শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত -৩

বুলটিরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আগ্নেয়গিরিটার দিকে!বুলটি স্বগত স্বরে বলে ওঠে, ‘এই সেই অভিশপ্ত দ্বীপের অভিশপ্ত আগ্নেয়গিরি!’ ওরা দেখে আগ্নেয়গিরিটার চুড়ো থেকে তলদেশ অবধি অনেকগুলি বরফের ঝরনা গা বেয়ে বেয়ে লম্বালম্বি হয়ে নেমে আসছে ...।

তিমিমাছ-লঞ্চ যতই সৈকতের কাছাকাছি যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির চুড়োটা আকাশছোঁয়া হচ্ছে। বুলটিরা চোখ সরাতে পারছে না ওখান থেকে।ডাব্বু গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলে ওঠে, ‘আগ্নেয়গিরিটা যদি এখনই ফেটে ওঠে...!’ বুলটি ধেতিয়ে ওঠে, ‘এই ভিতুয়া ,ওসব কথা মনেই আনবি না। ভুলে গেলি হেডস্যারের দেওয়া অভয়বানীটি, ভয় পায় ভীরুরা/ জিতে ফেরে বীরেরা...।যদি ভয় পাস এই অভয়বাণীটি জপ কর, ভয় দূর হয়ে যাবে...।’ আর কারো মুখে কোনও কথা নেই।

একসময় তিমিমাছ গিয়ে থামে সৈকতের বালুকাচরে।সেখানেও আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে!ওরা দেখে ওখানে যেন কারা বিছিয়ে রেখেছে নানা রঙের গালিচা।যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখা যায় এই গালিচা...।কোথাও সবুজ,কোথাও কালো,কোথাও হলুদ, কোথাও সোনালি...।অবাক হয়ে বুলটি বলে ওঠে, ‘ ওমা এখানে এত বিশাল বিশাল রঙিন কার্পেট কারা বিছালো!’ বুলটির কথাটা শুনে হেরম্ব গাঙ্গুলি হেসে বলে ওঠেন , ‘ আরে ওগুলো কার্পেট নয়, সাগর-সৈকত(সাগরের তীর)তো বালুময় থাকে, ওখানকার ওই বালুগুলো প্রকৃতির ইচ্ছায় এ-রকমই হয়, দেখতে অনেকটা বিচিত্র রঙের বিশাল বিশাল কার্পেটের(গালিচার)মতই!’

--এই অভিশপ্ত দ্বীপের প্রথম চমকই এই, এরপর আরও কী চমক দেখতে পাবো কে জানে!’ কথাটা বলতে বলতে ঢিলে হয়ে যাওয়া মাথা থেকে গলা অবধি মোড়ানো মাফলারটিকে ঠিকঠাক করতে থাকে বিট্টুস। ওর গলায়ও শঙ্কা।

তিমিমাছের পেট থেকে একে একে নেমে পড়ল সবাই।লঞ্চটা যেখানে এসে থেমেছে সৈকতের সে জায়গাটা ঘন সবুজ। নেমেই বুলটিরা যে যেভাবে পারে সবুজ বালুগুলিকে নিয়ে লোফালুফি শুরু করে। বুলটি বলে ওঠে, ‘ওমা একেবারে আমাদের রং খেলার আবির রে... খেলবি নাকি...। ‘ইয়েস ইয়েস ইউ ক্যান স্টার্ট ইয়োর ফেস্টিভ্যাল অফ কলার হিয়ার এগেইন...হা হা হা...’(হ্যাঁ হ্যাঁ তোমরা এখানে আবার তোমাদের রং-খেলা শুরু করে দিতে পার...হা হা...) তিমিমাছটা উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে উঠল কথাটা। হেরম্ব গাঙ্গুলিও হাসতে হাসতে গিয়ে বসেন আবার তাঁর আসনে । গিয়ারে হাত রেখে চালিয়ে দেন তিমিমাছটাকে। তিনি ফিরে যাচ্ছেন হনলুলু। হাত দেখিয়ে বললেন, ‘ঈশ্বর চাইলে আবার কোনোদিন দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে হে আমার ছোট্ট বন্ধুরা,এখন তোমাদের রক্ষা করতে পারেন কেবলই ঈশ্বর ...’। বলতে বলতে তিনি ওপরের ঝাঁপ ফেলে দিলেন।তিমিমাছটিও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ মে গড প্রটেক্ট ইউ...’(ভগবান তোমাদের রক্ষা করুন)। হেরম্ব গাঙ্গুলিকে আর দেখা যাচ্ছে না এখন। বুলটিরা সবাই গভীর সাগরে চলে যাওয়া তিমিমাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তিমিমাছটি এক সময় সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের আড়ালে হারিয়ে যায়।

বুলটিরা আবার সৈকতের সবুজ বালুগুলির দিকে মনোনিবেশ করে।ডাব্বু তো লাফালাফি শুরু করে দেয় বালুগুলির ওপর।ওদের দেখাদেখি বাকিরাও। দিনের আলো বালুগুলোতে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে ওদের গায়ে ।বিট্টুস ওর মাফলারটাকে সামলে এই সবুজের আনন্দ-উল্লাসে মিশে গিয়ে মোবাইলে নিজেদের ছবি তুলতে থাকে।

এক সময় ওরা সৈকত ছেড়ে ক্রমশ উঁচাই পাড় পেড়িয়ে উঠে আসে সমতলে। সমতলে উঠেই সামনের দৃশ্য দেখে ওদের দুচোখ স্থির।এত সুন্দর দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি ওরা। সাড়া দ্বীপভূমি জুড়ে শুধু ফুল আর ফুল, সাদা হলুদ বেগুনি কত রকম রঙের ফুল! গাছে গাছে যেন ফুলগুলোই রাজপাট বিছিয়ে রেখেছে। একে অপরের সঙ্গে খেলছে দুলছে! বিস্ময়ে মুখ দিয়ে ওদের কথা সরে না কিছুক্ষণ।তারপর একসময় সবাই একসঙ্গে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো হর্ষোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওয়াও,কী দারুণ...’। বিট্টুস বলে ওঠে, ‘প্যারাডাইজড বিউটি ...প্যারাডাইজড বিউটি...’(‘স্বর্গীয় সুন্দর...স্বর্গীয় সুন্দর’) । ওই মুহূর্তে ফুলের বনের ভেতর থেকে মাইক্রোফোন জাতীয় কোনও যন্ত্র থেকে কে যেন সাবধান করে দেয়, ‘কুল ডাউন ...কুল ডাউন...’(‘শান্ত হও...শান্ত হও...’)। এ আরেক বিস্ময়! ওরা তটস্থ হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।মনে অজানা শঙ্কা আর কৌতূহল ! ওই মাইক্রোফোন থেকে আর কোনও কথা ভেসে আসছে না দেখে একসময় বুলটি চুপি চুপি বলে ওঠে, ‘চল এবার আমরা আস্তে আস্তে পা চালাই’।

ওরা গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকে ফুলের বনের দিকে। ফুলের বনের ভেতর ঢোকা মাত্রই ওদের চোখে পড়ে দূর থেকে এগিয়ে আসা একজন মানুষকে। ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে।মানুষটা কেমন যেন ছায়া ছায়া ,আবার কখনো কখনো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে...মানুষটি যতই ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ততই ফুটে উঠছে তাঁর অবয়ব। ওরা মুহূর্তে একটু যেন ভরসা পেল এই নির্জন দ্বীপে মানুষের দেখা পেয়ে। মানুষটা যখন ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল দেখল মানুষটির গাঁয়ের রং যেন দুধে-আলতায় সাদা।ওই সাদা গায়ে পরা একটি মাত্র সাদা আলখাল্লা। অনেকদিন দাড়িগোঁফ কাঁটা হয়নি। সাদা সাদা চুলগুলো ঘাড় ছাড়িয়ে নীচে নেমে গেছে। সাদা সাদা দাড়িগুলো ভুঁড়ি ছুঁই ছুঁই। গোঁফটা এতো পুরু আর দুপাশে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তার ঠোঁট দুটো দেখা যায় না।পিঙ্গল চোখ দুটো তার যেন জলের ওপর ভাসছে। ওই-চোখ দুটি তার এতোই উজ্জ্বল যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! মানুষটিকে দেখে বুলটির মনে পড়ে যায় ‘ফেয়ারি-টেল ফ্রাইডে’তে(শুক্রবারের রূপকথা) পড়া সেই দেবদূতটির কথা।হুবহু এমন দেখতে। তিনিই যেন নেমে এসেছেন এখানে।মানুষটিকে দেখে ওরা আরও চমৎকৃত হয় এই কারণে যে, মানুষটির চওড়া কাঁধে বসে আছে একটি ঝকঝকে বাজপাখি।বাজপাখিটি চুপচাপ বসে নেই,চারদিকে চোখ ঘুরাচ্ছে শুধু...।

হঠাৎ ওরা আবিষ্কার করে ওই ঝোপসদৃশ গোঁফের আড়ালে মানুষটি ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। শুধু গোঁফে নয় , বিস্ময় ভরা দু চোখেও যেন হাসি ফুটে উঠছে তার।মানুষটি হঠাৎ বাংলায় বলে ওঠে, ‘তোমাদের কে সাহস যোগালো এখানে আসার, হে আমার ছোট্ট সোনা বন্ধুরা’!

বুলটি চমকে বলে ওঠে ‘আপনি বাংলা জানেন!’

মানুষটি উদাস ভাবে বলে ওঠে, ‘না জানার কি হয়েছে বন্ধু, আমি তো একাল ওকাল পরকালের সব ভাষা জানি , তোমরা যে বাংলায় কথা বলছিলে আমি শুনতে পেয়েছি,তাই বাংলায় বলছি... সে যা হোক আমার প্রশ্নের জবাব দাও...।’

মানুষটির কথাগুলো বুলটিদের কাছে কেমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা ঠেকলো। মাথায় ঢুকলো না । মানুষটির গলার স্বরও যেন কেমন অন্য রকমের লাগলো ওদের কাছে!কেমন আজব...আজব...।

বিট্টুসের আর তর সয় না ।সে বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে জবাব দেয়, ‘আওয়ার মা-বাবা,আওয়ার হেডস্যার অ্যান্ড আওয়ার দেশ সাহস জুগিয়েছে স্যার।’

বিট্টুসের মুখের ভাষা শুনে মানুষটি মুখে আঙুল চেপে প্রথমে এক চোট হেসে নেয়,তারপর বলে, ‘ওহ গুড গুড তোমাদের দেশ তোমাদের সাহস জুগিয়েছে, শুনে খুব ভালো লাগলো...তা বেশ তোমরা কোন দেশের খোকাখুকু বল তো বন্ধুরা?’

বুলটিরা সবাই গলা মিলিয়ে বলে ওঠে, ‘ভারতবর্ষ...।’

বিট্টুস আলাদাবাবে বলে ওঠে, ‘ইন্ডিয়া...ইন্ডিয়া...’

ওদের এ কথার প্রতিক্রিয়ায় মানুষটি বলে ওঠে, ‘হুম, ইন্ডিয়া,তোমরা যখন এই দ্বীপে এসে নামলে তখনই আমি এটাই সন্দেহ করেছিলাম...তোমাদের চোখমুখ দেখে আরও একটি বিষয়েও আমি সন্দিহান হয়েছিলাম , তোমরা বেঙ্গলি... তারপর যখন তোমাদের বাংলায় কথা বলতে শুনলাম, নিঃসন্দেহ হলাম...।’

বুলটিরা আবার এক সঙ্গে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ স্যার আমরা সবাই বাঙালি।’

এখানেও বিট্টুস আলাদাভাবে বলে ওঠে, ‘বেঙ্গলি...বেঙ্গলি...’

--হ্যাঁ হ্যা,তা তো বুঝলাম,কিন্তু তোমরা যে এখানে কি বিপদ মাথায় করে নিয়ে এসেছ জানো কি?’ মানুষটি তাঁর ভ্রু-যুগল কপাল অব্দি ছড়িয়ে দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।

ভোম্বল বুক উঁচিয়ে জবাব দেয়, ‘ জানি স্যার, পদে পদে মৃত্যু...’।

ডাব্বু বলে ওঠে, ‘মৃত্যু আমাদের পায়ের ভৃত্য...’।

শিম্মি বলে ওঠে, ‘ভয় পায় ভীরুরা/ জিতে ফেরে বীরেরা...’।

বুলটি বলে ওঠে, ‘নতুন কিছু জানতে হলে,দেখতে হলে অত ভাবতে নেই স্যার...’।

বিট্টুস ওর জামার আস্তিনটা সরিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেখায় মানুষটাকে, ‘এই যে দেখুন স্যার কার কার ট্যাটু আঁকা আছে— মহাদেব, হজরত মহম্মদ,জিশু খ্রিস্ট আর বুদ্ধ, এরা আমাদের সঙ্গে যখন আছেন কোনও ভয় নেই স্যার...’।

---উরে বাপরে বাপ, তোমরা ড্যাম কেয়ার দেখছি ...সত্যি তোমাদের দেশ সুশিক্ষাই দিয়েছে তোমাদের, তাঁর ওপর বাঙালি,তোমাদের দেশে চিরকালের একজন বীর ছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু, তিনি তো বাঙালি, জার্মানের সঙ্গেও তাঁর আত্মীয়তা ছিল, আমিও জার্মানি, আই লাইক হিম ভেরি মাচ(আমি তাঁকে খুব ভালোবাসি)...।’ এই বলে মানুষটি বুলটিদের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ,তারপর আবার বলে, ‘আই লাইক ইউ অলসো(আমি তোমাদেরকেও ভালোবাসি)...এই শান্ত-সুন্দর প্রকৃতিও সাহাসীদেরই পছন্দ করে, ভীরুদের ছুড়ে ফেলে দেয়...’,বলতে বলতে নিঃশব্দে হেসে ফেলে মানুষটি...


চলবে ...।