মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -৮

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ... পঞ্চাননতলার মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে বানীদিদের গান শুনছিলাম । হঠাৎ কে যেন কাঁধের ওপর হাত রাখলো, পিছন ফিরে দেখি সুজনদ। 'কী রে, পরীক্ষা তো এসে গেলো, কেমন হয়েছে প্রস্তুতি', দাদা আমাদের পাড়াতেই থাকে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, একটু খ্যাপাটে টাইপের, সবাই বলে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটা নাকি পড়তে পড়তেই এমন হয়ে গিয়েছে । সেদিন কী কারণে যেন সকালবেলায় দাদাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি হলঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে সুজনদা দু-হাত তুলে ক্রমাগত গেয়ে যাচ্ছে, 'মিল গ্যায়া, মিল গ্যায়া দিল দিল সে', সুজনদাকে ঐ ভাবে চিৎকার করতে দেখে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম আর আমার অবাক হওয়া মুখটার দিকে চেয়ে দাদা একসময় নিজেই বলে উঠলো, 'বুঝলি কুশল, কাল রাত থেকে ব্যাটা বহুত জ্বালিয়েছে , কিন্তু পারলো কি শেষ অবধি আমায় জব্দ করতে'?

কে জ্বালালো বা কীসের জব্দ , কিছুই বুঝে উঠতে পারি না তাই বোকার মত প্রশ্ন করে বসি, 'কে জ্বালাচ্ছিল'?

সুজনদা ততক্ষণে আবার যেন নিজের জগতে ফিরে গিয়েছিল , আমার কথার উত্তর না দিয়ে নিজের মনেই বলে উঠেছিল, কুশল, তুই বোস, আমি ততক্ষণে অংকটার বাকি স্টেপ দুটো সেরে ফেলি , কথাটা বলেই এক লাফে বিছানায় উঠে অংক কষতে লেগে গিয়েছিল সুজনদা। পরে বুচিদি মানে সুজনদার বড়দিদির মুখে শুনেছিলাম , আগের দিন সারারাত জেগে নাকি দাদা একটা অঙ্ক নিয়ে পড়েছিল , কিছুতেই অংকটার উত্তর মিলছিল না, আর সকালে অংকের জট খুলতেই ঐ মিল গ্যায়া দিল দিল সে গান।

ঘাড় নেড়ে জানালাম, মোটামুটি তৈরি।

মোটামুটি ! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মোটামুটি ! ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ কাঁধটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে সুজনদা বলে উঠল, লাইক এ ব্রেভ সোলজার কেন বুক ঠুকে বলতে পারছিস না যে ইয়েস, আই অ্যাম রেডি ফর দ্য এক্সাম! অঙ্কে আর ফিজিক্যাল সাইন্সে লেটার পাবি তো ?

মাথা নেড়ে জানালাম , আশা করছি , তবে অংকের জ্যামিতির এক্সট্রা নিয়ে একটু ভয়ও করছে।

জ্যামিতির এক্সট্রা নিয়ে ভয় করছে ! কীসের ভয়? শোন, প্রথমে প্রবলেমটা খুব মন দিয়ে পড়বি, দরকার হলে দু-তিনবার করে পড়বি, তারপর ছবিটা এঁকে ফেলবি, মনে মনে ভাববি প্রবলেমটার সঙ্গে কোন কোন উপপাদ্যগুলি রিলেটেড, দরকার হলে সেগুলো মনে মনে একটু আউরে নিবি ... সুজনদা হয়তো রাস্তাতেই জ্যামিতির ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিত, তমাল এসে আমায় বাঁচালো, তমালও আমার মত এবার মাধ্যমিক দেবে তবে ও অন্য স্কুলে পড়ে । তমাল জানালো যে সে খাতা আনতে রমেশ স্যারের কোচিংয়ে যাচ্ছে, আমি ওর সঙ্গে যাব কি না । আমাদের এখানকার বেশীরভাগ ছেলে-মেয়েই ক্লাস সেভেনে ওঠার পর রমেশ স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে যায়। স্যার এক সময় নৃপেন্দ্রনাথ স্কুলের ইংরেজির টিচার ছিলেন , রিটায়েরমেন্টের পর বাড়িতে কোচিং খুলেছেন , ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আমিও স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি এখন সব সাবজেক্ট পড়ি না , শুধু ইংরেজি ক্লাসটা করি , বাকি সাবজেক্টগুলোর জন্য অলোককাকু ওনার এক বন্ধুকে ঠিক করে দিয়েছেন, স্যার সপ্তাহে তিনদিন করে বাড়িতে এসে আমায় পড়িয়ে যান। তমালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোচিংয়ের দিকে হাঁটা শুরু করি।

হাঁটতে হাঁটতে দত্ত ডেকরাটার্স, নিতাইদার মুদি দোকান পার করে আমরা এখন আমাদের ক্লাব ঘরটার সামনে , মতিকাকু দেখি ক্লাব লন দিয়ে হেঁটে আসছেন , পরনে অফিসের পোশাক , কাকু অবশ্য অফিস থেকে নয় , সারাদিন ক্লাবে তাস পিটিয়ে এখন বাড়ি ফিরছেন, তবে কাকিমা জানবেন কাকু অফিস থেকেই ফিরলেন , শুধু তাই নয় অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে কাকিমার দেওয়া চা-জলখাবার খেয়ে কাকু আবার ক্লাবের দিকে রওনা দেবেন । বড় অদ্ভুত মানুষ এই মতিকাকু ! তাস খেলার নেশা যে একটা মানুষকে কতখানি পাগল করে তুলতে পারে তা কাকুকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাবার মুখেই শুনেছি তাস খেলার জন্য ছুটি নিতে নিতে ওনার অফিসে নাকি এখন এমন অবস্থা যে একদিন কামাই করলেই ওনার উইদাউট পে হয়ে যায়, তবু কাকুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সপ্তাহের বেশীরভাগ দিনই বাড়িতে অফিস যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গুটিসুটি ক্লাবে এসে ঢুকে যান, এক-একদিন তো এমনও হয়, করুণাময়ীর বাসস্টপ অবধি গিয়েও বাসে না চড়ে আবার ইউ টার্ন নিয়ে নেন, ক্লাবের সবাই ওনাকে অনেক বারণ করেছে কিন্তু কাকু কারোর কথা শোনার পাত্র নন, তাসের নেশা যেন মানুষটাকে পাগল করে রেখেছে । অফিস টাইমে যদি কোনোদিন কাকিমাকে কোনো কাজে ক্লাবের সামনের রাস্তাটা দিয়ে যেতে হয় তাহলে সেদিন ক্লাবে একটা বেশ মজার দৃশ্য হয় , কাকিমাকে দূর থেকে আসতে দেখে কাকু নাকি ক্লাবের দেওয়াল ঘেঁসে শতরঞ্চি মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন । বাবা একদিন হাসতে হাসতে এসব গল্প করছিল আর সেদিনই শুনলাম ক্লাবের সবাইকে উনি বলে রেখেছেন ওনার মৃত্যুর পর গীতার বদলে যেন ওনার বুকের ওপর একটা তাসের প্যাকেট রাখা হয়!

রমেশ স্যারের কোচিংটা চার নম্বর কলোনিতে , আমাদের এখানকার কলোনিগুলির এরকমই সব নাম, তিন , চার , পাঁচ , ইনফ্যাক্ট আমাদের পঞ্চানন তলাও আসলে পাঁচ নম্বরেরই একটা অংশ , আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বলে তমাল কোচিংয়ের ভিতরে চলে গেলো আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই খাতা নিয়ে ফিরে এলো, ওর মুখটা এখন বেশ খুশী খুশী, কে জানে কীসের এত খুশী, আমার তো পরীক্ষার কথা ভাবলেই পেটের মধ্যে গুড়গুড় শুরু হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হাত-পা-ও ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, তমালকে বললাম, চল না একবার করুণাময়ীর কালীমন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে আসি ।

তমাল জানালো যে যাবে তবে একটু বাদে, ওর নাকি এখন এখানে একটা ছোট কাজ আছে, সেটা সেরে তারপর যাবে, কথাগুলি বলতে বলতে তমাল কোচিংয়ের সামনে যে লাইট পোস্টটা আছে তাতে হেলান দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।

মনে মনে ভাবছি কী কাজ হতে পারে! জিজ্ঞাসা করাতে শেষ অবধি তমাল ইতস্তত করে কাজটার কথা বলেই ফেললো , তবে বলবার আগে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলো যে কথাটা যেন আমি কাউকে না বলি , ব্যাপারটা হচ্ছে যে কোচিংয়ে এখন নাইনের যে ব্যাচটা চলছে তাতে রঞ্জনা বলে একটি মেয়ে আছে, রঞ্জনাকে আজকাল দিনের মধ্যে অন্তত একবার দেখতে না পেলে তমালের নাকি রাতে ঘুম হয় না । আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তমাল বারবার কোচিংয়ের মেন গেটটার দিকে তাকাচ্ছিল আর কিছুক্ষণ বাদেই দেখলাম সেখান থেকে এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে কলকল করতে করতে বেরিয়ে আসছে, ওদেরকে বেরিয়ে আসতে দেখে তমাল লাইট পোস্টের হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো , ওর চোখ-মুখই বলে দিচ্ছে যে ভিড়ের মধ্যে ও বিশেষ কাউকে খুঁজছে আর সেই খোঁজা শেষ হলে এক সময় আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, কুশল, ঐ যে নীল-সাদা চেক-চেক ফ্রক পরা মেয়েটা দেখছিস, ওরই নাম রঞ্জনা।

ফর্সা, গোলগাল, পুতুল পুতুল দেখতে মেয়েটি দু’জন বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা রাস্তার যেদিকে দাঁড়িয়ে তার উলটো দিকের ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে, আমার কিন্তু একটু অবাকই লাগলো , যাকে দেখার জন্য তমাল এত উদগ্রীব তাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে সে-ও কাউকে খুঁজছে। একবারের জন্যও মেয়েটি এদিক ওদিক না তাকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে যেমন হাঁটছিল তেমনি ভাবেই কিছুক্ষণের মধ্যেই পথের বাঁকে হারিয়ে গেলো।

আর রঞ্জনা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে আমরা করুণাময়ী কালী মন্দিরের দিকে হাঁটা লাগালাম।

কী ব্যাপার রে, একটু খোঁচাই তমালকে ।

বলছি, আগে বল, রঞ্জনাকে কেমন দেখলি?

মন্দিরে যেতে যেতে তমাল তার প্রেমের বিষয়ে আরো কিছু গুপ্ত কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করলো , তবে শেয়ার করার আগে অবশ্যই কাউকে কিছু না বলার শর্তটি আরেকবার মনে করিয়ে দিলো, রঞ্জনা নাকি তমালদের স্কুলেরই গার্লস সেকশনে পড়ে, এবারের সরস্বতী পূজায় ভোগ খাওয়ার সময় রঞ্জনার সঙ্গে তমালের ধাক্কা লাগে আর সেই ধাক্কায় রঞ্জনার পাতের খিচুড়ি গিয়ে চলকে পড়েছিল তমালের জামায় , রঞ্জনা সে জন্য নাকি তাকে তিন তিন বার সরি বলেছে। এই সব কথা জানানোর ফাঁকে তমাল হঠাৎ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে উঠলো, বস, আমার একটা কাজ করে দিবি?

কী কাজ?

কাল তোকে যদি একটা চিঠি দেই তাহলে সেটা তুই রঞ্জনার হাতে একটু পৌঁছে দিবি?




প্রায় ছ’টা নাগাদ মন্দির থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম , তমাল অবশ্য এলো না, ও এখন মন্দিরের পিছনে রাজা লাল্টুদের সঙ্গে আড্ডা মারছে , রাজা-লাল্টুরা আমাদের পাড়াতেই থাকে , সন্ধ্যাবেলায় ওরা রোজ মন্দিরের পিছনে এসে সিগারেট ফোঁকে । হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই, দূরে কারো বাড়িতে শাঁখ বাজছে আর আমাদের বাড়ি থেকে মায়ের গলা ভেসে আসছে

বিশ্ব পিতা তুমি হে প্রভু, আমাদের প্রার্থনা এই শুধু

তোমারই করুণা হতে বঞ্চিত না হই কভু

এ আকাশ এ বাতাস এই নদনদী

এ সাগর এ পাহাড় এই বনানী

ফুলে ফলে রঙে রসে

ভরে ভরে যে দিয়েছ ...



লগ্ন হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটায়, তাই ফুলে ফুলে সাজানো অলোককাকুর গাড়িটা আমায় নিয়ে ছ’টার মধ্যেই পৌঁছে গেল উর্মিদের বাড়িতে, এর আগে আমি দু'বার উর্মিদের বাড়িতে এসেছি, প্রথমবার আমাদের আলাপের কিছুদিন বাদে, সেদিন উর্মি ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, আমাকে বসবার ঘরে বসিয়ে উর্মি বাড়ির ভিতরে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে ও আর শর্মী ফিরে এসেছিল ওদের বাবা-মায়ের সঙ্গে, বাবা-মাকে আড়াল করে শর্মী চোখের ইশারায় আমায় যেন জানাতে চাইছিল, গেট রেডি, এবার কিন্তু আপনার ফাইনাল ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য প্রশ্নকর্তারা এসে হাজির। পা ছুঁয়ে মালাকার দম্পতিকে নমস্কার জানালে উর্মির মা আমায় বসতে বলে এক এককরে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিলেন যে আমাদের বাড়িটা ঠিক কোথায়, আমি কোন অফিসে চাকরি করি, অফিসে আমার কাজটাই বা ঠিক কী, বাবা কবে মারা গিয়েছেন, বাবার ঠিক কী হয়েছিল, তোমার মা তো শুনেছি নাম করা গায়িকা, তা উনি কি সিনেমায় গান করেন?

না না, মা সিনেমায় গান করেন না, উনি আসলে রাগ সঙ্গীত গান।

আচ্ছা, তার মানে ঐ যে আ আ টাইপের খেয়াল গান, তাই তো?

উর্মিই এরপর আমার হয়ে তার মায়ের কথার উত্তর দিয়ে বলেছিল, মা, মাসীমা ক্লাসিক্যাল গান করেন, আমি তোমায় পরে ডিটেলে বুঝিয়ে বলবো।

কিছু মনে করো না বাবা, আমি আবার অত ক্লাসিকাল ফ্লাসিকাল বুঝি না, রেডিওতে রোজ সন্ধ্যাবেলায় মনের মত গানের যে প্রোগ্রামটা হয় সেটা শুনি আর মাঝে-মাঝে রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে শ্যামা সঙ্গীত ।

এসব কথার মাঝেই এক সময় মালাকার কর্তা গলা খাঁকারি দিয়ে জানান দিয়েছিলেন যে এবার উনি কিছু বলতে চান, গলাটা আরো একবার পরিষ্কার করে আমার দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠেছিলেন, দেখো কুশল, মানুষটা আমি ঠোঁট কাটা , যাকে যা বলবার তা সোজাসুজিই বলতে ভালবাসি, একটু থেমেছিলেন, যেন বুঝতে চাইছিলেন যে ওনার কথায় আমার রিঅ্যাকশনটা ঠিক কী, সত্যি কথা বলতে কী আমার ভিতরেও সেদিন কিন্তু ওনার কথায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারছিলাম না যে ভদ্রলোক ঠিক কী বলতে চান, ভাবছিলাম উনি যদি আমাদের দুই ফ্যামিলির মধ্যে বৈভবের যে ব্যবধানটা আছে সেটা আমায় মনে করিয়ে দিতে চান তাহলে উনি ভুল করছেন, কারণ ওটা আমি জানি, আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নেই , ইনফ্যাক্ট উর্মিদের বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিন আগে নিজেই আমি উর্মির সামনে সেই প্রসঙ্গটা তুলে ছিলাম, তবে উর্মি কিন্তু সেদিন তার জবাবে আমায় লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল।

কুশল, তুমি কী মনে করো! ভালবাসা কি শুধুই একটা হিসেব নিকেশ ... কথাগুলি বলতে বলতে উর্মির চোখদুটো সেদিন জলে ভরে উঠেছিল।

দেখো, ক্ষণিকের স্তব্ধতা কাটিয়ে মিস্টার মালাকার আবার তার বক্তব্যে ফিরে এসেছিলেন , দুই মেয়েকেই আমি ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে বড় হতে দিয়েছি , তাই উর্মি যেদিন তোমার কথা আমাদের জানিয়েছিল আমি কিন্তু সেদিন ওর পছন্দ বা মতামত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি, তবে একটা কথা বলেছিলাম আর সেই কথাটাই আজ আমি তোমাকেও একবার বলতে চাই, এ সম্পর্ক তুমি আর উর্মি যেমন তোমাদের নিজেদের পছন্দ বা সিদ্ধান্তের ওপর গড়ে তুলতে চাইছ তেমনি এর ভালোমন্দের দায়িত্বও কিন্তু তোমাদেরকেই নিতে হবে। উর্মির বাবার সঙ্গে সেদিন প্রায় আধ ঘণ্টার মত কথা হয়েছিল, সত্যি বলতে কী ভদ্রলোককে কিন্তু আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল, এত বড় ব্যবসার মালিক অথচ একটুকুও অহংকার নেই, মাটির কাছাকাছি থাকা একটা মানুষ, বরঞ্চ উর্মির মায়ের কথাবার্তায় সব সময় কেমন যেন একটা বৈভবের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছিলাম। দ্বিতীয়বার যেদিন উর্মিদের বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন মা আসলে উর্মিকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল, অলোককাকুও আমাদের সঙ্গে ছিলেন, অলোককাকুকে দেখে উর্মির মা জানতে চেয়েছিলেন যে উনি আমাদের ঠিক কে হন, মা সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানিয়েছিল, কুশলের বাবার বন্ধু, আমাদের পরিবারের অভিভাবকের মত।

বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়িটাই আজ যেন আলোয় ঝলমল করছে, মেনগেটের সামনে আমাদের গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই অনেক মেয়ে-বৌ একসঙ্গে বাড়ির ভিতর থেকে শাঁখ বাজাতে বাজাতে ছুটে এলো। শর্মীকে দেখলাম দলটার পুরোভাগে , গাড়ি থেকে নামবার সময় আমার ডান হাতে একটা চিমটি কেটে বললো, রাজকুমার, শেষ অবধি তাহলে রাজকুমারীকে হরণ করিতে আসিয়াই পড়িলেন, তবে একটা কথা মনে রাখিবেন , এই রাজকুমারীকে হরণ করাটা কিন্তু মোটেও সহজ কর্ম হইবে না , তার জন্য আপনাকে আজ বাসর সজ্জায় রাজকুমারীর সখীবৃন্দের সামনে অনেক রকমের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হইতে হইবে, মনে-মনে তাহার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।




সন্তোষপুরের মোড়ে বাসটা এসে দাঁড়াতে নেমে পড়লাম , বাসস্টপের গা ঘেঁসেই রিকশা স্ট্যান্ড , একটা রিকশাওয়ালাকে জায়গাটার নাম বলাতে সে বললো পাঁচ টাকা ভাড়া, রিকশার হুডটা নামিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসি। এই জায়গাগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে কলোনিগুলি সব সদ্য গজিয়ে উঠেছে , বেশীরভাগ বাড়িরই প্লাস্টার বিহীন ইটের গাঁথুনি আর তার ওপর টিনের বা টালির চাল, এধার-ওধারে বেশ কটা বেড়ার বাড়িও নজরে পড়লো, মেন রোডের দুদিকেই অজস্র গলি, গলিগুলি এত সরু-সরু যে গাড়িঘোড়া তো দূরের কথা রিকশা ঢোকাতেও চালককে বেশ কসরত করতে হবে, সব গলির মুখেই প্রায় একই দৃশ্য , বিভিন্ন বয়সের মানুষের জটলা। এই রকমই একটা গলির মুখে রিকশাওয়ালা আমায় নামিয়ে দিয়ে বললো, বাবু , এসে গিয়েছি, উলটো দিকে চাইতে শুভ্রার কথা মত একটা মন্দিরও দেখতে পেলাম, এই মন্দিরটার কথাই শুভ্রা সেদিন ফোনে বলেছিল , তার মানে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি , গলির মুখে দেখি একটা চায়ের দোকান, দোকানী ভদ্রলোক বড় একটা ডেকচিতে জল চাপিয়ে স্টোভে পাম্প দিচ্ছেন, দুপুরবেলা বলে এখন দোকানে সেরকম খদ্দেরের ভিড় নেই , শুধু তিন-চারজন উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চটায় বসে আড্ডা মারছে, ওদেরকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, ৭/১ কোনদিকে হবে বলতে পারেন ?

দাদা বাড়ির নম্বর বললে এখানে সারা জীবন খুঁজেও বাড়ি পাবেন না, তার চেয়ে বাড়িওয়ালার নামটা বলুন। বেঞ্চে বসা ছেলেগুলোর মধ্যে একজন উত্তর দিলো, আমার বিহ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি এবার বললো, আসলে কী জানেন, এখানে বাড়িগুলোর নাম্বারিংয়ের কোনো মা-বাপ নেই, ছত্রিশের পরই হয়তো দেখবেন দুশো ছত্রিশ তাই বলছিলাম বাড়িওয়ালার নাম জানা না থাকলে এখানে বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল।

এই রে! বাড়িওয়ালার নামটা তো জানি না, ফোনে সেদিন শুভ্রা ওদের ভাড়াবাড়ির ঠিকানাটাই শুধু বলেছিল আর ল্যান্ডমার্ক হিসেবে গলির উল্টোদিকের ঐ মন্দিরটার কথা , শুভ্রাদের বিয়ের মাস খানেক বাদে প্রথম সেদিন দুপুরবেলায় শুভ্রা অফিসে ফোন করেছিল, আরে মশাই, আপনি তো দেখছি সাংঘাতিক রকমের অসামাজিক! শুভ্রার বিয়ের পর প্রথম সেই ওর সঙ্গে কথা বলা , গলা শুনেই বুঝেছিলাম মেয়েটা সুখে আছে , সুখে না থাকলে কোনো মেয়ের গলা থেকে এরকম আদুরী স্বর বেরয় না।

কেন, আমি আবার কী অসামাজিকতা করলাম, ফোনের এ প্রান্ত থেকে কথাগুলি বলে উঠেছিলাম।

অসামাজিকতা নয়! সেই যে সেদিন রেজিস্টার অফিসে ফুলের গোছা হাতে দিয়ে উইশ করে বলে এলেন , উইশ ইউ বোথ এ হ্যাপি ম্যারেড লাইফ, তারপর তো একবার খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না যে আমরা কেমন আছি!

খোঁজ যেমন নেওয়া হয়নি তেমন খোঁজ না নেওয়ার কিন্তু একটা কারণও আছে।

শুনি, শুনি, কী কারণ, শুভ্রার গলায় যেন নকল ঝগড়ার সুর মিশে ছিল সেদিন।

খোঁজ যে নেব তার জন্য তো দেখা-সাক্ষাত হওয়া প্রয়োজন, আমি তো এটাও জানি না যে তোমাদের বাড়িটা ঠিক কোথায়।



শুভ্রাদের বিয়ের অনুষ্ঠান সারা হলে রেজিস্টার অফিস থেকে বেরিয়ে সেদিন আমরা সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছিলাম , চা খেতে খেতে সমুদ্র জানিয়েছিল যে তার বাবা-মা-ও শুভ্রার বাবা-মায়ের মতই তাদের বিয়েটা মেনে নিতে রাজী নয়, আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি , তাহলে তোমরা এখন থাকবে কোথায়? সায়ন নামে ওদের যে বন্ধুটা রেজিস্টার অফিসে বিয়ের পুরো ব্যাপারটা তদারকি করেছিল তাকে দেখিয়ে সমুদ্র জানিয়েছিল যে সেদিনের মত রাতটা ওরা সায়নদের বাড়িতেই কাটাবে আর পরের দিন সকালবেলায় ওরা দিঘায় চলে যাবে হানিমুনের জন্য । দিঘা থেকে ফেরত আসবার আগেই সমুদ্রের বন্ধুরা নাকি ওদের থাকার জন্য একটা বাসা খুঁজে রাখবে। চা খাওয়ার পর সমুদ্র যখন ওর বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেটে টান দিচ্ছিল আমি তখন শুভ্রাকে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করি , তুমি তো বললে সমুদ্র গান ছাড়া আর কিছু মানে চাকরি-বাকরি করে না, তাহলে তোমাদের এখন চলবে কী করে?

কথাটা শুনে শুভ্রা সেদিন যেন একটু বিরক্তই হয়েছিল, কুশলদা আপনি না সারা জীবন শুধু হিসেব নিকেশ করেই কাটালেন, আরে বাবা অত ভাববেন না, দেখবেন, কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়েই যাবে, আর যদি কিছু না হয় তখন আমিও না হয় আপনার মতই টিউশন করা শুরু করে দেব।


ফোনেই শুভ্রা সেদিন জানিয়েছিল যে সমুদ্র তিন জায়গায় অডিশন দিয়েছে , প্রতিটা অডিশনই খুব ভালো হয়েছে, আশা করছে যে কোনোদিন এদের কারোর সঙ্গে সমুদ্রের এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে যাবে , ফোন ছাড়ার আগে শুভ্রা বারবার করে সেদিন আমায় বলেছিল যে আমি যেন ওদের বাড়ির ঠিকানাটা নোটবুকে টুকে নেই আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার ওদের বাড়িতে এসে চুটিয়ে আড্ডা মেরে যাই । ঠিকানাটা লিখে নিলেও যাব-যাচ্ছি করে এই এক বছরে আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি । এর মাঝে যে’কবার শুভ্রা ফোন করেছে সে'কবারই ও অনুযোগ করেছে আমার নাকি খুব দেমাক বেড়ে গিয়েছে , তাই এতবার বলার পরও সময় করে একদিনও ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারিনি ।

কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরনর মুখে বেশ ক'দিন বাদে আবার শুভ্রার ফোন এলো, তবে কাল ফোনে শুভ্রার গলাটা যেন কেমন অন্য রকম শোনাচ্ছিল, ভালো আছি প্রকাশ করবার আগেকার সেই জোশটা যেন সামহাউ মিসিং , জিজ্ঞাসা করাতে বললো সর্দি হয়েছে, কিন্তু কারোর ঠাণ্ডা লাগলে তার কথাগুলি এরকম এলোমেলো শোনাবে কেন, বারবারই সেই একই কথা , কুশলদা প্লিজ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার আমাদের বাড়িতে আসুন, আই নিড টু শেয়ার সাম থিং উইথ ইউ ।

হাতের ব্রিফকেসটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে রেখে ছেলেগুলোকে বললাম আসলে আমি সমুদ্র বলে একটি ছেলের বাড়ি খুঁজছি , এই আশেপাশেই কোথাও ভাড়া থাকে ।

সমুদ্র! মনের খাতায় নামটা খুঁজে না পেয়ে একজন বললো, কেমন দেখতে বলুন তো ? আমি কিছু বলে ওঠবার আগেই দোকানী বুড়োটা এবার আমাদের আলোচনায় অংশ নিলেন , প্যাকাটি মার্কা আর মাথায় অনেক লম্বা লম্বা চুল, তাই না ?

মাথার চুলটা মিলে যাচ্ছে , কিন্তু এক বছর আগে সমুদ্রকে যখন দেখেছিলাম তখন ও বেশ ছিপছিপে ছিল , এখন সেই ছিপছিপে ভাবটাকেই যদি ভদ্রলোক প্যাকাটি মার্কা বলে ভাবেন তাহলে হয়তো উনি ঠিক মানুষকেই আন্দাজ করেছেন, আমার ভাবনার মাঝেই লম্বা মত ছেলেটি এবার দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো , কে গো খগেনদা ?

খগেনদা জবাব দেওয়ার আগেই দ্বিতীয় ছেলেটা যে এতক্ষণ বেশ কায়দা করে সিগারেটে টান দিচ্ছিল সে হাতের সিগারেটের শেষ অংশটুকু চটি দিয়ে পিষে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো , গান-ফান করে , তাই তো? আমি সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়তেই ছেলেটি এবার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, আরে , ঐ যে নিবারণ পালের চিলেকোঠায় একটা মাল এসে উঠেছে না , এখান দিয়ে মাঝেমাঝে গীটার ফীটার নিয়ে যায়, তৃতীয় ছেলেটি এবার সমুদ্রকে চিনতে পেরে বলে উঠলো, বুঝেছি বুঝেছি আরে যার বৌটা খুব সে... আমার জন্যই হয়তো ছেলেটি তার কথা শেষ করতে পারলো না , নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, দাদা , এই গলি দিয়ে একটু এগিয়ে যান, দেখবেন ডান দিকে আরেকটা গলি পাবেন , সেই গলিটার একদম শেষের ডানদিকের যে তিনতলা বাড়িটা আছে তারই চিলেকোঠায় সমুদ্র বাবুরা থাকেন।





ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই খেয়াল করিনি যে কখন বাসটা বাগুইহাটি পার করে ডান দিকে টার্ন নিয়েছে , এবার বিরাটির মোড়ে এসে বাসটা বাঁদিকে টার্ন নিতেই হেল্পার ছেলেটা তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো , কলাবাগান, কলাবাগান, নামবার হলে এগিয়ে আসুন। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াই, এখানেই আমায় নামতে হবে , কলাবাগানে নেমে তারপর রিক্সায় করে ঝুমুরতলা, ব্যানার্জীবাবুর কথা মত দশ মিনিটের পথ। গত সপ্তাহে অফিসের কাজে রায়গড়ায় গিয়েছিলাম, অন্ধ্র আর উড়িষ্যার বর্ডারে এই জায়গাটায় একটা কাগজকল আছে, প্রতিবছরই এই কাগজকলটা থেকে আমরা ভালো অর্ডার পাই, এবারে যখন ভিজিটে এসেছিলাম তখন সৈকত ব্যানার্জী বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো , আমার থেকে বয়সে সামান্য ছোটই হবেন , মাস খানেক হলো মেন্টেনেন্স ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছেন , ফ্যামিলি এখনো আনেন-নি, বৌ-ছেলে কোলকাতার ঝুমুরতলাতে থাকে। ব্যানার্জীবাবুর সঙ্গে সেদিন কাজকর্মের কথা শেষ করে যখন ওনার চেম্বার থেকে বেরচ্ছি তখন ভদ্রলোক নিজের থেকেই বললেন, আরে আপনার ট্রেন তো সেই রাত বারোটায়, কাজ না থাকলে আমার কোয়ার্টারে আসুন না , দুজনা মিলে একটু আড্ডা মারা যাবে’খন। বুঝলাম, সদ্য কোলকাতা ছেড়ে এসে বাঙালি পেয়ে আড্ডা মারার লোভটা সামলাতে পারছেন না, আমারও ইনফ্যাক্ট হোটেলের রুমে এখন টিভি দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই , বললাম, ঠিক আছে, কোয়ার্টার নম্বরটা বলুন, হোটেল থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।

যাওয়ার সময় হোটেলের নিচের দোকান থেকে একটা হুইস্কির বোতলও নিয়ে নিলাম , ভদ্রলোক ভালোই টানেন , বোতল খোলা থেকে আধঘণ্টার মধ্যেই অনেকগুলো গ্লাস খালি করে ফেললেন , আমার আবার এভাবে গোগ্রাসে মদ খাওয়াটা একদম পছন্দ নয়, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে গ্লাসে চুমুক দিতে ভালো লাগে , ওনার যখন ফিফথ পেগ তখন হঠাৎ টেবিলের ওপর থেকে একটা খাতা নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলেন, বুঝলেন দাদা, কাল রাতে এটা নামিয়েছি।

বুঝতে পারলাম না যে কাল রাতে উনি কী বা কাকে নামিয়েছেন, শুধু নামানোই নয়, সেটাকে আবার খাতাবন্দী করে রেখেছেন, আত্মা-ফাত্মা হলে তাতে আমার অত ইন্টারেস্ট নেই, কিন্তু জ্যান্ত পরী হলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না, এখন যদি একটি সুন্দরী রমণী আমাদের গ্লাসগুলি ভরে দেয় বা ভাজাভুজির প্লেটগুলি হাতে-হাতে এগিয়ে দেয় তাহলে বেশ হয়! কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে একটি আস্ত পরীকে কি খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব! যাই হোক ভদ্রলোক আমার কৌতূহল নিরসনে বেশীক্ষণ সময় নিলেন না, দাদা বুঝলেন , আমার না আবার একটু কবিতা লেখার শখ আছে , কথাগুলি বলবার সময় ম্যানেজার বাবুর মুখে যেন ষোড়শীর লজ্জা, কবিতা পড়তে বা শুনতে আপনার ভালো লাগে তো?

ইতিবাচক মাথা নাড়ি, ক্লায়েন্টের সামনে পৃথিবীর সব ব্যাপারেই আমি এরকম ইতিবাচক মাথা নাড়ি বা আগ্রহ দেখাই , গাঙ্গুলী স্যারের থেকে শেখা, যখন এই অর্গানাইজেশনে জয়েন করেছিলাম তখন গাঙ্গুলী স্যারই ছিলেন কলকাতা অফিসের বস, স্যার সব সময় বলতেন, প্রাইস বা ডেলিভারিটা কিন্তু সব সময় অর্ডার ফাইন্যালাইজেশনের মেন ফ্যাক্টর হয় না, এমনকি প্রোডাক্ট কোয়ালিটিও অনেক সময় ম্যাটার করে না , সেলস লাইনে সবচেয়ে বড় যেটা ম্যাটার করে সেটা হচ্ছে কাস্টমারের সঙ্গে তোমার রিলেশন, এখন প্রশ্নটা হচ্ছে এই রিলেশনটা তুমি কিভাবে ডেভেলপ করবে, টু বিল্ড আপ এ রিলেশন ইউ নিড টু স্পেন্ড টাইম উইথ ইওর কাস্টমর, সোজা বাংলায় যাকে বলে গ্যাঁজানো আর এই কাজটাই তোমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে করে যেতে হবে। গাঙ্গুলি স্যার মানুষটা একটু অন্য ধরনের ছিলেন, কর্পোরেটের বসেরা সচরাচর যেমন নিজেদের জব অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ফোকাসড থাকেন উনি কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের মানে ওনার সহকর্মীদের গ্রুমিংয়ের দিকেও বেশ নজর দিতেন , ওনার মধ্যে একটা কর্মী গড়ার নেশা ছিল, অনেকটা সেই ফুটবল কোচ অচ্যুত ব্যানার্জীর মত, অচ্যুত ব্যানার্জীর যেমন ফুটবলার তৈরি করা প্যাশন ছিল স্যারও চাইতেন যে আমরা সবাই যেন এক একজন মার্কেট কাঁপানো সেলস ম্যান হয়ে উঠি। অফিস শেষে তখন আমরা প্রায়ই জড়ো হতাম স্যরের চেম্বারে আর গল্পের মাধ্যমে উনি আমাদের ভোকাল টনিক দিতে থাকতেন, দেখো কুশল, তুমি যদি ক্যাটালগ দেখিয়ে কাস্টমারদের কানের কাছে অনবরত গুণগুণ করতে থাকো যে আমাদের প্রোডাক্টটাই সেরা আর আপনার এটাই কেনা উচিৎ তাহলে দেখবে কোনোদিনই তুমি ওনাকে দিয়ে তোমার ইচ্ছে মত বা তোমার টার্মসে অর্ডার করাতে পারছ না...ইউ নিড টু মেক ফ্রেন্ডশিপ উইথ ইওর কাস্টমার, আর এই বন্ধুত্বটা তখনই গড়ে উঠবে যখন সামনে বসা মানুষটি তোমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করবে , নাও কোয়েশ্চেন ইজ হোয়েন এ পার্সন লাইকস টু স্পিক , আমাদের সবার মুখের দিকে একবার নজর বুলিয়ে স্যার নিজেই নিজের করা প্রশ্নের উত্তর দিতেন , সাধারণত দেখবে মানুষ যখন তার আলোচনায় নিজের পছন্দ মত বিষয় খুঁজে পান তখন কিন্তু তার আর কথা বলতে কোনো আপত্তি থাকে না, গোমড়া মুখের মানুষকেও তখন দেখবে কাজ-টাজ ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে। সো, ফার্স্ট ট্রাই টু ফাইন্ড আউট দ্যট প্লেস অফ ইন্টারেস্ট আর সেটা একবার জানা হয়ে গেলে প্রসঙ্গটা তুলে কাস্টমারের সামনে তুমি বাধ্য শ্রোতার মত বসে থাকো এন্ড টাইম টু টাইম সেই আলোচনায় ফুয়েলিং করে যাও যাতে উনি ঝিমিয়ে না পড়েন , কয়েকটা ভিজিটের পর দেখবে কাস্টমর হ্যজ বিকাম ইওর ফ্রেন্ড এন্ড একবার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেলে দেন ইউ ক্যান ডু ম্যাজিক উইথ দ্যট ম্যান।

ব্যানার্জীবাবুর সামনে আমি এখন তাই খুব আগ্রহী মুখ নিয়ে বসে আছি , ভদ্রলোক খাতার পাতা উলটে পড়তে শুরু করলেন

এখন শীতকাল

তবু কী উত্তাপ

চন্দ্রমল্লিকা, পাপড়ি মেলেছ তুমি

আমার চোখে তবু কিসের কুয়াশা আজ?

কবিতা আমি সেরকম বুঝি না তবে কোনো লাইন কখনও ভালো লাগলে তা মাথার মধ্যে কিছুদিন গুনগুণ করতে থাকে , আমার এক কবি বন্ধু আছে, সুনন্দ, অনেক লিটল ম্যাগাজিনে লেখে-টেখে, ব্যানার্জী বাবুর কবিতার লাইনগুলো মনে করে সুনন্দকে একবার বলতে হবে, দেখি ও মানেটা বুঝিয়ে দিতে পারে কি না । তবে তার আর দরকার পড়লো না, কবিতা পড়া শেষ করে সৈকত বাবু নিজেই দায়িত্ব নিলেন কবিতার মানে বোঝাতে, গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন , দাদা চন্দ্রমল্লিকা বলতে আমি এখানে নারীদের কথা বলতে চেয়েছি, দেখবেন জীবনে নারী থাকলে মনটা কেমন যেন একদম টগবগ করে ফুটতে থাকে, তাই তো লিখেছি শীতকালেও কী উত্তাপ ...

আর ঐ কুয়াশার ব্যাপারটা, স্যারের কথা মত আলোচনায় ফুয়েলিং করতে থাকি।

ওটা হচ্ছে গিয়ে ট্রাজেডি, সাহিত্যে দেখবেন শেষ অবধি ট্রাজেডিরই জয় হয় , এই কর্ণ বা দেবদাসকে দেখুন , আলটিমেটলি পাবলিকের পুরো সেন্টিমেন্টটা কিন্তু ওনারাই নিয়ে গিয়েছেন , আমার কী মনে হয় জানেন , ব্যানার্জী বাবুর চোখদুটো এখন বেশ ঢুলুঢুলু, ট্রাজেডির একটা অন্য রকম আকর্ষণ আছে আর আমরা মানে বাঙ্গালীরা ট্র্যাজিক হিরোদের প্রতি একটু বেশীই যেন সিমপ্যাথেটিক। লাস্ট লাইনটা তাই ওভাবে লিখেছি, আমার চোখে কিসের কুয়াশা আজ, কুয়াশার রূপকে এই যে আমি কবির হতাশাটাকে ফ্রেম করতে চেয়েছি , আপনার কি মনে হয়, পাঠকরা এটা পছন্দ করবেন না?

গাঙ্গুলী স্যারকে আরো একবার মনে মনে স্মরণ করি, ঠিক বলেছেন, শেষ লাইনটায় এসে কিন্তু সত্যিই একটা ইমোশনাল ব্রেক-ডাউন হয়ে যাচ্ছে যেন।

ভদ্রলোক ঠকাস করে হাতে ধরা গ্লাসটা খাটের বাঁজুতে রাখলেন , একটু হলেই গ্লাসটা পড়েই যেত , একজাক্টলি, আমিও তো এটাই চেয়েছি, বিদেশ-বিভুয়ে এরকম অনুগত শ্রোতা পেয়ে ভদ্রলোক এখন বেশ উত্তেজিত, আপনার সঙ্গে দেখছি আমার ফ্রিকোয়েন্সিটা একদম ম্যাচ হয়ে যাচ্ছে, যাকে বলে কি না ক্যারিং সেম ওয়েভ লেন্থ , খাটের বাঁজু থেকে নিজের গ্লাসটা তুলে উনি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন তাহলে পৃথিবীর সব ট্র্যাজিক হিরোদের সম্মানে আজ আমরা আমাদের এই পেগটা উৎসর্গ করি। সেদিন হোটেলে ফেরার পথে ভদ্রলোক একটা মোটা এনভেলাপ ধরিয়ে দিয়েছিলেন , গত দু’মাসে লেখা ওনার সব কবিতার পাণ্ডুলিপি, এই পাণ্ডুলিপিগুলি যেন আমি ওনার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেই, এক প্রকাশকের সঙ্গে ওনার কথা হয়ে গিয়েছে , কবিতাগুলি পেলেই ওনারা নাকি বই হিসেবে ছাপিয়ে দেবেন।

বেশী খুঁজতে হলো না, ঝুমুরতলার ঠিক মোড়েই সৈকত ব্যানার্জীর বাড়ি, পাণ্ডুলিপি ভর্তি লেফাফাটা ওনার স্ত্রী-র হাতে দিয়ে ফেরবার সময় রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, জোড়াদীঘিটা এখান থেকে ঠিক কত দূরে?

তখন আমাদের বিয়ের দু'বছর হয়েছে, আমি আর উর্মি একদিন এই জোড়াদীঘিতে একটা বাগানবাড়িতে এসেছিলাম, উর্মিদের স্কুলের বন্ধুদের রি-ইউনিয়ন ছিল, আমরা মানে হাজবেন্ডরাও সেই রি-ইউনিয়নে নিমন্ত্রিত ছিলাম, তবে জোড়াদীঘি জায়গাটাতেও এই ক’বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে, তাই সেদিনের সেই বাগানবাড়িটা ঠিক কোথায় তা আর ঠাহর করতে পারলাম না।

উর্মিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সেদিন আমারও রি-ইউনিয়ন হয়েছিল আমার এক স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে, ওর নাম চঞ্চল, আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তো, পড়াশুনায় তেমন ভালো ছিল না , একটু মস্তান টাইপের ছেলে ছিল, সবাই বলতো ওর দুই দাদাও নাকি নাম করা মস্তান, যে পাড়ায় ওরা থাকতো সেই পাড়ায় সবাই নাকি ওদের এই তিন ভাইকে বেশ সমঝে চলতো , যাই হোক আমাদের সেবার ক্লাস নাইন, ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষা সেদিন , মাইতি স্যার গার্ড দিচ্ছিলেন, ফাইভ আর সিক্সে স্যার সংস্কৃত পড়ান আর আসা যাওয়ার পথে যে ছাত্রের সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই অমনি বেদ বা উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চান যে এই মনুষ্য জীবনটা আসলে ঠিক কী, একঘেয়ে সেই জ্ঞান দেওয়ার জন্য ভদ্রলোক ছাত্র মহলে ভীষণ অপ্রিয় ছিলেন , তবে ওনার অপ্রিয় হওয়ার বা ওনাকে এড়িয়ে চলবার আরো একটি কারণ ছিল, স্যারের শরীর থেকে ভীষণ ঘামের দুর্গন্ধ ভেসে আসত, ওনার মনে হয় একটাই পাঞ্জাবী আর একটাই ধুতি ছিল , আর সেটা পরেই উনি রোজ স্কুলে আসতেন , ওনার শরীরের কাছাকাছি এলেই তাই সেই ঘামের আর নস্যির গন্ধ মিলে একটা বিদঘুটে গন্ধ বেরতো যাতে শরীরের ভিতরটা যেন একেবারে গুলিয়ে উঠতো।

একমনে পরীক্ষার খাতায় লিখে চলছিলাম, হঠাৎ স্যারের চিৎকার , এই, এই, তুমি কী করতাছ?

মাথা ঘুড়িয়ে কে কী করছে তা দেখার আগেই দেখি স্যার ধুতি সামলে দ্রুতবেগে গিয়ে পৌঁছেছেন চঞ্চলের ডেস্কের সামনে, চঞ্চলের খাতাটা চোখের নিমিষে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য হাতে চঞ্চলের চুলের মুঠি ধরে চীৎকার করে চলেছেন , এত সাহস তোমার, পরীক্ষায় খাতায় টুকলি করতাছ ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ , তুমি জানো না টুকলি কইরা জীবনে কেউ কখনো সত্যিকারের পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না, স্যার সেদিন চঞ্চলের কোনো কথাই শোনেননি , ওর কাছ থেকে পাওয়া চোথাগুলি বাজেয়াপ্ত করে চঞ্চলকে উনি ক্লাস থেকে বের করে দেন। তবে আসল ঘটনাটা ঘটে সেদিন বিকেলে আর আমরা সেটা জানতে পারি পরেরদিন স্কুলে এসে, আগের দিন বিকেলে স্যার যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন কুঁদঘাট বাসস্টান্ডে চঞ্চলের দুই দাদা ওনার ওপর চড়াও হয়ে এমন মার মারে যে স্যারকে হাসপাতালে সাতদিন শুয়ে থাকতে হয় , এই ঘটনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ চঞ্চলকে রাস্টিকেট করে দেয়, আমার এমনিতেই ওর সঙ্গে খুব একটা ভাব ছিল না, ইনফ্যাক্ট ঐ ঘটনার পর কিছুদিনের মধ্যেই আমি ওর কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম , বেশ কয়েক বছর আগে একদিন চঞ্চলদের পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে এভাবেই রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেদিন সেই ছেলেটার মুখ থেকেই শুনেছিলাম যে চঞ্চল নাকি রাস্টিকেট হওয়ার পর ওপেন স্কুল থেকে সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাস করেছে।

আমাদের ট্যাক্সিটা সেদিন করুণাময়ীর মোড়ে এসে দাঁড়াতে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলেছিলাম, ভাই আমাদের এখানেই নামিয়ে দাও, আমার আসলে ওষুধের দোকানে যাওয়ার ছিল, প্রেগন্যান্সি কনফার্ম হওয়ার পর ডাক্তারবাবু তখন উর্মিকে কতগুলো ওষুধ নিয়ম করে খেতে বলেছিলেন, ট্যাক্সিওয়ালা ব্রিজের বাঁদিক ঘেঁসে বিশাল লম্বা যে প্রাইভেট গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল তার ঠিক পিছনে আমাদের ট্যাক্সিটা এনে দাঁড় করালে মিটার দেখে ভাড়া মিটিয়ে উর্মিকে বললাম তুমি আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ির দিকে যাও, আমি ওষুধগুলো নিয়ে আসছি। উর্মি বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালে রাস্তাটা পার করে আমি আরোগ্য বলে যে ওষুধের দোকানটা আছে সেদিকে সবে পা বাড়িয়েছি হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি সাফারি সুট পরা আমারই বয়সী এক ভদ্রলোক হাতে চাবির রিং নিয়ে প্রাইভেট গাড়িটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে , মাঝের এই ক’বছরে চঞ্চলের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে , সেদিনের সেই লিকলিকে চেহারাটা বদলে এখন ওর সারা শরীর জুড়ে যেন একটা বেশ ভারিক্কী ভাব , সঙ্গে মানানসই একটা ভুরি, মাথার সামনের দিকের চুলও বেশ পাতলা হয়ে এসেছে, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, প্রথমে চঞ্চলকে চিনতে একটু অসুবিধাই হচ্ছিল , আসলে অনেকদিন পরে দেখা তো আর তার ওপর চেহারায় এরকম আমূল পরিবর্তন, কথায় কথায় চঞ্চল জানিয়েছিল যে সাদার্ন এভিনিউর দিকে ফ্লাট কিনেছে, কী একটা কাজে যেন সেদিন আমাদের এদিকে এসেছিল , আমি জানতে চাইলে বললো যে ও এখান ইমপোর্ট- এক্সপোর্টের ব্যবসা করছে, ডালহৌসির দিকে অফিসও নিয়েছে, চঞ্চলের সব কথাতেই তার সাফল্য যেন ঝিকমিক করে প্রকাশ পাচ্ছিল সেদিন, কথায় কথায় জানিয়েছিল যে গত দু’বছরে ব্যবসার কাজে তাকে প্রায় বার পাঁচেক ফরেনেও যেতে হয়েছে, ওসব শুনে আমি মনে মনে বলছিলাম , বস, এসব না বললেও চলবে , তোর চেহারা বা আদব কায়দাই জানান দিচ্ছে যে সেদিনের টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়া ছেলেটি জীবনের দৌড়ে আজ আমাদের সবাইকে অনেক পিছে ফেলে দিয়েছে, হাতে ধরে থাকা সিগারেটটায় একটা টান দিয়ে চঞ্চল বলে উঠেছিল , আজকাল কাজের চাপ এত বেড়ে গিয়েছে না যে কারোর সঙ্গে আর দেখা সাক্ষাতই হয়ে ওঠে না, আমিও ওর কথায় সায় দিয়ে বলেছিলাম, ঠিকই বলেছিস রে, আসলে বেঁচে থাকাটাই যেন দিন-দিন একটা যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে , স্কুলের কথা উঠলে চঞ্চল নিজের থেকেই বললো , আরে তোর মাইতি স্যারকে মনে আছে, হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়লাম, চঞ্চলের মুখে মাইতি স্যারের কথাটা শুনে একটু অবাকও হয়ে গিয়েছিলাম, চঞ্চল ততক্ষণে বলতে শুরু করেছিল , আরে সেদিন কী হয়েছে জানিস, দুপুরের দিকে হাজরা মোড়ের ওখান থেকে যাচ্ছি , দেখি স্যার বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছেন, স্যারের চেহারাটা এখনো একই রকম আছে, একটু থেমেছিল চঞ্চল, দেখ কুশল, তোর কাছে লুকবো না, মাইতি স্যারকে দেখে আমার নিজের যেন কেমন অপরাধী অপরাধী লাগছিল , তাই ভাবলাম স্যারকে প্রণাম করে বলি পারলে যেন আমায় ক্ষমা করে দেন।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শুধু শারীরিক ভাবেই প্রবীণ হয়ে ওঠে না, তার ভাবনা চিন্তাও যেন সমান ভাবে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে , খুব ভালো লেগেছিল সেদিন চঞ্চলের মুখে মাইতি স্যারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথাটা শুনে , জিজ্ঞাসা করেছিলাম , তা স্যার চিনতে পারলেন তোকে?

না রে, গাড়ি পার্ক করে স্যারের সামনে এসে বললাম, স্যার, চিনতে পারছেন , আমি চঞ্চল।

সেদিন নাকি অনেক চেষ্টা করেও মাইতি স্যার চঞ্চলকে চিনতে পারেননি, মলিন ধুতি আর ততোধিক মলিন পাঞ্জাবী পরা স্যার ওনার শিরা বের করা হাত দুটো নিয়ে চশমাটার ডাটিগুলোকে একটু উপরে তুলে অনেকক্ষণ নাকি ওর মুখের দিকে চেয়েছিলেন আর তারপর চিনতে না পেরে এক সময় কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে উঠেছিলেন, মনে রাখা বড় শক্ত কাজ বাবা, একদিন পারলেও আজ আর আমি কিছু মনে রাখতে পারি না, তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও , এরপর পাঞ্জাবীর ঝুল পকেট থেকে নস্যির ডিব্বা বের করে নাকে এক টিপ নস্যি দিয়ে উনি ধীর পায়ে বাসস্টপের দিকে আসতে থাকা বাসটার দিকে এগোতে এগোতে বিড়বিড় করে বলে উঠেছিলেন , মানুষ যখন মনে রাখতে না পারে তখন জানবে সে আসলে মৃত, তাই আমিও এখন এক মৃত সত্বায় পরিণত হয়েছি, তবে তোমায় দেখে কিন্তু বাবা হিংসে হচ্ছে ...

তুমি মনে রাখতে পারছো, তাই তোমার কিন্তু এখন অনেক দায়িত্ব …

ক্রমশ