বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১৯ ( অন্তিম পর্ব )

১৯

ঘনঘন আমায় ঘড়ি দেখতে দেখে ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো যে ট্রেন কটায়।

রাস্তায় আজ ভীষণ জ্যাম, বড়বাজার থেকে গাড়ির যে লম্বা লাইন শুরু হয়েছে তা যেন আর শেষই হতে চাইছে না, মাঝে মাঝেই আজকাল কোলকাতার রাস্তায় এমন জ্যাম হয়, গাড়িগুলি তখন যেন সব আলস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুতেই আর নড়তে চায় না, ভাগ্যিস মায়েদের ট্রেনটা আজ এক ঘণ্টা লেটে ছাড়বে, নইলে মায়ের সঙ্গে আজ হয়তো আর দেখাই হয়ে উঠতো না। আমার ট্যাক্সি ড্রাইভারটা বেশ চালু, এদিক ওদিক করে কখন যেন গাড়িটাকে একটা লালবাতি লাগানো ভি আই পি গাড়ির ঠিক পিছনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে, তবে লালবাতি লাগানো থাকলেও গাড়ির আরোহী মনে হয় সেরকম উঁচুদরের কেউ নন, একে তো আগে পিছে কোনো কনভয় নেই, আর তাছাড়া কেউকেটা হলে নিশ্চয়ই কোলকাতার পুলিশ এতক্ষণে যেভাবেই হোক রাস্তা পরিষ্কার করে দিত, যাই হোক আমার কাছে উনিই এখন ভরসা, এই ভিড়ের মধ্যে ওনার গাড়ি যদি কোনো ভাবে রাস্তা খুঁজে পায় তাহলে আমার ট্যাক্সিও তার পিছু পিছু দৌড় লাগাবে।

মা ইতিমধ্যে দুবার ফোন করেছে, জিজ্ঞাসা করছিল যে কতদূর পৌঁছলাম, মাকে আশ্বস্ত করে বলি, চিন্তা করো না, ট্রেন ছাড়ার আগে ঠিক পৌঁছে যাব। আসলে ভেবেছিলাম অফিস থেকে আজ ছুটিই নিয়ে নেব আর সকালবেলায় সিঁথির বাড়িতে গিয়ে মায়েদের নিয়ে একদম স্টেশনে পৌঁছব, কিন্তু কাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে মিত্রের ফোন এলো, আরে কুশল, তোমায় বলা হয়নি, বিকেলে আজ ইগর কনস্ট্রাকশন থেকে ফোন এসেছিল, ওরা কাল সকাল দশটায় একটা মিটিং ডেকেছে।

কালকে ! আমার বলার মধ্যে মনের যে অস্বস্তিটা ফুটে উঠেছিল সেটা বুঝতে পেরে মিত্র বললেন, কী হলো, কাল কোনো কাজ আছে নাকি !

না মানে, একটু ইতস্তত করে ওনাকে জানালাম যে কাল ফার্স্ট হাফে ছুটি নেওয়ার কথা ভাবছিলাম।

মিত্র জানালো যে খুব অসুবিধা না হলে আমি যেন ছুটি নেওয়ার প্লানটা ক্যানসেল করি কারণ এই মিটিংটা খুব ইম্পরট্যান্ট, বুঝলাম একা একা মিটিংয়ে যেতে উনি চাইছেন না, মনের বিরক্তিটা চেপে তাই বললাম, ঠিক আছে, দশটা নাগাদ ইগরের অফিসে আমি পৌঁছে যাব, তবে সাড়ে এগারোটার মধ্যে মিটিং শেষ না হলে উনি যেন আমায় ছেড়ে দেন।

অলোককাকু সকাল সকালই মায়েদের ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন, ওনার গাড়িতে করেই মায়েদের উনি ষ্টেশনে নিয়ে এসেছেন, ইশ, কাকুর গাড়িটা আজ মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে যেতে পারত কিংবা আমি যেমন এখন ট্রাফিকে ফেঁসে আছি সেভাবে ট্রাফিকে আটকে যেতে পারত, তাহলে এখন যেমন আমি জ্যাম ছাড়ার জন্য মনে মনে প্রার্থনা করছি তখন তা না করে ভগবানকে উল্টে বলতাম, আজ যেন কলকাতার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম আর শেষ না হয়, কোলকাতার সমস্ত গাড়ি যেন আজ নাড়িভুঁড়ির মতো জট পাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, মিসেস কাজল কর যেন কিছুতেই আজ ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছতে না পারেন অথবা পৌছলেও গিয়ে দেখেন যে তার ট্রেন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, না কুশল, তুমি যদি মনে করো যে ট্রেন মিস করলেই তোমার মা অমনি কোলকাতা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা উইথড্র করে নেবেন তাহলে তোমার মাকে এখনও তুমি চিনতে পারনি, আজ হয়তো মিসেস কাজল কর স্টেশন থেকে ঠিকই ফিরে আসতেন কিন্তু ঐ ফেরার পথেই উনি আবার তার যাত্রার প্রস্তুতি কিন্তু শুরু করে দিতেন।

একটা ট্রাফিক সার্জেন্ট ফুটপাথের ওপর বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে ওয়াকিটকির মাধ্যমে আগে পিছে কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কাল আমার সঙ্গে ঝিনুকও গিয়েছিল ওর ঠাম্মার কাছে, শ্যামবাজার অবধি ঝিনুক মেট্রোতে চলে আসে আর ওখান থেকে আমি ওকে অফিস ফেরত পিক-আপ করে নেই, মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে মেট্রো স্টেশনে গিয়ে হয়ত দেখব ঝিনুকের পাশে তার মা-ও দাঁড়িয়ে আছে, না, উর্মি আসেনি, মায়ের টিকিট হয়ে যাওয়ার পর সেই যে সেদিন অফিস থেকে ফিরে উর্মিকে বলেছিলাম যে সামনের সোমবার মা চলে যাচ্ছে তারপর আর ওর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি।

ঝিনুককে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মা একসময় জিজ্ঞাসা করে উঠেছিল, কী রে দিদিভাই, তুই অমন চুপ করে বসে আছিস কেন, কথা বলছিস না যে !

ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঝিনুক বলে উঠেছিল, কেন বলব কথা, তুমি কি আমার কথা শোনো ?

আমি আবার তোর কোন কথা শুনি না রে?

ঝিনুক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এবার বিছানায় বসা মাকে জড়িয়ে ধরে, ও ঠাম্মা, তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ, যেয়ো না প্লিজ। তুমি গেলে কিন্তু আমার ভীষণ বাজে লাগবে।

মায়ের মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু জানি মায়ের চোখে এখন জলের ধারা, ঝিনুক তখন খুব ছোট, মাকে দেখতাম কোলে নিয়ে ওকে ঘুম পাড়ানর সময় এক দৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে, জিজ্ঞাসা করলে বলতো, বাবু জানিস ওর মুখটা না ঠিক আমার মায়ের মত, মায়ের বুকে মুখ রেখে ঝিনুকের পিঠটা কেঁপে কেপে উঠছে, এক সময় চোখের জল মুছে মা ঝিনুককে বললো, দিদিভাই, আমি গিয়ে একটু থিতু হয়ে বসি, তারপর তোকে কিন্তু তোর মা আর বাবাকে নিয়ে আমার ওখানে একবার আসতে হবে।

আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরনর সময় একবার ভেবেছিলাম উর্মিকে বলি যে ও যেন আজ ষ্টেশনে আসে, কিন্তু শেষ অবধি কথাটা আর উর্মিকে বলিনি, কী হবে বলে, যে প্রশ্নের উত্তর নির্ভুল ভাবে জানা তা জানতে চেয়ে বাকশক্তির অপব্যবহার করার কোনো মানে নেই, জুতোটা পরে বেরনোর আগে তাই শুধু বলেছিলাম, আজ বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হবে।

নিজের মনেই উর্মি যেন আমার কথার উত্তর দেয়, এ আর নতুন কথা কী!

নতুন কী পুরনো তা জানি না, তবে কথাটা জানানো দরকার, তাই বললাম।

তা দেরী হওয়ার কারণটা কি জানতে পারি?

অফিস থেকে আজ এক জায়গায় যেতে হবে, কাজ আছে।

পুরনো ছাত্রীকে নতুন করে পড়ানোর যে কাজটা শুরু করেছ, সেই কাজ, নাকি অন্য কিছু?

শুভ্রার সঙ্গে আমার রি-ইউনিয়নের কথাটা উর্মির আর অজানা নয়, আমাদের চেনাশোনা অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে উর্মিকে কথাটা জানিয়ে গিয়েছে, প্রথমে আকারে ইঙ্গিতে তারপর একদিন সরাসরিই উর্মি আমার কাছে শুভ্রার ব্যাপারে জানতে চায়, লুকোয় না কিছু, সব খুলে বলি, শুভ্রাকে পড়ানোর কথা, সমুদ্রের সঙ্গে ওর প্রেম বিয়ে পরে বিচ্ছেদ, তারপর একার হাতে ওর ছেলেকে বড় করে তোলা, কোলকাতায় শুভ্রার চাকরি নিয়ে ফিরে আসা, তারপর একদিন গোল-পার্কের কাছে হঠাৎ করে আমাদের দেখা হয়ে যাওয়া, আমার কথা শেষ হলে উর্মি খুব নিঃস্পৃহ গলায় বলেছিল, পুরনো চেনা পরিচিত কারোর সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ করে একদিন দেখা হয়ে যাওয়া বা তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলা আর দুজন পূর্ণ বয়স্ক নারী পুরুষের দিনের পর দিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোটা কিন্তু এক নয়, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উর্মি তারপর বলেছিল, আজ যদি কেউ এসে আমায় বলে যে আপনার বৌকে প্রায়ই অমুক পুরুষের সঙ্গে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে তাহলে আমার কেমন লাগবে।

জবাব দিতে পারিনি, শুধু মনে মনে বলেছিলাম, উর্মি, এসবের জন্য তুমিই তো আসলে দায়ী, দিনের পর দিন তুমিই তো আমাকে আমার নিজস্ব

স্বত্বার মৃত্যু ঘটিয়ে তিল তিল করে সংসার থেকে বিমুখ করে তুলেছে, ইনফ্যাক্ট এই সংসারে আমার তো তেমন কিছু চাওয়ার নেই বা ছিল না কোনদিন, আমি শুধু আমার মত করে একটু বাঁচতে চেয়েছিলাম, না উর্মি, সেটুকুও তুমি দাওনি আমায়, উল্টে তুমি আর তোমার মা মিলে সংসারের নাগপাশে আমায় বেঁধে ফেলতে চেয়েছ, কিন্তু বোঝনি তোমরা, যত তোমরা আমায় বাঁধতে চেয়েছ ততই কিন্তু আমার থেকে তোমরা নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়েছ, আমার শুধু একটাই ভুল হয়েছে, কোনদিন আমি এসব কথা উর্মিকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি, আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু উর্মি তা শোনার মত বা বোঝার মত আগ্রহ কখনও দেখায়নি, তাই এক ছাদের নিচে থেকেও আমাদের দূরত্ব শুধু বেড়েই গিয়েছে, ঘরের মধ্যে গড়ে উঠেছে অদৃশ্য এক দেওয়াল আর সেই দেওয়ালের আড়ালে আমরা নিজেদের নিজেদের গণ্ডি টেনে নিয়েছি।

আজকের জীবনের রেসপেক্টে আমার তো কখনও কখনও মনে হয় বিবাহিত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাজবাদদের নতুন করে ভাববার সময় এসেছে, একই ছাদের নিচে থেকে দাম্পত্যের চ্যাটচ্যাটে গঁদের আঠায় জীবনটাকে কোনভাবে জুড়ে রাখা আর যাই হোক অর্থপূর্ণ কোনো কাজ নয়। কবুল, কবুল, কবুল তিনবার একই কথা বলে রিস্তে কবুল করা বা পাঞ্জাবীর খুঁটের সঙ্গে শাড়ির আঁচলের গিঁট বেঁধে সাত-পাক ঘোরার সময় সত্যিই কি আমরা বুঝতে পারি যে কত মহান এবং কত বৃহৎ একটা দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে চলেছি, জানি না ... খবরের কাগজে সেদিন পড়লাম পৃথিবীর দুই বিখ্যাত সেলিব্রেটি নাকি লিখিত ভাবে পাঁচ বছরের জন্য কন্ট্রাকচ্যুয়াল এগ্রিমেন্ট বানিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন, পাঁচ বছর পর তাঁরা নিজেদের সম্পর্ক রিভিউ করে দেখবেন যে ভবিষ্যতে এই সম্পর্কটা তারা কন্টিনিউ করবেন কি না, খবরটা পড়ে আমি কিন্তু অবাক হইনি, বরঞ্চ মনে হয়েছে, আজ না হোক কাল শহুরে জীবনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কন্ট্রাকচুয়াল এগ্রিমেন্ট এক অবশ্যম্ভাবী বিষয় হয়ে দাঁড়াবে …

না, জ্যামটা ছেড়েছে, ড্রাইভারকে বললাম ভাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্টেশনে পৌঁছে দাও।

গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে ছেলেটা উত্তরে বললো, স্যার, চিন্তা করবেন না, ফাঁক পেলেই একদম টেনে দেব।



স্টেশন থেকে ফেরার পথে আজ একবার বিরাটিতে যেতে হবে, রায়গড়ার পেপার মিলের সৈকত ব্যানার্জি ছুটিতে বাড়ি এসে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন, এখন বিছানায় শোওয়া, ওনার কিছু আর্জেন্ট এবং কনফিডেনসিয়াল পেপার এক জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে, পেপারগুলো উনি আজ আমায় দেবেন, তারপর সন্ধ্যাবেলায় শুভ্রার ওখানেও একবার যেতে হবে, ছেলেকে নিয়ে বেচারি খুবই সমস্যায় পড়েছে, উজান নাকি শুভ্রার সঙ্গে একই রকম দূরত্ব মেনটেন করে চলছে, শুভ্রা কিছু জিজ্ঞাসা করলে ছেলে এমন এমন সব জবাব দিচ্ছে যে যার বাংলা মানে দাঁড়ায়, শোনো মা, আমার জন্য তুমি এতদিন ধরে যা করেছ বা ভবিষ্যতে যা করবে, তা তোমার কর্তব্য, ইউ আর বাউন্ড টু ডু ইট, কিন্তু তার জন্য তুমি যদি ভেবে থাকো যে ইউ হ্যভ গট এভরি রাইট টু ইনটার-ফেয়ার ইন মাই পার্সোনাল লাইফ দেন ইউ আর লিভিং ইন ফুল’স প্যারা-ডাইস, আমার জীবনে তোমার ভূমিকা এখন খুবই সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত এবং সেটা মনে রাখা তোমার কর্তব্য।

পরশুই ফোনে কথা হচ্ছিল শুভ্রার সঙ্গে, আচ্ছা কুশলদা, বলুন তো ছেলেটার হঠাৎ করে কী হলো?

শুভ্রাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, কী আবার হবে, মনে হচ্ছে কোনো ব্যাপারে উজান একটু আপসেট আর সেটা তোমাকে ও ঠিক মত কম্যুনেকেট করতে পারছে না, হয়তো তার জন্যই এরকম করছে, আচ্ছা একটা কাজ করব?

বলুন, শুভ্রার গলায় একরাশ হতাশা যেন।

আমি না হয় গিয়ে একবার ওর সঙ্গে কথা বলি, মে বি যে কথাটা ও তোমায় বলতে পারছে না সেটা হয়তো ও আমার সঙ্গে শেয়ার করলেও করতে পারে।

দেখুন চেষ্টা করে, আমার আর কিছু ভালো লাগছে না, রিয়েলি আই কান্ট বেয়ার উইথ ইট এনি মোর।



প্লাটফর্ম টিকিট কেটে এসি টু টায়ারের দু নম্বর ডাব্বাটায় যখন এসে দাঁড়ালাম তখন ট্রেন ছাড়তে আর মিনিট পনেরর মত বাকী, আমায় কামরায় ঢুকতে দেখে মা বলে উঠলো, যাক শেষ অবধি এসে পৌঁছলি, আমি তো ভাবছিলাম তুই আর পৌঁছতেই পারবি না। হাঁপাতে হাঁপাতে মায়ের সিটের এক কোনে বসে পড়ি, ছবি তাড়াতাড়ি করে জলের একটা বোতলের ঢাকনা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দেয়, এর মধ্যেই ছবি কিন্তু ট্রেনের ডাব্বায় একটা যেন সংসার সংসার ছাপ এঁকে ফেলেছে, ব্যাগগুলি সিটের নিচে ঢুকিয়ে কম্পারমেন্টের দেওয়ালে লাগানো টেবিলটার ওপর মায়ের ওষুধের বাক্স থেকে শুরু করে খাওয়ার জিনিস, টুকিটাকি আরো কত কিছু যে সাজিয়ে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই, মায়ের সিটটা লোয়ার বার্থে, উলটো দিকের সিটে অবাঙ্গালী এক অল্প বয়সী দম্পতি বসে, ওনারাও হরিদ্বারে যাচ্ছেন, অলোককাকুকে দেখলাম যুবকটিকে বলছেন যে যাত্রাপথে ওনারা যেন একটু মায়ের খেয়াল রাখেন, ছেলেটি উত্তরে কাকুকে নিশ্চিন্ত করে ভাঙ্গা বাংলায় বলে উঠলো, আপনারা একদম শোঁচবেন না, মাতাজীকা হাম ঠিক খেয়াল রাখেঙ্গে।

কামরার মেঝের দিকে মুখ নিচু করে বসে আছি, এই মুহূর্তে এক এক করে কত স্মৃতি যে মনের মধ্যে ভেসে উঠছে তার ঠিক নেই, ঠাকুমার মুখে শোনা সেই গল্প, এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী বেশ কিছু বছর আগে এই হাওড়া স্টেশনেই একদিন মাথা ভর্তি সিঁদুর নিয়ে ট্রেন থেকে এসে নেমে দাঁড়িয়েছিল, তারপর গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে, সেই তরুণীটির জীবনেও সময়ের সাথে সাথে এসেছে নানা টানাপোড়ন আর ওঠানামা, চড়াই উৎরাইয়ে ভরা সেই জীবনে তরুণীটি কিন্তু সুখ বা আনন্দ সব সময়ই সংসারের পরিবার পরিজনের সঙ্গে দুহাতে ভাগ করে নিয়েছেন, দুঃখটাকেই শুধু কৃপণের মত সঞ্চয় করে রেখেছেন নিজের জন্য, আর হৃদয়ে জমে থাকা দুঃখের সেই লহরীই বারবার তার সঙ্গীতে যেন ফিরে এসেছে, জিন্দেগী এক মুসকান হ্যয়... দরদকি কোয়ি পহেচ্যান হ্যয় ... শ্রোতারা যখন এ গান শুনেছেন ভেবেছেন যে গানের কথাগুলি কত সুন্দর ... তারা কিন্তু কখনো বোঝেননি যে এ গান আসলে শুধু মাত্র কিছু কথা নয়, এ গান কাজল করের বুক নিঃসৃত কান্নার আওয়াজ।

কী রে, তখন থেকে মুখ নিচু করে কী ভাবছিস, আমাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে মা জিজ্ঞাসা করে উঠলো।

ঘড়ির দিকে তাকাই, ট্রেন ছাড়তে আর মিনিট পাঁচেকের মত আছে, মাথা নেড়ে বলি, কিছু না, কথা খুঁজতে মাকে জিজ্ঞাসা করি তার সুষমাদি ষ্টেশনে আসবেন কি না।

আসবে তো বলেছে, তুই আর এসব নিয়ে অত ভাবিস না তো, আমি ঠিক পৌঁছে যাব।

তোমাকে নিয়ে কবে আবার আমি ভাবতে গিয়েছি বা ঠিক করে বলতে গেলে কবে তুমি আমায় তোমায় নিয়ে ভাবতে দিয়েছ, উলটে সারা জীবন তো তুমিই আমায় আগলে আগলে রেখেছ যেমন করে মা পাখীরা তাদের ছানাকে আগলে রাখে, মুখে বললাম, তুমি কিন্তু ওখানে গিয়ে যতক্ষণ না নতুন সিম নিচ্ছ ততক্ষণ পুরনো নম্বরটাই চালু রেখো।

হ্যাঁ রে বাবা রাখব'খন, মা এবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমাদের বললো, গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছে কিন্তু, যা, তোরা নিচে যা।

অলোককাকু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, সাবধানে যেয়ো বৌদি, মাঝে মাঝে ফোন করে জানিও যে কতদূর গিয়ে পৌঁছলে, ছবিকে মায়ের খেয়াল রাখতে বলে কাকু এবার দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মাকে প্রণাম করে আমিও কাকুর পিছু পিছু কমপারমেন্টের দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম, মা সিট ছেড়ে উঠে কমপারটমেন্টের গেট পর্যন্ত এলো, নামবার আগে আমার হাতদুটো ধরে মা বললো, সাবধানে থাকিস, আমার জন্য অত চিন্তা করিস না, বৌমা আর ঝিনুকের খেয়াল রাখিস, গাড়িটা দুলে উঠছে, আমাদের মত আরা যারা যাত্রীদের ছাড়তে এসেছেন তাদেরকে ছেড়ে ট্রেনটা এবার ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো, কাকুকে দেখলাম জানলার কাঁচে হাত রেখে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন, ভালো করে তাকিয়ে দেখি, কাঁচের ওপারে কাকুর হাতের ছায়ায় একটা অস্পষ্ট হাতের ছাপ।

বুক চিরে কেন জানি আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।


শর্ত মেনে আর পিছন ফিরে তাকানো হবে না কোনদিন ...

তবু আনমনা আলো মেখে কবি দাঁড়িয়ে পড়েন, পিছনে পড়ে রয়েছে বিস্তৃত উৎরাই, চেনা অচেনারা ফিরে গেছে কতবার এ পথ বেয়ে

আর কুলীন বাতাস বয়ে এনেছে দীর্ঘশ্বাস ...

অসংখ্যবার এই শরীরের মৃত্যু হয়েছে অথচ গোনা হয়নি মৃত্যুর ঠিক কতদিন বাদে আবার বেঁচে উঠেছি প্রতিবার... এই যে ঘুমের মধ্যে পুরনো সময়ের দিকে হেঁটে যাওয়া, এই যে প্রতিদিন জেগে ওঠা, এক টুকরো আয়নায় দু'জনার তাকিয়ে থাকা...

যেখানে তুমি কথা বলো আমার প্রতিবিম্বের সঙ্গে আর আমি তোমার ছায়ার হাতে হাত রাখি...


না, এই হাতদুটো কখনো মিলতে পারেনি, কাঁচের দেওয়ালের ব্যবধানে তাদের ছায়া-দুটোই শুধু পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে, ট্রেনের গতি বাড়ছে, প্লাটফর্ম পার করে ট্রেনটা এক সময় এগিয়ে গেলো সামনের দিকে --


হেঁটে যান কবি চড়াইয়ের পথ ধরে, আরো বেশী বেশী করে যেন যেতে চান ঐ আকাশের দিকে ...

যদি কোনদিন ফিরে আসো, যদি দেখো পথ ভুল করেছে বাতাস আবার, দিগন্তে কেউ ভুলে ফেলে গেছে তার গান, জানবে সে আসলে আমারই ছায়া

তুলে নিও পড়ে থাকা সে মৃত কবিতার খাম... দেখো লেখা আছে 'ভালবাসা'... যা ছিল তোমাকে দেওয়া আমার ডাকনাম...

আনমনা আলো গায়ে কবি দাঁড়িয়ে পড়েন শেষ একবার ... পিছনে বিস্তৃত উৎরাই...



অলোককাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখের কোনে যেন টলমল করছে এক বিন্দু জল, আমাকে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাকু তাড়াতাড়ি করে পাঞ্জাবীর হাতায় চোখের পাতাদুটো মুছে নেন, কোন দিকে যাবে তুমি, আমি কিন্তু তোমায় নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি।

মিস্টার গোস্বামী, কেন বলুন তো সেদিন অফিস ফাংশনে ছেলেটির মুখে আপনার কবিতা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, জানেন, সেই দিন থেকে এই চলমান জীবনটা মাঝে মাঝেই আমার চোখে আপনার কবিতা হয়ে যায়,


“দুটো ট্রেন দুদিকে ছিঁড়ে গেলো। প্লাটফর্ম ফাঁকা। আমরা কেউ কারোর নাম বলিনি ...”

চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে, দুটো হাত কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে ছুঁতে চাইছে, অথচ পারছে না। কাকু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, না, কাকু, আপনি যান, ভেতরে ভেতরে এখন আমি আসলে অনেকগুলো টুকরো হয়ে গিয়েছি, টুকরোগুলোর ওপর বিভিন্ন সব নাম লেখা, মা, উর্মি, ঝিনুক, শুভ্রা, বলুন কাকু আপনি কোন টুকরোটাকে নিয়ে যাবেন, তার চেয়ে এই শহরের রাজপথে আমি না হয় এখন একটু একা একা হাঁটি, দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে নিজেকে যদি আবার একটা সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি!

“চল্লিশ পেরিয়ে মোটে একটা বছর হেঁটেছি, অমনি

নির্বাপণ এসে পড়ল। তার হাতে কালো লাঠি।

বলল এবার থেকে শরীরটাই কেবল থাকবে তোমার সঙ্গে।

ঘুরে বেড়াবে, মিষ্টি হাসবে, তামাসা বাজাবে,

কিচকিচ করবে অফিসে, মুকুট পরবে, ডানদিক বাঁদিক

ঘুরে ঠিক মত আলো নেবে মুখে।

কিন্তু আগুন আর এখন তোমার সঙ্গে রইল না।

সে এখন বিষাদ দেশে পৌঁছেছে। সে মুহ্যমান।

তার আর (জ্বলবার) ইচ্ছে হয় না।“



ব্যানার্জিবাবুর বাড়ি থেকে কাগজগুলি নিয়ে ট্রাঙ্গুলার পার্কে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গেলো, কিছুক্ষণ আগে শুভ্রা ফোন করে জানতে চাইছিল যে কখন আসব, জানালাম যে আরো মিনিট পনের কুড়ির মত লাগবে, ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে উজান ঠিক আছে কি না, চাপা গলায় শুভ্রা জানালো যে ছেলে তার শোওয়ার ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আসবার সময়ে একটা বইয়ের দোকানের সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে উজানের জন্য গ্রিসামের লেখা একটা বই নিয়ে নিলাম, যতটুকু ওকে দেখেছি তাতে বয়সের তুলনায় একটু বেশীই গম্ভীর বলে মনে হয়, গ্রিসামের লেখা হয়তো ভালো লাগবে উজানের।

লিফটে ফোর্থ ফ্লোরের বাটনটা টিপে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা একবার পুঁছে নেই, লিফটের খাঁচা থেকে বেরনর আগে পিছনের দেওয়ালে লাগানো আয়নায় মুখটাও একবার ভালো করে দেখে নেই, গাঙ্গুলি সাহেব সব সময় বলতেন, পরিস্থিতি ভেদে প্রত্যেকটা মুখ বা মুখোশের নাকি আলাদা আলাদা অ্যাপিল থাকে, কারোর সঙ্গে ইন্টারেক্ট করার আগে তাই প্রথমেই ঠিক করে নেওয়া দরকার যে টেবিলের উলটো দিকে বসে থাকা মানুষটার কাছে তুমি তোমার কোন মুখটা নিয়ে পৌঁছবে, আমার যেসব কাস্টমার বয়সে বড় তাদের সঙ্গে দেখা করার আগে আমি তাই মুখে একটা সরল ছেলেমানুষির মুখোশ এঁটে নেই, আবার কাস্টমার যখন সমবয়স্ক তখন ছেলেমানুষির মুখোশটা খুলে সেখানে আমি একটা বন্ধুত্বের রূপটান দিয়ে নেই।

উজানের সঙ্গে কথা বলার জন্য সঠিক মুখোশটা আজ পরে নেওয়া দরকার, না হলে ছেলেটা হয়ত মন খুলে কথাই বলবে না।

লিফট থেকে বেরিয়ে ওদের ফ্লাটের দরজার দিকে এগই, কলিং বেলটা প্রেস করতে গিয়েও থমকে দাঁড়াই, বন্ধ দরজার ওপার থেকে শুভ্রা আর উজানের গলার স্বর ভেসে আসছে, শুভ্রা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছে তোর কি এখন শপিংয়ে যাওয়াটা খুবই জরুরী?

তোমায় বললাম না সামনের সপ্তাহে হয়ত আমি ফিরে যাব, আমার হাতে তাই আর বিশেষ সময় নেই।

কিন্তু আঙ্কল তো আজ তোর সঙ্গে দেখা করবেন বলেই আসছেন, তোর বাড়িতে না থাকাটা কি ভালো দেখায়?

দেখো মা, এক ভদ্রলোক যাকে আমি ঠিক মত চিনি না বা যার সঙ্গে আমার কথা বলার কোনো ইচ্ছেই নেই তার হঠাৎ করে ইচ্ছে হলো যে আমার সঙ্গে দেখা করবেন আর তার জন্য আমার সমস্ত প্রোগ্রাম চেঞ্জ করে বাড়িতে বসে থাকতে হবে, ডোন্ট ইউ থিং এটা একটু বেশী ধরনের বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, দরজার এপার থেকেও উজানের গলাটা ভীষণ কর্কশ শোনাচ্ছে। আর একটা কথা শোনো, কথাটা শুনতে হয়ত তোমার খারাপ লাগবে কিন্তু সত্যি বলতে কী আই ডোন্ট ফাইন্ড এনি রিজন টু গিভ সাচ ইম্পরটেন্স টু দ্যট ম্যান।

এই তোর কী হয়েছে রে, সেই আসা থেকে দেখছি আমার সঙ্গে তুই সমানে টেরিয়ে টেরিয়ে কথা বলে যাচ্ছিস!

কী হবার হবে, আই অ্যাম ফাইন এন্ড প্লিজ লিভ মি এলোন।

শোন উজান, শুভ্রার গলাটা যেন আবার নরম হয়ে এলো, বল না বাবা তোর কী হয়েছে, কেন এমন করছিস?

এ তো আচ্ছা ঝামেলা! বলছি না আমার কিছু হয়নি এন্ড নাও প্লিজ স্টপ দিস ডিসকাশন, আমাকে এখন বেরতে হবে...

ঠিক আছে বেরবি নয় কিন্তু তার আগে আমার কথাটার উত্তর তো দিয়ে যা।

কোন কথার উত্তর?

ঐ যে তোকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আসা থেকে কেন আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছিস, বল না বাবা আমি কী কিছু ভুল করেছি?

তুমি সত্যিই এবার আমায় কিন্তু ইরিটেট করছ, কতবার তো তোমায় বলেছি যে আই অ্যাম অলরাইট, কিচ্ছু হয়নি আমার, একটু থামে উজান, তারপর ওর গলার স্বরটাও যেন বদলে যায়, একটা কথা বলি, আমার কী মনে হয় জানো মা, কখনো কখনো কিছু কথা আলোচনা না করাই ভালো, তাতে অনেক সময় অনেক অপ্রিয় পরিস্থিতির থেকে মুখোমুখি হওয়া এড়ানো যায়, যেরকম আছি আমরা সেরকম থাকাই মনে হয় ভালো, তাতে দেখবে বোথ অফ আস উইল রিমেন হ্যাপি।

যেরকম আছি মানে! কী বলতে চাস তুই, শুভ্রার গলাটা আবার যেন চড়ছে।

বললাম না সব সময় সব কথা খুলে বলা যায় না বা বলাটা ঠিক নয়।

উজান, তুই আমার ছেলে আর আমি তোর মা, আমার মনে হয় না যে আমাদের মধ্যে কোনো আড়াল থাকা জরুরী, তোকে আজ বলতেই হবে যে তোর কোথায় সমস্যা, কেন তুই এরকম করছিস, আই ওয়ান্ট টু লিসন।

দরজার ওপারে কিছুক্ষণের নীরবতা আর সেই নীরবতা ভেদ করে শুভ্রার গলাই আবার ভেসে এলো, কী রে, অমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, উত্তর দে, তুই তো ভালো করেই জানিস যে তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই আর সেই তুই যদি আমার সঙ্গে এরকম বিহেভ করিস তাহলে কী নিয়ে বাঁচব বল তো, শুভ্রার গলাটা যেন আবার ধরে আসল।

আর সেই অভিমানের ছোঁয়ায় উজানের বুকে জমে থাকা পাথরটাও যেন গলতে শুরু করলো এবার। আমিও তো এতদিন ধরে সেটাই জেনেছি বা জেনে এসেছি মা, ছোটবেলা থেকে তাই নিজেকে সব সময় বলে এসেছি ঠিক আছে উজান, তোমার বাপী না হয় তোমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে, তোমার অন্য বন্ধুদের মত তুমি না হয় তোমার বাবার সাহচর্যে বড় হয়ে উঠতে পারনি বা পারছ না, কিন্তু তাতে কী হয়েছে, তোমার মা তো রয়েছে, সে তো তার জীবনের সব কিছু দিয়ে তোমায় বড় করে তুলছে ...

ছেলেকে ইন্টারেপ্ট করে শুভ্রা বলে ওঠে, সেটা কি আজ তোর ভুল বলে মনে হচ্ছে?

না মা, ভুল নয়, তবে কী জানো, এই কথাগুলো যেমন সত্যি তেমনি আমাদের জীবনে আরো কিছু সত্যি আছে যা তুমি এতদিন ধরে সযত্নে আমার থেকে আড়াল করে রেখেছ।

আরো কিছু সত্যি ! আমাদের জীবনে! কী বলছিস! কোন সত্যি তোর থেকে আমি আড়াল করে রেখেছি ! শুভ্রার গলায় অজানা এক উদ্বেগ যেন।

জানি না কথাগুলো তুমি কীভাবে নেবে, কিন্তু এটা তো ফ্যাক্ট যে ছোটবেলা থেকে যে কথাগুলো তুমি বলে এসেছ বা যা শুনে আমি বড় হয়ে উঠেছি সেগুলোর মাঝে কিন্তু অনেক ফাঁক আছে, এই যে অন্যান্য ছেলেদের মত আমার একটা সুস্থ সংসারে বড় হয়ে ওঠা হলো না তার জন্য কিন্তু বাপীই শুধু দায়ী নয়, আই থিংক, ইউ আর অলসো ইকোয়ালি রেসপন্সিবেল, রাদার আমি তো বলবো যে বাপীর থেকে তোমার ভুলটা অনেক বড়, একটু থামে উজান, খুব কঠিন সত্যি কিন্তু এটাই হচ্ছে বাস্তব, মা, তোমার হাত দিয়েই কিন্তু আমাদের সংসারের ভাঙনটা আসলে শুরু হয়েছিল, চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে ওঠে উজান।

আমার হাত দিয়ে আমাদের সংসারের ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল! কী বলছিস তুই উজান?

হ্যাঁ মা, এই জন্যই তো বললাম কথাগুলো তোমার হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানো, এটা সত্যি, উজানের গলার স্বরটা এবার যেন একটু উদাস, জানো মা, কিছুদিন আগে একটা বই পড়ছিলাম, সেখানে একটা লাইন আছে, এই পৃথিবীর ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনারই দুটো দিক আছে, অথচ বেশীরভাগ সময়ই আমরা ঘটনার একটা দিক দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, দিস ইস নট ফেয়ার, ছোটবেলা থেকে তুমি বলে এসেছ যে বাপী তার নিজের সুখ খুঁজতে গিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে বা নিজের সাফল্যের দিনে বাপী তোমাকে বা আমাকে আর তার পাশে রাখাটা জরুরী বলে মনে করেনি, কথাগুলি শুনতে শুনতে জানো তো আমিও কিন্তু বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, তারপর ...

তারপর কী?

তারপর ... মা, এই গল্পের আরো একটা দিক আছে কিন্তু, আর সেই দিকটা সযত্নে তুমি এতদিন ধরে আমার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছ, বাপীর মুখ থেকে সেদিন যদি ঐ কথাগুলি আমি না জানতাম তাহলে হয়তো আজও বিশ্বাস করতাম যে আমার বা আমাদের জীবনের সমস্ত ট্রাজেডির জন্য বাপীই আসলে দায়ী...

বাপী তোকে কী বলেছে আর বাপীর সঙ্গে তোর দেখাই বা হলো কবে?

ও হ্যাঁ, তোমায় বলা হয়নি, কোলকাতায় আসার কিছুদিন আগে বাপী দেরাদুনে এসেছিল, আচ্ছা মা, একটা কথা বলো তো, ঐ যে কুশল কর বলে ভদ্রলোক যার আজ এখানে আসার কথা, উনি আসলে কে হন, আই মিন আমাদের সংসারে ওনার ভূমিকাটা ঠিক কী, আমার বা বাপীর সঙ্গে তো ওনার কোনো সম্পর্ক নেই বা কোনদিন ছিল না, তোমার থ্রুতেই তো এই ভদ্রলোক আমাদের সংসারে ঢুকেছেন, ক্যান ইউ টেল মি, তোমাদের দুজনার আসল সম্পর্কটা ঠিক কী?

দরজার এপাশে দাঁড়িয়েও আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা হিম-স্রোত বয়ে যাচ্ছে এখন। শুভ্রাও যেন উজানের এমন সরাসরি করা প্রশ্নে একটু থতমতই খেয়ে গেলো, উনি কে মানে, উনি আমার বন্ধু, তোকে তো বলেছি কুশলদা এক সময় আমাকে পড়াতেন, সেই থেকেই আমাদের চেনাশোনা, তোকে বলিনি এসব?

শুভ্রাকে থতমত খেতে দেখে উজান যেন আরো আক্রমণাত্মক এখন, মা, ওভাবে মেঝের দিকে তাকিয়ে কথা বলো না, প্লিজ লুক এট মি, আমার চোখের দিকে তাকাও, কুশল কর কি শুধুই তোমার বন্ধু, তোমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই?

উজান, আমার মনে হয় তুই তোর অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস।

অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি! উজানের গলায় এক রাশ বিদ্রূপ, কথাটা কিন্তু আমি শুরু করিনি, তুমিই আজ বাধ্য করেছ আমায় এসব নিয়ে আলোচনা করতে, তুমিই রিপিটেডলি এতক্ষণ ধরে বলেছ যে আমি যেন বলি আমার কী হয়েছে, কেন আমি আমার মনের সব কথা তোমায় খুলে বলছি না, আর এখন যখন আমি আমার মনের কথা বলতে শুরু করলাম তখন কিন্তু তুমি নিজেকে লুকোতে চাইছ, দিস ইজ নট ফেয়ার, আর অধিকারের কথা বলছ, তুমি আমার মা, তোমার আচরণ নিয়ে যদি সমাজে কোনো প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি ছেলে হিসেবে আমার অধিকার নেই সে বিষয়ে তোমায় প্রশ্ন করার, বলো মা, কুশল করের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঠিক কী, কে হন ঐ ভদ্রলোক?

বললাম তো, উনি আমার বন্ধু, উই আর গুড ফ্রেন্ডস, আর তাছাড়া আমি তো বুঝতে পারছি না যে আমাদের পারিবারিক ডিস্টারবেন্সের সঙ্গে কুশলদার কী সম্পর্ক, শুভ্রা যতই লুকনোর চেষ্টা করুক ওর গলার স্বরে কিন্তু ওর মনের ভিতরের অস্থিরতা ভীষণ ভাবে ধরা পড়ছে এখন।

সম্পর্ক আছে মা, কারণ ঐ লোকটার জন্যই বাপী সেদিন আমাদের সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

আমার পায়ের তলার মেঝেটা যেন কেঁপে উঠছে, না উজান, এটা তোমার ভুল ধারণা, বিশ্বাস করো, তোমার মায়ের আর তোমার বাপীর যখন ছাড়াছাড়ি হয়েছিল আমি তখন ওদের থেকে অনেক দূরে ছিলাম, বন্ধ দরজার ওপার থেকে শুভ্রার গলা ভেসে আসলো আবার, কী বললি, কুশলদার জন্য তোর বাপী এই সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তোর বাপী তোকে এই সব বুঝিয়েছে?

বাপী কেন বোঝাবে, আমার নিজের কি এখনও সেই বয়স হয়নি যে বয়সে মানুষ নিজের মত করে সব কিছু বুঝতে পারে বা বোঝার চেষ্টা করে, আর বাপীর বোঝানোর কথা বলছ, তা বাপী যদি সত্যিই এ কথা আমায় বুঝিয়ে থাকে তাহলে কি খুব ভুল বুঝিয়েছে, শোনো মা, লিসন, তুমি স্বীকার করতে না চাইলেও বাস্তবটা হচ্ছে যে বাপীকে তুমি কোনদিনই ভালবাসনি, বাপীর সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই ঐ লোকটার সঙ্গে তোমার একটা সম্পর্ক ছিল আর সেই সম্পর্কটা ভেঙ্গে তুমি কোনদিনই বেরিয়ে আসতে পারনি বা আরো সত্যি করে বলতে গেলে বলতে হয় বেরিয়ে আসতে চাওনি …

না উজান, তুমি আবারও ভুল করছ, এটা ঠিক যে অল্প বয়সে আই মিন তোমার মাকে যখন আমি পড়াতাম তখন তোমার মায়ের দিক থেকে আমার প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল কিন্তু সেটা যেমন তোমার মায়ের তরফ থেকে এক তরফা ছিল তেমনি ওটা একটা সাময়িক মোহ ছিল, আর তাই তোমার মা সেই মোহ ভেঙ্গে তোমার বাবার প্রেমে পড়েছিল, আর একটা কথা যেটা হয়তো তোমার মা কখনো তোমায় বলেনি সেটা কিন্তু তোমার জানা দরকার, আসলে এই কথাটা জানা না থাকলে তুমি হয়তো তোমার মাকে কখনই ঠিক মত বুঝে উঠতে পারবে না, তোমার বাবাকে বিয়ে করার জন্য তোমার মা কিন্তু তার জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, তুমি জানো না উজান, তোমার তখনও জন্ম হয়নি, আমি কিন্তু দেখেছি, সন্তোষপুরে তোমাদের সেই চিলেকোঠার ঘর, আমি দেখেছি আজীবন ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত একটা মেয়ে কিভাবে সেদিন মুখ বুঝে দারিদ্রের সঙ্গে লড়ে গিয়েছিল, দুবেলা পেটে ভাত নেই, পরনে শতচ্ছিন্ন পোশাক, তবু তোমার মা কিন্তু সেদিন তোমার বাবার সম্মান রক্ষার্থে একের পর এক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল, তুমি বলবে এসব ভালবাসা নয়! এসব সব মিথ্যে! আমি আবারও বলছি, ভুল করছ উজান, সমুদ্র আর তোমার মায়ের জীবনে সত্যিই আমি কোনদিন ছিলাম না, তোমাদের সংসারের ভাঙনের জন্য আমি কোনভাবেই দায়ী নই, দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই যেন কথাগুলো বলে যাচ্ছি আমি।

দরজার ওপার থেকে উজানের গলার আওয়াজ এখনও ভেসে আসছে, বাপী ওনাকে পছন্দ করত না, সে কথা জানার পরও দিনের পর দিন কেন তুমি বাপী যখন বাড়িতে থাকত না তখন ঐ লোকটাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গল্প করতে, বলো মা, চুপ করে রয়েছ কেন, এসব কি সত্যি নয়, আসলে কী জানো, বাপীর সেন্টিমেন্টকে কোনদিনই তুমি ইমপরটেন্স দাওনি, আর কেন দাওনি সেটাও আমি জানি, কারণ বাপী জীবনে তখন এসটাবলিশড ছিল না, এট দ্যট পিরিয়ড অফ লাইফ হি ওয়াজ জাস্ট এ স্ট্রাগলিং সিঙ্গার, সাফল্যের ছোঁয়া তখনো যে বাপীর জীবনে আসেনি...

উজানকে তার কথা শেষ করতে দেয় না শুভ্রা, চিৎকার করে ওঠে, প্লিজ চুপ কর, জানিস না পাগলের মত তুই কীসব বলে যাচ্ছিস।

পাগলের মত নয় মা, যা বলছি তা ভেবেচিন্তেই বলছি, আমি জানি, কথাগুলি তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু কী করব বলো, এগুলিই তো বাস্তব, এই যে সবাই বলে আমার জন্য নাকি তুমি তোমার জীবনের সমস্ত কিছু উজাড় করে দিয়েছ তারা কিন্তু এটা জানে না যে আমার জন্মের আগেই ঐ নোংরা লোকটার কথায় তুমি আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, এখন কী মনে হয় জানো, সেদিন যদি তুমি সত্যিই আমায় মেরে ফেলতে তাহলে হয়ত ভালো হতো, একটা দীর্ঘশ্বাস যেন উজানের বুক চিরে বেরিয়ে আসে, আজ তাহলে আর এ যন্ত্রণা নিয়ে আমায় বেঁচে থাকতে হত না, কেন যে বাপী তখনই ঠিক কাজটা পেয়ে তোমায় নিয়ে মুম্বাইতে চলে গেলো কে জানে, না গেলেই মনে হয় ভালো হতো, আমাকে তাহলে আর এ পৃথিবীর মুখ দেখতে হতো না, বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে ছেড়ে একা-একা বড় হয়ে ওঠার যন্ত্রণা যে কী ভীষণ... উজানের গলার স্বরটা ক্রমশই ধরে আসছে, বিশ্বাস করো মা, সব কথা জানার পর ছোটবেলা থেকে তোমায় যে শ্রদ্ধার চোখে এতদিন দেখে এসেছি সেটা আর কন্টিনিউ করতে পারছি না, আর তার জন্য তুমি যদি আমায় অ্যাকুইজ করতে চাও প্লিজ করো কিন্তু আই অ্যাম হেল্প-লেস, আমি বলছি না যে বাপী যা করেছে তা ঠিক, কিন্তু বাপী অ্যাট-লিস্ট আমার সঙ্গে কোনদিন লুকোচুরি করেনি যেটা তুমি এতদিন ধরে আমার সঙ্গে করে এসেছ।

শুভ্রার গলায় ওর হারানো আত্মবিশ্বাসটা যেন আবার ফিরে আসছে, আচ্ছা, একটা কথা বল, এতদিন তুই আমায় এই প্রশ্নগুলি করিসনি কেন?

ঐ যে বললাম না এতদিন ধরে তুমি খুব যত্ন সহকারে আমাদের জীবনের এই সত্যিগুলি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে, ইনফ্যাক্ট গতবার এখানে আসার আগে আমি তো কুশল কর বলে কাউকে চিনতামই না, আই কান্ট রিমেম্বর তার আগে তুমি কখনো ওনার কথা আমায় বলেছিলে কি না, অথচ যে ভদ্রলোকের কথা ভেবে তুমি কোলকাতায় ফিরে এলে তোমার কি মনে হয় না যে তার কথা আমায় আগেই বলা উচিৎ ছিল তোমার।

কী বলছিস! কে বললো তোকে কুশলদার জন্য আমি কোলকাতায় ফিরে এসেছি!

আমি জানি, আচ্ছা তুমি অস্বীকার করতে পারবে যে এই স্কুলে চাকরি পাওয়ার সময় তোমার কাছে মুম্বাইয়ের পোস্টিংয়ের অপশন ছিল না?

ছিল তো, কিন্তু মুম্বাইয়ের পোস্টিং কেন নেইনি সেটাও তোর জানা, ইনফ্যাক্ট তুইই আমাকে তখন কনভিন্স করেছিলি যে পুনেতে একা একা থাকতে তোর অসুবিধে হবে না।

করেছিলাম, কিন্তু তখন তুমি আমায় ভুল বুঝিয়েছিলে, তুমি বলেছিলে মুম্বাইতে থাকলে বাপীর জন্য তোমায় অকওয়ার্ড সিচুয়েশন ফেস করতে হতে পারে, তাই তুমি কোলকাতায় পোস্টিং নিতে চাইছ, তোমার কথা সেদিন আমি অন্ধের মত বিশ্বাস করেছিলাম আর তাই তোমায় বলেছিলাম, ঠিক আছে, তুমি যাও, আমার জন্য ভেবো না, আই শ্যাল বি ক্যাপাবেল এনাফ টু টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ, কিন্তু আজ বুঝি, সেদিন কেন তুমি মুম্বাইয়ের পোস্টিং নিতে চাওনি, আসলে ঐ কুশল করের জন্য তুমি কোলকাতায় ফিরে আসতে চাইছিলে ... একটু থামে উজান, তারপর আবার বলে ওঠে, এনিওয়ে, ছাড়ো এসব, আমার এখন বেরতে হবে আদার ওয়াইজ দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাবে আর তাছাড়া আই ওয়ান্ট টু লিভ দ্য হাউস বিফোর দ্যট স্ক্রাউন্ডেল ...

উজান! চিৎকার করে ওঠে শুভ্রা, কী বললি, পড়াশুনা করে এরকম অভদ্রের মত কথা বলছিস কেন! গুরুজনদের সম্মান করাটাও কি ভুলে গিয়েছিস!

গুরুজন! ওনাকে গুরুজন বলে প্লিজ গুরুজন কথাটার সম্মানহানি করো না! হি ইজ নাথিং বাট এ, একটু থামে উজান, কী যেন বলে, হ্যাঁ, দুশ্চরিত্র, লম্পট টাইপের একটা মানুষ, নিজের ঘরে বৌ আর মেয়ে থাকতে যে অন্যের ঘর ভাঙ্গে তাকে আমি ঘৃণা করি এন্ড ওয়ান মোর থিং, এরপরেও যদি ঐ লম্পট লোকটার সঙ্গে তুমি কোনো সম্পর্ক রাখো তাহলে এবার কোলকাতা ছেড়ে আমি যে যাব তারপর আমাদের আর কোনদিন দেখা নাও হতে পারে ... ওকে মা, আমি বেরলাম ...

শুভ্রার ফ্লাটের দরজা ছেড়ে চট করে সরে আসি, উজান দরজা খুলে বেরনর আগেই সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করি, ওপরে লিফটের দরজা খোলার আওয়াজ, মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে, কুশল কর একজন লম্পট, সে একজন দুশ্চরিত্র, না, উর্মি নয়, আজ উজানের মত একটা বাচ্চা ছেলে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছে, অথচ উজান যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন আমি কিন্তু পারিনি ওদের বন্ধ দরজা ঠেলে উজানের মুখোমুখি হতে, পারিনি উজানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে, উজান, বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের ঘর ভাঙ্গিনি, হতে পারে একটা ঘরের ইচ্ছে আমার বহুদিনের, একটা ঘর, যেখানে আশ্রয় থাকবে, যেখানে সম্পর্ক থাকবে, যেখানে দিনের শেষে ঘরে ফেরার জন্য মনের ভিতর আকুলি বিকুলি থাকবে, কিন্তু ঐ ঘরটা না পেলেও যাদের ও ঘর আছে তাদের সেই ঘর কিন্তু কখনই আমি ভাঙ্গতে চাইনি... না, না, আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, এতদিন ধরে নিজের সম্পর্কে আমার যে ধারনাটা আমি বহন করে আসছি সেটা মনে হয় সত্যি নয়, উর্মিই মনে হয় ঠিক, উজান ঠিকই আজ আমায় চিনতে পেরেছে, আমি সত্যিই একটা লম্পট, একটা দুশ্চরিত্র, আসলে সম্পর্ক জিনিসটাই আমি মনে হয় ঠিক মত হ্যান্ডল করতে পারি না, আর তাই আমার কাছের লোকগুলো এক এককরে সব দূরে সরে যাচ্ছে...

সিঁড়ি বেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসি, উজানকে দেখলাম আবাসনের মেন দরজাটা পার করে রাস্তার দিকে হেঁটে গেলো, নিজেকে লুকোতে আমি মেন গেটটা আড়াল করে যে গাড়িগুলি দাঁড়িয়েছিল তার পিছনে এসে দাঁড়ালাম, পকেট হাতড়াচ্ছি, একটা সিগারেটের খুবই প্রয়োজন, ফোনটা বাজছে, আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক-ভাগী, চেনা রিংটোনে, শুভ্রার নম্বর থেকে ফোন এলে এই গানটাই রিং টোন হয়ে বাজে, ফোনটাকে বাজতে দেই, ধরি না, সিগারেট শেষ করে এক সময় আবাসনের গেটটা পার করে রাস্তায় নেমে আসি।




ঝিনুকের গলার আওয়াজটা খুব ক্ষীণ হয়ে কানে ভেসে আসলো, ও বাবা খাবে না, মা তো সেই কখন থেকে ভাত বেড়ে বসে আছে, উর্মিও একবার এসে ডেকে গিয়েছে, কী হলো, খাবে না, সাড়া না পেয়ে নিজের নাকটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে বুঝতে চেষ্টা করলো যে আজও মদ গিলে এসেছি কি না, না উর্মি, আজ আমি মদ খাইনি, কুশল কর একজন লম্পট, দুশ্চরিত্র, সে অন্যের সংসার ভাঙ্গে, উজানের মুখ থেকে উচ্চারিত ঐ শব্দগুলিই আজ আমাকে হুইস্কির কিক দিয়েছে, সব নার্ভগুলি আমার এখন অবশ, ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞাসা করলো, স্যার, শরীর খারাপ নাকি, নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, না ভাই, মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছে, বাড়ি ফেরার সময় জানলার কাঁচটা পুরো নামিয়ে শরীরটাকে ব্যাক সিটে এলিয়ে দিলাম, না উজান, তুমি ঠিকই বলেছ, সত্যিই আমি একটা ভীষণ ফালতু টাইপের মানুষ, সত্যিকারের লম্পট, কিন্তু আজ তোমায় আমি প্রমিস করছি, ইয়েস, আই প্রমিস ইউ, তোমার মায়ের জীবনে আমি আর কোনদিন ফিরে আসব না, আমি চাই না তুমিও আমার মত তোমার মাকে হারাও, আমার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি মাকে হারানোর যন্ত্রণা কী ভয়ংকর, আমি চাই না তোমার জীবনে তুমি সেই যন্ত্রণা পাও, তাই আজ থেকে আমি আর কোনদিন তোমাদের মা-ছেলের মাঝে এসে দাঁড়াব না, আই প্রমিস, আই প্রমিস ইউ, ইনফ্যাক্ট এই চেনা দুনিয়াটা ছেড়েই আজ আমি হারিয়ে যাব, ঐ যে আমার কবি মশাই বলেছেন

“... সব মৃতদেহ, তারা বাড়ি ফেরে না আর, অফিস করে অন্য এক জন, কাগজ পড়ে অন্য একজন, ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে আনা নেওয়া করে, অন্য অন্য অন্য অন্য অন্য একজন... কেবল এক একজন কবি মাঝে মাঝে তার চুল্লীর মধ্যে মাথা ঢোকায়, টগবগ করে ফুটে ওঠে ঘিলু ... এক সময় খুলি ফেটে সমস্ত মস্তিষ্ক মেঘ হয়ে উড়ে যায়, খুঁজে বেড়ায় সেই সব আগুনের গোলককে যারা মরুভূমিতে পর্বতপ্রান্তে, অজানা সমুদ্রতীরে অস্ত যাচ্ছে এখনও ...”

অজানা এক সমুদ্র তীরে অস্তমিত হয়ে যাব আমি আজ, কী হবে বেঁচে থেকে, মানুষ বাঁচে তার সম্পর্কের মাঝে, ঝিনুক ছাড়া আজ আমার কোনো সম্পর্কই তো আর অবশিষ্ট নেই, সব সম্পর্ক রহিত হয়ে আজ আমি এক শবের মত বেঁচে আছি, এই জীবনটার সত্যিই আর কোনো মানে হয় না, এ মনটাকে কেউ কোনদিন বোঝেনি আর বুঝবেও না, তাই বেঁচে থাকা আমার কাছে আজ শুধু মাত্র কিছু কর্তব্য পালন, কিছু দায়িত্ব পালন, আমি আর যন্ত্রের মত নিজের এই শবটাকে বয়ে বেড়াতে পারছি না, তার চেয়ে আমি আজ না হয় হারিয়েই যাব, জানি ঝিনুকের কাছে জবাবদিহি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, থাক, বড় হয়ে ও না হয় নিজের মত করে তার বাবাকে বুঝে নেবে, আর সেই বোঝায় যদি কোনো ফাঁক থাকে কী আর করা যাবে, পৃথিবীতে আরো একজন হয়ত সেদিন বলবে, দ্যট ম্যান ওয়াজ এ ইউজলেস গাই, একটা লম্পট, একটা দুশ্চরিত্র, একটা মাতাল, জীবনে যে শুধু হেরেই গিয়েছে ...

বাড়ি ফিরে ল্যাপটপের ব্যাগের পকেট হাতড়ে অ্যাটিভানের স্ট্রিপগুলো বের করে নিলাম, কিছুদিন আগে রাতে ঘুম আসছিল না বলে আরোগ্য মেডিক্যালের ছেলেটাকে পটিয়ে স্ট্রিপগুলো কিনে এনেছিলাম, অনেকগুলো দানা এখনও স্ট্রিপের গায়ে সারি সারি করে সাজানো, গুনলাম না, যে কটা দানা ছিল হাতের তালুতে ঢেলে জল দিয়ে গিলে ফেললাম, ঘুম আসছে, ভীষণ ঘুম আসছে, ঘুমের মধ্যে যেন এক অজানা দিগন্তে মুছে যেতে যেতে আমি ক্রমশ এক বিন্দুতে পরিণত হচ্ছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বিন্দুটাও হয়ত চিরতরে হারিয়ে যাবে...

“দিগন্তে, যেখানে সমুদ্রের শেষ, সেইখানে

কালো পাথরটাকে ভাসিয়ে রেখে তুমি

নৌকো নিয়ে ফিরে গেলে

তারপর তার পাশ দিয়ে কত সূর্য ডুবল

চাঁদ মুখ বাড়ালো কত”

আর আমাকে খুঁজে না পেয়ে

“কালো জলের ওপর দিয়ে ফিরে যাচ্ছে

তোমার সেই নৌকো...”


যেও না কালোমেয়ে, শেষযাত্রায় আজ আমায় একটু সঙ্গ দাও, তোমার নৌকায় না হয় পার করে দাও দিগন্তের ওপারে সেই ঘুমের দেশে আমায়, একদিন তুমি শুনতে চেয়েছিলে, আজ যাওয়ার আগে তোমাকেই না হয় বলে যাই আমার না বলা সেই কথাগুলো, কথাগুলো শুনতে শুনতে শেষবারের মত একবার তোমার হৃদপিণ্ডে আমায় না হয় একটু জায়গা করে দিও, জায়গা করে দিও তোমার সেই সবুজ হৃৎপিণ্ডে যা আমার জন্য তুমি বারবার ফোয়ারা করে দিয়েছ, জানো কালোমেয়ে, নিজের বলে যা কিছু ছিল আজ সকাল থেকে তা এক এক করে আমি বিলিয়ে দিয়ে এসেছি, ট্রেনের গার্ড-সাহেবের হাত থেকে সিগন্যালের সবুজ পতাকা নিয়ে আজ আমিই তা শূন্যে উড়িয়েছি, মায়ের ট্রেনটাকে প্লাটফর্ম থেকে বহুদূরের এক অজানা সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হৃৎপিণ্ডের যে প্রকোষ্ঠে এতদিন ধরে উর্মির প্রতি আমার ভালবাসাকে সযত্নে তুলে রেখেছিলাম সেই প্রকোষ্ঠের সমস্ত শিরা-ধমনীও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে এসেছি, প্রকোষ্ঠের সমস্ত কোনা কোনা থেকে ভালবাসাদের টেনে বার করে তা মুক্ত করে দিয়েছি, আর সব শেষে স্মৃতির মালাগুলো ভাসিয়ে দিয়েছি নদীর জলে, কালোমেয়ে, একবার তাকাও তুমি, তোমার সেই চেনা মানুষটাকে আজ হয়ত তুমি খুঁজে পাবে না, হারিয়ে গিয়েছে সে, হারিয়ে গিয়েছে সে চিরদিনের মত, তার জায়গায় দেখবে সম্পূর্ণ এক অচেনা মানুষ, যাকে আগে কখনো তুমি দেখনি, যার নিঃশ্বাস তোমার অচেনা, যার তাকানো তোমার অপরিচিত, যার ধকধক শুনলে তোমার মনে হবে এ অন্য কেউ, আর তাই তুমি হয়ত তাকে ফিরিয়ে দেবে আজ, ভালবাসবে না তাকে

কিন্তু যদি ভুল করে ভালবেসে ফেলো, যদি ভুল করে তোমার বুকে আবার তাকে জায়গা দাও তাহলে দেখবে প্রথমবারের জন্য তার চোখে কিন্তু আজ ভয় ... হ্যাঁ কালোমেয়ে, সত্যিই তার চোখে আজ তুমি দেখবে এক অজানা আশংকা ... কারণ তুমি যদি সত্যিই আমায় আবার ভালবেসে ফেলো ... জানি না কালোমেয়ে... সত্যিই আমি জানি না ... সত্যিই যদি তুমি আমায় আবার নতুন করে ভালবেসে ফেলো তাহলে তোমার সেই ভালবাসা আমি ফিরিয়ে দিতে পারব কি না ... হয়তো পারব না ... তুমি বলবে কেন ... তাহলে বলি ... হয়ত তুমি বিশ্বাস না-ও করতে পারো ... তবু জেনে রাখো ... উর্মি নয়, শুভ্রা নয়, টিয়া নয় ... তোমাকেই আমি সত্যিকারের ভালবেসেছি ... কারণ এ জীবনে তুমিই শুধু আমায় বুঝতে পেরেছ ... তোমার কাছে আমি তাই খুঁজে পেয়েছি আমার সেই ঘর যেখানে আমার জন্য তোলা থাকে এক টুকরো আশ্রয় … কিন্তু কালোমেয়ে তুমি যে সত্যিকারের মানবী নও, তুমি তো আসলে আমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠা এক অলীক কল্পনা মাত্র … আমার মন থেকেই তো তোমার সৃষ্টি … তাই কোনদিন তোমায় আমি ছুঁতে পারিনি … তবু যাওয়ার আগে তোমাকেই না হয় বলে যাই আমার না বলা সেই কথাগুলি ... মনের খাতায় না হয় তুমি লিখে নিলে সেই কথাগুলো লেখা-না লেখা কবিতার শব্দ দিয়ে



“একদিন কোনো তারা উঠল না।

তাহলে দিক চিনব কী করে?

তাই আর বাড়ি গেলাম না।

ওই মাঠেই শুয়ে পড়লাম। একটা রাত্রির কোনোমতে

কাটিয়ে দেওয়া নিয়ে কথা।

ঘুম আসতেই পাশের মাঠটি ওদিক থেকে তার

হাত বাড়িয়ে দিল। আঙুলে আঙুল বেঁধে ফেলল।

টানল আমাকে। আমি

পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে ওই মাঠের ওপর

উপুড় হয়ে পড়ে চুম্বন করতে লাগলাম তাকে চুম্বন করতে করতে

নেমে গেলাম কোথায় কোন কবরে

ঘোর যখন ভাঙল, তখন পিঠের উপর মাটি,

স্তূপ স্তূপ মাটি,

পিঠের ওপর আস্ত একটা জনপদ



এখন, এই কবরের মধ্যে থেকে যাওয়া ছাড়া

এই সমস্তটা পিঠে নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া

এই অন্ধকারের মধ্যে, আন্দাজে ভর করে

অবৈধ সেই প্রেমের কথা লিখে যাওয়া ছাড়া

আর আমার কোনো উপায় নেই”

ঘুম পাচ্ছে ... ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ... কথাগুলো তাই যেন জড়িয়ে যাচ্ছে ... কালোমেয়ে ... তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ... আমার বলা কথাগুলো কি স্পষ্ট হয়ে পৌঁছচ্ছে তোমার কানে...

“সংকোচে জানাই আজ, একবার মুগ্ধ হতে চাই।

তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।

এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্না-জলে লুণ্ঠিত হবার

আজ দেখি, অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে ...

জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছ।

তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে বলে যে প্রেমিক

ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যা বাগদান

হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।

আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কাল্গ্রন্থি আমি

ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি

আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল

অক্ষত রেখেছ ঐ রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?

শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে

এখনো গোপন করে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা,

সমস্ত যৌবন ধরে ব্যাধি-ঘোর কাটেনি আমার। আমি একা

দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,

জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোৎস্নার ধারনা দেব বলে

এখনো রাত্রির এই মরুভূমি জাগিয়ে রেখেছি।

দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে আজ পাঠালো সংকেত –

যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ কর বধির কবিকে,

সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে

তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার ...

পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি

সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত করে রেখে

উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছ প্রকাশ্য ঝর্নায়!”



আলো জ্বালানো নিষেধ, মেঘে ঢেকে গেছে তারা...

ধুলোবালি মনে স্মৃতিকথা নিয়ে বসে আছি ছাদের কিনারে ... নাবিকরা ঘরে ফেরে এসময়, দুয়ার খোলে তার নারী, তবু সমুদ্র আর চাঁদ আরো একবার যেন আজ আত্মহত্যার স্বপ্ন দেখে ...

নি:শর্ত কবিতার মত তুমি ভেসে গেছ আজ জ্যোৎস্না হয়ে...

শুধু পাহাড়ের বুকে বদলিয়েছ তোমার গতিপথ ...

প্রতিশ্রুতিগুলি কিন্তু থেকে গেছে গোপন কথার মতই সৎ...



... আমি কুশল কর ... বাবা বিশ্বনাথ কর ... মা কাজল কর ... দক্ষিণ কোলকাতার গড়িয়া সংলগ্ন বোড়াল বলে যে জায়গাটা আছে সেখানে আমার জন্ম ...



সমাপ্ত



কৃতজ্ঞতা স্বীকার: কবি জয় গোস্বামী, কবি সুবোধ সরকার;কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ,কবি বিভাস রায়চৌধুরি,লেখিকা বানী বসু,লেখক রূপক সাহা

এবং বিভিন্ন ওয়েব সাইট