বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১৮

১৮

কাল ঝিনুকের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হলো, মেয়েটা এবার নাইন থেকে টেনে উঠবে, পরীক্ষা শেষে কাল ওরা মা-মেয়ে সন্ধ্যার ট্রেন ধরে আসানসোলে গিয়েছে, সঙ্গে ঝিনুকের মামা মামীও আছেন, সবাই মিলে ওরা উর্মির বৌদির বাপের বাড়িতে গিয়েছে ওখানে আমার শালা মশাইয়ের ছোট শালার বিয়ে, আমাকেও যাওয়ার জন্য বলছিল, তা না না করে শেষ অবধি যাওয়াটা আটকিয়েছি, অচেনা মানুষের ভিড়ে আমার মত অন্তর্মুখী পুরুষরা কখনই যেন স্বচ্ছন্দ হতে পারে না, যাই হোক, শুক্র, শনি, রবি সপ্তাহের এই শেষ তিনদিন কার্যত আমি এখন ফোর্সড ব্যাচেলর। আজ শনিবার, সাধারণত শনিবারগুলি অফিস করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এই তিনটে-চারটে হয়ে যায়, আজ অফিস থেকে একটু দেরী করেই বেরলাম, বাড়িতে কেউ নেই, শুভ্রার ওখানে গিয়ে যে একটু আড্ডা মারব তারও উপায় নেই, সকাল থেকে আজ ওর একটা কনফারেন্স চলছে, শেষ হতে হতে সেই সন্ধ্যে, কাল অবশ্য ওর সঙ্গে আমার এক জায়গায় যাওয়ার কথা আছে, বজবজ লাইনে নুঙ্গী বলে যে জায়গাটা আছে সেখানে ওর এক সহকর্মীর বাড়িতে যাব, ভদ্রমহিলার হাজব্যান্ড দিন চারেক হলো মারা গিয়েছেন, সুস্থ সবল মানুষটা অন্যান্য দিনের মতই সেদিনও সকাল সকাল স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, বেরতে মনে হয় একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, তাই বাড়ির সামনের গলিটা পার করে যখন দেখলেন যে রুটের বাসটা স্টপ থেকে ছাড়ব ছাড়ব করছে দৌড়ে গিয়ে রাস্তাটা পার হতে গেলেন, দেখতে পাননি যে পিছন দিক দিয়ে একটা বাস সামনের বাসটাকে ওভারটেক করার জন্য প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে, একদম স্পট ডেড।

রবিবার তো এমনিতেই সেরকম কাজকর্ম থাকে না, আর এই রবিবার বাড়িতেও কেউ নেই, তাই ফোনে কাল যখন শুভ্রা ওর সঙ্গে যাওয়ার কথা বললো রাজী হয়ে গেলাম, ঘরে একা-একা ভুতের মতো বসে না থেকে শুভ্রার সঙ্গে কিছুটা সময় তো অন্তত কাটানো যাবে, কথা হলো সকাল দশটা নাগাদ আমরা টালিগঞ্জ রেল স্টেশনে মিট করব আর তারপর ওখান থেকেই বজবজের ট্রেন ধরব, শুভ্রা ফোনেই জানালো যে কাল নাকি দুপুরে ও আমাকে লাঞ্চও করাবে।

প্রস্তাবটা তো অতি উত্তম, কিন্তু উপলক্ষটা কী জানতে পারি?

উপলক্ষ আবার কী, সেদিন বলছিলেন না যে ইনক্রিমেন্টের জন্য নাকি আমার আপনাকে একটা ট্রিট দেওয়া উচিৎ।

ওঃ দ্যটস গ্রেট, গতমাসে শুভ্রার প্রমোশন হয়েছে, এখন ও ডিপারমেনটাল হেড, খবরটা শুনে সেদিন আমিই ওকে বলেছিলাম যে এসব ভালো খবর খালি মুখে ঠিক মানায় না, ইট শুড বি ফলোড বাই এ পার্টি। বুঝলাম শুভ্রা সেদিনের কথাটা সিরিয়াসলি নিয়েছে, ওকে ম্যাডাম, আপনার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম, কিন্তু ট্রিটটা কোথায় দেবেন তা কী ঠিক করেছেন?

শুভ্রা জানালো যে লিন্ডসেতে একটা নতুন আফগানী রেস্টুরেন্ট হয়েছে, আমার আপত্তি না থাকলে ওখানটায় যাওয়া যেতে পারে, ওখানকার আফগানী চিকেন আর রুমালি রুটি নাকি খুব টেস্টি।

ঠিক আছে তবে কাল তুমি যেমন আমায় ট্রিট দেবে আমিও কিন্তু তোমায় একটা রিটার্ন ট্রিট দেব।

রিটার্ন ট্রিট, নাইস, এতদিন রিটার্ন গিফটের কথা শুনেছি, তা শুনি আপনার এই রিটার্ন ট্রিটের ব্যাপারটা ঠিক কী।

আকাদেমিতে বহুরূপীর একটা নাটক চলছে, চলো কাল নাটকটা দেখে আসি।

শুভ্রা যেন আমাকেই নকল করে বলে উঠলো, আপনার প্রস্তাবটা উত্তম কুশলদা, কাল নাটকটা দেখা যেতেই পারে, হাসতে হাসতে শুভ্রা ফোনটা ডিসকনেক্ট করে দেয়, দেওয়ার আগে আমায় একবার রিমাইন্ড করিয়ে দেয় যে কাল সকাল দশটায় টালিগঞ্জ রেল স্টেশনে আমাদের দেখা হচ্ছে।




কিছুদিন ধরেই কাস্টমারদের ডাটা বেস আপডেটেশনের কাজটা কমপ্লিট করার জন্য বস তাগাদা দিচ্ছেন, আসলে হেড অফিস থেকে বারবার রিমাইন্ডার আসছে, লাঞ্চের পর তাই আজ ঐ জাবদা কাজটা নিয়ে বসলাম, ডাটা-ফিড করার কাজটা একটু বোরিং টাইপের হলে কী হবে ফাইলটা তৈরি হয়ে গেলে কিন্তু ভীষণ উপকারি, ইনডিভিজুয়াল কাস্টমারদের সেন্ট্রালাইজড তথ্য ভাণ্ডারের জন্য এই ফাইলটা তৈরি হচ্ছে। কাস্টমারদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ফ্যাক্স নম্বর, ডিপারমেন্ট ওয়াইস কনসার্ন পার্সনদের নাম উইথ দেয়ার মোবাইল নম্বর এন্ড ই-মেল আইডি, এই সব ডিটেল ছাড়াও আমাদের প্রোডাক্ট পপুলেশনের যাবতীয় খুঁটিনাটি রেকর্ডও থাকবে, ইন নাট-শেল, একটা কাস্টমারকে এক্সেলের একটা পেজে বেঁধে ফেলা আর কী, আজকাল যে কোনো ব্যাপারেই এই ডাটা বেস বানানোর ব্যাপারটা কিন্তু খুব পপুলার হয়েছে, এই তো দু-তিন সপ্তাহ আগে এক শনিবার বিকেলে বাড়িতে দুজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এলেন, সরকার থেকে নাকি ওনাদের মত আরো অনেক ভদ্রমহিলাদের বিভিন্ন বাড়িতে পাঠাচ্ছে সেই সব বাড়িতে বাস করা পরিবারের তথ্য জোগাড় করার জন্য, কোন বাড়িতে কত লোক আছে, তারা কোন কোন সম্পর্কে সম্পর্কিত, প্রত্যেকের বয়স কত, কে কী কাজ করে, এই সব যাবতীয় তথ্য, সরকারী তথ্য-বিদরা এই সব ডাটা নিয়ে নাকি সমাজের বুকে বাস করা মানুষদের শ্রেণী বিন্যাস করবেন, বকোয়াস, মানুষের শ্রেণী বিন্যাস কখনও এই ভাবে করা যায় না। বর্ণ, ভাষা, ধর্ম বা অর্থ সম্পদের ভিত্তিতে যারা মানুষের শ্রেণী বিন্যাস বা বিভাগ করতে চায় তারা আসলে আমার মতে সমাজদ্রোহী, আমি তো মনে করি, সমাজে শুধু দুটো শ্রেণীর মানুষই বাস করেন, ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ, তাদের ডিমার্কেশনটা এত সহজে কিছু কালেক্ট করা তথ্যের ভিত্তিতে করা যায় না বা করা সম্ভবও নয়।

কালু এসে দাঁড়িয়েছে, এই ছেলেটা আমাদের অফিস বয়, স্যার, শনিবারেও তো পুরো অফিস করে ফেললেন, বাড়ি যাবেন না!

ঘড়ির দিকে তাকাই, এই রে, সাড়ে-পাঁচটা বেজে গিয়েছে, না, না, আমার জন্য বেচারার শনিবারের বিকেলটা মাটি হয়ে গেলো, আর দশ মিনিট, তাহলেই ফাইলটা কমপ্লিট হয়ে যাবে, তুই বরঞ্চ ততক্ষণে আমার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আয়।

একটানা এতক্ষণ ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করেছি, তাই মাথাটা ধরেছে মনে হয়, বেশ কিছুদিন হলো চোখেও যেন একটু ঝাপসা দেখছি, শুধু চোখই নয়, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গই আজকাল যেন জানান দিতে শুরু করেছে যে এবার থেকে তাদের নিয়মিত মেন্টেনেন্স করা দরকার, না হলে রেট অফ ডেপ্রিসিয়েশন অ্যাক্সিলারেট করতে পারে, কালু চা নিয়ে এসেছে, চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করলাম। কোমরটাতেও টন-টন করছে, এতক্ষণ একটানা বসে থাকার জন্যই হবে হয়তো, অফিস থেকে বেরিয়ে তাই সামনের বাসস্টপটা থেকে বাস না ধরে পরের স্টপটার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, একটু হাঁটলে হয়তো কোমরের টনটনানিটা কমবে, কতদিন ধরেই ভাবছি সকালে উঠে এবার থেকে একটু হাঁটতে যাব, কিন্তু আলস্যের জন্য সকাল সকাল আর ওঠা হয় না। না, শরীরের ব্যাপারে এবার থেকে একটু সিরিয়াস হতে হবে, অন্তত নিয়ম করে একটু হাঁটা বা এক্সারসাইজ করা দরকার, নইলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিন্তু সত্যি সত্যিই জং ধরে যাচ্ছে।

অফিসের বদ্ধ দেওয়ালের মধ্যে থেকে বুঝিনি যে বাইরে এমন সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, তিরতির করে বইতে থাকা হাওয়ায় শীতের যেন একটা হালকা আমেজ, ঠাকুমা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বলতো, বাবু গায়ে একটা গরম কিছু দিয়ে নে, নইলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে, ঠাকুমা নেই, মা নেই, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বারণ করার মানুষগুলি যেন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, কী অদ্ভুত, যখন ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম কবে বড় হব, কবে বড়দের মত আর বাঁধা নিষেধের বেড়াজাল থাকবে না, আর আজ যখন বড় হলাম, যখন বাধানিষেধের লাল ফিতেটা জীবনে আর ততটা অমোঘ নয় তখন কিন্তু মনে হচ্ছে ছোটবেলাকার ঐ নিয়ম বাঁধা জীবনটাই অনেক ভালো ছিল, আসলে এখন বুঝি, মায়ের, ঠাকুমার বা বাবার ঐ বারণগুলোর মধ্যে যত না নিষেধ মিশে থাকত তার থেকে অনেক বেশী করে মিশে থাকত স্নেহের ছোঁয়া, আর এই ছোঁয়াটাই যেন জীবন থেকে এখন একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে বা গিয়েছে।

বাইরের হাওয়ায় মাথার টিপটিপানিটা একটু কমলো যেন, খেয়াল করিনি, হাঁটতে হাঁটতে কখন পরের বাসস্টপটাও পার করে এসেছি, না, আর হাঁটা যাবে না, কাঁধের ল্যাপটপের ব্যাগটা এবার তার ভার জানাতে শুরু করেছে, সামনের বাসস্টপটায় এসে দাঁড়াই, শনিবারের সন্ধ্যা বলে বাসস্টপটা খালি, অন্যদিন হলে এই সময় অফিস ফেরত যাত্রীর ভিড়ে জায়গাটা একদম থিক থিক করত, সিগারেট খাব বলে ফুটপাথে উঠে বাসস্টপের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা অফিস-বাড়িটার দরজার সামনে যে সিঁড়িটা রয়েছে তার ওপর ল্যাপটপের ব্যাগটা রাখি, মোড়ের স্ট্রীট-ল্যাম্পের বাল্বটা কেটে গিয়েছে, ফুটপাথটা আবছা অন্ধকারে সোমবারের সকাল অবধি যাবতীয় ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে পুরনো অফিস বাড়িটা এখন বিশ্রামে মগ্ন যেন।

সিঁড়িতে আমাকে ল্যাপটপের ব্যাগটা রাখতে দেখে অফিস বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা সিকিউরিটি গার্ডটা একবার চোখ তুলে তাকালো। না, লোকটা আমার মুখে সেরকম কোনো সতর্কতা খুঁজে পেলো না অথবা এই লোকটাও হয়তো আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গিয়েছে যে আমার ভিতরে রাখা বারুদটা আসলে ভেজা বারুদ, তাই ভেজা বারুদ নিয়ে কারোর যেমন কোনো মাথা ব্যথা থাকে না তেমনি এই লোকটাও আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার অফিস বাড়ির দেওয়াল ঘেঁসে উবু হয়ে বসে থাকা ছাতু-ওয়ালার সঙ্গে গল্পে জুড়ে দিলো।

আমাদের স্কুলের সামনে লখণ বলে একটা বিহারী রোজ ছাতু নিয়ে এসে বসতো আর ছুটির সময় আমরা লখণের দোকানে এসে ভিড় করতাম। তেল, নুন, কাঁচা-লংকা আর তেঁতুলজল দিয়ে দারুণ ছাতু মাখত লখণ ভাইয়া, সিকিউরিটি লোকটার সঙ্গে ছাতু-ওয়ালাকে গল্প করতে দেখে আজ আবার সেই লখণ ভাইয়ার কথা মনে পড়ে গেলো, সিগারেটের টুকরোটাকে ছুড়ে ফেলে লোকটার কাছে গিয়ে বললাম, কী গো, ছাতু-মাখা খাওয়াবে নাকি?

এক গাল হেসে টিপিক্যাল বিহারী টোণে লোকটা উত্তর করলো, আপনি খেলে নিশ্চয়ই খাওয়াব।



বাড়ি ফেরার পথে বাসের ভিড়ে মাথার দপদপানিটা কিন্তু আবার ফেরত এলো, মনে হচ্ছে আজ মাথাধরাটা জ্বালাবে, ঘরে গিয়ে দেখি পেন-কিলার কিছু আছে কি না।


খাটের মাথার দিকের ড্রয়ারে সারিডনের একটা পাতা পেয়ে গেলাম, ভালোই হলো, একটা ট্যাবলেট খেয়ে এখন শুয়ে পড়ি, লম্বা একটা ঘুম হলে মাথাধরাটা হয়তো কমবে, ছাতু খেয়ে তখন পাশের পান-বিড়ি-কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকানটা থেকে জলের বোতল কিনে অনেকটা জল খেয়ে নিয়েছিলাম, পেট একদম ফুলে জয়ঢাক, আজ রাতে আর কিছু খাওয়ার দরকার নেই।


“ ... তবু রাত্রি হয়, এক সময় রাত্রি হয়, আর যখন রাত্রি হয়, সমস্ত ধ্বংসের গায়ে যখন ঝরে ঝরে পড়ে কোমল আর নিবিড় জ্যোৎস্না, তখন ধ্বংসাবশেষের গায়ে লতিয়ে ওঠা গাছকে দেখতে পাওয়া যায় তার একমাত্র ফুলটিকে শরীরে নিয়ে দুলছে হাওয়ায়, আর আমি তখন দেখতে পাই লুকিয়ে যাওয়া সব নদীরা আবার চলতে শুরু করেছে, মরুভূমি ভেদ করে সেইসব ক্ষীণ আর স্বচ্ছ-ধারার নদীরা এগিয়ে চলেছে, দিনের বেলায় তাদের দেখা যায় না, কিন্তু এই রাত্রির আলোয় আমি দেখতে পাই কী স্বাভাবিক আর শব্দহীন ভাবে তারা বয়ে চলেছে, চলেছে আর চলেছে, রাত্রি-রেখা পার করে চলেছে ... আর সেই সব নদীর সঙ্গে সঙ্গে নদীর ওপরের আকাশ দিয়ে উড়ে চলেছে, যেন সারারাত তাদের পাহারা দিতে দিতে উড়ে চলেছে, বিশাল আর প্রবল এক পাখি-মানুষ, ডানার বদলে যে হাত দিয়ে সাঁতার দিচ্ছে আর বাতাস কাটছে, তার হাত মাঝে মাঝে ছোঁয়া দিচ্ছে মেঘে আর উছলে উঠছে বিদ্যুৎ, তার হাত মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে তারায় আর ছিটকে নামছে উল্কা, তার একঝাক এলোমেলো চুল নিয়ে খেলছে উন্মাদ বাতাস, তার মাথায় মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে চাঁদ, কিন্তু সে উড়ছে, উড়ছে, সমস্ত ভালোবাসার, প্রণয়ের নদীকে আগলে রেখে সে উড়ছে, সভ্যতা তখন ঘুমন্ত, সমাজ তখন অচেতন, কিন্তু ঐ রাত্রিমরুভুমি জানে, ঐ ধ্বংসাবশেষ জানে, জানে ঐ নিঃশব্দে বয়ে চলা ভালোবাসার নদী বা পথেরাও, যে উড়ে চলছে, সে কেউ নয়, কিচ্ছু নয়, সে কেবল এক কবি ...”

কী গো, মাথার যন্ত্রণাটা কমেনি, তাই না!

কপালে নরম আঙুলের ছোঁওয়া, চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারি যে এ কার আঙুল, নাক টেনে তবু বড় করে একটা শ্বাস নেই, যা ভেবেছি ঠিক তাই, আমার কালোমেয়ের গা থেকে ভেসে আসা চন্দনের গন্ধে ঘর এখন সুবাসিত, কতদিন পরে কালোমেয়ে আজ আবার এলো আমার কাছে, বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে যাই, মানা করে কালোমেয়ে, উহু, একদম উঠবে না, তোমার না সেই বিকেল থেকে কপালে যন্ত্রণা, চুপ করে শুয়ে থাকো।

বিকেল থেকে আমার কপালে যন্ত্রণা, তুমি কী করে জানলে?

আমি তো তোমায় বলেছি, তোমার সব কথাই আমি জানি।

সব কথা জানো!

হ্যাঁ, সব কথা, তোমার শরীর, মন, সব কথা আমার জানা।

আমার মনের কথাও তুমি জানো, কালোমেয়ে?

কেন জানব না, আচ্ছা বলো তো আজ বিকেলে অফিসে বসে তুমি ভাবছিলে না যে বাড়ি না ফিরে আজ মায়ের ওখানে যাবে, রাতটা ওখানেই থেকে আসবে, সত্যি কি না বলো।

তাই তো, সত্যিই আজ অফিসে বসে একবার ভেবেছিলাম, যাই, রাতটা মায়ের ওখানে গিয়ে থেকে আসি, কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া আর হলো না, আসলে নিজের কাছেই নিজে যেন হেরে গেলাম, মনে মনে ভাবলাম, এ তো জোচ্চুরি, উর্মি নেই, তাই আমি যেন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছি, উর্মি বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই মায়ের ওখানে গিয়ে থাকার কথাটা ভাবতে পারতাম না, উর্মির চোখেমুখে লেগে থাকা অদৃশ্য নিষেধের বেড়াজালগুলি যে আজকাল আমি আর কিছুতেই পার করে উঠতে পারি না।

কী গো, আবার কী ভাবতে শুরু করলে?

কই, কিছু ভাবছি না তো।

উহু, কিছু তো একটা ভাবছ, আমি জানি, তুমি উর্মির কথা ভাবছ, ভাবছ যে ও বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনলে উর্মি কি কথাটা ভালো মনে নিত, আমি বলি কী কুশল, অত আর ভেবো না, এখন থেকে মন যা চায় তাই করো। কথা বলতে বলতে কালোমেয়ে তার আঙ্গুল দিয়ে আমার চুলে বিলি কাটতে শুরু করলো, ওর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো আলতো করে চেপে ধরি, কালোমেয়ে, তোমার আঙুলগুলি কী নরম গো!

তাই বুঝি, কালোমেয়ে মুখটা আমার কানের কাছে নামিয়ে আনে, ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করে, তোমার ভালো লাগছে আমার আঙুলের ছোঁওয়া?

এক টানে কালোমেয়েকে আমার নিজের বুকের ভিতর টেনে নেই, আমার একটা উপকার করে দেবে?

বলো কী করতে হবে।

শরীরের যন্ত্রণার মত তুমি আমার মনের যন্ত্রণাটাও একটু বুজিয়ে দাও না প্লিজ, আমি আর পারছি না, আজকাল আমার ভীষণ একা-একা লাগে, খালি মনে হয় আমার চারপাশে কেউ নেই আর আমি যেন ক্রমশ একটা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

আমাকে যেন আরো গভীর ভাবে কালোমেয়ে তার বুকে জড়িয়ে ধরে, আমি এখন ওর প্রত্যেকটা শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, মন খারাপ করো না কুশল, একটা কথা জেনে রেখো, এই পৃথিবীতে তুমিই শুধু একা নও, আমরা সবাইই কিন্তু একা। সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, এসব আসলে আমাদের চোখের সামনে ধরে রাখা কিছু আপেক্ষিক সত্য মাত্র, দেখবে সময়ের সাথে সাথে এই সত্যগুলি তাই বিভিন্ন রূপ নেয়, ভালবাসা মুহূর্তে হয়ে যায় অভিশাপ, স্নেহ রূপ নেয় যন্ত্রণার, আর মনের যন্ত্রণার কথা বলছ, সে তো থাকবেই, তাকে কী করে আর ভোলাবে, মন তো আসলে যন্ত্রণার কথা ভুলতে চায় না, মন তো জ্বলতেই ভালবাসে, পুড়ে যাওয়ার মধ্যেই সে যেন তার সম্পূর্ণতা খুঁজে পায়, দেখো না, পাওয়ার কথা ভুলে মানুষ তাই সব সময় কেমন হারানোর কথাই ভাবতে থাকে।

কিন্তু আমি তো হারানোর কথা ভাবতে চাই না কালোমেয়ে, আমি তো ভুলে যেতে চাই যে এই জীবনে আমি কী কী হারিয়েছি, কিন্তু কেন বলো তো এত চেষ্টা করেও সে সব কথা আমি ভুলতে পারি না?

ঐ যে বললাম না মানুষের মন বড় অদ্ভুত, কারো নিয়ন্ত্রণে সে থাকে না, তুমি বরঞ্চ এসব কথা না ভেবে যেমন আছ তেমনই থাকো, জীবনটাকে উপভোগ করো।

কিন্তু আমি তো এটাই বুঝি না যে আমি কেমন আছি, আজকাল নিজেকে আমার মাঝে মাঝে মৃত বলে মনে হয়।

ধুর, এসব তোমার মনের ভুল, নিজেকে কখনো মৃত মনে করবে না, আসলে মৃত্যু জীবনকে সম্পূর্ণতা দেয় তা সত্যি কিন্তু মৃত্যুর পর জীবন বলে কিন্তু আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, পথের শেষে পৌঁছনর আগে তাই পথটাকে যতটা সম্ভব নিজের মত করে উপভোগ করে নাও, কথাগুলি বলতে বলতে কালোমেয়ের গলার স্বর যেন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে, কালোমেয়ে তুমি কি চলে যাচ্ছ, প্লিজ যেয়ো না, আরো একটু থাকো, অন্ধকারে কালোমেয়েকে আমি জাপটে ধরতে যাই, কিন্তু খুঁজে পাই না, আমার দু হাতের মাঝে এখন অসীম শূন্যতা যেন...

হয়তো বা তোমার বাড়ির সামনের আকাশে মেঘের পরত এখন...

তুমি কি দেখতে পাও না তা!

আসলে যে দিন প্রতিদিন শেষ হয় তারা সব পুরনো মনখারাপ আর তাই তুমি বা আমি আনমনা হয়ে যাই, মনে পড়ে তখন মৃত সেই কোন সম্পর্ক... চোখ মেলে তাকাই...

আর আয়ত চোখে নেমে আসে আবার মৃত সব বৃষ্টিরা ...

কিন্তু জানো এই বৃষ্টি-ফোঁটারা এখন আর আমাদের নয়...

নিজেদের জন্য তো আসলে আমরা আর কাঁদি না...

শুধু মেঘদুটো কখনও কখনও নিঃস্ব হয়ে যায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ...

আর তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে আশ্চর্য সব জটিল প্রেম...আশ্চর্য সব সরল বৃষ্টি...

তুলি ধরেন কবি আবার...

এ গল্পের শুরু হয় আকাশে আয়ত সেই দুই মেঘ নিয়ে...

অভিশাপ নিয়ে যারা বেঁচে থাকে গায়ে বৃষ্টিজল মেখে ...



চোখ মেলি, ঠোঁট-দুটো শুকিয়ে গিয়েছে, গলায় যেন ভীষণ পিপাসা, অন্ধকারে মাথার কাছে রাখা জলের বোতলটা হাতড়াতে থাকি।



ভদ্রমহিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম, উঁচুনিচু রাস্তায় রিকশাটা ক্রমাগত ঝাঁকানি খাচ্ছে, শুভ্রার ডান হাতটা এসে পড়লো আমার গায়ে, এ বাবা, আপনার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, দেখেছেন, তখনই বলেছিলাম যে আপনাকে আসতে হবে না। মাথাধরার সাথে সাথে কাল রাতে জ্বরটাও এসেছিল, মাঝরাতে গলা শুকিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেতে মনে হচ্ছিল সারা শরীরে যেন একটা আগুনের হলকা বয়ে যাচ্ছে, তবে সকালের দিকে জ্বরটা কমের দিকেই ছিল, প্রায় ছিল না বললেই চলে, তাই চা আর ব্রেড টোস্ট খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ে টালিগঞ্জ রেলস্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, শুভ্রা কিন্তু আমার চোখমুখ দেখেই বুঝেছিল যে কিছু একটা হয়েছে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ও তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, কী ব্যাপার কুশলদা, কাল রাতে ঘুমোননি নাকি, চোখগুলো এরকম জবাফুলের মত লাল হয়ে রয়েছে কেন?

সংক্ষেপে কাল সন্ধ্যা থেকে মাথা ধরা আর তার সঙ্গে রাতে জ্বর আসার কথাটা ওকে বলি আর তা শুনে শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে বলে যে আমার আর তাহলে এই রোদ্দুরে এতটা পথ যেয়ে কাজ নেই।

আপনি বরঞ্চ বাড়ি ফিরে বিশ্রাম করুন, আমি একাই ঘুরে আসি।

আমি ওর কথায় পাত্তা দেই না, আরে বাবা, এসব সিজন চেঞ্জের জ্বর, কিচ্ছু হবে না, দু-তিনটে ক্রোসিন খেয়ে নিলেই দেখবে জ্বর সেরে গিয়েছে, সকালে বেরনের আগে ক্রোসিন খেয়েই বেরিয়েছিলাম, জ্বরটা কিন্তু দুপুরের দিকে ফিরে এলো, ভদ্রমহিলার বাড়িতেই পাখার নিচে বসে বেশ শীত শীত করছিল, আর এখন তো মনে হচ্ছে গা যেন একদম পুড়ে যাচ্ছে।

শুনুন, এই শরীরে আপনাকে আর এখন লিন্ডসেতে খেতে যেতে হবে না... শিয়ালদা লোকালের কামড়ায় মুখোমুখি বসে আমরা, শুভ্রার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ওকে বলে উঠি, যা, তাই কখনো হয় নাকি, আমি কী না সকাল থেকে আফগানী চিকেন আর রুমালি রুটি খাব বলে বসে রয়েছি!

ফাঁকা কমপারমেন্টে সামান্য যে কজন প্যাসেঞ্জার ছিলেন তাদের কান এড়িয়ে শুভ্রা বলে উঠলো, একদম পেটুকের মতন করবেন না তো, সুস্থ হন, তারপর আপনাকে আমি আফগানী চিকেন আর রুমালি রুটি খাওয়াব।

ঠিক আছে, কী আর করা যাবে, ম্যাডামের আজ্ঞা মাথা পেতে নিলাম, বাড়িই যাই তাহলে, ফেরার পথে দেখি পটলার দোকানে কী পাওয়া যায়। মুখটায় একটা দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে কথাগুলি বলে উঠলাম।

শুভ্রা আমার কপালে ওর ডানহাতটা রাখলো, ইশ, জ্বরটা তো বাড়ছে মনে হচ্ছে, শুনুন কুশলদা, বৌদিরা তো কেউ বাড়িতে নেই, আপনার এখন আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই, আমার ওখানে চলুন, দুটো যা হোক কিছু মুখে দিয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন, তারপর নিজের মনেই শুভ্রা যেন বলতে থাকে, বিকেলের মধ্যে জ্বরটা না কমলে আপনাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।




মা, সত্যি বলছি, আমার মাথায় এখনো ঢুকছে না যে হঠাৎ করে তুমি হরিদ্বারে গিয়ে থাকতে চাইছ কেন।

বিছানায় বসে মা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ছবি ঘরের লাগোয়া রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমার কথায় সায় দিয়ে ও বলে উঠলো, ঠিক বলেছেন দাদাবাবু, মাসীমাকে একটু বোঝান তো, আমার বা মেশোমশাইয়ের কথা তো উনি কানেই নিচ্ছেন না।

এই মেয়ে, ছবির উপর ছদ্ম রাগ দেখিয়ে মা বলে ওঠে, তোকে বলেছি না, আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি থাকলে যাবি না, আমি অলোককে বলে দেব’খন, ও তোর ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে।

আমি আবার কখন বললাম যে তোমার সঙ্গে যাব না...

ছবিকে তার কথার মাঝে থামিয়ে দেয় মা, বকবক না করে দাদাবাবুর জন্য কটা লুচি আর বেগুন ভেজে নিয়ে আয় তো, ছেলেটা অফিস থেকে ফিরেছে, কোথায় তাড়াতাড়ি করে জলখাবার বানিয়ে দিবি, তা না, সেই তখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে খালি বকবক করে যাচ্ছিস। মায়ের হরিদ্বারে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্তটা নিয়ে পরশু অলোককাকুর সঙ্গে ফোনে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল, কাকুর সঙ্গে কথা বলে যা মনে হলো তাতে বুঝলাম মায়ের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কাকুও আগেভাগে কিছু জানতেন না, ওনার কাছেও খবরটা তাই যেন অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন, তবে কাকুর মুখ থেকেই পুরো ঘটনাটা জানলাম, পন্ডিতদাদুর ওখানে মায়েদের সঙ্গে সুষমা বলে এক পাঞ্জাবী ভদ্রমহিলা গান শিখতে আসতেন, কেন জানি না সেই ভদ্রমহিলার মাকে খুব ভালবাসতেন, ভবানিপুরে ওনাদের গাড়ির স্পেয়ার পার্টসের দোকান ছিল, ছেলেপুলে ছিল না, স্বামীর মৃত্যুর পর তাই উনি কোলকাতার দোকান-পত্র বেঁচে হরিদ্বারে এক আশ্রমে চলে যান আর এখন সেখানেই থাকেন, ঐ আশ্রমটাতে ওনার মত আরো অনেক মহিলা থাকেন যারা ঠাকুরের পূজা, নামগান এসব করার ফাঁকে ফাঁকে দুঃস্থ মহিলাদের জন্য নানা রকম সেবা মূলক কাজকর্মও করে বেড়ান, মায়ের এই সুষমাদি মাস দুয়েক আগে কোলকাতায় এসেছিলেন আর কিভাবে যেন ঠিকানা জোগাড় করে এসে পৌঁছে গিয়েছিলেন মায়ের কাছে। ছবির কথা অনুসারে এই ভদ্রমহিলাই ধীরে ধীরে মাকে প্রভাবিত করেছেন ওনাদের ঐ আশ্রমে গিয়ে থাকার জন্য।

কী গো মা, বললে না তো, হঠাৎ করে তুমি কেন হরিদ্বারে গিয়ে থাকতে চাইছ?

ধুর পাগলা, তুই খালি সব কিছুতে কারণ খুঁজে বেড়াস, আরে, শেষ বয়সে মন একটু ধর্ম-কর্ম করতে চাইছে, তাই যাচ্ছি।

আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে।

শুনি তোর কী মনে হচ্ছে।

একটা কথা বলি মা, দেখো, আমার কোনো ব্যবহারে তুমি যদি কখনো দুঃখ পেয়ে থাকো তাহলে সেটা খোলাখুলি বলো, আমি এখুনি তোমার কাছে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেব, কিন্তু আমাদের সবাইকে ছেড়ে তুমি এভাবে এত দূরে একা একা থাকবে সেটা আমি মেনে নেব না।

তোরা আজকালকার ছেলেপুলেরা যে কী হয়েছিস ভগবানই জানে, সব কিছুতেই খালি তোরা কার্য কারণ খুঁজে বেড়াস, কোনো কিছুই যেন তোরা সোজা চোখে দেখতে পারিস না, এখন যা তো হাত-পা ধুয়ে নে, লুচিগুলি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, আমি যখন খাচ্ছিলাম মা আমার মাথায় হাত রেখে বললো, মন খারাপ করিস না, বুঝিস না কেন মানুষের আলাদা আলাদা বয়সে আলাদা আলাদা কিছু কাজ করার থাকে আর মানুষ যদি বয়স অনুসারে সেই কাজগুলি না করে তখন জীবনটা কিন্তু অসম্পূর্ণ থেকে যায়…

মুখের লুচিটা খেতে খেতেই মায়ের কথার পিঠে বলে উঠি, তোমার সুষমাদি কি তোমায় এসব শিখিয়েছে?

সুষমাদির কাছে কেন শিখতে যাব, আমার এতখানি বয়স হলো, নিজের বোধবুদ্ধি কি এখনো হয়নি!

কে জানে, তোমার কাণ্ড কারখানা দেখে তো আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে তোমার মাথা-ফাথা আজকাল কিছুই কাজ করে না, নইলে কোথাকার কে ভদ্রমহিলা, সে এসে তোমায় বোঝালো, আর তুমি অমনি বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে চললে আশ্রমে থাকবে বলে!

আরে বাবা কতবার তদের বলবো বল তো, কারো কথায় নয়, নিজের ইচ্ছেতেই আমি ওখানে গিয়ে থাকছি, আর শোন, আমি নিজেও সবকিছু খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওখানে আমার বয়সী অনেক মহিলা আছেন যারা বিভিন্ন কাজে-কর্মের মধ্যে দিন কাটান, ওনাদের সঙ্গে থাকলে আমারও বাকী জীবনটা মনে হয় আনন্দেই কেটে যাবে, আর গিয়ে যদি দেখি যে ভালো লাগছে না তখন তো ট্রেনের টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলেই হলো।



না, হরিদ্বারে যাওয়ার ব্যাপারে মা মনে মনে বোধ হয় ঠিকই করে ফেলেছে।



আসবার সময় ট্রাঙ্গুলার পার্ক আর লেক মার্কেটের মাঝামাঝি যে ওষুধের দোকানটা আছে সেখান থেকে শুভ্রা দোকানের ছেলেটাকে বলে আমার জন্য দু ধরনের ট্যাবলেট কিনে নিলো।



ওষুধের কারণেই হোক বা পেটে ভাত পরার জন্যই হোক মোদ্দা কথাটা হলো আমার কিন্তু এখন খুব ঘুম পাচ্ছে, শুভ্রার বেডরুমে আমি এখন শুয়ে আছি, হলঘরে শুভ্রা কিছু করছে, ভেজানো দরজার পাল্লা ভেদ করে মাঝে মাঝেই জিনিসপত্রের নাড়াচাড়ার শব্দ পাচ্ছি, বাড়ি ফিরে শুভ্রা জোড় করে আমার জিভের তলায় থার্মোমিটার গুঁজে দিয়েছিল, প্রায় একশো দুইয়ের মতন জ্বর তখন, শুভ্রা ওদের হাউসিং কমপ্লেক্সের কাছাকাছি যে ডিসপেনসারিটা আছে তখনই সেখানে নিয়ে যেতে চাইছিল, মানা করি, আরে এই যে আসার সময় এত ওষুধ কিনে আনলে আগে সেগুলো খেয়ে দেখি, কথাটা শুভ্রার খুব একটা পছন্দ হয়নি, কিন্তু আমার শরীরের কথা ভেবেই হয়তো অন্য সময়ের মত তর্ক জুড়ে দিলো না, জল আর ওষুধ দিয়ে বললো, ওষুধগুলি খেয়ে শুয়ে পড়ুন, হলঘরেই আছি আমি, দরকার হলে ডাকবেন কিন্তু।

দরকারটা আর হবে কী, অ্যান্টিবায়োটিক এমনই এক জিনিস যা শরীরের সব যন্ত্রণাকে ইমিডিয়েটলি সাময়িক ভাবে কমিয়ে দেয়, যাকে বলে কী না একদম ইনস্ট্যান্ট রিলিফ, তবে রিলিফটা পার্মানেন্ট নয়, একটু ব্যথা বা জ্বর, একটা গোলি খাওয়া, কিছুক্ষণের জন্য ইনস্ট্যান্ট রিলিফ, আবার কিছুক্ষণ বাদে ব্যথা, আবার একটা গোলি, কিছুদিন এরকমই চলতে থাকে, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ব্যবধানে শরীরের ব্যাগড়বাই আর ঘড়ি ধরে ধরে জল দিয়ে ট্যাবলেট গেলা, শারীরিক যন্ত্রণা কমানোর মত মানসিক যন্ত্রণা কমানোরও অ্যান্টিবায়োটিক থাকাটা দরকার, বিদেশ থাকলে অবশ্য বলতো, আরে ইয়ার, মানসিক অ্যান্টিবায়োটিক তো সেই কবেই আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে, খারাপ হওয়া মন ইনস্ট্যান্ট যদি মেরামতি করতে চাও তাহলে চারিদিকে তার জন্য কত রকমের দাওয়াই না আছে, সিগারেটে দু টান দাও কিংবা গলায় দু পাত্তর ঢালো, নয় তো বা সিনেমাহলে গিয়ে মশলাদার কোনো মুভিও দেখে নিতে পারো, মন খারাপের ইনটেনসিটি যদি একটু গভীর হয় অথবা যে মানুষটির মন খারাপ সে যদি একটু অন্য প্রকৃতির হয় তাহলে তার জন্য অন্য দাওয়াইও দেওয়া যেতে পারে, কারোর সামনে এগিয়ে দেওয়া যেতে পারে সাদা পৃষ্ঠা আর কলম, পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত শিল্পেরই জন্ম লগ্ন কিন্তু শিল্পীর মন খারাপ হওয়া কোনো মুহূর্ত।

আমার অবশ্য ছোটবেলায় মন খারাপ হলে আমি তখন করুণাময়ীর কালী মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতাম, মন্দিরের চাতালে বসে কমল পাগলার কাণ্ড কারখানা দেখতাম, সবাই বলতো, এই ছেলেটা নাকি খুব বড় ঘরের ছেলে, বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হওয়ায় ছেলেটি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়েছে, জানি না কথাটা সত্যি কি না, তবে কালী মন্দিরে যে সব মানুষ আসত তারা কিন্তু কমল পাগলাকে দেখে দাঁড়িয়ে যেত, একমাথা চুল আর মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে কমল সকাল থেকে ইটের টুকরো দিয়ে চাতালের বুকে ইংরেজিতে কত কিছুই না লিখে যেত!

আমার মন খারাপের দিনে আমি কমল পাগলার পিছনে দাঁড়িয়ে সেই সব লেখা পড়তাম।

এখন মন খারাপ হলে আমি টিয়ার কাছে যাই, বিদেশ ঠিকই বলেছে, এই মেয়েটা কিন্তু সত্যিই অন্য রকম, টিয়াকে দেখলে যৌন কর্মীদের সম্বন্ধে আমাদের মনের মধ্যে পুষে রাখা ধারনাটা অনেকেরই বদলে যেতে পারে, দু-একবার ওর কাছে আসার পরই টিয়া বুঝে গিয়েছিল যে আমি কেন ওর কাছে আসি, তাই আমাকে আসতে দেখলেই ও এখন সাদা চাদরটা মেঝের ওপর টানটান করে বিছিয়ে দেয়, খাটের তলা থেকে বের করে নেয় হারমোনিয়াম, আমার আরামের জন্য মেঝেতে পাতা বিছানার ওপর দুটো তাকিয়া রেখে নিজে গিয়ে বসে হারমোনিয়ামের সামনে, তারপর চোখ বন্ধ করে ধরে --

'মিরা কে গিরিধর নাগর, রাঁধা কে মনোমোহন, রাঁধা দিন শৃঙ্গার করে, আউর মিরা বন গ্যায়ি যোগন, এক রানী, এক দাসী, দোনো হরি প্রেম কি পিয়াসী, অন্তর কেয়া দোনো কি তৃপ্তি মে বোলো...'

টিয়া নয়, মা যেন আমার সামনে বসে রয়েছে, হারমোনিয়াম নিয়ে মা গান গাইছে, ঐ তো আজও মায়ের পরনে সেই শ্যাওলা আর সাদা রঙের শাড়ি, আজও মায়ের কপালে সেই শঙ্খের মত ছোট ঘন সবুজ টিপ, মারোয়ায় সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরে মা এখন মধ্যলয়ে থেকে কূট তানে চলে গেলো, তার-সপ্তকের ধৈবতে সুর-স্পন্দন সেরে মায়ের গলায় তার-সপ্তকের সা, কয়েক সেকেন্ড সেখানে থেকেই মা নেমে এলো মধ্য-সপ্তকে আর তারপর গলায় তুলে নিলো মন্দ্রের সা, মায়ের হাতে আজ যেন সময় বড়ই কম, তাই মুহূর্তে এক সুর থেকে আরেক সুরে ভেসে বেড়াচ্ছে মা, পিলুতে ঠুমরী শেষে মা এখন ধরেছে মৎ যা, মৎ যা, মৎ যা যোগী ...

বাবা, ঠাকুমা, অলোককাকু, হল-ভর্তি দর্শক সবাই হাততালি দিচ্ছি আমরা মায়ের গানে, এর মধ্যে কখন যেন জুবেন আঙ্কল আর পন্ডিতদাদুও এসে বসেছেন আসরের মাঝে, দাদুর দু’পাশে মা আর কাকু, মা তার শাড়িটা বদলে ফেলেছে এর মধ্যে, এখন মায়ের পরনে চন্দন রঙের লাল পাড় কাঞ্জিভরম, জুবেনকাকুর গায়ে তসরের পাঞ্জাবী, বাদামী কাজ করা তাতে, কাকু উদাত্ত গলায় ধরেছে দরবারী, সুরকে দুহাতে পাকড়ে কাকু যেন পুরুষালী বিক্রমে সভাকে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি।

কাকু যদি পুরুষ সিংহ হন তবে মা আজ বিদীর্ণ আকুতি যেন, আলাপের পরতে পরতে তাই সেই আকুতি এখন যেন গভীর আর্তিতে বদলে যাচ্ছে, পট খো-ল বলে মা মিড় টানলো, হলঘরে সবাই বিষাদে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছি আমরা, আর কাকু সেই বিষাদ ভেঙ্গে চোখের নিমেষে হলক তানে হলঘরটাকে আবার ভাসিয়ে দিলো লয়কারীতে, আজ দুজনাই কাউকে যেন এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ, তাই কাকুর হলতানের প্রত্যুত্তরে মা এবার নেমে এলো বিলম্বিত ত্রিতালে, ধাক্রে – ধিনক্রে – ধিনক্রে - ধাতিৎ - ধাগিতেটে - ধিনক্রে – ধিনক্রে - ধাতিৎ - তাক্রে – তিনক্রে – তিন - তাতিৎ - ধাগিতেটে - ধিনক্রে – ধিন - ধাতিৎ - দুজনার মাঝে বসে দাদু ঘন ঘন মাথা নেড়ে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝেই ওনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, বহুত আচ্ছা, মায়ের ত্রিতাল শেষ হলে কাকু দ্রুত বন্দিশে ফিরলেন, কাকুর সুরের গমকে সময় যেন এখন থমকে যেতে চাইছে, চোখের পাতা যেন তার পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে, আবর্তনের পর আবর্তনে কাকুর কণ্ঠ সুরের এক অলিক দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন, বিশাল বিশাল তেহাইয়ে হলঘরের সবাইকে মাতিয়ে কাকু ধরলেন, আজ মুরলি বজাই শুনাই রে, চলো সখী বৃন্দাবনে যাই...

কাকু যেখানে শেষ করলেন সেখান থেকেই মা ঠুমরীতে ধরলো, মায়ের গলা এখন যেন আরো করুণ, আর সেই করুণ আবেদনে সারা দিয়ে কাকুও এবার গলা নামিয়ে গেয়ে উঠলেন, জাগিয়ে রঘুনাথ কুঁয়ার পানছি বন বোলে ...

স্টেজ থেকে মা কখন যেন নেমে গিয়েছে, জুবেনকাকু এখন একাই গাইছেন, টুট গ্যায়া এ দিল কা খিলোনা, মিল গ্যায়া মিট্টি মে এ সোনা, প্যাঁর কি কিসমত মে হ্যাঁয় রোনা, ও কাকু, কোন রাগে রুমি এ গান গাইছ, তোমার গানে চারিদিকে কেন এত আগুনের হলকা, কোথায় গেলে মা তুমি, দেখো না, কাকুর সুরের হলকায় সারা শরীরটা আমার কেমন পুড়ে যাচ্ছে এখন, বলো না মা কাকুকে তুমি মল্লার ধরতে, ও কাকু, মল্লার ধরো, মল্লারের সুরে বৃষ্টি নামাও, আর সেই বৃষ্টিতে শেষ হয়ে যাক চারিদিক পুড়িয়ে দেওয়া এই তপ্ত দাহ, বৃষ্টির সুরে তুমি ভিজিয়ে দাও আমায়, ভিজতে চাই আমি, দেখো মা, কাকু বৃষ্টি নামিয়েছে, বৃষ্টির ঝরনায় গোটা পৃথিবীটা এখন স্নিগ্ধ হয়ে উঠছে কেমন আর তার পেলব স্পর্শ আমার কপালও যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে, ডান হাত দিয়ে কপালে ছুঁয়ে থাকা আঙুলগুলো চেপে ধরি, কপালের ওপর রাখা ভেজা কাপড়টাকে টেনে ছুড়ে ফেলি, উর্মি, তুমি কখন এলে, কে বললো তোমায় যে আমার শরীর খারাপ, না, উর্মি, প্লিজ আমার কপাল থেকে তুমি তোমার ঐ আঙুলগুলো সরিয়ে নিয়ো না, জানো উর্মি, আমার না আসলে জ্বর হয়নি, জুবেনকাকু তখন কী যেন একটা রাগ ধরলো আর অমনি চারিদিকে আগুন জ্বলে উঠলো, আর সেই আগুনে আমি, বাবা, ঠাকুমা, হলঘরের সবাই আমরা পুড়ে যেতে লাগলাম, শুধু মা আর কাকু পুড়ল না, ওরা গান গাইতেই থাকলো, আগুনটা যখন আমাদের সবাইকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে তখন পন্ডিতদাদু কোথা থেকে এসে ওদেরকে বললেন, ওরে, তোরা এবার বৃষ্টি নামা, যেমন করে পাহাড়ের বুক থেকে ঝরনার ধারা নেমে আসে সেই ভাবে তোরা এবার আকাশের বুক থেকে বৃষ্টি নামা, বৃষ্টির জলে একটা প্লাবন আসুক, আর সেই প্লাবনে নৌকার মত ভেসে যাক আমাদের এই জীবন, সব বাঁধা পার করে একটা জীবন খুঁজে পাক সমর্পিত হওয়ার জন্য আরেকটা জীবন ...

না, তুমি তো উর্মি নও, তুমি উর্মি হতে পারো না, উর্মির মধ্যে কুশল কখনো তার সমর্পণ খুঁজে পায়নি, উর্মির আলিঙ্গনে কুশল আজকাল হাঁসফাঁশ করতে থাকে, সে আলিঙ্গনে এখন আর ভালবাসা থাকে না, সেখানে থাকে শুধু শরীর থেকে আরেকটা শরীরের সুখ খুঁজে নেওয়ার তীব্র বাসনা, তুমি উর্মি নও, তাহলে তুমি কে, কে তুমি আমায় ভিজিয়ে দিচ্ছ শুকনো ছররা ঘাসকে যেভাবে হেমন্তর প্রথম শিশির ভিজিয়ে দেয়, তুমি কি আমার সেই কালোমেয়ে, কালোমেয়ে তুমি কখন এলে, প্লিজ তুমি ওভাবে নিজেকে আড়াল করে রেখো না, এসো, আমার কাছে এসো, আমার দু-চোখে তুমি একবারের জন্যও অন্তত ধরা দাও, আমি তোমায় দেখতে চাই, আমার কপালের ওপর রাখা কালোমেয়ের হাতটা ধরে টান দেই, আর সেই টানে ওর নরম শরীরটা এসে আছড়ে পড়ে আমার বুকের ওপর, কালোমেয়ে, তোমার শরীর জুড়ে কীসের সুগন্ধ এত, তুমি কি এখনি স্নান করে এসেছ, তোমার সারা শরীর জুড়ে তাই কি এত স্নিগ্ধতা, প্লিজ তোমার ঐ শরীরের স্নিগ্ধতায় আমার জ্বলন তুমি শেষ করে দাও, নিজেকে ভিজিয়ে নেওয়ার জন্যই যেন এবার আমি এক-এককরে নিজের আর কালোমেয়ের শরীরের সব আবরণ উন্মোচন করে দেই, ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠি আমার প্রিয় কবির সেই লাইনগুলো

"শেষ অবধি (আমার) দিনগুলির মৃত্যু হলো, আকাশের বুকে (তখন) সন্ধ্যা নামলো, মাটির পৃথিবীতে (তখন) সন্ধ্যা নামলো, আমি তোমার হাত দুটো ধরলাম, বললাম, আমাকে আর একবারের জন্যও কি তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না কবেকার সেই শেষ হয়ে যাওয়া চুম্বনে?"

কালোমেয়ের নিরাবরণ শরীরটা এখনও আমার শরীর ছুঁয়ে রয়েছে, আমার হৃৎপিণ্ডের তালে তালে ওর নরম বুক-দুটো ওঠানামা করছে।

মিস্টার গোস্বামী, প্লিজ এক্সকিউজ মি, আজ বারবার আপনাকে ধার করতে হচ্ছে


শেষে বাঁচবার জন্য, কেবল বেঁচে থাকবার জন্য বাধ্য হয়ে

আমরা ঢুকে পড়লাম এ ওর হৃৎপিণ্ডের মধ্যে

আর, তখনই তারপর তাপের জন্ম হলো ধীরে ধীরে ধোঁয়ার মতো

তাপ বেরোতে লাগলো আমাদের যৌথ হৃৎপিণ্ড থেকে

তারপর একসময় তাঁবুর মধ্যে জ্বলতে লাগল ছোট্ট একটা

বাতি, চাঁদের মাটিতে তো হাওয়া নেই, তাই একবারও

কাঁপলো না তার আলো


এক সময় নিথর হলো আমাদের শরীর দুটো, উত্তাপ জুড়িয়ে পরস্পরের শরীর থেকে বেরনো স্বেদ-বিন্দুতে মাখামাখি আমরা, কালোমেয়ে ফিসফিস করে আমার কানে তার মুখ রেখে বললো, বহু বছর আগে আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম, কুশলদা, আই লাভ ইউ, কথাটা কিন্তু আজও আমি পুরনো হতে দেইনি, আজও কিন্তু আমি আমার বুকের মধ্যে আমার প্রথম ভালোবাসাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছি, চোখ মেলে তাকাই, এক ঝটকায় আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মুখটাকে তুলে ধরি, এ কী, এ তো কালোমেয়ে নয়, এ তো শুভ্রা, এ আমি কী করলাম, শুভ্রার শরীর থেকে নিজেকে আলাদা করে উঠে বসি, মেঝেতে পড়ে থাকা জামাটা তুলে ওর দৃষ্টি থেকে নিজের লজ্জাকে আড়াল করি, শুভ্রাও ততক্ষণে বিছানার চাদরের এক প্রান্ত টেনে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে, বিশ্বাস করো শুভ্রা, আই ওয়াজ নট ইন সেন্স, আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি যে তুমি আমার মাথার কাছে এসে বসেছ, প্লিজ, প্লিজ, ফরগিভ মি শুভ্রা, চাদরের আড়াল থেকে নিজের হাত দুটো বের করে শুভ্রা আমার হাতদুটো নিজের হাতে তুলে নেয়, আমার দিকে তাকান কুশলদা, হোয়াই ইউ আর ফিলিং সো গিলটি, শুভ্রা আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে, দোহাই কুশলদা, চুপ করুন, হোক না কুড়িয়ে পাওয়া, তবু নির্লজ্জের মত কুড়িয়ে পাওয়া এই সুখটুকুকে এই মুহূর্তে আমায় উপভোগ করতে দিন।

ওহ কবি মশাই, আপনি না আজ বড় জ্বালাতন করছেন, কেন বলুন তো সেই তখন থেকে খালি আমার কানের কাছে গুনগুণ করে যাচ্ছেন...


‘এ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে (চলো) এক সঙ্গে জ্বলে পুড়ে (আরো একবার) ছাই (হয়ে যাই)’

আর তখনই

ভেঙ্গে যায় প্রতিরোধ সব ... ভুল হয় বৃষ্টির বিন্যাসে... বিষণ্ণ মাধবী যে আজ আবার একা একা ফুটে আছে...

তোমায় নিয়ে শহরতলীর ট্রেন সেদিন ছুটে গিয়েছিল, মুখরিত আত্মায় মিশে গিয়েছিল সেদিন আমাদের সময়ের গুঞ্জন ... অবলীলায় রোজকারের খুঁটিনাটি সেরে তুমি বলেছিলে... নিহিত সন্ধ্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলে আমাদের আলোর সব সন্ন্যাস ...

মন্ত্রমুগ্ধ কবি কান পাতেন...

শোনেন স্মৃতির কণ্ঠস্বর আবার ...আঁকড়ে ধরেন পূর্বজন্ম যার বৈভব আজ গোধূলি-বেলায় ...

দূরে উপকুলে দাঁড়িয়ে তখন ঝাউ-বীথি ... দাঁড়িয়ে নক্ষত্রের সারি ...

আগে কখনো জানিনি জীবনের সমস্ত অভিষেক আসলে অনুভূতিরই বিস্তৃতি... রক্তে আনে তা ঝড়ের জাগৃতি... অলৌকিক বাগান থেকে তাই বহুবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে অন্ধকারে... ঝরে পড়ে আমারই রক্ত হয়ে...

তোমায় আমি ডাকতে পারতাম রাধা কিংবা খাদিজা কিংবা মারিয়া বলে, অথবা অন্য কোনো নামে ... কিন্তু পারিনি...

আর তাই ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে আমার এই মস্তিষ্কের সব উজ্জ্বল কর্টেক্স, নিভে আসে আমার সেই দীপ্ত চোখদুটো ... তবু দেখো, অবেলায় আজও অবিরল ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে আমার এই জীবন, বয়ে যাচ্ছে তা আমার সারা শরীর বেয়ে... অনিঃশেষ আবেগের স্রোতে...

আজ না হয় ভিজে যাক আবার জাহাজের সব পাটাতন... জলমগ্ন হোক আমার সব স্মৃতি ...

তুমি না হয় ভাসিয়ে দিও তোমার সব রঙিন ফানুস ঐ আকাশে আবার...



কী ব্যাপার ম্যাডাম, ছেলে আসাতে তো দেখছি আপনি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, গত দুদিনে ফোনটাও তো সুইচ অন করতে ভুলে গিয়েছিলেন!

আরে না না কুশলদা, অ্যাকচুয়ালি হ্যান্ড-সেটটায় একটু গণ্ডগোল হচ্ছিল, তাই সারাতে দিয়েছিলাম।

আমি তো ভাবলাম ছেলের সঙ্গে গল্পের সময় যাতে আমাদের মত আউট সাইডাররা ডিস্টার্ব করতে না পারে তার জন্যই ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিলে, তা আমাদের উজানবাবু কী বলছেন।

ফোনের অপর প্রান্তে শুভ্রা চুপ, না, ঠিক চুপ নয়, আমি যেন অস্পষ্ট একটা ফোঁপানির ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।

কী হয়েছে শুভ্রা, এনিথিং রং?

কুশলদা... এবার ফোঁপানিটা স্পষ্ট।

আরে বলবে তো কী হয়েছে, উজানের শরীর ঠিক আছে তো?

আচ্ছা কুশলদা, বলতে পারেন, আমি কী এমন করেছি যে উজান আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছে?

মানে, কি হয়েছে, উজান তোমার সঙ্গে কী ব্যবহার করছে?

আসা থেকে এখন অবধি একবারের জন্যও আমার সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলেনি, সব সময় আমার সঙ্গে যেন একটা ডিসটেন্স মেনটেন করে চলেছে।

ধুর বাবা, এগুলি তোমার মনের ভুল, একটা কথা বলো তো, উজান কেন তোমার সঙ্গে ডিস্টেন্স মেনটেন করে চলবে, না, না, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, আর তাছাড়া দেখো ছেলেমেয়েরা বড় হলে ওরা কিন্তু আর ছোটবেলাকার মত মা-বাবার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করে না, এতে এত আপসেট হওয়ার কিছু নেই।

না কুশলদা, আপনাকে মনে হয় আমি ঠিক মত বোঝাতে পারছি না, প্রশ্নটা শেয়ারিংয়ের নয়, বিলিভ মি, উজানের আচরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে ও কোনো কারণে আমায় ঘৃণা করছে এন্ড হি ইজ ট্রায়িং টু মেনটেন এ ডিসটেন্স ফ্রম মি।

ঘৃণা করছে! কী বলছ! আর ইউ শিওর! উজান তোমায় ঘৃণা করছে! ও কি জানে না যে তোমার সবকিছু দিয়ে তুমি ওকে বড় করেছ বা এখনও করছ। না, না, না শুভ্রা, আমি এখনও বলছি, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।



ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মাদার কলিং, কী গো মা, শরীর ঠিক আছে তো, আমার গলায় উদ্বেগের ছোঁওয়া, মা সাধারণত খুব একটা প্রয়োজন না হলে অফিস টাইমে আমায় ফোন করে না।

হ্যাঁ রে বাবা, শরীর ঠিক আছে, আচ্ছা আমি কি তোকে শুধু শরীর খারাপের খবর দেওয়ার জন্যই ফোন করি, শোন, ট্রাভেল এজেন্টের লোকটা এসে এই মাত্র টিকিট দিয়ে গেলো, সামনের সোমবার কুম্ভ এক্সপ্রেসে টিকিট হয়েছে, দুপুরের ট্রেন।




ক্রমশ