মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -৭

জানলার পাশে তুমি সম্পর্ক রহিত বসে আছ

চারপাশে শহরের উদ্দেশ্যপ্রবন শব্দ, ভিড়

তুমি সব সম্পর্কের অতিরিক্ত আহ্বানের দিকে

তাকিয়ে রয়েছ । আমি, মনে হয়, কোনো একদিন

সেই মুগ্ধ পার্বণের পিঁড়িতে বসব, যেখানে তোমার

সমস্ত শুশ্রূষা নিয়ে বিকেলের পাখী উড়ে যায়”

আচ্ছা উর্মি, তুমি কি ঐ কবিতার নায়িকার মত

“… প্রথম থেকে(ই) টের পেয়েছিলে , মানুষের

সমস্ত সম্পর্ক শুধু ব্যাহত অনন্ত নিয়ে বাঁচে?

আশ্রয়ের দিকে আমরা হাত বাড়িয়ে থাকি, কোনোদিন

মনে হয় পাহাড়ের শেষ বাঁক পেরিয়ে নিঃশ্চুপ

সমতলে এসেছি, মুহূর্ত পরে টের পাই আরো ঘন শীর্ষের সংকেত

এখনও জাগ্রত, আমরা পথের দাক্ষিণ্যে (শুধু) বেঁচে থাকি । “

আমরা এখন বেলুর মঠে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, উর্মির চোখদুটো দূরের আকাশে নিবদ্ধ, সেখানে যেন শেষ বিকেলের আলোয় একটা ক্যানভাস পাতা রয়েছে আর উর্মি সেই ক্যানভাসে মনের খাতায় একের পর এক ছবি এঁকে চলেছে , ওকে দেখে মনে মনে ভাবছি এখন যদি আকাশের থেকে কিছুটা সিঁদুর গোলা রঙ নিয়ে ওর সীমন্তে পরিয়ে দেই তাহলে কি ও না করবে? সকাল সকাল আজ আমরা দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এসেছিলাম , পুজো শেষ হলে ঠাকুরমশাই আমাদের দুজনার হাত নিজের হাতে নিয়ে কী সব মন্ত্রতন্ত্র বিড়বিড় করে আওড়ে গেলেন আর ওনার মন্ত্র পড়া শেষ হলে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন , সুখী হও, ভগবান যেন তোমাদের সারা জীবন সুখে রাখেন। ঠাকুর মশাইয়ের কথা শুনে উর্মির চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল, আরে বাবা, ঠাকুরমশাইয়ের আর কী দোষ , উনি তো আমাদের জোড়ায় দেখে ভেবেছেন যে আমরা উড বি স্বামী-স্ত্রী, তাই মিডিয়েটর হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন যাতে আমরা সুখী হই। উর্মির হাতটা নিজের হাত থেকে সরাই না , হাতে হাত রেখেই মন্দিরের সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকি, ‘একদিন এসো না আমাদের বাড়িতে, মায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব’ , কথা খুঁজতে গিয়ে এই কথাটাই মাথায় এলো।

আপনার মা যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি কে, তাহলে কী উত্তর দেবেন?

আমার মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, তবে এরকম আপনি-আজ্ঞে করে কথা বললে হয়তো জিজ্ঞাসা করেও ফেলতে পারেন।

আপনি কিন্তু আজও বলেননি যে আপনি কোন ব্রান্ডের আফটার শেভ ইউজ করেন ?

উর্মির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকি, এই রূপক প্রশ্নের মানে বা উত্তর দুটোই এখন আমার জানা , উর্মির হাতে আরো একটু চাপ দিয়ে বলে উঠি ,

“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ,

আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন

পাপ করতে পারি ?’’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো তার নীরাকে উদ্দেশ্য করে এই লাইনগুলো লিখেছিলেন, তা আপনার নীরাটি কে, সেটা কি জানতে পারি , উর্মির চোখমুখ জুড়ে দুষ্টু হাসি ।



ভালো নাম কী গো তোমার?

উর্মিমালা মালাকার।

বাঃ, তোমার নামটাও তোমার মুখের মতই যেন মিষ্টি! মা আর উর্মি সোফায় বসে গল্প করছে , আমি মায়ের বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে রয়েছি আর মাঝে মাঝে ওদের কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটছি , ঘরের দেওয়ালের পাশে রাখা হারমোনিয়াম, তানপুরার দিকে তাকিয়ে উর্মি এক সময় বলে উঠলো আপনি এই ঘরে বসেই রোজ রেওয়াজ করেন, তাই না মাসীমা, মা ইতিবাচক ঘাড় নাড়লে উর্মি আবার বলতে থাকে , জানেন, আমি না আগে একদম ক্লাসিক্যাল গান শুনতাম না কিন্তু রিসেন্টলি আপনার অনেকগুলি ক্যাসেট কিনে শুনেছি , সত্যি আপনি বড্ড ভালো গান করেন ।

আরে বাবা না না, আমি হচ্ছি গিয়ে ঐ যাকে বলে কী না সখের গায়িকা...

না, না, আপনি মোটেও সখের গায়িকা নন, আমি জানি, আপনার গান শুনে একবার এক বাস লোক একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল।

ঐ পাগলটা বুঝি তোমায় এসব বলেছে , ওর কথা কিন্তু একদম বিশ্বাস করবে না ।



তোমার মা কিন্তু ভীষণ অমায়িক, একদম যেন মাটির মানুষ, ওনার সঙ্গে কথা বললে বোঝাই যায় না যে উনি একজন এত বড় গায়িকা , উর্মিকে নিয়ে আমি এখন বাসস্টপের দিকে হাঁটছি ।

হ্যাঁ মা বলে, মানুষের সব চেয়ে বড় ভূষণ হচ্ছে তার বিনয় আর অহংকারী মানুষদের নাকি ঈশ্বর একদম পছন্দ করেন না।



আচ্ছা, খবরটা কি তাহলে সত্যি? ভদ্রলোক সেই এক চেক-চেক লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরা।

কোন খবরটা?

ঐ যে শুনলাম দুপুরের দিকে নাকি বালিগঞ্জ সার্কুলার আর সার্কাস এভিনিউর মোড়ের বাড়িটায় আগুন লেগেছে।

হ্যাঁ আজ এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে বটে কিন্তু সেই ঘটনার সঙ্গে এই ভদ্রলোকের যে ঠিক কী যোগ সেটা বুঝতে পারছি না। আমার ভাবনার মাঝেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আচ্ছা কুশলবাবু, আপনার কি ওদিকে যাতায়াত আছে ?

কেন বলুন তো?

না , মানে তাহলে জিজ্ঞাসা করতাম সার্কাস এভিনিউ থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে যাওয়ার মোড়ে ভূপতির যে চায়ের দোকানটা ছিল সেটা আজও আছে কি না।

মনে মনে জায়গাটা একবার খুঁজে দেখি , না, উনি যে জায়গাটার কথা বলছেন সেখানে কোনো চায়ের দোকান দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক নিজেই বলতে থাকলেন , জানেন ৩/১ সার্কাস এভিনিউতে যে সিনহা এন্ড সিনহা বলে পাবলিশার্সটা আছে সেখানে আমি এক সময় কাজ করতাম আর ঐ ভূপতির চায়ের দোকানটা ছিল আমাদের আড্ডার জায়গা, বড় ভালো চা বানাতো ভূপতি , দুধটা জ্বাল দিয়ে ঘন করতে করতে তাতে এক সময় চায়ের পাতার সঙ্গে আদার কুচি, ছোট এলাচ এসব ফেলে দিতো, একদিন কী হয়েছিল জানেন ...

গল্পটাকে আর এগোতে দেই না , তাড়া আছে বলে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে থাকি , আমাদের পাড়ার মোড়ে রঞ্জিতের চায়ের দোকান আছে, মাঝে মাঝে আমি ওখানে চা খেতে যাই , রঞ্জিত আমাকে বেশ খাতিরও করে, এক গ্লাস চায়ের দামে দেড় গ্লাস করে চা খাওয়ায়, তার সঙ্গে নানা সুখ দুঃখের কথাও বলে, এই তো সেদিন বললো ওর বৌয়ের পেটে নাকি পাথর হয়েছে, অপারেশন করাতে হবে, সম্ভব হলে আমি যেন ওকে হাজার তিনেক টাকা ধার দেই, উর্মি অবশ্য চায় না যে আমি এইসব মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি , বারণ করে আমায়, আজকাল ঝগড়া করার সময় এগুলিকেই পাঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে , আমার চরিত্রের এই সব ‘সো কলড’ ফাঁক ফোকরগুলো টেনে টেনে বার করে আমায় বলে আমার নাকি যতসব হাভাতে-খেউরে লোকদের সঙ্গে ওঠবস , আমি নাকি কোনদিন তাই ক্লাস কথাটার মর্মটাই বুঝে উঠতে পারব না , উর্মি যখন আজকাল এসব বলে আমি আর প্রতিবাদ করি না , চুপ করে শুনে যাই, কী দরকার কথা বাড়িয়ে , আসলে উর্মি কোনোদিনই বুঝবে না অ্যাক্রস দ্য সোসাইটির মানুষদের সঙ্গে মেলা-মেশার মজাটা ঠিক কী বা কতখানি , ওকে এসব বুঝিয়েও লাভ নেই, এই বয়সে ওর পক্ষে আর নিজের স্বভাব বদলানো সম্ভব নয় , তার চেয়ে থাকুক না ও ওর চেনাজানা সাজানো গোছানো গণ্ডির মাঝে, সেখানে মিশতে মিশতে একদিন হয়তো ও ক্লিশ হয়ে যাবে আর সেদিন ... না, না, তা আর কোনদিন হবে বলে মনে হয় না , আমার আর উর্মির যুগল স্রোতটা অনেকদিন আগেই ধাক্কা লেগে একদম একশো আশি ডিগ্রীতে বেঁকে গিয়েছে , তারা আর কোনদিনই মিলিত হবে না।




মা বাথরুমে গিয়েছে, ছবি রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে আমার জন্য , টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চৌকো বাক্সটা দেখে কৌতূহল হলো, খুলে দেখি বি পি মাপবার মেশিন , ছবি ঘরে ঢুকে আমায় বাক্সটা নাড়াচাড়া করতে দেখে জানালো যে অলোককাকু কাল দিয়ে গিয়েছেন আর তার সঙ্গে ওকে শিখিয়েও গিয়েছেন যে কীভাবে এটা চালাতে হয় ।

হ্যাঁ রে, কাকুর হাঁটুর ব্যথাটা কেমন আছে রে?



আজকের সকালটা যেন খুব ঝলমলে, আকাশে মেঘের ছায়া মাত্র নেই , কিছুদিন আগেও দিনভর যে মেঘগুলি আকাশের বুকে ভেসে বেড়াত তারা যেন আজ সবাই ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়েছে, সকাল থেকে বাবা-মা আজ একদম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, সপ্তাহ খানেক বাদে যাকে বলে কী না একদম সরাসরি, ঠাকুমা বা আমায় আজ আর ভায়া বা মিডিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হতে হচ্ছে না , এই তো বাজার থেকে ফিরে মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললো , কাজল , ভালো করে এক কাপ চা বানাও দেখিনি , ঠাকুমা মুচকি হেসে কানে কানে বললো, বুঝলি ভাব হয়ে গিয়েছে মিঞা বিবির , আমি অবশ্য ভেবে পেলাম না যে দুম করে ভাবটা হলো কী করে, কাল রাতেও তো ঘুমোতে যাওয়ার আগে দুজনার মুখেই সাত দিনের থমথমে কালো মেঘ ছিল, কাল রাতেও তো মা মেঝেতে বিছানা পেতে আলাদা শুয়েছিল।

স্নান সেরে মা রান্নাঘরে ঢুকেছে , গ্যাস ওভেনের তাপে মায়ের নাকের ডগায় এখন বিন্দু বিন্দু ঘাম , কড়াইতে মাংস চাপানো, মাকে গিয়ে বললাম, ও মা দেখো না মাংস সিদ্ধ হয়েছে কি না, আমায় তাহলে এক পিস দাও, বাবা বারান্দায় বসে পেপার পড়ছে , ঠাকুমা রান্নাঘরে সবজী কাটায় ব্যস্ত। বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পেলাম, যা ভেবেছি ঠিক তাই , ঈশ আজকেই অলোককাকুকে আসতে হলো! আকাশের দিকে চট করে একবার তাকালাম, না, সেখানে ছুটি শেষ করে মেঘদের হঠাৎ করে ফিরে আসবার কোনো লক্ষণ নেই, তবু ঠাকুমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ও ঠাকুমা, কাকুকে বলো না চলে যেতে, বাবা অবশ্য ততক্ষণে গ্রিলের দরজা খুলে কাকুকে ভিতরে আসতে বলেছে , বারান্দায় চটি ছাড়ার আওয়াজ, পর্দা সরিয়ে কাকু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন , ও বৌদি শিগগিরি এদিকে এসো, কাকুর হাতে বিশাল একটা মিষ্টির হাড়ি।

ভাবতে পারছ দাদা, বৌদি এবার কোথায় পৌঁছে যাবে, বসবার ঘরের সোফায় কাকু আর বাবা এখন পাশাপাশি বসা , ঠাকুমা মেঝেতে বসে ওদের কথা শুনছে। কোম্পানিটার নাম যেন কী বললে , অলোককাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা বলে উঠলো, কাকুকে আসতে দেখে কিছুক্ষণ আগে আমার মনে যে দুশ্চিন্তাটা পাঁক খাচ্ছিল সেটা যেন বাবার হাসি হাসি মুখ দেখে উধাও এখন, ভালো করে তবু একবার বাবার মুখের দিকে তাকালাম , না , আজকাল কাকুকে দেখলে বাবার মুখে যে বিরক্তির ছায়াটা ফুটে ওঠে এখন সেখানে তার কোনো লক্ষণ নেই।

দাদা কোম্পানিটার নাম হচ্ছে গিয়ে সঙ্গীত এন্ড সুর লিমিটেড, ইসমাইল বালওয়া বলেছেন ক্যাসেটের দুদিক মিলিয়ে মোট দশটা গান থাকবে, বৌদি আর জুবেনের তিনটে করে সোলো আর বাকী চারটে ডুয়েট।

আজ দুপুরে কাকু আমাদের বাড়িতেই খেলেন, মিনি সেলিব্রেশন ফর কাজল কর’স কামিং অ্যালবাম। শুধু তাই নয়, বিকেলে আজ অনেক দিন বাদে আবার আমাদের হলঘরে চাঁদর পাতা হলো, ফোন করে জুবেন আঙ্কলকেও ডেকে আনা হলো। মা আর জুবেনকাকু আজ আমাদের ওদের দ্বৈত সঙ্গীত গেয়ে শোনাবে ।

দুনিয়া বদল গায়ি, মেরে দুনিয়া বদল গায়ি

টুকরে হুয়ে জিগরকে, ছুরি দিল পে চল গায়ি

দুনিয়া বদল গায়ি , মেরে দুনিয়া বদল গায়ি

এইসি চলি হাওয়া , খুশী দুঃখ মে ধল গায়ি

দিল খাক হো গয়া, ইয়ে কিসি কো খবর নাহি

সব ইয়ে সমজ রাহি হ্যায়, তামান্না নিকাল গায়ি

বরবাদ হো গ্যায়া মেরি উমিদ কা চমন

যিস দিল পর কিয়া থা বসেরা ও জ্বল গ্যায়ি

হারমোনিয়াম , তবলা সব এক সময় স্তব্ধ হলো , আমাদের নিচের তলায় যে সুদীপজেঠু আর জেঠিমা ভাড়া এসেছেন ওনারা এখন বাবা আর অলোককাকুর সঙ্গে মায়ের গান নিয়ে কথা বলছেন , তবলা দুটো জায়গা মত রেখে এলাম, ঠাকুমা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে , এক-একদিন মায়ের গান শুনে ঠাকুমার এরকম হয়, জিজ্ঞাসা করলে বলে, দেখিস না, মেয়েটা গান গাইবার সময় বুকটাকে কেমন নিংড়ে দেয় , ওর গান শুনে কি চোখের জল আটকে রাখা যায় ?

ওদিকে সুদীপজেঠুকে উদ্দেশ্য করে অলোককাকু তখন বলে চলেছেন, বুঝলেন দাদা, আমি কিন্তু প্রথম দিনই বৌদির গান শুনে বুঝেছিলাম যে এই গলা যে সে গলা নয়, একটু ঘষামাজা করলে এ গলায় জাদু ফলবে আর তাই পরের দিনই গুরুজির কাছে গিয়ে বলেছিলাম, নিজের কানে একবার শুনুন, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন শেখাবেন কি না।

জেঠু মাথা নাড়েন , যা বলেছ ভাই, কাজল মায়ের গলা সত্যিই খুব সুন্দর , ওর গান শুনলে মনের ভিতর কেমন যেন একটা শান্তি আসে , তবে তোমারও ভাই অনেক অবদান আছে , ঠাকুমার দিকে আঙুল তুলে জেঠু বলতে থাকেন , মাসীমা তো সব সময়ই বলেন, বৌমার নিষ্ঠা তো ছিলই তবে অলোক না থাকলে বৌমা এত দূর পৌঁছত কি না সন্দেহ।

বাবা সবাইকে জিজ্ঞাসা করলো চা খাবে কি না, জুবেনকাকু মানা করলেন , অলোককাকু আর সুদীপজেঠু অবশ্য মাথা নেড়ে জানান দিলেন যে এখন একবার চা পর্ব হলে মন্দ হয় না, ও মা, একটু চা বানাও না , ঠাকুমা এখনও সেই একই ভাবে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে, ঠাকুমাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে মা বলে উঠলো, মা বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছেন, তোমরা কথা বলো, আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি । রান্নাঘর থেকে মা আর আমি ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে এলাম, এক এক করে সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো মা, অলোককাকুর র চা, বাবা আর সুদীপজেঠুর বেশী দুধ দেওয়া ঘন চা, জেঠুর চায়ে আবার আধ চামচ চিনি, বাবা-জেঠু-কাকু সবার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে মা এবার ঠাকুমার চায়ের কাপটা নিয়ে গিয়ে রাখলো ঠাকুমার সামনে ।

ও মা, চা খেয়ে নিন।

ঠাকুমার চোখ এখনও বন্ধ।

নিজের কাপটা হাতে নিয়ে মা এসে বসলো ঠাকুমার পাশে , কী হলো মা, চা খাবেন না , চা তো জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। ঠাকুমা যেন মায়ের কথা শুনতে পাচ্ছে না, চোখ বন্ধ করে যেমন বসেছিল তেমনিই বসে আছে, মা এবার আস্তে করে ঠাকুমার গায়ে একটা ঠেলা দিলো আর সেই ঠেলায় ঠাকুমার শরীরটা সামনে রাখা চায়ের কাপগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়লো ।



ফুলে ফুলে ঢাকা ঠাকুমার শরীরটা যখন খাটে তোলা হচ্ছে মা হঠাৎ গেয়ে উঠলো

ভজ রে মন রাম গোবিন্দ হরি

ভজ রে মন রাম গোবিন্দ হরি

জপ তপ সাধন কছু নাহি লগত

জপ তপ সাধন কছু নাহি লগত

সন্তাত সনপাট সুখ কে কারন

সন্তাত সনপাট সুখ কে কারন

কহাত কবির – কহাত কবির – শুনো ভায়ি সাধো

কহাত কবির – কহাত কবির – রাম যা মুখ নাহি

কহাত কবির – রাম যা মুখ নাহি – ও মুখ ধুলপরি

ভজ রে মন রাম গোবিন্দ হরি

ভজ রে মন রাম গোবিন্দ হরি

ভজ রে মন রাম গোবিন্দ হরি

কবীরের এই দোঁহাটা ঠাকুমার বড় প্রিয় ছিল , প্রায়ই বলতো, বৌমা, একবার গেয়ে শোনাবে ঐ গানটা।

“নদীর মধ্যে নেমে গিয়ে আমি পিঠ দিয়ে

ঠেলে তুললাম চর, সেই হলো তোমার জমি,

আমার দুইবাহুকে আমি আটকে দিলাম খুঁটির মতো দুদিকে

তার উপর ছাউনি করে টাঙিয়ে দিলাম একটুখানি আকাশ

আর আকাশ দিয়ে তৈরি সেই চালা আমি ঢেকে দিলাম

আমার লেখা না-লেখা কবিতার লতাপাতা দিয়ে, যাতে

ঘুমোবার সময় অন্তত হিম না লাগে তোমার গায়ে.........”


আজ আমাদের অফিসের বার্ষিক অনুষ্ঠান আর সেই অনুষ্ঠানে ফাইনান্স বিভাগের জয়ন্ত এখন বেশ গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করছে, লাইনগুলো কিন্তু বেশ সুন্দর, “ঘুমোবার সময় অন্তত হিম না লাগে তোমার গায়ে ......” না, শব্দের এত মসৃণতা কখনও আমার বলার মধ্যে ছিল না কিন্তু অ্যাট ডিফারেন্ট ফেজ অফ লাইফ এই কথাগুলোই তো আমি উর্মিকে বলতে চেয়েছি, কিন্তু উর্মি কখনো তা বোঝার চেষ্টা করেনি, শী ডিডন্ট ট্রাই টু আণ্ডারসটান্ড মি, আমার দীর্ঘশ্বাসটা কখন যেন নিঃশব্দে ভেসে গেলো কবিতার পরবর্তী লাইনগুলোর মাঝে

“যে- কোনো তাণ্ডবের শেষে আমি রেখেছি গ্রাম আর গ্রামের মধ্যে

অজস্র কুটির

যে-কোনো, যে-কোনো পথের মধ্যে জলসত্র আর সরাইখানা রেখেছি আমি

যে-কোনো পথের শেষে রেখেছি গন্তব্য আর আশ্রয়

আমি বলি, আকাশের সবচেয়ে উঁচু তারাকে এরপর আমি বলি

আর আমারই কি একখানা ঘর থাকবে না?

সারাদিন পর তবে কোথায় ফিরবো আমি?”

আবৃত্তির শুরুতে জয়ন্ত কবি আর কবিতার নাম বলেছিল, তখন ঠিক মত শোনা হয়নি, তবে যেই লিখে থাকুন না কেন একদম বেড়ে লিখেছেন, ঠিক যেন আমার মনের কথা, মিস্টার কবি, আপনি যেই হোন না কেন আমার একটা স্যালুট নিন, ইউ হ্যভ আস্কড দ্য রাইট কোয়েশ্চেন, ‘সারাদিন পর তবে কোথায় ফিরব আমি?’ জানেন, বেশীরভাগ দিনই অফিস থেকে ফেরার সময় আজকাল আমার মনের মধ্যে এই প্রশ্নটাই ঘুরতে থাকে আর উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে বাড়ির ঠিকানাটা খুঁজে পেতে মন চায় সেই বাড়ির ঠিকানাটা না পেয়ে তখন আমারও যেন ভয় হয় যে আমিও কি তবে চিরদিন আশ্রয়হীন হয়েই থেকে যাব , বাট, ইউ নো, ধুর ছাই, তখন আপনার নামটা ঠিক মত শোনা হয়নি, দাঁড়ান, জয়ন্ত গ্রিনরুম থেকে বের হলে আপনার প্রথম নামটা ওকে জিজ্ঞাসা করে নেব'খন, আর ততক্ষণ না হয় আপনাকে আপনার সারনেম ধরেই ডাকি , হ্যাঁ কী যেন বলছিলাম মিস্টার গোস্বামী, মনে পড়েছে, ঐ যে লিখেছেন, ‘যে-কোনো পথের শেষে রেখেছি গন্তব্য আর আশ্রয়’, আমার কী মনে হয় জানেন , ইট’স পারশিয়ালি কারেক্ট, আপনার জীবনে আপনি হয়তো গন্তব্য আর আশ্রয় দুটোই পেয়েছেন, বাট বিলিভ মি, এই পৃথিবীতে আমার মত অনেকেই আছেন যারা এদের মধ্যে একটাকে খুঁজতে গিয়ে আরেকটা হারিয়ে ফেলেন, আপনাদের মত আমি লিখতে পারি না কিন্তু জানেন মাঝে মাঝে আমার মাথার মধ্যেও অনেক কিছু ঘুরপাক খায় , আজ সেরকমই একটা কথা আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই, অজানা এই পথের শেষে জানেন আমদের সবার জন্যই কোথাও না কোথাও কিন্তু একটা আশ্রয় ঠিকই থাকে এন্ড ডু ইউ নো, ঐ আশ্রয়টা ঠিক কী বা কোথায়, ঐ আশ্রয়টা আসলে হচ্ছে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের নিজেদের নিজেদের স্বত্বা, আর তাই ঠিকানা হারিয়ে ফেললেও দেখবেন এট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে সবাই কিন্তু আমরা ফিরে আসি আমাদের নিজেদের পরছাঁইয়াতে। আমার এক বন্ধু সেদিন তার প্রিয় এক কবির কটা লাইন বলছিল “ … স্টেশনের একবগ্গা রেলঘরটির উঁচু জানলা থেকে চেয়ে আছেন তিনি, ষ্টেশনে ট্রেন দেখে ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে আবার তার নিঃস্পৃহ , বয়স্ক মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছেন নগরাভিমুখী ট্রেনটির চঞ্চল জানলা-দরজার দিকে। সারাদিনে হয়তো গোটা পাঁচেক ট্রেন আসে এই নিরপরাধ ষ্টেশনে , পাঁচবারই তিনি কর্তব্য সামলে তাকিয়ে দেখেন জীবনের দশ রকম সাজপোশাক , শিশুর দুরন্ত হাত ধরে সামলাচ্ছেন মা , মোবাইলে সশব্দে কথা বলছেন এক সফেন বাঙালি , জানলার পাশে বসে দাঁতে ঠোঁট কাটছেন অন্যমনস্ক তরুণী । স্টেশনের পাশেই তার দু কামরার কোয়ার্টার , কাজ সেরে তিনি বাড়ি ফেরেন , উঠোনে টাঙানো ছেলের সরল হাফপ্যান্ট , রান্নাঘরের শিশিতে করমচার আচার ভরছেন তার রোগা গৃহিণী ।

আর তারপর

“ আমি এই রূপকথা নিজের মধ্যেও আলোকিত

রাখতে গিয়ে পুড়ে গেছি, ভেঙ্গে গেছি তুচ্ছ পরাজয়ে

তুমি কত অনায়াস অথচ নির্মম

বিন্যাসে সচ্ছল থাক ভেবে, আমি, অনুত্তীর্ণ অপরাধ বোধে

তোমার পাড়ের কাছে বারবার ভাঙতে চেয়েছি “

শুভ্রা আমার মুখে আজকাল এসব কথা শুনে বলে আমি নাকি দিনদিন খুব বদলে যাচ্ছি, আমার অগোছালো মনটার সঙ্গে নাকি পরিমিত হারে ব্লেন্ডিং হচ্ছে দার্শনিক চিন্তাধারার ।

উঃ! এই মেয়েটা কত সহজেই না কত কিছু ভুল ভাবতে পারে!


শুভ্রার কথা মত নির্দিষ্ট দিনে বিকেল চারটে নাগাদ রবীন্দ্র সদনের সামনে এসে দাঁড়ালাম আর আমার এসে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি প্রায় ওর সমবয়সী একজন যুবককে সঙ্গে করে শুভ্রা ভিক্টোরিয়ার দিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছে।

কুশলদা, এই হচ্ছে সমুদ্র, সমুদ্রের দিকে ফিরে আমি আমার ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলাম , শুভ্রা ততক্ষণে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করেছে , সমুদ্র ইনিই হচ্ছেন কুশলদা যার কথা তোমায় বলেছি, বিখ্যাত গায়িকা কাজল কর ওনার মা হন । শুভ্রার মুখে মায়ের কথা শুনে মনে পড়ে গেলো যে সেদিন ও বলেছিল আমি যেন সমুদ্রের গানের ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলি , মাকে কথাটা বলতে একদম ভুলে গিয়েছি , তবে বললেও মনে হয় খুব একটা লাভ হতো না , ফোক আর রকের ককটেল করে সমুদ্ররা যে ধরনের গান গায় তার সঙ্গে মায়ের গানের হাজার মাইল দূরত্ব।

শুভ্রা অবশ্য ও প্রসঙ্গেই এলো না , আমার হাতটা ধরে বলেলো, কুশলদা চলুন না কোথাও গিয়ে একটু বসি, ভীষণ খিদে পেয়েছে এন্ড উই হ্যভ সাম থিং টু ডিসকাস উইথ ইউ।

তিনজনের জন্য চিকেন কবিরাজি আর কালো কফি বললাম।

ফর্কে কবিরাজির একটা টুকরো গেঁথে কোনো ভূমিকা ছাড়াই শুভ্রা জানালো যে কাল নাকি সমুদ্রের সঙ্গে ওর বিয়ে আর আমাকে সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে হবে শুভ্রার তরফের সাক্ষী হয়ে , ইউ উইল হ্যভ টু সাইন দেয়ার অ্যাজ এ উইটনেস ফ্রম মাই সাইড। কে জানে , শুভ্রার কথাটা শুনে নাকি অন্য কোনো কারণে বিষম খেলাম একটা , তাড়াতাড়ি করে শুভ্রা টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাসটা আমার মুখের সামনে ধরলো । জলটা খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে শুভ্রা আর সমুদ্রকে অভিনন্দন জানিয়ে সমুদ্রকে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? মানে, তুমি ঠিক কী কাজ করো?

সমুদ্র কিছু বলবার আগেই শুভ্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো , যা বাবা, সেদিন বললাম না যে সমুদ্র গান করে, হি ইজ আ সিঙ্গার।

না, মানে আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে ওর প্রফেশনটা ঠিক কী, চাকরি না ব্যবসা?

সমুদ্রই এবার আমার কথার উত্তর দিলো , কুশলদা, আমি চাকরি বা ব্যবসা কোনটাই করি না, বিকজ আই ফিল, একজন শিল্পী যদি চাকরি বা ব্যবসার মত কোনো কিছুতে জড়িয়ে পড়ে তখন তার পক্ষে আর শিল্পের জন্য পুরোপুরি মনঃসংযোগ করা বা নিজেকে ডেডিকেট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।



ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিই ঠাণ্ডাটা এবার বিদায় নিলো , মাধ্যমিক শুরু হতে আর মাত্র দশ দিন বাকী, বাবার নির্দেশে এখন আমার বিকেলে খেলতে যাওয়া বারণ, তাই রোজ বিকেলে পাড়াটাতেই একটা চক্কর মারি। আমাদের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে পঞ্চানন তলার মাঠ, আগে এখানে একটা জলাজমি ছিল , জলাটার মালিক যে ঠিক কে তা পাড়ার কেউই সঠিক ভাবে জানতো না, লোকে বলতো ভদ্রলোক নাকি এখানে থাকেন না , যাই হোক ছোটবেলায় জলাটার পাড়ে আমরা বন্ধুরা মিলে ফড়িং ধরতাম আর বর্ষাকালে যখন জলাটা বৃষ্টির জলে ভরে যেত তখন লালার দোকান থেকে বড়শি কিনে মাছ ধরতে দাঁড়িয়ে যেতাম। লালার দোকানের ঠিক উলটো দিকেই ছিল পঞ্চানন বাবার থান, থান বলতে একটা বেটে মত অশ্বত্থ গাছ আর তাকে ঘিরে শ্যাওলা ধরা ইটের চাতাল , চাতালটার চারপাশে ঢোল কমলির জঙ্গল, পাড়ার মানুষরা বিশ্বাস করত যে অশ্বত্থ গাছের কাণ্ডে নিজের মনোবাসনা জানিয়ে লাল কাপড়ে মুড়ে একটা ঢিল বেঁধে দিলে তা ফলবেই। মাঝে মাঝে তাই দেখতাম পাড়ার কারোর বাচ্চাকাচ্চা হলে বা কারো বাড়ির ছেলে চাকরি পেলে তারা এসে পঞ্চানন বাবার থানে পূজো দিয়ে তাদের বাঁধা ঢিলটা খুলে দিতেন , আমি অবশ্য খুব দরকার না পড়লে চাতালটায় যেতাম না কারন অশ্বত্থ গাছটার কাণ্ডের নিচের দিকে যে বড় গর্তটা ছিল সবাই বলতো ওখানে নাকি বাবা পঞ্চাননের সাপটা শুয়ে থাকে , ছোটবেলা থেকেই আমার সাপে খুব ভয়, তাই দু'বেলা আমি দূর থেকেই পঞ্চানন বাবাকে রোজ একবার করে নমস্কার করে যেতাম।

জলার ঠিক ওপারেই ছিল সন্তোষজেঠুর বাড়ি, রোগা লম্বা মানুষটি এমনিতে খুব হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর ভদ্রলোক যেন আঘাতটা সহ্য করতে পারলেন না, তারপর থেকেই কী যে হলো পাড়ার কারোর সঙ্গেই আর বিশেষ কথাবার্তা বলতেন না, নিজের মনেই সব সময় কীসব যেন বিড়বিড় করতে থাকতেন , অফিস থেকেও সময়ের অনেক আগে রিয়াটেরমেন্ট নিয়ে নিলেন, রিটায়েরমেন্টের পর দিনভর জেঠু পঞ্চানন তলার চাতালে এসে বসে থাকতেন , ওনার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া থাকতেন ওনার সঙ্গে , ভদ্রমহিলাকে দেখতাম দুপুরের দিকে এসে জেঠুকে প্রায় জোড় করে বাড়িতে নিয়ে যেতেন। এরই মাঝে একদিন হঠাৎ জলাটার পাশে অনেকগুলো মাটির লড়ি এসে দাঁড়ালো আর পাড়ার লোকরা আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে সন্তোষ জেঠু দিনভর তদারকি করে জলায় মাটি ফেলছেন , পরে জানা গেলো জমির মালিককে খুঁজে জেঠু নাকি জমিটা কিনে নিয়েছেন। জলা বুজে মাঠ হলে মাঠের এক পাশে পঞ্চানন বাবার মন্দিরটাও পাকা করে দিলো জেঠু। মাঠের বাকী অংশে তখন থেকেই পাড়ার বাচ্চারা বিকেলে এসে খেলাধুলা করে , শীতে বড়রাও কোর্ট কেটে রাতে ব্যাডমিন্টন খেলেন, জেঠু যতদিন বেঁচে ছিলেন ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে প্রায় সারাদিনই উনি মন্দিরের দাওয়ায় এসে বসে থাকতেন আর বিকেলে যখন মাঠে বাচ্চারা খেলতে আসতো তখন তাদের ডেকে ডেকে লজেন্স খাওয়াতেন ।

গত বছর থেকে পঞ্চানন তলার মাঠে মনিমেলা চালু হয়েছে , কানুদা আর সুবলদা আমাদের পাড়ার দুই দাদা উদ্যোগ নিয়ে এই মনিমেলাটা চালু করেছেন । আজ বিকেলবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পঞ্চানন তলার মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালাম , জনা তিরিশ ছেলে-মেয়ে এখন মাঠটার একদিকে সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা টি-শার্ট পরে কানুদার সঙ্গে পি টি করছে , অন্যদিকে সুবলদা বড় দাদা-দিদিদের নিয়ে মার্চ-পাস্ট করাচ্ছেন। দিদিরা সবাই সাদা চুড়িদার পরা, দাদাদের শরীর ঢাকা সাদা লং প্যান্ট আর টি-শার্টে । পি টি শেষ, কানুদা ওনার বুকে ঝুলে থাকা বাঁশীটায় একটা লম্বা ফুঁ দিয়ে বাচ্চাদের মাঠের মাঝখানে এসে হাতে হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়াতে বললেন। সুবলদাও ততক্ষণে বড়দের দলটাকে নিয়ে বৃত্তের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন , সবার হাত এখন বুকের সামনে জড়ো করা , চুড়িদারের ওড়না কোমরে পেঁচিয়ে বানীদি শুরু করলো, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা ... মাঠের সবাই বানীদির সঙ্গে এখন গলা মেলাচ্ছে … এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ... সত্যি বলছি , আমারও খুব ইচ্ছে করছে ওদের সঙ্গে গলা মেলাতে ... ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ ... নিজের অজান্তেই আমি যেন ওদের সঙ্গে গলা মেলালাম ... ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর মা এখন রোজ সকালবেলায় স্নান সেরে ঠাকুরঘরে পূজো করতে বসে, গরদের শাড়ি পরা মাকে দেখে তখন আমার মনে হয় কাজল মা শুধু আমার মা নয়, আমাদের সবার মা ... ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম মা গো ...

খুব ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে মায়ের পা-দুটো নিজের বুকে জড়িয়ে ধরি।

ক্রমশ