শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

তিমির তীর্থ, ৩য় ভাগ

পনেরোশ’ টাকা মাইনে? নিদ্রিতা স্ত্রীকে নিজের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে বালিশটাতে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে দিল। নিজে হাত পা লম্বা করে মেলে আরাম করে এক দিবা মধুর স্বপ্নের মতো প্রহ্লাদ ভাবতে শুরু করল---পনেরোশ’ টাকা মাইনে? চল্লিশের ঘাটে পা দিতে আর মাত্র দুই বছর রয়েছে। যৌবনের দিনগুলো প্রায় শেষই হল। এখন তার এমন এক বয়স যখন তার মতো সাধারণ মানুষের জীবনে আর নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। এখন শুধু ঘটতে পারে অতীতের ক্লান্তিকর আর অন্তহীন পুনরাবর্তন।দিনের পরে দিন।মাসের পর মাস।কলুর বলদের মতো মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত চক্রাকারে ঘুরতে থাকার যন্ত্রণা।বারো বছর সংবাদপত্রে সাংবাদিকের চাকরি করে এই আটত্রিশ বছর বয়সেও তার মাইনে হয়েছে মাত্র পাঁচ শত টাকা। অসমীয়া সংবাদ পত্রের যা অবস্থা তাকে পাঁচশ টাকার বেশি মাইনে দিতে মালিকেরও সংগতি নেই।সে কথা সে বুঝে।পাঁচশো টাকার ভেতরে দেড়শত টাকা ঘর ভাড়া দিতেই যায়।বাকি সাড়ে তিনশো টাকাতে এ দুর্মূল্যের বাজারে মোটা চালের ভাত, ডালের জল আর বেগুন ভাজার বাইরে স্ত্রী-সন্তানকে আর কিছু খাওয়াবার সাধ্য তার নেই।প্রোটিনের অভাবে ছেলেমেয়ের দৈহিক আর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন ব্যাহত হয় এ নিয়ে সে নিজেই সংবাদপত্রে বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছে।কিন্তু তার নিজের ছেলেমেয়েরাই দুমাসের মাথায় একবার মাছ-মাংসের চেহারা দেখতে পায় কি না পায়---তারই ঠিক নেই।স্ত্রীর অবস্থা আরও শোচনীয়।ভারতীয় নারীর সতীত্ব ধর্ম রক্ষা করে ললিতা এই অভাবের সংসারে সবই স্বামী সন্তানকে খাওয়াবার চেষ্টা করে নিজে প্রায় আধপেটাই থাকে।ঘরে কখনও মাছ একটুকরো এলে ললিতার পাতে তার অবশেষটুকুই পড়ে। না খেয়ে না খেয়ে বত্রিশ বছরের মেয়েটার পঞ্চাশ বছরের মহিলার মতো চেহারা হয়েছে।প্রহ্লাদের নিজের অনেক শখ-আহ্লাদ ছিল।মাসে মাসে বই কিনে লাইব্রেরি করা।একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে মাঝে মধ্যে ভালো ভালো গান দুই একটা শোনা,বছরে কখনও কোথাও বেড়াতে যাওয়া। এখন এসব শখ পূরণ হওয়া দূরের কথা,জীবনে যে কখনও এসব স্বপ্ন দেখেছিল সেসব কথাই গেছে ভুলে।তার জীবন এখন বাস্তবিক অর্থেই শুধু দিন যাপনের,শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানি।জীবনে যে কখনও এই অবস্থার পরিবর্তন হবে সে আশাও সে এখন আর মনে আনে না।মাইনে হয়তো বছরে বিশ টাকা বাড়বে,কিন্তু সে অনুপাতে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামও বাড়বে।খাদ্য সন্ধানী বন্য জন্তু বা আদিম মানুষের মতো তার পুরো জীবন শেষ হয়ে যাবে দুবেলা দুমুঠো খাদ্যের সন্ধানে।সেই ভয়ঙ্কর ভবিতব্য-কেই সে এখন মেনে নিতে শিখেছে।না মেনে আর লাভ নেই।কিন্তু হঠাৎ এই পনেরো শো টাকার মাইনে অবর্ণনীয় সুযোগ।আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে এলেও বোধহয় সে এরচে’ বেশি চমকিত হত না।

আলাদীনের প্রদীপের মতোই পনেরো শো টাকার এ চাকরি তার জীবনটাকে না চেনার মতো সমূলে পালটে দিতে পারে।অবশেষে সে মানুষের মতো বাঁচতে শুরু করতে পারে।যৌবনের আবেগ আর আদর্শবাদের মোহে আবদ্ধ হয়ে সে এক এক করে অনেক সোনালি সুযোগ নষ্ট করেছে।পড়াশোনায় সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল।তখন চাকরি সমস্যাও আজকের মতো তীব্র ছিল না।ইচ্ছে করলেই একটা ভালো চাকরিতে ঢুকে সে আজ নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ আর আরামের জীবন যাপন করতে পারত। বেশিরভাগ সহপাঠীরাই --- যাদেরতার সঙ্গে এক আসনে বসবার যোগ্যই ছিল না—জীবনে একটা ক্ষেত্রে অন্তত তার চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।প্রহ্লাদের মতো নিজেকে যৌবনসুলভ ভাবালুতা বা স্বপ্ন বিলাসিতা দিয়ে অন্ধ হতে দেয় নি তারা। এক এক করে জীবনের সব সুযোগ গ্রহণ করেছে।এদের মধ্যে কেউআজ উঁচু পদের আমলা,কেউ ডাক্তার,কেউ উকিল, কেউবা সফল রাজনৈতিক।তারা ভালো ঘরে থাকে,ভালো খায়,ভালো মটরগাড়িতে ঘুরে।তাদের সুবেশা সুন্দরী স্ত্রীদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয় আরাম পুষ্ট জীবনের ঔজ্জ্বল্য আর সুরভি।এ সবই তার নিজেরও হতে পারত।তাদের সবার থেকে প্রতিভা আর যোগ্যতা ছিল তার বেশি।ঈশ্বর তাকে প্রতিভা আর দিলে কী হবে সদ্ব্যবহারের বুদ্ধি তেমন দেন নি।সঙ্গীরা যেদিন সামাজিক মানমর্যাদা,ধনদৌলত,সুন্দরী পত্নী আর বিলাস-বৈভবের স্বপ্ন দেখছিল সেদিন প্রহ্লাদের কানে এসেছিল এক অপরিচিত দুর্গম পথের আহ্বান।যুগে যুগে যেসব মানুষ পৃথিবীটা ভেঙে চুরে চায় এক নতুন গড়ে তুলতে আর জীবনকে চায় এক নতুন অর্থ দিতে প্রহ্লাদ ছিল তাদেরই একজন।

যৌবনের অহংকারে ভোগ বিলাস আর আরাম স্বাচ্ছন্দ্য তার চোখে ছিল পরম অবহেলা আর ঘৃণার বিষয়।প্রতি মুহূর্তে ঐ সময় সে জপ করত গ্যাটের মহামন্ত্র--- হে স্বর্গীয় শক্তি,যে মানুষ কখনও চোখের জল মুছে মুছে আহার করে নি আর বিষাদের রাত জেগে চোখে জলে বালিশ ভেজায় নি তেমন মানুষ কখনও তোমাকে লাভ করতে পারে নি।” সেই স্বর্গীয় শক্তির সন্ধানই ছিল সেদিন তার জীবনের পণ।বহুমূল্য সুদৃশ্য মটরগাড়িতে সুন্দরী স্ত্রীকে বসিয়ে ক্লাবে বা পার্টিতে যাবার কল্পনা সেদিন তাকে রোমাঞ্চিত করতে পারে নি।তার অন্তর রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল এমন এক পথিকের দৃশ্য--- যে কিনা রক্তাক্ত পায়ে সুদূরে এক দুর্গম পথ ধরে এগোচ্ছে।যার বজ্র গম্ভীর আহ্বানে শুয়ে থাকা মানুষেরা এক এক করে জেগে উঠছে; পথের শেষে যার জন্য অপেক্ষা করছে সমস্ত জীবনের পুরস্কার স্বরূপ মান-সম্মান বা বিলাস –বৈভব নয়, আছে ঘাতকের ছুরি বা বন্দিশালার লৌহকপাট।এমন এক উন্মাদ বাসনা তাকে এত আবিষ্ট করে রেখেছিল যে কলেজে পড়তে এসেই সে এক গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগ দেয়।পঞ্চাশের দশকের প্রথম বছর ক’টা তখন।মেধাবী ছেলেদের জন্যে চারদিকে তখন ভালো চাকরি বাকরির সুযোগ। সে সবই উপেক্ষা করে সে হল বিপ্লবী।সরকার যখন দলটাকে বে আইনি ঘোষণা করে ধরপাকড় আরম্ভ করল প্রহ্লাদ আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াল।কিছুদিন পরে ধরা পড়ল আর দুবছর কাটাতে হল জেলে।জেল থেকে বেরিয়ে বাবার চাপে আবার পড়তে বাধ্য হল।কিন্তু জীবনের যে দুর্গম পথের আহ্বানে একদিন সে সর্বস্ব পণ সংকল্প করেছিল সেই আহ্বান তখনও তার সঙ্গ ছাড়ে নি।কিন্তু এখন?তার মুখে এসে পড়া ললিতার চুল কটা আলতো করে গুছিয়ে দিয়ে প্রহ্লাদ নিজেকে প্রশ্ন করল---‘সুদীর্ঘ পনেরো বছরের পর,হাজারটা উপবাসী দিন আর জেগে থাকা রাত পার করে যৌবনের এই পড়ন্ত বেলায় সেই আহ্বান এখনও আমার রক্ত টগবগিয়ে তুলে কি?যৌবনের যে অহংকারে একদিন আমি সমস্ত পৃথিবীর বোঝা নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম সে অহংকার আজও অটুট আছে কি? শীতের দিনে যখন গরম কাপড়ের অভাবে কেঁপে কেঁপে মানিক আর মুনমুনের স্কুলে যাবার দৃশ্য দেখে আমার কলজে ফাটার উপক্রম হয়; অত্যধিক পরিশ্রম,অর্ধাহার আর রোগের যন্ত্রণায় যখন ললিতার এ যৌবনেই কোমর ভেঙে নুয়ে পড়বার উপক্রম দেখি বোবা যন্ত্রণায় দেয়ালে মাথা কুটে আমার মরে যেতে মন চায়।তখনও আমার সে অহংকারকে বুকের রক্ত খাইয়ে জিইয়ে রাখার দুঃসাহস বাকি আছে কি?’

প্রহ্লাদ সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নের উত্তর দিল না।সে ভালো করেই জানে যে সে প্রশ্নের কোনও সহজ সরল উত্তর নেই।আর বাস্তব বুদ্ধি যে উত্তর দেবে,বিবেক তার প্রতিবাদ করে উঠবে।অহংকার তার টুঁটি চেপে ধরার প্রয়াস নেবে।মনের সেই দ্বন্দ্ব চলতে দিয়ে সেই পনেরোসশ টাকা মাইনের চাকরিটার চিন্তা করা অনেক ভালো।মাসে পনেরোশ টাকা মাইনে তার গোটা জীবনকে পুরো পালটে দিতে পারে।

জীবনে সে বহু কষ্ট ভোগ করেছে।বেশির ভাগ কষ্টই সে স্বেচ্ছাতে বরণ করে নিয়েছে।যে সময়ে সে হাত মেললেই যে কোনো সরকারি চাকরির নিযুক্তি পত্র পেতে পারত। সে সময়ে স্বেচ্ছায় হাত মেলে দিয়েছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানার দিকে।অবশ্য সরকারি চাকরি না করেও সে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে দেয়ে থাকতে পারত,কারণ তার অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল।ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস না করা বহু মার্ক্সবাদী বন্ধুকে সে দেখেছে---যারা গ্রামে একটা ছোটোখাটো জমিদারি চালিয়ে শহরে কম্যুনিস্ট রাজনীতি করে।অথবা দরিদ্র আধিয়ারকে বঞ্চিত করে সে জমি মহাজনকে বিক্রি করে শহরে ভাড়াঘর সাজিয়ে তুলে। কিন্তু প্রহ্লাদের সেটুকু সুবুদ্ধিও হল না।যেহেতু সে নিজে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করে না আর অনুপস্থিত জমিদারের ভূমিকাও নিতে চায় নি,সেই জন্যে পৈত্রিক জমির নিজের অংশটুকুরও স্বত্ব আধিয়ারদের ছেড়ে দিল। গত বারো বছর ধরে সে নিজের আর ছোট্ট পরিবারটার প্রাণ রক্ষা করবার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে।তবুও কোনোদিন এরা কেউ পেট ভরে খেতে পায় নি। ললিতা বহুদিন ধরে রক্তাল্পতাতে ভুগছে।ডাক্তার অনেক সুপথ্য আর টনিকের ব্যবস্থা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেসব কেনার সামর্থ্য তার আজ অব্দি হয় নি।কোনোদিন যে হবে তার কোনও আশাও নেই।কিন্তু নিজেকে এভাবে সবদিক থেকে বঞ্চিত করেও ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার টাকার ধার তাত কাঁধে।আর দু-মাসের ঘরভাড়াও বাকি পড়েছে।তাগাদা করে কেউ তাকে ব্যতিব্যস্ত করে নি যদিও ঋণী হবার গ্লানি আর দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ তাকে পীড়ন করে চলেইছে।পীড়ন করে কেননা ধার শোধ করবার কোনও উপায় তার চোখে পড়ে না।কিন্তু এত কষ্ট ভোগার মূল্য কী? কী মহৎ উদ্দেশ্যে সে এমন এক দুঃখের জীবন বরণ করে নিয়েছে? এ ত্যাগের বিনিময়ে নিজের বা সমাজের কোনও মঙ্গল হয়েছে কি? জমা খরচের হিসাব করে সে দেখল—লাভের ঘরে একটা বিশাল শূন্য।জীবনের এক মহৎ আদর্শের জন্য গত পনেরো বছর ধরে সে কৃচ্ছ্র সাধন করছে বলে ভেবে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিল।নির্মোহ দৃষ্টিতে গভীর ভাবে চিন্তা করে সে দেখল এর কোনও মূল্য নেই।গেল পনেরো বছরে যে কাজ সে করেছে সেটুকু না করা হলেও সমাজের তিল পরিমাণও ক্ষতি বৃদ্ধি হত না।এক ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর খবরের কাগজের মন্ত্রী আমলা ব্যবসায়ী আদি ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর মানুষগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপকর্মের সংবাদ দেয়া।সে কেবলকারও বসার ঘরের মুখরোচক গল্পের বিষয়বস্তুর যোগান দিতে পারে,কারোবা কেবল ক্ষোভ নির্গমনের পথ খুলে দিতে পারে;কিন্তু এ নিশ্চয় এমন এক মহৎ Cause নয় যে তার জন্যে কেউ একজন তার জীবন উৎসর্গ করল বলে ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারে।সে একদিন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল।সমাজকে ভেঙে চুরে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।কিন্তু সেই বিপ্লবী আজ পরিণত এক পতিত আর রুগ্ন সমাজের দিনগত পাপক্ষয় লিখে রাখার সাংবাদিকে।এমন কি সমাজের প্রকৃত পাপের রূপ উদ্ঘাটনেরও সুযোগ আর সাহস তার আজ অব্দি হয়ে উঠেনি।তাহলে সে করছে কী এতদিন ধরে?কী আদর্শের বেদীতে স্ত্রী আর সন্তান দুটোর স্বাস্থ্য আনন্দ আর ভবিষ্যৎকে বলি দিচ্ছে? হঠাৎ এক নতুন আলোয় সে তার গোটা জীবনটার দেখা পেল আর অনুভব করল এক জঘন্য বেশ্যাবৃত্তির বাইরে সে জীবনে আসলে আর কোনও কাজই করেনি। বেশ্যা নিজের দেহ বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।সে তাই বুঝি বা করছে নিজের বুদ্ধি বিক্রি করে।এ অর্থহীন আত্মক্ষয়ী কৃচ্ছ্র সাধনার থেকে নিজের মিথ্যে অহংকার বিসর্জন দিয়ে পনেরো শো টাকা মাইনের চাকরিটা গ্রহণ করা নিশ্চয়ই কোনও অপরাধ বা অগৌরবের কথা হবে না।আর কিছু না হলেও এই পনেরো শো টাকাতে ছেলেমেয়ে দুটোর পেটে একমুঠো বেশি ভাত দিতে পারবে।তাদের মুখে ক ফোঁটা দুধ দিতে পারবে।বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি তার নিম্নতম দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবে।জগন্নাথ চৌধুরী এলে সে নিশ্চয় বলে দেবে যে,নিশ্চয় বলে দেবে,নিশ্চয় বলে দেবে...।

আধো ঘুমে প্রহ্লাদ শুনতে পেল দূরের থানার ঘড়িতে দুটো বাজার ঘণ্টা বাজছে।তারপর সে আর কিছুই বলতে পারে না। ছোট্ট শিশু যেমন মাকে ধরে তেমনি ললিতাকে জড়িয়ে সে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই প্রহ্লাদের রাতের গোটা ব্যাপারটা মনে পড়ল।কিন্তু কথাগুলো তার স্বপ্ন যেন মনে হল।সে সত্যিই কি ভেবেছিল জগন্নাথ চৌধুরীর প্রস্তাবে সম্মতি দেবে? অসম্ভব। সুস্থ মগজে এমন একটা কথা সে নিশ্চয়ই ভাবে নি।হয় সে স্বপ্ন দেখছিল অথবা দিনের ক্লান্তি আর তন্দ্রার জড়িমাতে অবশ করে তোলা এক মানসিক অবস্থাতেই শুধু সে এমন একটা কিছু ভাবতে পেরেছিল। নিজের বুকে হাত বুলোতে বুলোতে সে ভাবল---যে অহংকারকে বুকের রক্ত পান করিয়ে আজন্ম লালন করে এসেছি,যে অহংকার আমার দ্বিতীয় প্রাণ তাকে এখন আমি হত্যা করে নিজে কী করে বেঁচে থাকব?

ললিতা বিছানার কাছে এসে ডাক দিল,“ সাতটা বেজে গেল।তুমি বিছানা ছেড়ে উঠবে না কি?”

“আজ আমার শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না ললিতা।” প্রহ্লাদ স্ত্রীর আদর পাবার আশায় স্বরটা করুণ করে বলল, “স্নান করার সময় না হওয়া অব্দি আজ আমি শুয়ে থাকব।আমাকে এখানেই এক কাপ চা দাও।”

প্রহ্লাদের শরীর ভালো নেই শুনে ললিতা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল,“কী হয়েছে তোমার? মাথা ব্যথা করছে? জ্বর হয় নি তো?” কাছে বসে কপালে হাত দিল।

প্রহ্লাদ ললিতার হাতটা নিজের চোখ দুটোর উপর চাপ দিয়ে ধরে বলল,“আমার যে অসুখ করেছে ডাক্তারি শাস্ত্রে তার কোনও নাম নেই ললিতা। কিন্তু তার লক্ষণগুলো তোমাকে বলতে পারি।প্রথম লক্ষণটা এই যেএ অসুখে আক্রান্ত লোকের দিনে রাতে স্ত্রীর আদর পাবার ইচ্ছে যায়।”

“ঠাট্টা করো না।” ললিতা স্বামীর কপাল টিপে দিয়ে বলল,“তোমার সত্যিই কিছু একটা হয়েছে। কপালটা গরম হয়ে উঠেছে।”

প্রহ্লাদ খলখল করে হেসে উঠে স্ত্রীকে বুকের মধ্যে টান মেরে আনবার চেষ্টা করল।ললিতা জোরে বাধা দেবার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কি দিনে দিনে বুড়ো হচ্ছ,না শিশুটি হতে চাইছ?ছেলেই তোমার কাঁধের সমান হতে চলল,তবু দিন দুপুরে এসব কাণ্ড করতে লজ্জা হয় না? হঠাৎ যদি ছেলেমেয়ে দুটো এসে পড়ে কেমন লাগবে?”

“খুব ভালো লাগবে।” প্রহ্লাদ বলল,“তুমিই দেখি লোকজনকে বলে থাকো তোমার তিন ছেলেমেয়ে---মানিক, মুনমুন আর শ্রীযুক্ত প্রহ্লাদ হাজরিকা।তাই যদি হয়,তবে বাচ্চামো করবার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে।”

“দেখি,আমাকে ছাড়ো।তোমার জন্য চা এক কাপ করে আনি।ঘরটার সব কাজ পড়ে আছে।তোমার সাথে বসে বসে ঢং করে থাকলে আমার সংসার চলে না।”

খানিকক্ষণ পরে চা এক কাপ এনে প্রহ্লাদকে দিয়ে ‘সংসার চালাবার’ জন্যে চলে যাচ্ছিল,খাপ করে প্রহ্লাদ তার আঁচল ধরে বলল,“তুমি যেতে পারবে না।আমার কাছে অল্প বস।”

“তোমার আজ হলটা কী?আমার কাছে বসে থাকলে মানিক মুনমুনের ভাত রেঁধে দেবে কে? স্কুলে যেতে হবে না? সঙ্গে এরকম দিনে রাতে প্রেম করে থাকতে হলে ঘরে দুটো চাকর রাখতে হয়।”

“এবার সত্যিই চাকর রাখব,জানো?”, প্রহ্লাদ চায়ের কাপ মুখে দিয়ে বলল।

“চাকর রাখবে? কোথাও লটারির টাকা পেলে বুঝি?” ললিতা ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল।

“টাকা শুধু লটারির থেকেই আসে না।তুমি তোমার স্বামী-রত্নটির মূল্য বুঝে না পেলে কী হবে?পাকা জহুরি ধূলি বালিতে পড়ে থাকা এই রত্নটিকে ঠিকই খুঁজে বের করেছে। ... বসই না,খানিকক্ষণ আমার কাছে!”

ললিতা স্বামীর কাছে বিছানায় বসে প্রহ্লাদের চোখে খুব গভীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“আমার একটা কথা সবসময়েই স্বপ্ন যেন মনে হয়।বিশ্বাস করতে মন চায় না।আমাদের বিয়ের ক’বছর হল –তোমার মনে আছে? বারো বছর,পুরো বারো বছর!কিন্তু আজও তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কর যেন আমাদের বিয়ে হল এই গতকাল। কোনও মেয়ের এতটা সৌভাগ্য কী করে হতে পারে? সত্যি করে বল দেখি তুমি আমার সঙ্গে অভিনয় কর, না সত্যি তোমার মনটা এত সুন্দর?”

চা-কাপটা শেষ করে কাছের টেবিলে রেখে প্রহ্লাদ দু’হাতে ললিতাকে মুখের কাছে টান দিয়ে আনল আর পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখ দুটোতে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশ্ন শুনে আমার সক্রেটিসের একটা কথা মনে এল।একদিন সক্রেটিস বন্ধু একজনকে বললেন,‘কী অবাক করা কথা জান নিকারেটাস বুঝি ওর স্ত্রীকে ভালোবাসে,আর ওর স্ত্রীও বুঝি নিকারেটাসকে ভালোবাসে।স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসে এর চেয়ে অবাক করা কথা যেন এ পৃথিবীতে আর দুটো নেই।তোমার প্রশ্নটাও এরকমই হল না কি?”

স্বামীর প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি আর মধুর কথা ললিতার মনে এমন এক প্রবল আবেগের উথাল পাথাল ঢেউ তুলল যে তার আনখশির দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল।নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সুপ্ত তার মুহূর্তে ঝংকৃত হয়ে উঠার মতো ওর সমস্ত হৃদয় গান গেয়ে উঠল।প্রহ্লাদও মুগ্ধ দৃষ্টিতে ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল---প্রাত্যহিক তুচ্ছতার আবরণ খসে গিয়ে ওর আবেগ বিহ্বল মুখটাতে এমন এক নবীন লাবণ্য ফুটে উঠেছে যে লাবণ্য শুধু প্রেমের আপন হাতে তৈরি। এক অপার্থিব শিল্প কর্ম। সে খুব ধীরে ধীরে ললিতার মুখটা নিজের মুখের কাছে নিয়ে এল। আর দু-হাতে মুখটা ধরে আলতো করে একটা চুমা খেল।ঠিক সে মুহূর্তে মানিক কিছু একটা খুঁজে সে ঘরে চলে এল আর মা-বাবাকে চুম্বনরত দেখে ভূত দেখার মতো দৌড়ে পালাল। ললিতা লজ্জায় মরে যায় আর কি। অর্থহীন কীসব চেঁচামেচি শুরু করে দিল।

কিন্তু কেবল প্রেম আর মানুষকে কদিন আর বাঁচিয়ে রাখতে পারে---ললিতা চলে যাবার পরে প্রহ্লাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল।ললিতার বয়স মাত্র বত্রিশ। অথচ রোগ পরিশ্রম আর অর্ধাহারে ওর অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন পঞ্চাশ বছর বয়সের মহিলা।তাদের পাশের বাড়ির জয়ন্ত চৌধুরী ব্যারিস্টারের স্ত্রী অপর্ণা ললিতার সমবয়সী।কিন্তু বিলাস বৈভবে জীবন কাটানো অপর্ণার রূপ আর স্বাস্থ্যের দীপ্তি দিনে দিনে যেন উজ্জ্বল হয়েই চলেছে।দু-জনকে এক সঙ্গে দেখলে মা-ঝি বলেই মনে হয়।প্রহ্লাদের ইচ্ছে যায় তার স্ত্রী দীর্ঘ যৌবনা হয়ে থাক,সুন্দরী আর স্বাস্থ্যবতী হয়ে থাক,বিচিত্র সুন্দর সাজপোশাকে তারও শরীর বিচিত্র সুরে গান করতে থাকুক।তার কি ইচ্ছে হয় না শরীরের সেই শতদল প্রতি প্রভাতে নিতি-নব বর্ণগন্ধে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠুক।আর জীবনটাকে নিতি-নব ধারায় প্লাবিত করে রাখুক? কী আদর্শের বেদীতে সে তার সেইঅন্তহীন,উদ্দেশ্যহীন, প্রচণ্ড অথচ স্বাভাবিক লোভ বিসর্জন দিয়েছে?এই অর্থহীন,উদ্দেশ্যহীন ত্যাগের দ্বারা কার কী মঙ্গল করছে?... আবার তার মনটা ঘুরে এল জগন্নাথ চৌধুরীর পনেরো শো টাকার মাইনের চাকরির প্রস্তাবে।অতি শীঘ্র এ নিয়ে কিছু একটা হেস্ত নেস্ত না করলেই নয়। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে কী লাভ?চাকরিটার প্রতি তার প্রচণ্ড লোভ হচ্ছে।জীবনে অনেক সুযোগ সে স্বেচ্ছায় নষ্ট করেছে।দারিদ্র্যের দাসত্ব আর আত্মক্ষয়ী অহংকারের লৌহ বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার এই তার শেষ সুযোগ।এ সুযোগ যদি হারায়,তবে এ অভিশাপের থেকে তার আর কোনোদিনই মুক্তি পাবার নিশ্চয়ই কোনও আশা নেই।


(ক্রমশ...)