বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত ... শেষ পর্ব

’ ###

যখন ওরা সবাই দেবদূতদাদুর শিবিরে ফিরে এলো তখন শিশির ঘন হয়ে পড়ছে। আগ্নেয়গিরিটিকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। শিশিরের আড়ালে চলে গেছে।দেবদূতদাদু শিবিরের ভেতর চলে গেলেন।বুলটিরাও পেছন পেছন ঢুকে গেল।

ভেতরে ঢুকেই দেবদুতদাদুকে আর দেখা গেল না। ওরা সবাই মিলে শিবিরের আনাচে-কানাচে তন্ন তন্ন করে ওঁকে খুজল। কোথাও পেল না । ভোম্বল অনেকটা বিরক্ত হয়েই প্রশ্নমুখর হয়ে ওঠে, ‘আচ্ছা,দেবদূতদাদু কি জাদু জানেন নাকি রে,হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যান!’ শিম্মি গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলে ওঠে, ‘ ভূত নয় তো?’

ডাব্বু ভয়ে ভয়ে শিম্মির কথায় সায় দেয়, ‘হতে পারে, তার ওপর সাদা ভূত...’! বুলটি ধমকে ওঠে, ‘এই চোপ, ও সব বাজে কথা বলবি না তো, আমার ভয় করে...।’

ওই মুহূর্তে দেবদূতদাদু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে যেন নেমে এলেন। মুখে তাঁর আশ্বাসের হাসি, ‘কীসের ভয়,কোনো ভয় নেই বন্ধুরা, আমি আছি না...নাও তোমরা এবার বিশ্রাম কর ,আজ তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, কারণ আসছে কাল শেষ রাতে উঠতে হবে তোমাদের, ইয়েতি অভিযান?’

বিট্টুস উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ইয়েতি ইয়েতি কাল ইয়েতিকে পাকড়াও করতেই হবে...।’

দেবদূতদাদু শান্ত গলায় বলে ওঠেন, ‘নো টেনসান বন্ধু, নো টেনসান, উত্তেজিত হবে না, ওই অভিযানের জন্য তোমাদের এখন সব রকম চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে...তাই গান গাও,গান শোনো,বই পড়, লুডো খেলো,দাবা খেলো...।’বলতে বলতে তিনি তাঁর হোম থিয়েটারে নিচু স্বরে গান চালিয়ে দিলেন।আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন লুডো , দাবার বোর্ড আর একগুচ্ছ রূপকথার বই উড়ে এসে ঝুলে রইল বুলটিদের হাতের কাছে।

দেবদূতদাদু আবার বললেন, ‘এবার তোমরা আনন্দ কর,শুধু আনন্দ...বাকি সব ভুলে যাও বন্ধুরা... আমি আসছি...।’

--কেন তুমি থাকবে না আমাদের সাথে?’ বুলটি গ্রীবা সটান করে শুধোয়।

দেবদূতদাদু জবাব দেন, ‘ না বন্ধুরা এখন আমার প্রে(প্রার্থনা) করার সময়, আমি তো সব সময় আমার আরাধ্য দেবতা ওই আগ্নেয়গিরিটাকে নিয়েই থাকি।ও-ই তো আমার আশ্রয়দাতা...।’বলতে বলতে তিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।

ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু সত্যই সত্যই ভ্যানিস হয়ে যাওয়ার মন্ত্র জানেন,ফেরার সময় শিখে নিতে হবে...।’

--থোরাই তোকে শেখাবেন...।’ বিরবিরিয়ে কথাটা বলে শিম্মি।

বুলটিরা সবাই আনন্দে মেতে ওঠে...এবং আস্তে আস্তে কার ইশারায় যেন ওরা এক সময় নিজেদের হারিয়ে ফেলে...।


###

... হঠাৎ ওরা সবাই একসময় জেগে ওঠে...। কে যেন ওদের ডাকছে আয়...আয়...আয়...। ধরমরিয়ে উঠে বসে বুলটিরা। অন্ধকারে চোখ কচলায়। সবাই নিজের মধ্যে ফিরে এলে ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।বিট্টুস ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেবদূতদাদুকে ডাকে, ‘ ও দাদু, দাদু, তুমি কোথায়?’ দেবদূতদাদুর কোনো সাড়া নেই। বাইরে থেকে আয়...আয়...আয়... ডাকটা ওদের যেন টেনে নিয়ে যেতে চায়...। বুলটিরা ভয়ে একেবারে জুবুথুবু হয়ে পড়ে।

এমন সময় সারা ঘরে সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। ওই আলোয় ওরা দেখে একটি ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে...।একটি মানুষের স্বর বলে ওঠে, ‘হে আমার সোনা বন্ধুরা, তোমরা ভয় পেয়ো না, এখন থেকে আমি যা বলব তাই করে যাবে...।’বুলটিদের বুঝতে অসুবিধে হল না যে, এইটি দেবদূতদাদুর গলা। ওই ছায়া আবার বলে ওঠে, ‘ তোমরা একে একে বিছানা ছেড়ে নেমে এস...।’ ছায়ার কথা মতো ওরা সবাই বিছানা থেকে নামলো। ছায়া এবার নির্দেশ দেয়, ‘যাও তোমরা আমার ট্রায়াল রুমে যাও, ওখানে তোমাদের ইয়েতি অভিযানের সব সামগ্রী পড়ে রয়েছে, চটপট পরে নাও...।’

ওরা সবাই ট্রায়াল রুমে যায়, দেখে ওখানে সাজানো রয়েছে গাঁইতি,সোলে(জুতোর তলে)কাঁটা লাগানো বুটজুতো, ভারী ভারী মোটা কম্বলের প্যান্ট আর জ্যাকেট,গরম দস্তানা আর টুপি...।ওরা পরে নিলো ওগুলো, হাতে নিল গাঁইতি ...।তারপর কার নিঃশব্দ নির্দেশে যেন শিবিরের বাইরে এসে হাঁটা ধরল সামনের দিকে।ওরা ওদের ভেতরে নেই যেন।তখনো বাতাসে ধেয়ে আসছে ...আয়...আয়...আয়... ডাক। তখনো আকাশ থেকে নিরন্তর পড়ছে বরফ আর বইছে হিমেল বাতাস।

ওরা এক সময় পৌঁছে যায় বরফে মোড়া আগ্নেয়গিরিটির কাছে...।বরফগুলোর শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে আবছা আবছা অদ্ভুত রকমের আলো।ওই আলোতেই মালুম করা যায় আগ্নেয়গিরিটিকে। আগ্নেয়গিরিটির চুড়োটাকে ওরা খোঁজার চেষ্টা করে।কিন্তু চোখে পড়ে না ওটা।ওখান থেকেই যেন ডাকটা নেমে আসছে নিচের দিকে...আয়...আয়...আয়...। দেবদূতদাদুর গলা শোনা যায়।তিনি যেন কাছেই আছেন ওদের।তিনি বললেন, ‘না বন্ধুরা, চুড়োটাকে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না, ওটা আকাশের সঙ্গে মিশে আছে...।’বলে একটু থামলেন তিনি।তারপর আবার বলা শুরু করেন , ‘হারি-আপ বন্ধুরা, তোমরা গাঁইতি চালিয়ে চালিয়ে ওপরে উঠতে থাক,ভয় পেয়ো না, আমি আছি তোমাদের সঙ্গে...।’

বুলটিরা টের পেল ওই মুহূর্তে যেন কেউ ওদের শরীরে জুগিয়ে দিল নতুন শক্তি। ওরা সবাই গাঁইতি খুঁড়তে খুঁড়তে ওপরে উঠতে থাকে। ওরা বুঝল বরফ খুঁড়ে খুঁড়ে পাহাড় চড়া বড় কঠিন কাজ...।ক্ষণে ক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠছে। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘ওভাবে এক নাগাড়ে চড়লে হাঁপিয়ে উঠবেই, রয়েসয়ে ওঠো, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে...।’ওরা সে-ভাবেই ওঠা শুরু করে।আয়...আয়...ডাকটাই যেন ওদের টেনে তুলছে।

উঠতে উঠতে এক সময় হঠাৎ ওরা ঘূর্ণি হাওয়ার ভেতর ঢুকে পড়ল। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘ বন্ধুরা শিখরের এই অংশ থেকে শুরু হয় ঘূর্ণি হাওয়া, এই ঘূর্ণি হাওয়া সইতে সইতেই ওপরে উঠতে হবে তোমাদের এবার ... এগিয়ে চলো বন্ধুরা ...।’বুলটিদের এবার মনে হল দেবদূত দাদুর গলাটা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এলো।ঘূর্ণি হাওয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। নিজেদের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু ওই আয়...আয়...আয়... ডাকটা ওদের অস্থির করে তুলছে। ওরা ঘূর্ণি হাওয়া প্রতিহত করতে করতে আরও ওপরে উঠতে চেষ্টা করে। কিন্তু বার বার আছড়ে পড়ছে।ভোম্বল আর শিম্মি পিছিয়ে পড়ছে। ভোম্বল তো দু-তিন বার বরফের ওপর পড়ে গিয়ে পালটি খেল। বিট্টুস খেল ডিগবাজি। বাকিরা সবাই নাস্তানাবুদ।

যতই ওপরের দিকে ওঠা যাচ্ছে ততই ঘূর্ণির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।সেখানে এই ঘূর্ণির ডামাডোলের ভেতর হঠাৎ ওরা দেখে অনেকগুলো বরফের ডেলা ঘূর্ণি খাচ্ছে! ঘূর্ণি খেতে খেতে মানুষের রূপ নিচ্ছে ! রূপ নিতে নিতে ঝড়ের বেগে ওপরে উঠে যাচ্ছে।বিট্টুস চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ এই তো ইয়েতি,এই তো ইয়েতি, দেবদূত দাদু ইয়েতি দেখেছি ...।’ দেবদূত দাদুর কোনও সাড়া পাওয়া যায় না।বাকিরা সবাই শ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে ওগুলোর দিকে। নতুন নতুন আরও হচ্ছে ঘূর্ণি খেতে খেতে।বিট্টুস উত্তেজিত হয়ে ডাকতে থাক, ‘এই যে ইয়েতি বন্ধুরা একবার আমাদের কাছে আসুন না হ্যান্ড-শেক করব...।’

কিন্তু কে কার ডাক শোনে। ওগুলো ওদের খেয়াল মতো ঘূর্ণি হচ্ছে আর হুস হাস ছুটছে এদিক-ওদিক...। বিট্টুস ক্ষান্ত হয় না, ডাকতেই থাকে...।এমন সময় আচমকা একটা ইয়েতি এসে দাঁড়ায় ওদের কাছে।ওরা তটস্থ হয়ে ওঠে।ওরা দেখে ওদের সামনে সত্যই দাঁড়িয়ে আছে একটি বরফের মানুষ,অর্থাৎ তুষার মানব। ওর বরফের শরীরের গর্তে ঢোকা দুটো চোখ আর নাক ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ইয়েতিটা অনেকটা নাকি সুরে বলে ওঠে, ‘ তোমাদের মধ্যে বিট্টুস কে আছ?’ বিট্টুস উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, ‘আমি আমি আমি বিট্টুস...। ’ইয়েতিটা বিট্টুসকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, ‘ তুমিই তো চেয়েছিলে ইয়েতির সঙ্গে হ্যান্ড-শেক করতে,এসো তালে হ্যান্ড-শেক করি...।’ বলতে বলতে ওটা বিট্টুসের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বিট্টুস ওর মনের উত্তেজনা আর আবেগ ধরে রাখতে পারে না আর।তড়িৎ বেগে ইয়েতির হাতটা ধরে ফেলে। ইয়েতিটা এবার বিট্টুসের হাতটি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে। বিট্টুস আপ্লুত হয়ে যায়। ইয়েতি বলে ওঠে, ‘কি,খুশি তো’?বিট্টুসের মুখে ভাষা নেই, সে শুধু মাথা নাড়ায়।

ওই ফাঁকে বুলটি আকুল হয়ে বলে ওঠে, ‘আমরা কি বাদ যাব ইয়েতি বন্ধু?’ ইয়েতি বলে ওঠে, ‘ না না কেন বাদ যাবে, তোমরা আমায় বন্ধু বলে ডাকছ, তোমরাও আমার বন্ধু হলে আজ থেকে, বিট্টুস ওর মনের ইচ্ছেটা আগেই প্রকাশিত করেছিল বলে ওর সঙ্গে প্রথম হাত মেলালাম, এসো এবার তোমাদের সঙ্গে হাত মেলাই...।’বলতে বলতে ইয়েতিটা বুলটি,শিম্মি,ভোম্বল আর ডাব্বুর সঙ্গেও হাত মেলায়।

হাত মেলানো শেষ করে ইয়েতিটা আবার বলা শুরু করে, ‘হে আমার ক্ষুদে বন্ধুরা, তোমাদের কথা আমি আগেই শুনেছি। তোমরা সাহসী খোকা-খুকু, তোমাদের সাহসিকতার তুলনা হয় না । তোমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছ। ইন্ডিয়ার খোকা-খুকুরা যে এতো সাহসী হয় আগে জানা ছিল না। কিন্তু তোমরা ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে যাও এটা কেমন কথা...!’

বিট্টুস সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে ছাড়ে না, ‘ ভূতের ভয় কে না পায়,সবাই পায়,বড়রাও পায়,হু-উ-উ...। ’বিট্টুসের এই প্রতিক্রিয়ায় ইয়েতি হো হো করে হেসে ওঠে। ওর সে হাসি বরফশিখরের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনিত হয়।হাসি থামিয়ে ইয়েতি আবার বলে ওঠে , ‘ ঠিক বলেছ ঠিক বলেছ বন্ধু,ভূতের ভয় আমিও পাই,একটু-আধটু ভূতের ভয় পেতেই হয় ,কি বলো...।’ বলে একটু থামল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে কী জানি দেখল কিছুক্ষণ। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘ তবে তোমরা তো খোকা-খুকু, বেশি ভূতের ভয় সহ্য করতে পারবে না...এই দ্বীপ,এই শিখরটা তো সব্বনেশে, অভিশপ্ত্‌...এখানে মানুষ থাকে না...।’

শিম্মি চট করে ইয়েতিকে বাঁধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘কেন আমাদের দেবদূতদাদু তো থাকেন এখানে!’

ইয়েতি যেন না জানার ভান করে ওর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, ‘দেবদূত দাদু,কে দেবদূতদাদু?’

বুলটি অবাক গলায় বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদুকে চেন না, যে দারুণ জাদু করে, ওঁর শিবিরেই আমরা আছি... !’

---ওঁ ওঁ ওঁ... জাদু তো করবেই, জাদু করাই তো ওর কাজ...।’বলতে বলতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে ইয়েতি।

--হ্যাঁ,ঠিক বলেছ ইয়েতি বন্ধু, তিনি সব সময় যেন জাদুর মধ্যেই থাকেন...!’ওই সুযোগে টুস করে এই মন্তব্যটি করে ভোম্বল।

ইয়েতি কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর গম্ভীর স্বরে বলে, ‘ওই জাদুতে তোমরা একদিন হারিয়ে যাবে বন্ধুরা... কেউ খুঁজে পাবে না তোমাদের... জানো তো তোমাদের মা-বাবারা তোমাদের জন্য ভীষণ চিন্তা করছেন,মায়েরা তো কান্নাকাটি করছে...তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না বলে...এই দ্বীপটা তো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে বহু কাল ধরে, কোন নেট- ওয়ার্ক যোগাযোগ করা যায় না এই দ্বীপের সঙ্গে...।’ বলতে বলতে ইয়েতি আবার আকাশটাকে নিরীক্ষণ করে।তারপর বলে, ‘এখানে তোমাদের পদে পদে বিপদ বন্ধুরা , এটা একটা রহস্যময় দ্বীপ, তোমরা আজই ফিরে যাও বন্ধুরা ,আজই ফিরে যাও... ভোর হয়ে এলো আমি এবার যাই...। ’বলতে বলতে ইয়েতি বন্ধু আবার ঘূর্ণির ভেতরে ঢুকে চোখের নিমেষে ছুটে বেরিয়ে যায় ওপরের সিকে।

বুলটিরা সবাই অপার বিস্ময়ে ওদের ইয়েতি বন্ধুকে যেন একটা ছায়ার মতো সরে যেতে দেখল। ওপর থেকে এবার হাওয়ায় ভেসে আসছে নতুন রব,...ফিরে যাও...ফিরে যাও...।

ইয়েতি বন্ধু চলে যাওয়ার পরই আকাশ ফর্সা হতে শুরু করে।বরফগুলো থেকে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত আলো এখন আর নেই। ফর্সা হতেই আরেক বিস্ময়। ওরা দেখে,বরফে ঢাকা শিখরের গায়ে ওদের চোখের সামনে থেকে কতগুলো বড় বড় পায়ের ছাপ ওপরের দিকে চলে গেছে...!বুলটি অভিভূত হয়ে বলে ওঠে, ‘এগুলোই ইয়েতির পায়ের ছাপ...।’ বাকিরা সায় দেয়, ‘হ্যাঁ তাই...।’ তখনো ওপর থেকে নির্দেশ ভেসে আসে, ...ফিরে যাও ...ফিরে যাও...।

কীসের একটা অমোঘ টানে যেন বুলটিরা মুহূর্তের ভেতর ফিরে আসে দেবদূতদাদুর শিবিরে।তখন ভোর হয়ে গেছে।এখানে এসেই ওরা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। ওদের শরীরে অভিযানের পোশাকগুলো নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে গাঁইতিও!অথচ গত রাতের স্মৃতিগুলো মাথায় ঘুরছে।

হঠাৎ বিট্টুসের বোধের উদয় হলো, ‘আরে দেবদূতদাদু কোথায় গেলেন!’ বিট্টুসের কথাটা শুনে বাকিরা ‘হ্যাঁ, তাই তো...’ বলে তড়িঘড়ি দেবদূতদাদুকে চারপাশে খুঁজতে থাকে। দেবদূত দাদুকে কোথাও পাওয়া যায় না। অবশেষে ওরা শিবিরের ভেতর গিয়ে খোঁজে। সেখানে শুধু হাওয়া বয়। দেবদূত দাদু নেই।ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার জাদুটা ভালোই জানেন, ওঁর কাছ থেকে ট্যাকটিসটা(কায়দাটা) শিখে নিতেই হবে...।’ ওরা এবার বাইরে এসে দেবদূত দাদুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

অধীর অপেক্ষা শুধু অপেক্ষা...। এমন সময় দেবদূতদাদুর রাইটহ্যান্ড বাজবাখিটা উড়ে এসে বসে শিবিরের কাছে থাকা গুয়ানাবানা গাছটার ডালে। ওরা লক্ষ্য করে বাজটি ওর চঞ্চুতে ধরে রেখেছে আকারে বড় একটি গাছের পাতা।পাতাটি ভাঁজ করা। বাজটি ডালে বসেই চঞ্চু থেকে ছেড়ে দেয় পাতাটি। পাতাটি মাটিতে এসে পড়ে।প্রথমেই বুলটির কৌতূহলী চোখ গিয়ে পড়ে পাতাটির গায়ের ওপর,যেখানে রয়েছে বাংলা অক্ষরে কিছু লেখা ।লেখাগুলো জ্বল জ্বল করছে।সে হাতে তুলে নেয় পাতাটি। বাকিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেটার ওপর। ওরা দেখে লেখাটি একটি চিঠি। তাতে লেখা—

প্রিয় আমার সোনা বন্ধুরা,

তোমরা জানতে চেয়েছিলে আমার বাকি সঙ্গীদের কথা। ওরা কোথায় গেল? চার্লস ফ্রেটনের কথা তো আগেই বলেছি। ও হারিয়ে গেছে এই দ্বীপের সব্বনেশে সুন্দরের ভেতর। রইল বাকি তিনজন। এবার একটু ইতিহাসে যাই। সালটা হবে ১৯৭০। আমরা পাঁচজন বিজ্ঞানী বন্ধু পরিকল্পনা নিয়েছিলাম এই দ্বীপে এসে বসবাস করব। এই দ্বীপে তখনো মানুষ আসতে ভয় পেত,আমাদের আগে কেউ আসেনি।আমরা স্থির করেছিলাম এখানেই থাকার ঘর বানিয়ে নেব, চাষবাস এবং অন্যান্য উপায়ে নিজেদের পানীয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে নেব।আমরা পাঁচ বন্ধু হলাম অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ফ্রেটন(পদার্থ বিজ্ঞানী), কানাডার উইলিয়াম ফ্রুট (চিকিৎসা বিজ্ঞানী) , ইংল্যান্ডের মাইকেল ল্যান্ড ( যন্ত্রবিদ), জাপানের হুয়াং চ্যাং(ভূতত্ত্ববিদ) ও আমি জার্মানের হারবার্ট গুন্টার (উদ্ভিদ বিজ্ঞানী)।

আমরা কিন্তু খুব সহজে আসতে পারিনি এখানে। বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল আমেরিকা সরকারের। শুধু অনুমতি নয় মুচলেকাও (আইনের মাধ্যমে প্রতিজ্ঞা করা) দিতে হয়েছিল। এখানে যদি আমাদের কোনও কারণে মৃত্যু হয় সেজন্য দায়ী আমরা নিজেরাই,অন্য কেউ নয়...এই মুচলেকা।

তো আমরা এখানে এসে প্রথমেই বানিয়ে নি থাকার বাসস্থানটা । এখন যেখানে তোমাদের থাকার শিবিরটা রয়েছে সেখানেই। তখন শিবিরটার আয়তন ছিল প্রায় ১২০০ বর্গফুট। তারপর নিজেরাই চাষবাস শুরু করে দেই। সবজি- মসলা ইত্যাদি। এ ছাড়া ফলে-ফুলে ভরা সারা বনাঞ্চল আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে তুলি।দিনরাত খাটি।এই অরণ্যের জীবন-যাপন উন্নত করার চেষ্টা করি।

ও-ভাবেই দিনগুলো বেশ সুন্দর কেটে যাচ্ছিল...।দেখতে দেখতে প্রায় কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। একদিন আমার তিন সঙ্গী উইলিয়াম ফ্রুট, মাইকেল ল্যান্ড ও হুয়াং চ্যাং ঠিক করল ওরা ওয়াশিংটন (আমেরিকার একটি বড় শহর) গিয়ে কিছু দরকারি যন্ত্রপাতি ও বইপত্র কিনতে যাবে। আমিও উৎসাহিত হয়ে ওদের হাতে ধরিয়ে দিলাম কিছু সবজি ও মসলা বিজের নামের তালিকা। কিন্তু আমি গেলাম না। এই দ্বীপটাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করল না।... ওরা চলে গেল।...এবং সে রাতেই নেমে এলো সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়...।ওই আগুনশিখরটি(আগ্নেয়গিরিটি) জেগে উঠলো। ভীষণ গর্জনে ফেটে গেল ওর মুখ... বের করতে শুরু করল নানা রঙের আগুন আর লাভা...চরাচর যেন দুলছিল...।সারা দ্বীপভূমি উথাল-পাথাল, লণ্ডভণ্ড হতে লাগলো...আমি দেখেছিলাম সেদিন মৃত্যুর বিভীষিকা!এই প্রলয় আর বিভীষিকা কমতে কমতে চলেছিল প্রায় এক সপ্তাহ,...।

ওই প্রলয়ের পরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এই দ্বীপভুমি,আজও তাই। আমার তিন সঙ্গী আর ফিরে আসেনি এই দ্বীপে। এসেই বা কী করবে? ওরা বুঝে নিয়েছিল আমি আর নেই । ওরা ঠিকই ভেবেছিল। ওই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক প্রলয়ে কী ভাবেই বা বাঁচতে পারি আমি?......তবে আমি আছি... অর্থাৎ আমার আত্মা আছে... হারবার্ট গুন্টারের আত্মা।এই আত্মা গত তিরিশ বছর ধরে এই দ্বীপভূমিকে আবার সে সাজিয়ে তুলেছে।সবজি ফলাচ্ছে, ফল ও ফুলের গাছগুলোকে লালন পালন করছে, আগুনশিখরটির কোলে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকছে ...।বন্ধুরা, তোমরা এই দ্বীপভূমির অতিথি হয়ে এসেছ অর্থাৎ আমারই অতিথি হয়ে এসেছ...। তোমাদের প্রতি আমার আতিথেয়তার ত্রুটি রাখিনি বন্ধুরা...। তোমাদের সব শখ-আহ্লাদ মিটিয়েছি...।এবার বন্ধুরা, তোমরা ফিরে যাও তোমাদের নিজের দেশে...। আর এক দণ্ড থেক না এখানে। তোমাদের পদে পদে সংকট এখন। কখন জেগে ওঠে ঈশ্বর আগুনশিখর?! দ্বিতীয় যুগ শেষ হয়ে তৃতীয় যুগ(১ যুগ = ১২ বছর কাল) তো এগিয়ে এলো...।মাঝে মাঝে ওটা গর্জে ওঠে, আবার থেমে যায়। কখন কী হয়।তোমরা এখনই রওনা হও।তোমাদের হেরম্ব গাঙ্গুলি তিমিমাছকে নিয়ে হয়তো চলে এসেছে সৈকতে।আমি খবর পাঠিয়েছি ওকে। আর যেতে যেতে হে আমার সোনা বন্ধুরা, উপহার হিসেবে নিয়ে নিও এ দ্বীপভূমির ফুল-ফল, পাতা, আনাজ...। ফিরে গিয়ে ওগুলো দেখিয়ে বার্তা দিও, এ দ্বীপভূমি অভিশপ্ত,অপয়া হলেও সে চায় পৃথিবী সুখে থাকুক ,শান্তিতে থাকুক, তার পরিবেশ, আবহাওয়া নির্মল থাকুক...ফুলে-ফলে-আনাজে ভরে উঠুক তাঁর ক্ষেত–খামার ... গভীর বন-বনানিতে ঢেকে যাক তার পাহাড়-পর্বত,প্রান্তর-ভুমি... শহর-নগরে আর বেশি মন না দিয়ে ফিরিয়ে আনুক আবার সেই অরণ্যের অধিকার,হাসিখেলা...শুধু শহর-নগর হলে তো হবে না...এ পৃথিবীর তো অরণ্যও চাই...সমানুপাতিক অরণ্য...

আর কী বন্ধুরা?অনেক লিখে ফেললাম। ভূতেরা এতো কথা লেখে না বা বলে না।তোমরা আমার খুব কাছের বলেই লিখলাম...। আবার কবে দেখা হবে জানি না। ভালো থেকো ,সুখে থেকো... । টা-টা...

তোমাদের দেবদূতদাদু

চিঠিটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন পলক পড়ার আগেই পট পরিবর্তন হয়ে গেল ওদের চার পাশে!পাতায় লেখা চিঠিটাও ওদের হাতে নেই। ওদের থাকার শিবিরটাও হাওয়া!ওখানে এখন সারি সারি ফুলের গাছ হেলছে দুলছে!ওদের ব্যাগগুলো কে যেন ওদের পিঠে চাপিয়ে দিচ্ছে! এবং ঠেলে দিচ্ছে সৈকতের দিকে...।

অথচ, সারা দ্বীপভূমিটা যেন ধীরে ধীরে আরও সুন্দর হয়ে উঠলো ওদের কাছে...! ঠাম্মার কাছে শোনা স্বর্গের পরীরা যেন এখনই নেমে আসবে এখানে...। হাল্কা হাল্কা হাওয়া বইছে... সারা বনাঞ্চল নিঃশব্দ নির্জন ... বরফে ঢাকা আগ্নেয়গিরিটি যেন আবার ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে...আয়...আয়...আয়...। ওদের গা ছম ছম করে ওঠে...।ওটার দিকে আর ফিরে তাকাতে চায় না...। ভাবতেই ওদের মন খারাপ হয়ে যায়, এই দ্বীপভূমিতে কোনও মানুষ থাকে না, শুধু হারবার্ট গুন্টারের সাদা ভূত একা একা বিচরণ করে বেড়ায় দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত...।ভূতটি ওদের কাছেই আছে এখন।ওরা টের পাচ্ছে...। দেবদূতদাদু হয়ে ওদের খুব ভালোবেসে ফেলেছে গুন্টার!ওরাও খুব ভালোবেসে ফেলেছে দেবদূতদাদুকে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না ওঁকে।সাদা ভূত হলেও ওরা ওঁকে ভয় করেনি কখনো । ইচ্ছে করে ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় নিজের দেশে।কিন্তু সে উপায় তো নেই। বিচ্ছেদ বেদনায় ওরা কাতর হয়ে পড়ে। চোখের জল বেরিয়ে আসে ওদের। সৈকত থেকে শোনা যায় তিমিমাছটির ডাক—‘কাম...কাম... হারি-আপ মাই ফ্রেন্ডস...’।ওরা এগোতে থাকে মন্ত্রচালিতের মতো...।

যেতে যেতে ওরা নিতে ভোলে না ফল ফুল পাতা কিছু আনাজপাতি আর সাদা ভূতের আদর- চুম্বন ...

শেষ

..............................................................................

** এই গল্পটির আধার গড়ে উঠেছে যে দ্বীপটিকে নিয়ে সেটি সত্যি সত্যি বাস্তবে রয়েছে।হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জেরই একটি অংশ। ওখানে রয়েছে কয়েকটি আগ্নেয়গিরি, ওগুলো মৃত নয় , যেকোনো মুহূর্তে জেগে উঠতে পারে।অতীতেও কয়েকবার জেগে উঠেছিল।যারফলে ওখানে জীবের অস্তিত্ব নেই।জনশূন্য। কয়েক বছর হল কয়েকজন বিজ্ঞানী ওখানে গিয়ে ডেরা পেতেছেন গবেষণার জন্য। ওঁরা সেখানে চাষবাস করছেন। দ্বীপটি নাকি দারুণ সুন্দর। নানা রকম ফুল ফোটে সেখানে । আগ্নেয়গিরিগুলো থাকে বরফে ঢাকা। এই বার্তাটি ওঁরাই পৃথিবীবাসীকে জানিয়েছেন।ওখানকার শান্ত-নির্জন প্রকৃতি ওঁদের এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, ওঁরাও যাতে জোরে কথা না বলেন সে জন্য সেখানে বসিয়েছেন একটি শব্দ সেন্সর-যন্ত্র।তো, এইসব বাস্তব উপাদানের বাইরে এই গল্পের পারিপার্শ্বিক-আখ্যান ও চরিত্রগুলো সবই কাল্পনিক।