বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১৩

১৩

“মাথায় একটাও লেখা নেই, তাই এই অন্ধকারে বেরিয়ে পড়া ভালো

বেরিয়ে পড়েছে ঝড় বৃষ্টিরাও

বেরিয়ে পড়েছে উন্মাদ মৃত্যুদিন

বেরিয়ে পড়েছি মেঘ চিরে চিরে, যে চুম্বনে চমকে উঠে

একদিন উলটে গেছে সাদা পৃষ্ঠারা ...

একদিন ভেবেছিলাম আজ না লেখা হোক , কাল ঠিক লিখবই

কাল ঠিক সারারাত স্বপ্নে বৃষ্টিহবে

কাল ঠিক মরে যেতে যেতে কষ্ট হবে আরও বেশী

কাল ঠিক পেয়ে যাব আগের জন্মের একটা না একটাসকাল

একটা না একটা হু হু করে কান্না

একটা না একটা চড়ুই ঠোটে খড় নিয়ে ছুটে আসবে

আর সঙ্গিনীকে চেঁচিয়ে বলবে

বাসা বানানোর মতো চমৎকার একটা মন পেয়ে গেছি

কিন্তু আমি তো জানতাম না তার আগেই বাতাস আসল খবর পেয়ে গেছে

আর পাওয়া অবধি ছুটে ছুটে আসছে

দমকা হাওয়ায় পুড়িয়ে দিচ্ছে আগুনে জন্মানো একটা প্রেম

যে প্রেমে স্পষ্ট দেখা যেত একটা হাত ধরে আছে

আর একটা হাত ... “


রাসবিহারী এভিনিউ থেকে ট্রাঙ্গুলার পার্কের গা ঘেঁসে বাঁ দিকে যাওয়ার যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে তারই একটু ভিতরে পাঁচতলা অ্যাপারটমেন্টার ফিফথ ফ্লোরে এখন বসে রয়েছি । হলঘরের সোফায় আমায় বসতে বলে শুভ্রা ভিতরে গিয়েছে, হয়তো চেঞ্জ করবে, হলঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো, খুব বেশী আসবাব না থাকলেও সোফা টেবিল কোনে রাখা বুক শেলফ সব কিছু থেকেই যেন একটা রুচির ছাপ ফুটে উঠছে, দেওয়াল গুলিতে দামী ডিসটেম্পার করা, ডিসটেম্পারের কালারের সঙ্গে ম্যাচ করা জানলার ব্লাইন্ড, সোফার ডানদিকের দেওয়াল জুড়ে সাদাকালো একটা ওয়াল পেইন্টিং, বুকশেলফের ওপরে কালচে নীল রঙের একটা চীনেমাটির ফুলদানী, টাটকা রজনীগন্ধার অনেকগুলো কলি থেকে হালকা একটা সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মধ্যে, আমি সত্যিই এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে সতের বছর পর আজ আবার শুভ্রার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে,বইয়ের দোকানে আমাকে দেখে শুভ্রাও ঠিক একই রকম চমকে উঠেছিল , আরে কুশলদা! আপনি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি !

ইংরেজি লেটাররাইটিংয়ের বইটা ততক্ষণে দোকানদার ভদ্রলোক আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ওনার হাত থেকে খুচরো টাকা গুলো নিয়ে ওয়ালেটে ভরতে ভরতে আমিও যেন শুভ্রাকে ওর বিস্ময়টাই ফেরত দেই।

শুভ্রা! তুমি! হোয়াটএ প্লেজেন্টসারপ্রাইজ ! কবে ফিরলে কোলকাতায় ?

কালো রোদ চশমায় চোখ দুটো ঢাকা শুভ্রার, মিটিমিটি হাসছে ও, কুশলদা, এই এ'কবছরে আপনি কিন্তু অনেক বদলে গিয়েছেন!

বইয়ের দোকানের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এখন গড়িয়াহাটের মোড়ের দিকে যাচ্ছি।

বদলে গিয়েছি? তা বদলটা কেমন, শুনি।

বদলটা কেমন সেটা এক কথায় বলা মুশকিল তবে এটা ঠিক যে আপনার লুকে এখন একটা বেশ রাশভারী রাশভারী মানুষের ছাপ।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ যেআগে আমি ফাজিল টাইপের দেখতে ছিলাম, তাই তো!

না সেটা ঠিক নয়, তবে আপনাকে দেখলে এখন কেমন যেন একজন বেশ অভিজ্ঞ অভিজ্ঞ মানুষবলে মনে হয়। আগে আপনার মুখে যে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব লেগে থাকত সেটা কিন্তু সত্যিই এখন হারিয়ে গিয়েছে।

আরে বাবা সোজাসুজি বলছ না কেন যে আমাকে দেখে এখন বুড়ো বুড়ো লাগে ।

দেখুন কুশলদা, এতদিন বাদে দেখা হলো, আপনি কিন্তু আমার সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করলেন, শুনুন আমি যা বলতে চেয়েছি সেটা হলো আপনার মুখের দিকে তাকালে এখন যেন মনে হয় দিস ম্যান হ্যজ সিনদ্য লাইফ ভেরি ক্লোজলি।

কী করে শুভ্রাকে বলি ,তুমি যা বললে তা তো সত্যিই , সত্যিই আমি এই জীবনটাকে এই ক'বছরে অনেক কাছের থেকে দেখেছি, জীবনের উঁচু নিচু সব বন্ধুর পথ পায়ে হেঁটে পার করে এসেছি আর সেই পার হওয়ার পথে জীবনের বিভিন্ন দিকগুলো নিজের থেকেই যেন আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে, এই চোখ যে আজ কত ঘটনার সাক্ষী তা শুধু আমিই জানি, এই মন যে কত মানুষের স্মৃতি বয়ে বেড়ায় তা আর কেউ জানে না,জানো শুভ্রা আমাদের চারপাশে এই যে এত মানুষের ভিড় তাদের প্রত্যেকেরই কিন্তুআলাদা আলাদা একটা গল্প আছে,আর সেই গল্পে আছে প্রেম , প্রীতি ভালবাসা অথবা ঘৃণা। সম্পর্কের সুশীতলছায়ায় যেমন আমরা জীবনটাকে উপভোগ করি তেমনি আবার কখনও বা সেই সম্পর্কেরই লেলিহানশিখা কিন্তু আমাদের পুড়িয়ে মারে, এনিওয়ে এসব কথা এখন থাক, এতদিন বাদে আজ আমাদের দেখা , এসো শুভ্রা আজ আমরা বরঞ্চ অন্য গল্প করি,তোমাকে না হয় বলি, তুমিও কিন্তু বেশ বদলে গিয়েছ, ইয়েস শুভ্রা, রিয়েলি আই মিন ইট,তোমার চোখমুখ থেকে সেদিনের সেই কিশোরী কিশোরী ভাবটা যেন হারিয়ে গিয়েছে, এখন সেখানে যেন এক গভীর পরিপূর্ণতা, হারিয়ে গিয়েছে সন্তোষপুরের চিলেকোঠার সেইকালো ছায়াও,তার বদলে এখন সেখানে আলোর ঝলকানি যেন, তোমার এইদামী সিল্কের শাড়ি , চোখে নাম করা ব্রান্ডের কালোরোদ চশমা , হাতে ঝকঝকে মোবাইল ফোন, সত্যি বলছি শুভ্রা, আমার কিন্তুখুব ভালো লাগছে তোমাকে দেখে, মনে হচ্ছে কতদিন বাদে যেন আবার আমাদের দেখা হলো তোমার সেইপড়ার ঘরে ,শুভ্রা কারোর সঙ্গেফোনে কথা বলছে , ফোনালাপের কিছু কথা কানে ছিটকে এলো , কাউকে ও বলছে , ঠিক আছে আপনারা কাল বারোটা নাগাদ স্কুলে চলে আসুন , তারপর দেখছি প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে কিছু করা যায় কি না।

সরি কুশলদা , কান থেকে ফোন নামিয়ে শুভ্রা আমার মুখের দিকে চেয়ে বললো,আরে কি হয়েছে জানেন,আমাদের স্কুলের একটা মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে ,মাস তিনেক হলো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে , যাই হোক, অনেক টানাপোড়নের শেষে ওর শ্বশুর বাড়ির লোকরা বিয়েটা মেনে নিয়েছে, আর শুধু মেনেই নেয়নি, এখন শ্বশুর শাশুড়িচাইছেন মেয়েটা যেন আবার পড়াশুনা শুরু করে, তা ঐ শ্বশুর-মশাই ফোন করেছিলেন, বলছিলেন যে প্রিন্সিপালকে রাজী করিয়ে এই বছরই যদি মেয়েটাকে ফাইনাল পরীক্ষায় বসানো যায়।ছাড়ুন এসব কথা, বলুন কেমন আছেন, শুভ্রা প্রসঙ্গ বদলালো।

আমি তো ভালোই আছি ম্যাডাম কিন্তু তোমরা কবে কোলকাতায় ফিরলে তা তো বললেনা ।

কোলকাতায় তো আমি প্রায় তিন বছর হলো ফিরে এসেছি।

হোয়াট! তিন বছর হলো তুমি কোলকাতায় ফিরে এসেছ আর এই তিন বছরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করনি! নিজের অজান্তেই আমার গলায় যেন অভিমানের সুর মিশে যায়।

আরে বাবা শুনুন তো আগে, বিলিভ মি এই তিন বছরে অনেকবার আমি অনেকভাবে চেষ্টা করেছি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার,ইনফ্যাক্ট বোম্বে থেকে ফেরার পরের দিনই আপনার অফিসের যে ফোন নম্বরটা আমার কাছে ছিল সেটাতে ডায়ালকরেছিলাম , কিন্তুএক্সচেঞ্জ থেকে জানাল যে দিস নম্বর ডাজন্ট এক্সজিস্ট , মনে মনে ভাবলাম এতগুলি বছরে হয়তো নম্বরটা বদলে গিয়েছে, তাই এক্সচেঞ্জের এনকোয়ারিতে ফোন করে আপনার অফিসের নাম বলে জানতে চেয়েছিলাম যে ওরা যদি আমায় হেল্প করতে পারে ,কিন্তুএক্সচেঞ্জ থেকে জানালো যে ওদের রেকর্ডে আপনাদের অফিসের নামে কোনো অফিস রেজিস্টার্ড নেই।

বুঝলাম, আমাদের কোম্পানির বছর দশেক আগে যে নাম চেঞ্জ হয়েছিল সেই কারণেই এক্সচেঞ্জের লোকরা শুভ্রাকেহেল্প করতে পারেনি,আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে একটা লম্বা টান দেই, নাক মুখ দিয়ে বেরনো ধোঁয়ার মতন স্মৃতিরা যেন এখন আমার মনের পর্দায় ওড়াওড়ি করছে, র‍্যাপিড ফায়ারের সেই প্রশ্ন-পর্ব, বন্ধ দরজার পাল্লায় আমার পিঠ ঠেকে যাওয়া, আই লাভ ইউ, ডু ইউ লাভ মি, শুভ্রার সেই জিজ্ঞাসা, তারপর ম্যারেজ রেজিস্টার অফিসে সমুদ্রের সঙ্গে শুভ্রার বিয়ে, আমার সেখানে সাক্ষী দেওয়া, তিনতলার ছাদের ঘরে ওদের সংসার পাতা, কাকুলিয়া রোডের সেই ক্লিনিক, ডান হাতের পাঞ্জা নেড়ে ধোঁয়ার সরলরেখাটা ভেঙে দেই ,তারপর তোমার বরের কী খবর , কেমন আছে আমাদের সমুদ্রবাবু ?

শুভ্রা যেন আমার কথাটা শুনতে পায়না,কুশলদা বলছি কী আমার বাড়িটা কিন্তু কাছেই,জাস্ট ফাইভ মিনিটস ওয়াকিং ডিস্টেন্স,চলুন না আমার ওখানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে । যেতে যেতে শুভ্রা জানালো যে ওদের স্কুলে মল্লিকাদি বলে এক দিদি আছেন, ভূগোল পড়ান ভদ্রমহিলা , শুভ্রা এখন যে ফ্লাটটায় থাকে সেটা আসলে ঐ মল্লিকাদির ভাইয়ের, ভদ্রলোক চাকুরী সূত্রে বিদেশে থাকেন, তাই মল্লিকাদি বলাতে ভদ্রলোক শুভ্রাকে ফ্লাটটা ভাড়া দিয়েছেন।

তুমি কোন স্কুলে পড়াও ? হাঁটতে হাঁটতে ট্রাঙ্গুলার পার্কের সামনে এসে পড়েছি আমরা।

শুভ্রা জানালো যে ও গোলপার্কের পাশে যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটা আছে সেখানে ইংরেজিপড়ায় ।

তাই বুঝি ইংরেজি কবিতার বই খোঁজ করছিলে?

আরেনা, না, বইগুলো তো খুঁজছিলাম একজনকে গিফট করব বলে।

পুরনো বই কিনে গিফট করবে! স্ট্রেঞ্জ!

হ্যাঁ স্ট্রেঞ্জই একটু, আসলে আমাদের স্কুলে এক দিদি আছেন, পরশু ওনার জন্মদিন, দিদি বই পড়তে খুব ভালবাসেন মানে যাকে বলে কী না একদম অ্যাভিড রিডার, তাই ওনার জন্যই বইগুলো কিনলাম।

সে তো বুঝলাম, কিন্তু পুরনো বই, এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

আরে সবটা তো শুনুন আগে, দিদির যেমন বই পড়ার নেশা তেমনি আবার একটা অদ্ভুত শখও আছে, উনি ঝাঁ চকচকে নতুন বই পড়তে একদম পছন্দ করেন না, উনি বলেন, যে বই অনেকে পড়েছেন, যার পৃষ্ঠাসব পুরনো হয়ে গিয়েছে, সেই বই পড়ার মজাই নাকি কিছু আলাদা , পড়তে পড়তে আগে যে সব মানুষরা বইটা পড়েছেন তাদের পড়ার অনুভূতিগুলি নাকি বইয়ের পৃষ্ঠায় অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায়!

অদ্ভুত তো!

হ্যাঁ, অদ্ভুতই বটে, একদিন কী হয়েছে জানেন, সেদিন অফ পিরিয়ডে স্টাফরুমে বসে রয়েছি , রমলাদির ওঅফ পিরিয়ড, আমার উলটো দিকের চেয়ারে বসে উনি এক মনে একটা বই পড়ছিলেন, হঠাৎ , দেখ মেয়েএদিকে আয়, কাছে গিয়ে দেখি যে উনি যে পৃষ্ঠাটা পড়ছেন সেখানে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ,বুঝলি, আগে যারা এই বইটা পড়েছেন তাদের মধ্যেকেউ কিন্তু এই পাতাটা পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলেছিলেন, দেখ ওনার চোখের জল আজও বইয়ের পাতায় স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে।মানুষ বড় অদ্ভুত, তাই না, কুশলদা?

জানো শুভ্রা ,এই প্রশ্নটাই আজকাল আমাকে যেন কুড়েকুড়ে খায়, কিছুতেই আমি বুঝতে পারি না যে মানুষ আসলে কেমন, আশেপাশের মানুষগুলিকে তাই চিনতে যেন বড় কষ্ট হয়, মাঝে মাঝেই চেনা মুখগুলি কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়, তখন মনে হয় আমরা সবাই আসলে একটা মুখ আর অনেকগুলি মুখোশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেদিন রাস্তায় একটা হোর্ডিংয়ে পড়ছিলাম, বড় বড় করে সেখানে লেখা, পৃথিবীতে এত বিলিয়ন মানুষ আর ঠিক তার নিচে আরও বড় করে ঐ সংখ্যার দ্বিগুণ সংখ্যা দিয়ে লেখা আর এতগুলো মুখোশ, বুঝলে শুভ্রা, মানুষ আসলে বহুরূপী আর তাই তার কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ সেটাই আজকাল আর যেন বুঝতে পারি না, আমাদের পাড়ায় সুবলদা, কানুদা, ছোটবেলা থেকে যাদের দেখলাম কতরকম সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন , পঞ্চাননতলার মাঠে যারা অত সুন্দর একটা মনি-মেলা চালাতেন, জানো শুভ্রা সেদিন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেলো ওনাদের , পরে শুনলাম, ওনাদের প্রেসটা থেকে নাকি পর্ণো মার্কা বই ছাপা হতো, শুধু তাই নয়, নেশার কারবারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, আবার দেখো,আমাদের অফিসের বীরেন সমাদ্দার, ডেস-প্যাচ সেকশনে কাজ করেন, চিঠি পত্তর খামে করে পোস্ট বা কুরিয়র করাই ওনার কাজ, থাকেন শিয়ালদা লাইনে ছ-সাতটা স্টেশন পর , ভীষণই ছাপোষা টাইপের মানুষ, কারোর সাতপাঁচে থাকেন না,শান্তশিষ্ট নির্বিরোধী মানুষটাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখে একটা অমায়িক হাসি জুড়ে সব সময় উত্তর দেন, মাঝে একদিন বীরেনদা অফিসেএলেন না, পরেরদিন আবার যথারীতি এসে হাজির, কপালের কোনে ছোট্ট একটা ড্রেসিং, হাতেও দু-এক জায়গায় ব্যাণ্ডেড লাগানো, অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, কী হয়েছে, বীরেনদার সেই অমায়িক হাসি আর সংক্ষিপ্ত জবাব, কিছু না ভাই, একটু পড়ে গিয়েছিলাম , দশটা নাগাদ একটা স্থানীয় খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বিদেশ অফিসে এলো আর আমরা তখন সত্যিটা জানলাম, ঐ খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় বীরেনদার ছবি আর তার সঙ্গে লেখা, আগের দিন শিয়ালদা লাইনের লোকালে কিছু ইয়ং ছেলে সকাল সকাল কলেজে যাওয়া মেয়েদের উত্যক্ত করছিল, কামরায় উপস্থিত আর কেউ সেই ঘটনার প্রতিবাদনা করলেও জনৈক বীরেন সমাদ্দার ছেলেগুলির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন , ফল স্বরূপ ছেলেগুলো ঐ বয়স্কমানুষটিকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে, শেষ অবধি কামড়ায় উপস্থিত বাকি মানুষদের বিবেক জাগ্রত হওয়ায় পরবর্তী স্টেশন আসার আগেই ছেলেগুলি রানিং ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে যায়।

সত্যিইমানুষবড় অদ্ভুত ! তাই না ! ভালো খারাপ কত রকমের স্ফুলিঙ্গ যে তার মধ্যে খেলা করে তা আমরা বেশীরভাগ সময়ই কিন্তু বাইরে থেকে টের পাই না।

শুভ্রা ভিতরের ঘর থেকে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো, দু মিনিট, কুশলদা, চায়ের জলটা চাপিয়ে দেই, ওর কিচেনটা হল ঘরের লাগোয়া, তাই সোফায় বসেই দেখলাম শুভ্রা গ্যাস ওভেন জ্বালালো, তারপর মাপমত দুজনার চায়ের জল কাঁচের কেটেলে ভরে ওভেনে বসাতে বসাতে কিচেন থেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করলো, আপনার মা কেমন আছেন ?

হাতে ধরা ম্যাগাজিনটা টেবিলের ওপর রেখে শুভ্রার কথার উত্তর দেই, মায়ের কথা আর বলো না, শরীর একদম ভালো নেই , বয়স হয়েছে তো , তাই রোগ বিমারী যেন আজকাল লেগেই থাকে।

ধুর, মাসীমার আবার এমন কী বয়স, ওভেনের নবটাকে ঘুরিয়ে শুভ্রা টেম্পারেচার অ্যাডজাস্ট করছে, কী হয়েছে ওনার?

সে অনেক কিছু, বেশ কয়েক বছর আগে লিভারে একটা প্রবলেম হয়েছিল, তখন হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্ট করাতে সেটা সেরেও গিয়েছিল কিন্তু রিসেন্টলি প্রবলেমটারিভাইভ করেছে , এছাড়া প্রেশারের ফ্লাকচুয়েশন তো আছেই, মাঝে মাঝেই মাথা ঘোরে, রিসেন্টলি রক্তে সোডিয়ামের ডেফিসিয়েন্সিও ধরা পড়েছে, না শুভ্রা, লেটমি বিঅনেস্ট ,মা কেমন আছে সেটামনে হয় তোমাকে ঠিক মত আমি বললাম না বাবলতে চাইলাম না,দোষটা অবশ্য আমার নয়, অ্যাকচুয়ালিইউ ওয়ারনট ভেরি স্পেসিফিক ইন ইওর কোয়েশ্চেন ,তুমি আমার কাছে জানতে চাও নি যে মায়ের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মনও কেমন আছে, তাই তোমাকে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা যে বললাম না তাতে কিন্তু আমাকে কেউ অ্যাকিউজকরতে পারবে না,কিন্তু এখন যদি তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করো যে মা মানসিক ভাবে কেমন আছে তাহলে তোমায় আমি কী উত্তর দেব, কেমন করে তোমায় বলব যে মিসেস কাজল কর আমাদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও তারকথা আমরা এখন আর খুব একটা জানি না,এমনও অনেক দিন যায় যে সারাদিন হয়তো মায়ের সঙ্গে আমার কথাই হয় না,উর্মি তো আজকাল নেহাত বাধ্য না হলে মায়ের সঙ্গে কথা বলে না আর বললেও সে বলার মধ্যে মিশে থাকে উপেক্ষা আর অভব্যতা …থাক শুভ্রা, এসব কথা থাক, তুমি আমায় এসব কথা প্লিজ জিজ্ঞাসা কোরো না, তারচেয়ে চলো আমরা না হয় অন্য কথা বলি,তুমি বরঞ্চ আমায় বলো কেমন করে তুমি সেই তিনতলার চিলেকোঠার ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলে, কেমন করে তোমাদের চারদিকে ঘিরে থাকা দারিদ্রের নোনাধরা দেওয়ালগুলি তোমরা ভেঙ্গে দুরমুশ করে দিলে, বলো শুভ্রা, সেসব কথা আমায় বলো, মায়ের কথা নাজিজ্ঞাসা না করে তুমি বরঞ্চ তোমাদের ফিরে আসার সেই গল্পটা আমায় শোনাও ...

এই যে মশাই , কী এত ভাবছেন বলুন তো , আমায় অন্যমনস্ক দেখে শুভ্রা জিজ্ঞাসা করে ওঠে।

কিছু না, স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি।

উহু,কিছু তো একটা ভাবছিলেন, বৌদির কথা?

আচ্ছা তখন যে তোমায় সমুদ্রের কথা জিজ্ঞাসা করলাম তুমি বললে না তো যে ও কেমন আছে , ও কি এখনও গান বাজনা নিয়েই আছেনা কি চাকরি বাকরি করছে ?

হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে যাওয়াতে শুভ্রামা কালীর মত জিভ বের করে দৌড় লাগালো কিচেনের দিকে,দেখছেন, ভুলেই গিয়েছিলাম যে চায়ের জল বসিয়ে এসেছি , দাঁড়ান চা-টা ছেঁকে নিয়ে আসছি । দামি চায়ের কাপ দুটো সেন্টার টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে শুভ্রা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটে আমায় জিজ্ঞাসা করলো যে মা এখনও নিয়ম করে সকাল সন্ধ্যায় রেওয়াজকরে কি না ... না, মেয়েটা দেখছি আজ আমাকে বেআব্রু করেই ছাড়বে, আমাকে দিয়ে বলিয়েই নেবে যে কাজল কর নামক এক ভদ্রমহিলা শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকলেও ওনার মানসিক স্বত্বাটা আজ আর বেঁচে নেই, অনেকদিন আগেই তার মৃত্যু হয়েছে, আর সেই মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ নয় , দায়ী হচ্ছে তার ছেলে, মাথা নাড়ি, না গো, মায়ের যা এখন শারীরিক অবস্থা তাতে মা আর গান-বাজনা করতে পারে না।

জানেন কুশলদা তখন আমরা সদ্য সদ্য বোম্বেতে গিয়ে পৌঁছেছি , একদিন একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম , দেখি লিঙ্কন কুমারও সেখানে হাজির, তার কিছুদিন আগেই ওনার সুর করা মন মেরা মিত ছবিটার গান রিলিজ করেছে, তা পার্টিতে যেমন হয়, উপস্থিত জার্নালিস্টরা ওনাকে ঘিরে বাইট নিচ্ছিলেন, কথায় কথায় মন মেরা মিত ছবিটার কথাও উঠলো, কুমারজি তখন বললেন, ঐ সিনেমাটায় যে ক্লাসিক্যাল গান দুটো আছে তার জন্য নাকি উনি প্রথমে মাসীমার কথাই ভেবেছিলেন, কিন্তু মাসীমা প্লে-ব্যাক করতে রাজী না হওয়ায় শেষ অবধি অন্যকে দিয়ে গানগুলি গাওয়ান।

হ্যাঁ, মা তো কোনোদিনই প্লেব্যাক করা পছন্দ করত না, বাংলা সিনেমা থেকেও অনেকবার অফার এসেছিল , অফারগুলি সব ফেরত দিয়েছে।

হাতঘড়ির দিকে নজর চলে যায়, ছ’টা বাজে, সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই, ঘরের কোনে রাখা ছোট্ট টেবিলটার হাইটটা কম, তাই বোধহয় এতক্ষণ টেবিলের ওপরে রাখা ফটো ফ্রেমটার দিকে নজর পড়েনি,তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা কিশোরের মুখ সেখানে ফ্রেম বন্দী করা, ফটোটার দিকে তাকালে যে কেউই বলে দিতে পারে শুভ্রার ছেলে, তবু জিজ্ঞাসা করি,ছেলে?

হ্যাঁ কুশলদা , উজান।

বাঃ খুব সুন্দর নাম তো, কোন ক্লাসে পড়ে ?

এবার টুয়েলভের ফাইনাল দেবে ।

টুয়েলভের ফাইনাল, তার মানে শুভ্রার ছেলের বয়স এখন প্রায় সতের , মনে মনে হিসেব করি, যে বছর শুভ্রারা কোলকাতা ছেড়েছিল সেবছরই তাহলে উজানের জন্ম হয়েছে, মনের মধ্যে নিজের অজান্তেই কেন জানি কাকুলিয়ারোডের সেই ক্লিনিকটার কথা ভেসে ওঠে। আর শুভ্রা যেন আমার মনের কথাটা পড়ে ফেলে।

না কুশলদা, শেষ অবধি সেদিন আর অ্যাবরশনটা করানো হয়নি, উজানের ফটোটা হাতে নিয়ে শুভ্রা তাতেএকটা চুমু খায় , সেদিন যদি ওটা করাতাম তাহলে বলুন তো কোথায় পেতাম আমার উজানবাবুকে ?

ছেলে কোথায় ,পড়তে গেছে নাকি? ফ্লাটের দরজায় দাঁড়িয়ে পায়ে জুতো গলাতে গলাতে কথাটা জিজ্ঞাসা করি।

উজান তো কোলকাতায় থাকে না কুশলদা, পুনেতে একটা বোর্ডিং স্কুল থেকে পড়াশুনা করে ।

কী গো তোমরা ! এই টুকুন একটা ছেলে, তাকে কী না এত দূরে রেখে কর্তা-গিন্নী এসে বসে আছ কোলকাতায় , অদ্ভুত বাবা-মা তো তোমরা !

শুভ্রা যেন একটু গম্ভীর হয়ে যায়,জানেন কুশলদা, আমাদের এই জীবনে অনেক কিছুই সব সময় ঠিক করে করা হয় না বাট সারকামস্টান্স ফোর্সেস আস টুডুঅল দিস। আচ্ছা, কথাটা কি শুভ্রা আমাকে উদ্দেশ্যকরে বললো , ও কি আমাদের সামান্য এই কথাবার্তাতেই পড়ে ফেলেছে আমাকে, কুড শী রিড অল দ্যোজ ওয়ার্ডস হুইচ আই ডিডন্ট টেল হার,ও কি জেনে গিয়েছে যে আমিও আমার এই জীবনে প্রতিদিন যে কাজগুলি করে যাই তার বেশীর ভাগই আমি করতে চাই না বা বাধ্য হয়ে করি , আর প্রতি মুহূর্তের সেই দায়বদ্ধতা আমায় যেন তিল তিল করে মেরে ফেলছে, দমবন্ধকরে দিচ্ছে ,জুতোর ফিতে বাঁধা হয়েগিয়েছে , লিফটের দিকে এগোতে থাকি, শুভ্রা লিফট অবধি আমায় এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমার পাশে পাশে হাঁটছে।

কীগো ,তখন থেকে জিজ্ঞাসা করছি সমুদ্র কেমন আছে, তুমি তো বললেনা।

লিফটের বাটনে শুভ্রার আঙ্গুল, মুখটা নিচের দিকে নামানো, কুশলদা ,সমুদ্র আর আমার অনেকদিন আগেই সেপারেশন হয়ে গিয়েছে, উজানের বয়স তখন পাঁচ।

দুপুরের দেখা স্বপ্নটা রাতে আবার যেন ফিরে এলো, কালোমেয়ে তার দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে,আঙুলের ডগায় শাড়ির আঁচলটা জড়াতে জড়াতে আমাকে বলছে , কী গো, শুভ্রার সঙ্গে এতদিন বাদে দেখা হলো, কেমন লাগলো ওকে দেখে ?

শুভ্রাকে তুমি চেনো, কালোমেয়ে ?

ও মা চিনব না কেন , আমি তো তোমায় ঘিরে থাকা সবাইকেই চিনি।

যা তা কী করে হয়! মিথ্যে বলছ তুমি!

না গো, মিথ্যে বলছি না, সত্যিই তোমায় জুড়ে থাকা প্রতিটি মানুষকে কিন্তু আমি চিনি, তুমি তো এক সময় ওকে পড়াতে, বলো সত্যি কি না?

হ্যাঁ তা পড়াতাম, কিন্তু ...

কালোমেয়ে আমায় কথা শেষ করতে দেয় না , একদিন ও তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিল যে তুমি ওকে ভালবাস কি না, বলো সত্যি না?

মাথা নাড়ি আমি , কালোমেয়ের ঠোঁটের কোনে মিটিমিটি হাসি যেন, দেখেছ, আমি কিন্তু সব জানি, তবে সেদিন তুমি ওর ভালবাসায় সাড়া দেওনি, কিন্তু তুমি কি জানো, সেই ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা তোমায় মনে মনে ভালবেসে এসেছে?

"ডুবন্ত শরীর মুহূর্তে কীসের জোড়ে উঠে এসেছিল ,

এতকাল পরে

তার কোনো ব্যাখ্যা নেই

শুধু শরীরের বিষণ্ণতা রয়ে গেছে আজও

আর জল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তো পড়ছেই

সেই অনন্ত শব্দের পাশে

চোখের পতঙ্গ স্তব্ধ হয়ে আছে বহুদিন

দ্যাখো , অজস্র রাত্রির শেষে এই মৃতদেহ আমার

আলো লাগা মাত্র যে এখনও প্রেমিক"

কীগো! আবার কীভাবতে শুরুকরলে ! তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে এসো,সেই সকাল থেকে তোমার জন্য আমি কিন্তু না খেয়ে বসে আছি।

স্বপ্ন যেন সেলুলয়েডের বুকে আঁকা ছায়াছবি, তবে তফাৎটা হচ্ছে , পর্দার ছবিতে নির্দেশক তার ইচ্ছে মত চরিত্রগুলি নড়াচড়া করেন আর স্বপ্নে চরিত্রদের নড়াচড়া হয় নিজেদের ইচ্ছে মত। ভাতের গ্রাস হাতে নিয়ে কালোমেয়ে আমায় বলতে থাকে, আসলে কী জানো , পুরুষরা অনেক সময়ই কিন্তু মেয়েদের চোখের ভাষা ঠিক মত পড়তে পারে না, অথচ মেয়েরা দেখো সহজেই কিন্তু অন্য মেয়েরচোখের ভাষা পড়ে ফেলে,তোমায় একটা কথা বলি,এই মেয়েটা কিন্তু আজও তোমায় ভালবাসে, দেখলে না আজও তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় ওরচোখদুটো খুশীতে কেমন ভরে উঠেছিল।

কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তো কোনদিন শুভ্রাকে সে অর্থে ভালবাসিনি।

সে আমি জানি, কিন্তু তাতে কী হয়েছে ,ভালবাসার কি কোনো শর্ত থাকে ,তাতে কি কখনও লেখা থাকে যে ভালবাসাকে উভমুখী হতেই হবে , পাখী রাতো সারা জীবন আকাশের বুকে তাদের বাসা খুঁজে বেড়ায়, আকাশ কি কখনও তাকে সে বাসা দেয়, আবার দেখো পাহাড়ের বুক থেকে নদী কিন্তু একদিন ঠিক সমতলে নেমে আসে, তাতে কি পাহাড়ের ভালবাসা মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়, আমি জানি শুভ্রা তোমায় ভালবাসলেও তুমি কখনও ভালোবাসিনি,কিন্তু তা বলে শুভ্রার ভালবাসাটাতো আর মিথ্যে হয়ে যেতেপারে না।

আমায় একটু ভাত দেবে কালোমেয়ে ?

হাড়ি থেকে হাতায় করে ভাত দিতে দিতে কালোমেয়ে বলে ওঠে, খুব খিধে পেয়েছে বুঝি,আজঘর থেকে বেরনোর সময় উর্মি তোমায় খেতেদেয়নি?

উর্মি! সেতো কবেই আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে,ও বলেআমি নাকি ওর জীবনের একটা অভিশাপ, একটা কার্স,তাই ও আমাকে... কে যেন ঠ্যালা দিচ্ছে, ধড়মড়য়ে চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসি, উর্মি আমায় ধাক্কা দিচ্ছে, কী গো ঘুমের মধ্যেতখন থেকে উর্মি উর্মি করে খালি ডাকছ কেন?

আমি উর্মির কথার উত্তর দেই না, মনে মনে ভাবতে থাকি, কে এই কালোমেয়ে, কে রোজ রোজ স্বপ্নে এসে আমায় ভাতের থালা বেড়ে দেয়, না,আই মাস্ট ট্রেস হার আউট ।

শব্দরা ভেঙে পড়ে, ভেঙে যায় শান বাঁধানো মেঝে ধরে, চতুর বাতাস তখনই সরল জানালার সীমাবদ্ধ গরাদ পার করে, হুড়মুড়য়ে তারা লুটপাট করে টেবিলবাতীর সঞ্চিত সেই আলো ... বইমুখে তারপর অন্ধকারে পায়চারি করেছি রাতভর, জিজ্ঞাসা করেছি ... নিঃশব্দ প্রেমিকার সাদা শীৎকারহীন শরীর আসলে প্রেম না কি প্রেমিকের অপমান ... তুমি তখন ফুঁপিয়ে উঠেছিলে একবার, তারপর দরজা খুলে হেঁটে গিয়েছ পরচর্চাকারী জ্যোৎস্নায় হু হু করা রাত্রির দিকে... পাহাড়ের নীচেই থাকে কোনো না কোনো এক শান্তগ্রাম অথবা উচ্ছল ঝর্ণা .. চিরদিন...চিরকাল... তাই তোমায় ঘিরে আজ সিঁথি-ছোঁয়া সিঁদুর, শৃঙ্খল, কপালে কখনো বা করুন মেরুন টিপ, হাতে সবসময়ের বৈষয়িক শাঁখা-পলা...

নিরপরাধ আয়নায় প্রতিদিন প্রতিরাত ফুটে ওঠে অর্ধেক এক মুখ

বাকি অর্ধেক ঝলসানো অতীত-দগ্ধ জমানো, কোনো এক সুখ..."

প্লে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর পাপান চটপট করে কতগুলো রাইমস শিখে ফেলেছে, ব্যাব্যা ব্লাক শিপ, টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার, আমাকে দেখলেই জনি, জনি, ইয়েস পাপা, দোতলার সেনবাবু আর নিচের তলার সুদীপ জেঠুরা মাঝেমাঝেই আজকাল পাপানকে নিয়ে আমাদের ঘরে অনুরোধের আসর বসান , শ্রোতাদের অনুরোধে সেখানে পাপানকে একের পর এক রাইমসবলে যেতে হয়, তবে যত দিন যাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু আমার বড় দুরন্ত হয়ে উঠছে, চোখের পলকে আজকাল সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে যায় আবার কখনো বা একা একাই ছাদে উঠে আসে, আমার খুব ভয় করে , বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িঘোড়া সেরকম না চললেও টু-হুইলার কিন্তু যখন তখন আসা যাওয়া করে, তবে রাস্তার থেকেও বেশী ভয় আমার পাপানের ছাদে যাওয়া নিয়ে, ছাদের রেলিঙয়ের হাইটটা আরো একটু উঁচু করা দরকার ছিল, ভাবছি কামালকে ডেকে আরো তিন ইট করে গাঁথিয়ে নেব, কিন্তু কামাল এখন দুটো বড় বড়বাড়ির কাজে খুব ব্যস্ত, ওকে ধরাই মুশকিল।

গতমাসে আমরা দুদিনের জন্য দিঘায় গিয়েছিলাম ,সুদীপ জেঠুরাও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন , আসলে এই ট্রিপটার অর্গানাইজার সুদীপজেঠুরাই ছিলেন,বয়সে সত্তরের কাছাকাছি হলে হবে কী জেঠু কিন্তু এই বয়সেও হই-হুল্লোড় করতে খুব ভালবাসেন , ঘোরাঘুরির ব্যাপারেও ওনার খুব আগ্রহ,জেঠিমাও কম যান না, স্বামী স্ত্রী দুজনাই বেশ আছেন , ছেলেমেয়ে না থাকলে বেশীর ভাগদম্পতিই একটা বয়সে এসে খুব ডিপ্রেশনে ভোগেন, জেঠুরা কিন্তু ওনাদের মনের সেই ক্ষতটাকে আড়াল করে জীবনটাকে বেশ উপভোগ করে চলছেন, আসলে আমি দেখেছি কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা জীবনের ক্ষতগুলি ঢেকে জীবনটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে পারেন, তবে বেশীর ভাগমানুষই কিন্তু আমরা জীবনটাকে সাজাতে গিয়ে সেটাকে বরঞ্চ আরো কদর্য করে তুলি ,প্রাত্যহিক জীবনের থোর বড়িখাড়ায় এমন ভাবে নিজেদের পিষতে থাকি যে জীবনএক সময় যেন দুর্বিষহ রূপ নেয়। জেঠু জেঠিমার সঙ্গে আমি উর্মি ঝিনুক আর পাপান গিয়েছিলাম দিঘায়, জেঠিমা অনেকবার করে মাকে বলেছিলেন যাতে মাও আমাদের সঙ্গে যায় ,আমি আর ঝিনুকও খুব ঝোলাঝুলি করছিলাম, ঝিনুক তো বারবারই বলছিল, ও ঠাম্মা চলোনা , দুটোদিন তাহলে খুব মজা হবে, মা কিন্তু রাজী হলো না।

নারে বাবা,তোরা ঘুরে আয় , আমাকে আর এইবুড়ো বয়সে টানা হেঁচড়া করিস না।

ঝিনুক আর মায়ের যখন এই কথোপকথন হচ্ছিল সুদীপজেঠিমা তখন ওখানেই ছিলেন।

কাজল আজকাল তুমি কিন্তু নিজেকে একটু বেশীই বুড়িবুড়ি বলে ভাবতে শুরুকরেছ।

কী যে বলেন দিদি, বয়স হয়েছে, বুড়ী বুড়ী ভাবব না!

কে জানে, আমার তো মনে হয় শরীরের থেকেও তোমার মনের বয়সটা আসলে অনেক বেড়ে গিয়েছে , তুমি বরঞ্চ একদিন আমার সঙ্গে আমাদের সেবাশ্রমে চলো , দেখবে সেখানে তোমার বয়সী কতমহিলাপুরুষ কাজ করছেন, তাদের দেখলে বুঝতেই পারবে না যে তারা এক-একজন সত্তরের কোটা পার করে ফেলেছেন।

না,মায়ের ব্যাপারে সত্যিই ভাববার সময় হয়েছে, মা যেন দিনদিন বড়বেশী ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছে , আজকাল সকাল-সন্ধ্যায় পূজো করারসময়টুকু ছাড়া মাকে দেখলে মনেই হয় না যে এই পৃথিবীর সঙ্গে মায়ের কোনো যোগাযোগ আছে, অলোককাকু আসলেও মায়ের ঘর থেকে আজকাল আর কথাবার্তার সেরকম আওয়াজ পাওয়া যায় না, মা বিছানায় চুপ করে বসেথাকে আর কাকু বিছানার উলটোদিকে পাতা সোফাটায় বসে টিভি দেখতে থাকেন।

উর্মি অবশ্য মায়েরএই না যাওয়াটার মধ্যেও বিশেষ একটা কারণ খুঁজে পেলো, আরে বাবাও রকম ভাবেবললে তোমার মা থোড়াই যাবেন !

উর্মি ঠিক কী বলতে চাইছে সেটা বুঝতে না পেরে আমি বোকার মত প্রশ্ন করে উঠি, মানে ?

আমাকে যেন খুব একটা গোপনকথা জানাচ্ছে এভাবে উর্মি বলে , শোনো ,তোমার মাকে যদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও তাহলে আগে তোমার অলোককাকুকে রাজী করাও , তখন দেখবে তোমায় আর বলতে হচ্ছে না , উনি নিজেই যাওয়ার জন্য তদ্বির শুরু করে দেবেন।

কিছু বলি না , পৃথিবীতে আমাদের জন্ম হয় দুটো চোখ নিয়ে, অন্ধরা না হয় দেখতে পান না কিন্তু যাদের আমাদের দৃষ্টিশক্তি আছে তারাও কি পৃথিবীর সব সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাই,পাইনা,কারণ কিছু কিছু মানুষের দৃষ্টি ঠিক শকুনের মত হয়, যত ওপরেই উঠুক না কেন তাদের নজর কিন্তু সব সময় ভাগারের দিকেই থাকে।

দিঘায় ঘুরতে গিয়ে ফ্রান্স থেকে আসা এক মধ্যবয়স্ক দম্পতীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো , ওনারা এক মাসের জন্য ছুটি নিয়ে ভারত ভ্রমণে এসেছেন, আমরা যে হোটেলেছিলাম সেই হোটেলেই উঠেছিলেন ভদ্রলোকরা , পাপানকে খুব ভালো লেগে যায় ফরাসী দম্পতীর, পাপানকে দেখলেই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা দুজনাই পাপানের চুলগুলি এলোমেলো করে দিতেন, ভদ্রমহিলা পাপানের চিবুকটা ধরে বলতেন,সুইট বেবি, ভেরি কিউট, ওনাদের দামী ক্যামেরায় ঝিনুক আর পাপানের অনেক ছবিও তুলেছিলেন, ফেরার দিন ভদ্রলোক আমায় অনুরোধ করলেন যাতে আমি আমাদের বাড়ির পোস্টাল অ্যাড্রেসটা ওনা কেলিখে দেই , তখন বুঝিনি , আজ কুরিয়ারের ছেলেটা একটা মোটা খাম ডেলিভারি দিয়ে গেলে দেখলাম ফরাসী দম্পতি পাপান আর ঝিনুকের তোলা সব ছবির একটা করে কপি পাঠিয়েছেন, সঙ্গে সুন্দর একটা কার্ড, ইংরেজিতে লেখা, পথের বন্ধু, দূরত্বকে ভুলে যাও, এসো আমরা পরস্পরের হৃদয়ে থাকি।

বৃষ্টিটা নামলো একদম অফিস ছুটির সময়, এখন যতক্ষণ না বৃষ্টিটা থামছে ততক্ষণ আর অফিস থেকে বেরনো যাবে না,ল্যাপটপও বন্ধ করে ফেলেছি ,খুলতে আর ইচ্ছে করছে না,হঠাৎ টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ল্যান্ডফোনের ইনস্ট্রুমেনটার দিকে নজর গেলো , শুভ্রা সেদিন একটা চিরকুটে ওর ফোন নম্বরটালি খেদিয়েছিল, একবার ফোন করে মেয়েটার খবর নেই বরঞ্চ ,নম্বর মিলিয়ে ডায়াল করতে থাকি,শুভ্রা ফ্রি থাকলে কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে গ্যাঁজানো যাবে,শুভ্রার ফোন বাজছে,হঠাৎকে যেন আমার কানের কাছে ফিসফিসকরে বলে উঠলো,নম্বরটা তো সেইকবেই দিয়েছিল আর এতদিনে কি না তোমার সময় হলো ফোন করবার , কালোমেয়ে ,এ তো কালোমেয়ের গলা , কালোমেয়ে তুমি কখন এলে,তোমারগলা শুনলেও আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছিনা কেন ,তুমি কি অদৃশ্য কেউ, আর ইউইন ভিজিবল ,কিন্তু আমি তো তোমায় দেখতে চাই কালোমেয়ে , আমি তো জানতে চাই, তুমি কে আসলে,কেন তুমি ধীরে-ধীরে আমার সমস্ত স্বত্বায় নিজের অধিকার কায়েম করে ফেলছ।

“দমকা হাওয়ায় পুড়িয়ে দিচ্ছে আগুনে জন্মানো একটা প্রেম ...

যে প্রেমে স্পষ্ট দেখা যেত একটা হাত ধরে আছে

আর একটা হাত ... “

অসতর্ক নিশি ডাকে দরজা খুলে যায়, পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঘুমন্ত লতাটি জাপটে ধরে তার একমাত্র ফুল, ধ্বংস চুইয়ে নামতে থাকা জ্যোৎস্নার দিকে তাকায় না সে, রাত্রিরেখার খোঁজে রাতজাগা পাখিরা হঠাৎ করেই যেন একসাথে একটানা ডেকে ওঠে... স্বাভাবিক আর শব্দহীন বাতাসে ফিরে ফিরে আসে আরো একবার মন খারাপেরা ...

প্রতিফলিত আয়নায় তখনই তুমি ভেসে ওঠো ... ভেসে ওঠো আমাদের সেই অবিশ্বাস্য সরল অতীত হয়ে...

শুধু একসাথে রাত্রিরেখা পার হওয়া হয়নি আমাদের, তাই ভোরের অস্পষ্ট আলোয় হেঁটে গেছি আমরা আলাদা আলাদা দুটো পথ হয়ে...

শুভ্রার নম্বরটা বেজেযাচ্ছে , নো রিপ্লাই।


ক্রমশ