিলেন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীতে । শান্তিনিকেতন থেকে অনুমোদন নেওয়া ইত্যাদি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই রেকর্ড কোম্পানী আধুনিক গানর রেকর্ড করলেন ।

১৩ বছরের কণিকার ওসব জানার কথা নয় । কণিকা আধুনিক গান করেছেন শুনে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেয়েছিলেন । তারপর আর কোন দিন কণিকা আধুনিক গানের রেকর্ড করেন নি । একবার সলিল চৌধুরীর গান গাইতে চেয়েছিলেন নিজেই । সলিল চৌধুরী তাঁর জন্য গান লিখে, সুর দিয়ে রেকর্ডও করেছিলেন । কিন্তু সে খবর শান্তিনিকেতনে পৌছে যাওয়ায় অনেকে আপত্তি করেছিলেন । সেই আপত্তি মেনে নিয়ে কণিকা সেই রেকর্ডের প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন । আর একবার, মানবেন্দ্র মুখার্জী দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করিয়েছিলেন তাঁর সুরে । সেই গানের রেকর্ডটিও প্রকাশিত হয়নি । ঐ বছরেই (১৮৩৭) কণিকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতা এসেছিলেন ‘বর্ষমঙ্গল’ অনুষ্ঠানে গান গাইতে । কলকাতার শিল্পীরা ছিলেন । রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে করে এনেছিলেন তাঁকে । ‘ছায়া’ সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত সেই ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ । গুরুদেবের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে গান গাওয়ার দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর ।

১৯৪৩এ ৪০টাকা বেতনে সঙ্গীত ভবনের শিক্ষিকা হয়ে যোগ দেন । তারপর অধ্যক্ষ ও এমিরেট প্রফেসর হয়ে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৮৪তে । দীর্ঘ ৪১ বছর রবীন্দ্রগান শিখিয়েছেন ।

দীর্ঘ ৬৩বছরের সাঙ্গীতিক জীবনে বহু সম্মাননা তিনি পেয়েছেন । সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মান(১৯৭৯), পদ্মশ্রী সম্মান (১৯৮৬), শিরোমণি পুরস্কার(১৯৯৬), বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সন্মান ‘দেশিকোত্তম’(১৯৯৭), আলাউদ্দীন পুরস্কার(১৯৯) কিংবা কলকাতার এক সুরম্য উদ্যানের নামকরণ তারই নামে চিহ্নিত করা (‘মোহরকুঞ্জ’) নিশ্চিতভাবেই তাঁর প্রতি গানপ্রিয় বাঙালির ভালোবাসার চিহ্ন ।

ওপার বাংলাতেও সমান লোকপ্রিয় ছিলেন কণিকা । স্বাধীনতার পরেই ১৯৭২এ শান্তিনিকেতন সঙ্গীত ভবনের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন । তিনমাস ছিলেন । পরে ১৯৭৩, ৭৪, ১৯৮৬ ও শেষবার গিয়েছিলেন ১৯৯৪এ বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ।

রবীন্দ্রনাথের গান আর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যকে পৃথক করা যায় না । সুদীর্ঘ সাঙ্গীতিক জীবনে অনেক রবীন্দ্র-গান গেয়েছেন । কিন্তু ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ এই গানটি তাঁর কাছে এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল । ১৯৫৬তে তিনি গানটি প্রথম রেকর্ড করেন । মালকোষ রাগ নির্ভর গানটি কণিকা তুলেছিলেন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষণে । গানটির মধ্যে শিল্পী খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের অমোঘ বিশ্বাস । শান্তিনিকেতনে তাঁর গৃহের নাম রেখেছিলেন ‘আনন্দ ধারা’, যে বইটিতে তাঁর আত্মকথন ধরা আছে তার নামও ‘আনন্দ ধারা’ । সেই বইটিতে শিল্পী লিখে গিয়েছেন “এ গানে মন আত্মবিশ্বাসে ভরে যায় । জীবনের প্রতি আশ্বাস নষ্ট হতে দেয় না এ গান । জীবনের প্রান্তসীমায় এ গান আমাকে আজও ভরসা জোগায়” ।

৫ই এপ্রিল ২০০০এ, ৭৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন রবীন্দ্রগানের এই প্রবাদপ্রতীম শিল্পী ।

সুচিত্রা মিত্র

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হতে চলেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ স্রেফ সময়ের ব্যাপার । কলকাতায় পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সেদিন পতাকার নিচে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন। সবাই গাইছেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র ।

১৯২৪এর ১৮শে সেপ্টেম্বর ডেহরি-অব-শোন থেকে কলকাতা ফেরার পথে ‘গুঝান্টি’ নামে এক অখ্যাত স্টেশনে, ট্রেনের কামরায় সূচিত্রা মিত্রর জন্ম । পিতা ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৌ্রিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় । বাড়িতে ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহ । সেইসূত্রে কবিগুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ঠিক কুড়ি দিন পরে সঙ্গীত শিক্ষার পাঠ নিতে পৌছেছিলেন শান্তি নিকেতনে, কুড়ি টাকার সরকারী স্কলারশিপ নিয়ে । ১৯৪৫এ ডিপ্লোমা নিয়ে ফিরে এলেন । ঐ বছরেই তাঁর প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হল এইচ এম ভি থেকে । দু’পিঠে দুটি গান – ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ আর ‘হৃদয়ের একুল ওকুল দুকুল ভেসে যায়’ ।

১৯৪৬এ প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষন প্রতিষ্ঠান ‘রবিতীর্থ’ । ১৯৪৮এর ১লা মে বিবাহ, ধ্রুব মিত্রর সঙ্গে । একমাত্র পুত্র কুনালের জন্ম ১৯৫০এর ২৩শে জুন । ১৯৫৫র ডিসেম্বরে বিবাহ-বিচ্ছেদ । সুচিত্রার নিজের কথায় “ ব্যক্তিত্বের মিলমিশ না হওয়াই আমাদের বিচ্ছেদের কারণ । ব্যক্তিত্বের সংঘাত হলে আর যে কোন সম্পর্কই থাক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকে না” ।

কানন দেবী,পঙ্কজ মকুমার মল্লিকের পর যাঁদের কন্ঠবৈভব ও গায়ন-ঐশ্বর্য আপামর বাঙালিকে গানের রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়েছে, সুচিত্রা মিত্র ছিলেন তাঁদের একজন । একমাত্র পুত্র কুণাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার বাসনা প্রকাশ করেছিল । সুচিত্রা তাকে বলেছিলেন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা দেবব্রত বিশ্বাসের মতো শিল্পী হতে পারবে মনে করলে চেষ্টা করে দেখ, নইলে পড়ালেখায় মন দাও’। কুনাল আর শিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেননি, লেখাপড়া করে প্রযুক্তিবিদ হয়ে এখন বিদেশে ।

সুচিত্রা মিত্র’র ব্যক্তি ও সংগীত জীবনের অনেকটা জুড়ে আছে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ । শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার পরেও এই সম্পর্ক অটুট ছিল এবং আরো ঘনিষ্ঠ হয় । সেখানেই তাঁর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে রবীন্দ্র-গানের আর দুই কিংবদন্তী শিল্পী তাঁর চেয়ে ১৬ বছরের বড় দেবব্রত বিশ্বাস ও চার বছরের বড় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । কত গান যে তারা একসঙ্গে গেয়েছেন ! তাঁর নিজের কথায় – “গণনাট্য সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য ছিলাম । কলেজে থাকতে গেট মিটিং করেছি । বক্তৃতা দিয়েছি । ঘাড়ে ঝান্ডা নিয়ে হেঁটেছি পথে পথে । একটা বিশ্বাস, একটা আদর্শের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলাম । মিছিল, টিয়ার গ্যাস, লাঠি চার্জ –এসবের মধ্য দিয়ে গিয়েছি । অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছি ঠিকই, কিন্তু তাকে ‘রাজনৈতিক জীবন’ আখ্যা দেওয়া যাবে না” । অথচ, সুচিত্রার গান নিয়ে রাজনীতি বড় কম হয় নি । প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সেদিন কলকাতায় আর কলকাতা রেডিওতে সুচিত্রা মিত্রর গানের অনুষ্ঠান । সুচিত্রা মিত্র বাল্মিকী প্রতিভা’র একটা গান গান গাইলেন, গানের পংক্তি ‘কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে’ । ব্যস, রেডিওর উর্বর মস্তিষ্কের তালেবররা বুঝে গেলেন আইপিটিএ-র সক্রিয় সদস্য সুচিত্রা মিত্র, প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেই এ গান গেয়েছেন । ফল হ’ল টানা ছয় বছর আকাশবাণীতে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন সুচিত্রা মিত্র ।

মর্যাদামন্ডিত এক পরিপূর্ণ শিল্পী ছিলেন সুচিত্রা মিত্র । গানের মতই পারদর্শী ছিলেন নৃত্যে । লিখেছেন তাঁর ছড়ার বই ‘খেয়াল খুশি’, নৃত্যনাট্য রচনা ও সুর করেছেন – অবন ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’, শান্তিনিকেতনে নৃত্যনাট্যে অংশ নিয়েছেন, মঞ্চের নাটকে অভিনয় করেছেন, এমনকি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন । মৃণাল সেনের পদাতিক ও উমাপ্রসাদ মৈত্র’র ‘জয় বাংলা’ সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন । রবীন্দ্রনাথে গান ছাড়াও গেয়েছেন অতুল প্রসাদ,হিমাংশু দত্ত,সলিল চৌধুরীর গান ।

কী ছিল তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের গান ? কেমন করে গাইতে হবে সেই গান ? সুচিত্রা মিত্র’র নিজের কথায় “রবীন্দ্রনাথের গান শুধু সুর,তাল,লয় নয় । রবীন্দ্রনাথের গানের সাহিত্যমূল্য না বুঝলে কিছুই হবে না । বারে বারে পড়তে হবে । বুঝতে হবে । উচ্চারণ,পাংচুয়েশন শিখতে হবে ।গানটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে । ‘ভিসুয়ালাইজ’ করতে হবে ......’তুমি আমায় লহো হে নাথ লহো’ যখন গাই, তখন এ গানের আর্তি মিশে যায় আমার আর্তির সঙ্গে । ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো’ – এই প্রার্থনার সঙ্গে আমার প্রার্থনার কোন অমিল থাকে না, যখন এ- গান আমি গাই । এভাবে আমার নিজেরই গান হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথে গান । হয়ে ওঠে আমার নিজেরই রচনা” । এই আর্তি নিয়েই রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন দুই বাংলায় অসামান্য লোকপ্রিয় সংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র ।

২০১১’র ৩রা জানুয়ারি কলকাতায় ৮৭ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় এই মহান শিল্পীর । কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র গান-প্রিয় বাঙালীর অন্তরে সুচিত্রা মিত্র যে মর্যাদার আসনে আসীন তাকে স্পর্শ করবে কোন মৃত্যু ? রবীন্দ্র-গানের যে অমিত ঐশ্বর্য তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার মধ্যেই অমরত্ব লাভ করেছেন সুচিত্রা মিত্র ।

‘বাংলা গানের সেকাল একাল’ ধারাবাহিকের ১৯টি পর্বে বাঙালির আদি গান কীর্তন থেকে আধুনিক বাংলা গান পর্যন্ত বিবর্তন ধারাটিকে বুঝতে চেয়েছি । শেষ পর্বে যে ধারাটিকে বুঝতে চাইব তার এ কাল নেই,নেই সে কালও। আছেঞ্চিরকাল – চিরকালের গান । সেই সঙ্গীতধারায় রয়েছে বাংলা গানের তাবৎ ধারার শিকড় । ধারাবাহিকের শেষ পর্বে বলব শিকড়ের গান : লোকগানের কথা ।

(আগামী পর্বে শিকড়ের গান : লোকগান)