বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

জমাট বাঁধা রক্ত,পর্ব -২

আরম্ভ কথা - ১৯৭২ সনের অসমের ‘মাধ্যম আন্দোলন’ বা ভাষা আন্দোলন ।উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মহাবিদ্যালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা মাধ্যম করার আন্দোলনই ছিল ‘মাধ্যম আন্দোলন’।এই আন্দোলন অসমের সমাজ জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তারই এক আংশিক চিত্র উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে ।


(দুই)

এখন পবিত্রের মনে হল যে এই সকালের রেল থেকে সে ছাড়া আর কোনো মানুষ নামেনি। সে ধীরে ধীরে একপা দুপা করে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। স্টেশনের জানালা দিয়ে পয়েন্টসম্যান ছুটিতে থাকায় পয়েন্টস ম্যানের কাজ করা বুড়ো স্টেশন মাস্টার এক অদ্ভুত জিনিস দেখার মতো তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকায় পবিত্র সেদিকে এগিয়ে গেল। তাকে এগিয়ে যেতে দেখে বুড়ো স্টেশন মাস্টার বসে থাকা টুল থেকে উঠে দরজার দিকে বেরিয়ে এসে তাকে ডাকল,‘আরে,পবিত্র নয়? কোথা থেকে এত সকাল সকাল এলে? গুয়াহাটি থেকে?’

স্টেশন মাস্টারের বাংলামিশ্রিত অসমিয়া শব্দ গুলি আজ যেন পবিত্রের কেমন নতুন শব্দ শোনার মত মনে হল।

‘ হ্যাঁ’ খুব ছোট একটা উত্তরদিয়ে পবিত্র এগিয়ে গেল এবং বারান্দায় উঠে বললঃ গুয়াহাটি থেকেই এলাম।

‘তুমিতো সেদিনই গেলে’ এক অনুসন্ধিৎসু চোখে পবিত্রের দিকে তাকিয়ে স্টেশনমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন,‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?’

পবিত্রের মনে হল বুড়ো স্টেশন মাস্টারের চোখে কিছু একটা ভয় এবং সন্দেহের ছায়া।

‘না এমনিতেই’- কিছুই না হওয়ার মতো একটা ভাব দেখিয়ে পবিত্র বলল-‘কলেজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে, তাই চলে এলাম…’

‘ কোথায় তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি কোথায়? স্টেশন মাস্টার চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও আসেনি যে, মাস্টারমশাইকে খবর দাও নি?’

মাস্টারমশাই হলেন পবিত্রের পিতা হরমোহন বরা। এল পি স্কুলের হেড পন্ডিত। এই অঞ্চলের অন্যতম শিক্ষিত ব্যক্তি এবং সম্মানীয় ব্যক্তি। এই গ্রামের মধ্যে এই পন্ডিতের ছাত্র সীমাবদ্ধ নয়, প্রায় বারো মাইল অঞ্চল জুড়ে এই শিক্ষকের ছাত্র ছড়িয়ে রয়েছে। ছাত্র হোক বা না হোক প্রত্যেকেই তাকে সম্মান করে ডাকে-কেউ বলে মাস্টার বাবা, কেউ পন্ডিত বাবা, অধিকসংখ্যকেই ডাকে স্যার এবং স্টেশন মাস্টারের মতো কিছু লোক ডাকে ‘মাস্টারমশাই’। পণ্ডিতের বাড়ি বললে এই অঞ্চলে পবিত্রের বাড়িটাকেই বোঝায়। সেই পন্ডিতের একমাত্র সন্তান পবিত্র-যে ন পাম গ্রাম থেকে গিয়ে গুয়াহাটিতে কলেজে পড়ছে। বুড়ো স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে মুখে কথা ফোটা শিশু পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাকে চেনে। সঙ্গীদের তো কথাই নেই, তার চেয়ে বড়রা বরং তাকে বেশি সমীহ করে।

না এবারও খবর দেয়া হল না,’ একদৃষ্টে বুড়ো মাস্টার তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকায় পবিত্র বলল,‘হঠাৎ চলে আসতে হল।’

‘হঠাৎ ?’ চট করে পবিত্রের মুখ থেকে বেরোনো শব্দটা মাস্টারের বুকে ধাক্কা মেরে যাওয়ায় একটা বিকৃত প্রতিধ্বনির মতো বুড়োর মুখ থেকে একই শব্দ বেরিয়ে এল এবং তারপরে খুব ধীরে ধীরে একবার চারপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পবিত্রকে জিজ্ঞেস করল- ‘শোনা কথাগুলা কি সত্য ? সেখানে কি হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে?’

যে প্রশ্নটা এই মুহূর্তে পবিত্রকে শুনতে হতে পারে বলে বিন্দুমাত্র আশা করেনি সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কী উত্তর দিতে পারে তা চট করে বুঝে উঠতে পারল না। তারপরে কিছু না বোঝার মতো সে জিজ্ঞেস করল –‘কিসের হাঙ্গামা?’

‘আমরা তো শুনলাম’, কিছুটা দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে মাস্টার বললেন,‘পরশুদিন আমাদের আগের এক কলিগের ছেলে এই ট্রেনে গিয়েছে, আমাকে তো বলে গেল সাবধানে থাকার জন্য, গুয়াহাটিতে বিরাট হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সে তো সমস্ত জিনিসপত্র হোস্টেলে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচিয়ে চলে এসেছে…’স্টেশন মাস্টারের কথা শুনে পবিত্র নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারল না। হঠাৎ তার ভীষণ রাগ উঠে গেল। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। তার যে রাগ উঠেছে সে কথা বুড়ো স্টেশন মাস্টার বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন মাস্টারের মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল। যে কথা বলার নয় সে কথা বলে দিয়ে পরে অনুশোচনায় পড়লে যেভাবে মানুষ কথা বলে ঠিক সেভাবেই তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বললেন ‘আমরা মানে… আমরা মানে… তুমি কিছু …’

‘আমি স্টেশনে নামার সময় আমার জিনিসগুলি যে ছেলেটি ধরে নামিয়ে দিয়েছিল তাকে দেখেছেন কি?’ হঠাৎ বাধা দিয়ে পবিত্র বলল,‘তিনি কে জানেন? একজন বাঙালি ছেলে, নাম অনিমেষ রায়, রংজুলি বাগিচার নাম শুনেছেন তো, সেখানকার ম্যানেজারের ছেলে। আমরা দুজনে একই রুমে ছিলাম এতদিন আর আজ আমরা একই কামরায় বাড়ি ফিরে আসছি। কোথায় সে তো কোনো জিনিস পত্রফেলে রেখে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসে নি…’

‘না, না তুমি কিছু মনে কর না’ বুড়ো স্টেশন মাস্টার পবিত্রকে কিছু একটা বোঝানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন এবং বললেন,’ আমরা… আমরা…’

’ আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাইছেন !’

বাধা দিয়ে পবিত্র বলল- 'আপনার কথায় আমি বিন্দুমাত্র খারাপ পাইনি।আমি অবাক হয়েছি কেবল অন্য একটি কথায় …যে জায়গায় মানুষ খবরের কাগজ কী জিনিস জানেনা, যে জায়গার মানুষ আজকের যুগেও ‘রেডিও’ কি জিনিস দেখে নি, যেখানে আমিই একমাত্র ছেলে যে প্রথম কলেজে পড়ছি, যে জায়গার ছেলেমেয়ে বাজারের লাইন বাস গুলি ছাড়া এবং পাঁচ বছর পরে পরে সংগঠিত নির্বাচনের সময় দেখা গাড়িগুলি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি দেখেনি সেই জায়গায় পা রেখেই আমি দেখলাম, আমি আসার আগেই আমি যে জায়গা থেকে এসেছি সেই জায়গার খবর আমার চেয়ে বেশি আপনারা পেয়ে গেছেন।…’

‘ তুমি কিছু মনে কর না, তুমি কিছু মনে কর না’ বাধা দিয়ে স্টেশন মাস্টার বললেন,‘আমরা জানি তোমার কথাই একমাত্র সত্য কথা হবে, ওগুলি রিউমার বলে আমি ছেড়ে দিচ্ছি…’

‘ কিন্তু কথা হল কেন সৃষ্টি হবে সেই রিউমারগুলি? কেন অনর্থক সত্যের অপলাপ করে মানুষের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হবে?’

পবিত্রের মনে হল রিউমার ছড়ানো মানুষগুলির গলা পারলে যেন টিপে ধরবে। তার মুখের মাংস পেশী গুলি কঠিন হয়ে উঠল। তার মনের ভাবের পরিবর্তন বুড়ো মাস্টার লক্ষ্য করলেন । তার বড় ভয় হল। সাম্প্রদায়িক অশান্তির নিজে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী মানুষ। পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ এবং অসমের ভাষার জন্য হওয়া সংঘর্ষের তিক্ত অভিজ্ঞতা তার আছে। কে জানে তার বলা কথাগুলি গ্রামে গিয়ে পবিত্র যদি বলে দেয়। যদি ভুলক্রমে মুখ থেকে বেরোনো কথাগুলির জন্য পবিত্র ভুল বুঝে এই ভয়ে বুড়ো স্টেশন মাস্টারের মনে এক ধরনের অনুশোচনা দেখা দিল। সমস্ত সম্ভাব্য বিপদের ভয় যেন তাকে ঘিরে ধরল। তারপর বুড়ো মাস্টার ভয়ে ভয়ে পবিত্রকে বললেন ‘তুমি ঐ কথাগুলি কাউকে বলনা, কাউকে বলনা পবিত্র, তুমি আমার ছেলের মতো…’।

পবিত্রের মনে হল বুড়োর কথাগুলি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বুড়ো তার মুখের দিকে কাঠগড়ার আসামি বিচারকের মুখের দিকে তাকানোর মতো করে তাকিয়ে রয়েছে। বুড়োর সমস্ত বিপদে একমাত্র সেই যেন ত্রাণকর্তা। পবিত্রের নিজেরই খুব খারাপ লাগল। উত্তেজিত হয়ে পড়ার জন্য তার বড় লজ্জা হল। সে জানে- সত্যিই যদি শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে সমস্যার জন্য এখানে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বীজাণু সংক্রামিত হয় তাহলে সে সংঘর্ষ বন্ধ করার দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়বে। তাই সে এখন এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লে চলবে না। সমস্ত কথা ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করতে হবে। তার নিজেরই বড় লজ্জা হতে লাগল এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ার জন্য। ধীরে ধীরে তার উত্তেজনা মিলিয়ে এল…’

‘আমি দুঃখিত। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে পবিত্র বলল,’আপনি কিছু মনে করবেন না। আসল কথা কি জানেন এই ধরনের ‘রিউমার’গুলি আমাদের পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ এবং সংশয়ের বীজ সংক্রামিত করবে। তাই এই সমস্ত কথায় কিছুতেই গুরুত্ব দেবেন না। গুয়াহাটিতে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই কিন্তু হোস্টেলের জিনিসপত্র ফেলে রেখে কাউকে প্রাণ নিয়েপালানোর মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। আন্দোলনে ছাত্ররা যাতে সক্রিয়ভাবে নেমে পড়তে না পারে এবং যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় তার জন্য সরকার কিছুদিনের জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে। তার চেয়ে বেশি কিছু হয়নি। আপনি এই সমস্ত কথা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবেন না।… আর এই সমস্ত কথা এখন বাদ দিন। আমি ট্রাঙ্ক- বেডিং আপনার কাছে ছেড়ে যেতে চাইছি। বাড়িতে পৌঁছে আমি একটা গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দেব এগুলো নিয়ে যাবার জন্য। আমি এখন যাই …’

‘কী বলছ তুমি’ বুড়ো স্টেশন মাস্টার বললেন,‘এতদূর তুমি ট্রেন জার্নি করে এসেছ, কিছু খাওয়া দাওয়া না করে…’

‘না,না সে সবের প্রয়োজন নেই’পবিত্র বলল, চার মাইল রাস্তা, এক ঘন্টায় পৌছে যাব, আপনি মিছা মিছি চিন্তা…’

‘ না না সেটা হবে না’,দাবি জানিয়ে স্টেশনমাস্টার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পয়েন্টসম্যানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন-‘ এই রামসিং এখানে এসো। এই জিনিসপত্রগুলি আমার রুমে নিয়ে রাখ তো…’

‘ তুমি আমার সঙ্গে আমার কোয়ার্টারে এসো’বুড়ো মাষ্টার এবা র পবিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘শুধু এক কাপ চা খেয়ে এই আপ ট্রেনটার জন্য এসেছিলাম…চল, আমার বাড়িতে কিছু একটা খেয়ে নেবে…’

বুড়ো স্টেশন মাস্টারের আন্তরিকতার এই আহ্বানকে পবিত্র অবহেলা করতে পারল না। তারচেয়েও বড় কথা পবিত্র এক কাপ চায়ের প্রয়োজন বড় বেশি করে অনুভব করছিল, সেই জন্য সে বিশেষ কোনো আপত্তি করল না। ইতিমধ্যে রামসিং তার ট্রাঙ্ক বেডিং নিয়ে এসে স্টেশনমাস্টারের ঘরে নিয়ে রেখে দিয়েছে। তাই সে সবের নিরাপত্তার ব্যাপারে সে একেবারে নিশ্চিত হল।

ইতিমধ্যে স্টেশনমাস্টার স্টেশনের কাছেই ছোট একটি কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পেছন পেছন পবিত্রও সেদিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল।এই স্টেশন দিয়ে পবিত্র অনেকবার যাওয়া-আসা করেছে। অঞ্চলটির মধ্যে একমাত্র সেই গুয়াহাটি থেকে পড়ার জন্যই হোক অথবা বাবা হরমোহন বরার খ্যাতির জন্যই হোক অঞ্চলটির প্রত্যেকেই পবিত্রকে জানে। সেই সূত্রে স্টেশন মাস্টারও তাকে জানেন। সে বাড়িতে আসার সময় তার জিনিসপত্রগুলি স্টেশন মাস্টারের নির্দেশে ঘর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া গরুর গাড়িতে পয়েন্টসমেন উঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্টেশন মাস্টারের বাড়িতে তাকে কোনোদিন কোনো কারনে আসতে হয়নি।

কোয়ার্টারের সামনের দরজাটা খুলে হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার মতো বুড়ো এক পা পিছিয়ে এসে খুব গোপনীয় কথা বলার মতো করে বললেন-‘তুমি… তুমি আমার পরিবারের সামনে এইগুলি কিছু বল না,She has…she has a very shocking memory…’ তারপর বাইরের বারান্দায় বসে পড়তে থাকা মেয়েটিকে চিৎকার করে বলল-‘মা অঞ্জনা, মাকে বলতো, মাস্টারমশাইয়ের ছেলে এসেছে …’

পবিত্রের মনে হল স্টেশনমাস্টার কথাটা বলা শেষ করার আগেই মেয়েটি আধা ভাঙ্গা বেতের চেয়ার থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল। বারান্দায় উঠে স্টেশনমাস্টার পবিত্রকে মেয়েটি রেখে যাওয়া চেয়ারটা দেখিয়ে বলল,’তুমি এখানে বস, আমি…আমি এখনই আসছি…

স্টেশন মাস্টারের বাংলা অসমিয়া মিশ্রিত ভাষাটা পবিত্রকে হঠাৎ বড় আমোদ দিল। এতক্ষণ সে তার ভাষার প্রতি লক্ষ্যই করেনি। সে চেয়ারটায় বসতে গিয়ে বলল,‘ঠিক আছে, আপনি যান আমি এখানে বসছি।’

পবিত্র দেখল চেয়ারটাতে একটা বই পড়ে রয়েছে। মেয়েটি সম্ভবত বইটি পড়ছিল। অভ্যাসবশত সে বইটা তুলে নিয়ে দেখল। জীবনানন্দের কবিতার বই- জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা। পবিত্র জীবনানন্দের নাম শুনেছে কিন্তু তার কবিতা কোনোদিন পড়েনি। এই ধরনের একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে একটি ছোট্ট স্টেশন মাস্টারের ঘরের বারান্দায় একটা ভাঙ্গা চেয়ারে জীবনানন্দের কবিতার বই পড়ে থাকবে সে ভাবতেই পারেনি। বহুদিন খেতে না পাওয়া মানুষের মতো সেই জন্য সে কবিতার বইয়ের পাতা উল্টে যেতে লাগল। কতক্ষণ সে তন্ময় হয়েছিল বলতে পারে না। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পড়ে যাওয়া কবিতা গুলি সে মুখ দিয়ে শব্দ করে পড়তে লাগলঃ

‘সুচেতনা,তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে,

সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃ্থিবীর রণরক্ত সফলতা

সত্য,তবু শেষ সত্য নয়।

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয় …’


হঠাৎ পবিত্রের মনে হল তার সামনে যেন কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এল। সে দেখল তার সামনে কিছুক্ষণ আগে বারান্দার এই চেয়ারটায় বসে থাকা মেয়েটি হাতে একটা ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে তাকাতে দেখে সুন্দর অসমিয়াতে বলল-‘মুখটা ধুয়ে নিন, অনেক দূর থেকে এসেছেন, ভালো লাগবে…’

এত সুন্দর উচ্চারণে অসমিয়ায় বলা কথাটা পবিত্র কে বড় অবাক করে দিল। সে কিছুক্ষণ কী বলবে বুঝতে পারল না। তারপরে একহাতে ঘটিটা নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল ‘এই বইটি আপনার?’‘আমার ছিল না’মেয়েটি বলল,‘অবশ্য এখন আমারই…’

‘ এত সকাল সকাল যে জীবনানন্দের কবিতা পড়ছিলেন, আপনার জীবনানন্দ খুব প্রিয় কবি নাকি?’

এবার মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, সে যেন কিছুটা গম্ভীর হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মেয়েটি বলল ‘জীবনানন্দ আমার প্রিয় কবি কিনা আমি জানিনা, কিন্তু এই বইটি, এই বইটি আমার বড় প্রিয়… আচ্ছা আপনি মুখ হাত ধুয়ে নিন, আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি…’

পবিত্রকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল। পবিত্র মুখটা ধুয়ে মোছার জন্য পকেট থেকে রুমাল বের করতে যেতেই মেয়েটি একটি পরিষ্কার অসমিয়া গামছা নিয়ে এসে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-‘বাক্সের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগল, কিছু মনে করবেন না।…’

‘না,না আমার রুমাল আছে’পবিত্র বলল। মিছামিছি কষ্ট করলেন।’

ঠিক তখনই কাপড়চোপড় পাল্টে নিয়ে, মুখ হাত ধুয়ে বুড়ো স্টেশন মাস্টার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন।

‘ তোমাকে একা রেখে গেলাম’ স্টেশন মাস্টার ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, ‘আমার একটু দেরী হল, কিছু মনে কর না…’

‘না,না’ পবিত্র বাধা দিয়ে বলে উঠল- ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’

‘ওকে চিনতে পেরেছ,মা অঞ্জনা’,মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্টেশনমাস্টার বললেন ও, পবিত্র মাস্টারমশাইয়ের ছেলে,গুয়াহাটিতে কলেজে পড়ে। তারপর পবিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,’আমার মেয়ে অঞ্জনা, এর আগে ফরকাটিঙে যখন ছিলাম কলেজে পড়ত,গোলাঘাটের কলেজ থেকে প্রি-ইউনিভার্সিটি পাশ করেছে, এখন বাড়িতেই থাকে। ও বলেছে প্রাইভেটে বি এ পরীক্ষা দেবে। ও পড়াশোনায় ভালো, মেট্রিক,প্রি ইউ ফার্স্ট ডিভিশনে…’

‘ওগুলি থাক বাবা’ বাধা দিয়ে অঞ্জনা বলল, তুমি একটু চুপ কর, আমার সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ পেলে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। তারপর পবিত্রের দিকে তাকিয়ে বলল,‘আসুন চা হয়েছে, বাবা আমার সম্পর্কে একটু বেশি বলেন…।’

‘মিথ্যা কথা আমি বলছি না’ …’ স্টেশনমাস্টার কিছুটা অপমান বোধ করার মতো প্রতিবাদ করে ওঠেন।

‘হ্যাঁ, তিনি ঠিকই বলেছেন, পবিত্র স্টেশনমাস্টারের কথায় সায় দিয়ে বললেন, তিনি তো কোনো মিথ্যা কথা বলেননি। আপনি পড়া বইটা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, আপনি শিক্ষিত।’

‘হবে, হবে আপনি আর বাবাকে আশকারা দেবেন না। তারপরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-‘ আমি তোমার মেয়ে, সেটাই আমার পরিচয় এবং অন্য কোনো পরিচয় নেই। পৃথিবীতে বহু ছেলেমেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক,প্রি- ইনভারসিটি পাস করেছে, একমাত্র আমিই নয়…’

কথা বলতে বলতে অঞ্জনা ভেতরে চলে গেল। পবিত্র বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। স্টেশনমাস্টার বললেন-‘এসো পবিত্র, ভেতরে এসো।’ তারপরে স্টেশন মাস্টার ভেতরে চলে গেলেন। পবিত্রও তার পেছন পেছন ভেতরে চলে এল। ঘরে ঢুকেই পবিত্র একটি টেবিল দেখতে পেল। সম্ভবত অঞ্জনার পড়ার টেবিলের এক মাথায় কিছু বইপত্র পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা আছে। টেবিলের অন্য প্রান্তে একটি চেয়ার এবং অন্যদিকে একটি বিছানা, বিছানার উপরে একটা পাটি পেতে রাখা আছে। অঞ্জনা চেয়ারটা কিছুটা টেনে নিয়ে পবিত্রকে বসতে বলল- তারপর বাবাকে বলল,‘তুমি ওখানে বস।’ কথা বলতে বলতে অঞ্জনা ভেতরে চলে গেল। তারপর দুটি প্লেটে লুচি এবং বেগুন ভাজা এনে টেবিলের ওপরে রাখল। ওর পেছন পেছন ওর মা এক কাপ চা নিয়ে চলে এল। অঞ্জনা পবিত্রের দিকে তাকিয়ে বলল,‘এই যে আমার মা।’ পবিত্র উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল।‘বস বস বাবা’ বলে অঞ্জনার মা বললেন-‘ বাড়িতে কিছুই ছিল না, তুমি প্রথম এসেছ…’বাধা দিয়ে পবিত্র প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললঃ‘অনেক দিয়েছেন। আমি আপনাদের অসময়ে এসে অসুবিধার সৃষ্টি করেছি। মিছামিছি এতগুলি…’

‘ আপনি একটু বেশি ভদ্রতা করছেন।’ অঞ্জনা বলল- এতদূর ট্রেন জার্নি করে নিশ্চয় আপনার ক্ষুধা পেয়েছে এবং ক্লান্ত লাগছে।আর কিছু না হলেও এক কাপ চা না খেয়ে আমি হলে এত দূর হেঁটে যাবার কথা ভাবতে পারতাম না…’

‘সেটা অবশ্য ঠিক’ পবিত্র বলল-এক কাপ চা খেয়ে আমার বেশ ভালোই লেগেছিল। কিন্তু কথা হল অনর্থক আপনারা এত কিছুর আয়োজন করলেন কেন…?’

‘তেমন আর কি?’ মা বলল,‘তোমার জন্য আলাদা আর কিছু করছি না, যা আছে তাই দিলাম…’।

‘শহর থেকে এসেছে তো’অঞ্জনা বলল, তাই এরকম ভদ্রতা শিখেছে মা, তুই এইগুলি বুঝতে পারবি না।’

‘তুই চুপ কর’ মা বলল, একটা নতুন ছেলে এসেছে, তুই এমন করে কথা বলিস না…’ তারপর পবিত্রের দিকে তাকিয়ে বলল,’ তুমি কিছু কর না বাবা, মেয়েটা বাবার স্নেহ পেয়ে …’

‘না, না আমি কিছুই মনে করিনি’ পবিত্র বাধা দিয়ে বলে উঠল ‘আপনি মিছামিছি চিন্তা করছেন…’শুধু কি আমিই স্নেহ করি?’ একান্তমনে এতক্ষণ চা খেতে থাকা বুড়ো স্টেশন মাস্টার এবার বলে উঠলেন –‘পবিত্র ঘরের ছেলে, কিছু মনে কর না, অঞ্জনা তো পবিত্রের সমবয়সী তাই একটু মজা…’ পবিত্র তুমি কোন সালে ম্যাট্রিক পাস করেছ?’

‘সিক্সটি নাইনে।’

‘কী?’এবার অঞ্জনা চিৎকার করে উঠল,‘আমার চেয়ে জুনিয়র,আমি সিক্সটি এইটে,তার মানে আমি আর আপনি বলব না, তুমি আমার ভাই, আমি তোমার দিদি, কেমন খোকা?’

‘ঠিক আছে’ পবিত্র বলল,‘আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমার একটা কন্ডিশন আছে।’

‘কী কন্ডিশন?’ আমাকে তুমি বলতে এলাও করতে হবে’ পবিত্র বলল।

‘ ঠিক আছে’ অঞ্জনা বলল-‘আমি এগ্রি করছি, মা-বাবা সাক্ষী রইল।’

অঞ্জনার কথা বলার ধরনে পবিত্র, মা-বাবা সমস্বরে হেসে ফেলল। সেই হাসিতে যোগ দিয়ে অঞ্জনাও বলল-‘ আজ থেকে আমি একটা নতুন ভাই পেলাম।’