শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত ... ৬

শিম্মি বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু , তোমাকে দেখলেই মনে হয় আমরা সব পারব,আমাদের সাহসগুলো তুমিই তো যেন কথা থেকে এনে দিচ্ছ...।’বলতে বলতে খিল খিল করে হেসে ওঠে সে।

ভোম্বল সিম্মির কথার তাল মিলিয়ে বলে ওঠে , ‘হ্যাঁ ঠিক কথা দাদু, আমাদের মনের ইচ্ছেগুলো তুমিই তো এনে দিচ্ছ...।’

দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘জানো তো খোকা-খুকুরা, ওই তুষারশিখরে ইয়েতিরা নেমে আসে?’

বুলটি উত্তেজিত হয়ে উঠে, ‘ইয়েতি মানে তুষার-মানব,স্নো-ম্যান...!’

--ইয়েস-’। দেবদূতদাদুর ছোট্ট উত্তর।

--কখন নামে?’ ডাব্বুর গলায় আকুলতা।

দেবদূতদাদু জবাব দেন, ‘ রাত গভীর হলে, থাকে রোদ ওঠার আগে পর্যন্ত... এরপর যেন কোথায় হারিয়ে যায় ওরা...।’

--যদি একবার ইয়েতির দেখা পেতাম...।’বুলটি ব্যাকুল হয়ে ওঁর মনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করে।

শিম্মিও বলে, ‘হ্যাঁ যদি দেখা পেতাম...।’

দেবদূতদাদু বলেন, ‘ইয়েতির দেখা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়,ভাগ্যের ব্যাপার,আমিও দেখা পাইনি আজ পর্যন্ত...পেয়েছিল আমার আরেক সঙ্গী উইলিয়াম ফ্রুট, ওঁর সঙ্গে হ্যান্ড শেকও করেছিল ইয়েতি...।’

দেবদূতদাদুর এ কথাটি শুনে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিট্টুস, ‘বলো কি দাদু, হ্যান্ড-শেক! আমাদের তো যেতেই হবে...।’

দেবদূতদাদু বলে ওঠেন , ‘ঠিক আছে,আসছে কাল ভোর রাতে, তোমরা সবাই এখন থেকে মানসিকভাবে তৈরি হও, এখন চলো ব্রেকফাস্টটা সেরে নেবে ...।’বলতে বলতে তিনি শিবিরের ভেতরে চলে যান।বুলটি ফিস ফিস করে বলে ওঠে, ‘ এই শোন তোরা, একটা কথা বলি , দেবদুত দাদু যখন আমার মাথায় হাত দিলেন, তখন আমার শরীরে যেন একটা ইলেকট্রিক শক বোয়ে গেল,তোদেরও কি তাই হয়েছে?’

--হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদেরও তাই হয়েছে, এ কথাটা বলার সাহস পাইনি তখন!’

বাকিদের এই জবাবে বুলটির গলায় লম্বা জিজ্ঞাসা, ‘কেনো রে...’? কারো মুখে এ প্রশ্নের কোনও জবাব নেই।

বুলটিরা দেখল সত্যই রোদ উঠতে–না-উঠতেই চরাচরের রূপ নিমেষে পাল্টে গেল।সূর্যের প্রথম আলোর রেখা এই ভূমিতে যেন বিছিয়ে দিল লালিমার সিফন চাদর ।ধবধবে বরফগুলো পরতে পরতে হয়ে উঠলো মায়াময়।সকালের প্রকৃতির এই রূপ দেখতে দেখতে ওরা শিবিরের বাইরে ছোট্ট লনে গাছের ডাল দিয়ে বানিয়ে রাখা লম্বা টুলে বসে ব্রেকফাস্ট সারতে থাকে...।এরই মধ্যে আস্তে আস্তে রোদ সোনালি হয়ে উঠতে থাকে। দেবদূতদাদু শিবির থেকে বেরিয়ে আসেন। হাতে ধরে রেখেছেন একটি ব্যাক-প্যাক। দেখলে বোঝা যায় ওতে ভরা রয়েছে কিছু শক্ত জিনিসপত্র। তিনি বলেন, ‘ চলো এবার আমার সোনা বন্ধুরা ,এখন তোমাদের ঘুরে ঘুরে দেখাব এই দ্বীপভূমির বন-বনাঞ্চল, আমার হাতে লাগানো গাছপালা,কৃষি-ভূমি,এই সময়েই আমি ওদের একটু পরিচর্যাও করি...।’বলতে বলতে তিনি ব্যাক-প্যাকটাকে পিঠে ঝুলিয়ে নিলেন।বুলটিরাও ব্রেকফাস্ট করার বাকি যেটুকু ছিল সেটা দ্রুত সেরে উঠে দাঁড়ালো।

শিবির ছেড়ে বুলটিরা বনাঞ্চলের পথে পা বাড়ায়। আগে আগে হাঁটছেন দেবদূত দাদু।রোদ তখন বরফের গায়ে পড়ে ঝলসে উঠছে। বিশেষ করে বরফশৃঙ্গের সাজে সেজে ওঠা আগ্নেয়গিরিটার সারা শরীর। ওদিকে চোখ রাখা যায় না বেশিক্ষণ। চোখও যেন ঝলসে যাবে। এতো আলোর বিচ্ছুরণ! ওরা এগোতে থাকে। রোদ বাড়তে থাকে। ওরা লক্ষ্য করে রোদ যতই বাড়ছে এই বনাঞ্চলের রূপ যেন নতুন নতুন করে ফুটে উঠছে। নানান রঙের ফুলে ভরে উঠেছে । দেবদূতদাদু ফুলের বনের এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েন।তারপর বলেন , ‘ দাদুভাইরা, এইসব নানা রঙের ফুলতো তোমরা গতকাল এসেই দেখেছ।এগুলো হেবিস্কাস। এবার দেখবে এসো আরও কিছু ফুল,যেগুলি শুধু এই দ্বীপেই জন্মায়।’ বলতে বলতে তিনি ওদের নিয়ে যান পাশের একটি ফুলের বাগিচায়।এই বাগিচার ফুলগুলোকে দেখে ওদের চক্ষু স্থির।ফুলগুলির আকার আর রং একেবারেই অন্যরকম।পাপড়িগুলো একেবারে বড় বড় পাখির পালকের মতো। কোনও কোনোটার আবার লকলকে ঝুঁটি আছে। দেবদূত দাদু গাছগুলোকে দেখিয়ে বলেন, ‘দাদুভাইরা এই ফুলগুলোর নাম হচ্ছে প্লামেরিয়া, চলো আরেকটি বাগিচায়...’।বলতে বলতে তিনি একটু দূরেই আরেকটি বাগিচায় নিয়ে গেলেন।

এখানে আরেক বিস্ময়! গাছগুলো বেঁটে বেঁটে এবং গাছের পাতাগুলো বড় বড় পানপাতার মতো। প্রতিটি গাছের শাখায় শাখায় ফুটে আছে বড় বড় বিভিন্ন রঙের ফুল। কোনও কোনও ফুলের রং এমনই যেগুলো ওরা আগে কখনো দেখেনি।ওদের স্কুলের ড্রইং স্যারকেও এ ধরনের রং ব্যবহার করতে দেখেনি ওরা । ওইসব ফুলের পাপড়িগুলোও দেখার মতো, প্যাঁচানো-প্যাঁচানো...। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘শোন সোনা বন্ধুরা ,এই ফুলগুলোকে বলা হয় হেলিকোনিয়া, এ ফুল গাছে অনেকদিন থাকে...।’

এরপর তিনি নিয়ে গেলেন আরেকটি বাগিচায়,যেখানে অসংখ্য ভিন্ন আকারের বিভিন্ন রঙের ফুল বাতাসে হেলছে দুলছে...। দেবদূতদাদু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ ক্ষুদে বন্ধুরা , এই ফুলগুলোকে বলে প্রোটিয়া অর্থাৎ বহুরূপী ফুল, ওরা ওদের রং ও রূপ পাল্টে ফেলতে পারে...ওরা সকালে এক রকম থাকে, দুপুরে অন্য রূপ আবার বিকেলে আরেক রূপ..., তোমরা ওদের এখন যে রং ও রূপে দেখছ,আমরা যখন বিকেলে শিবিরে এ রাস্তা দিয়ে ফিরব তখন এদের দেখবে আরেক রূপ ও রঙে...।’বলে তিনি থামলেন কিছুক্ষণ।

বুলটিরা চোখ সরাতে পারেনা ওই বহুরূপী ফুলগুলোর দিক থেকে। বিট্টুস পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভোম্বলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে , ‘ওই ভোম্বু আমরা যদি ফেরার সময় এইসব ফুল গাছের চাড়া নয়তো ডাল নিয়েনি কেমন হয়?’

বিট্টুস যতই নিচু গলায় অতি সংগোপনে কথাটা বলুক নয়া কেন দেবদূত দাদুর কানে ঠিক চলে যায় তা।তিনি বলে ওঠেন, ‘উহু, নিয়ে লাভ নেই।এই ফুলগুলোর বসবাস কেবল প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে রয়েছে যে সব দেশ ওই সব দেশেই । এরা অন্য কোথাও বা অন্য জলবায়ুতে বাঁচে না হে আমার ছোট্ট বন্ধুরা...।’বলতে বলতে তিনি নরম হাসেন। বিট্টুসের মুখ শুখিয়ে যায়।

ওই মুহূর্তে বরফশৃঙ্গরূপী আগ্নেয়শিখরটির দিক থেকে একটা দমকা তুষার হাওয়া এ মুখো বইতে শুরু করে।ওই হাওয়া এতোই জোরে বইছে যে, বুলটিরা ওদের শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারছে না । দেবদূতদাদু ওদের ভরসা দিতে দিতে বললেন , ‘আমার ছোট্ট সোনারা,ভয় পেয়ো না, সামলাও বাতাসটাকে,একটু কষ্ট কর, রোদ বাড়ছে তো ,আগুন শিখরের গায়ের বরফগুলো গলা শুরু করেছে, বরফের বড় বড় চ্যাঁইগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে আছড়ে পড়ছে নিচে...।ওখান থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে এই বাতাসের।ঘণ্টা খানেক এই বাতাস থাকবে...।’ দেবদূতদাদুর এই কথায় ওরা সবাই দ্রুত চোখ ঘোরায় আগুনশিখরটির দিকে। ওরা দেখে সত্যই আগুনশিখরটির গায়ে যেন ঝড় বইছে, বরফের ঝড়, উথালপাথাল...।

শিম্মি মুগ্ধ চোখে বলে ওঠে, ‘একেই বুঝি বলে হিমবাহ ...’।

--ইয়েস, গ্ল্যাসিয়ার...’।বিট্টুস ফটফটায় ।

--মাটিটাও কেমন যেন কাঁপছে...’, ডাব্বুর গলায় আতঙ্ক।

--বিশাল বিশাল পাথরের আকারের বরফের টুকরোগুলো নিচে আছড়ে পড়ছে বলেই মাটিটা কাঁপছে, এগুলো তো এই দ্বীপের প্রতিদিনকার রূপকথার গল্প হে আমার ক্ষুদে বন্ধুরা...।’বলতে বলতে দেবদূতদাদু হেসে ফেলেন।

একটু বাদে আগুনশিখরের বরফতাণ্ডব কমে আসতে থাকে। কমে আসতে থাকে তুষার হাওয়াও। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘হে আমার সোনা বন্ধুরা, এবার চলো সবজি ক্ষেতে,যেগুলো আমার নিজের করা...।’বলতে বলতে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন সামনের দিকে। বুলটিরা তাঁকে অনুসরণ করে।

এবার দেবদূতদাদুর গন্তব্য একটু চড়াইয়ের দিকে। এখানে এসেই ওরা লক্ষ্য করে ,মাটি আঁকড়ে থাকা সারা রাতের সব জমা বরফগুলো গলে গলে জল হয়ে যাচ্ছে।আর মুখ দেখাতে শুরু করেছে এই দ্বীপভূমির মাটি ঘাস আর সরু সরু পথ ...।জলগুলো কল কল স্বরে ছোটো ছোটো ঝরনা হয়ে নেমে যাচ্ছে উৎরাইয়ের দিকে...। দেবদুতদাদু এক সময় ওদের নিয়ে হাজির হলেন একটি মালভূমির মতো জায়গায়।ওরা দেখে বুঝল ওটা একটা বিছানো ক্ষেত। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘ শোন ক্ষুদে বন্ধুরা, কিছু আগে তোমরা দেখে এলে যে ফুলের বাগানগুলো সেগুলো ওখানে হয়েছে আপনাআপনি, বাইরে থেকে এনে পোঁতা হয়নি । আমি শুধু ওদের পরিচর্যা( দেখা-শোনা) করি...।’ বলে থামলেন কিছুক্ষণ তিনি। বুলটিরা তাঁর এই কথায় জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে ।তিনি আবার শুরু করেন, ‘কিন্তু এই সবজির ক্ষেতটা পুরোটাই আমার নিজের হাতে করা...।’দেবদূতদাদুর এ কথায় বুলটিরা সবাই তাজ্জব হয়ে একত্রে বলে ওঠে, ‘উড়ে ব্বাবা আপনি এই পুরো ক্ষেতটা একা চাষ করেছেন...!’

--না রে আমার সোনা বন্ধুরা, এখন আমি একা হলেও যখন এই চাষভূমি শুরু করি তখন ছিলাম আমরা পাঁচজন...।’কথাটা বলতে বলতে দেবদূতদাদুর গলা কান্নায় আটকে আসে ।ওই অবস্থায় কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকেন তিনি চাষভূমিটার দিকে।বুলটিরা এবার দ্বিগুণ জিজ্ঞাসু হয়। তিনি আবার বলেন, ‘আমি আর আমার চার সহযোগী মিলে তিলে তিলে দিনের পর দিন খাটা-খাটুনি করে এই চাষভূমিটাকে গড়ে তুলেছি...।’বলতে বলতে তিনি আর নিজেকে আটকাতে পারেন না।ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন।বুলটিরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে,কোনও ভাষা খুঁজে পায় না। নিজেকে সংবরণ করতে একটু সময় নেন দেবদূতদাদু। তারপর আবার বলেন, ‘ যখন প্রথম এই দ্বীপভূমিতে আসি তখন কোনও সবজির সন্ধান আমরা এখানে পাইনি, যে সবজিগুলো সাধারণত আমরা খেয়ে থাকি, এই যেমন, ক্যাবেজ, টমেটো,ক্যারট, পিপার, পার্সলে, মামে-সাপট ইত্যাদি ইত্যাদি...।’

বিট্টুস আর নিজেকে রোধ করতে পারে না।যে প্রশ্নটা ওর পেটে গুড় গুড় করছিল সেটা করেই ফেলল, ‘আচ্ছা দাদু, তুমি যে তোমার চার বন্ধুর কথা বলছিলে ওরা কোথায়?ওঁদের তো দেখতে পাচ্ছি না?হ্যাঁ, একজন তো হারিয়ে গেছে তুমি সকালে বললে, বাকি তিনজন?’ বিট্টুসের এই হঠাৎ প্রশ্নে দেবদূতদাদু যেন থমকে গেলেন। নিরুত্তর রইলেন কিছুক্ষণ। চোখ দুটো তাঁর ভিজে ওঠে আবার।বুলটিদের বাকি চারজন এবার অপ্রস্তুত হয়ে বিট্টুসের দিকে তির্যক তাকিয়ে থাকে । বিট্টুস মাথা নিচু করে রইল।

দেবদূতদাদু চোখ মুছতে মুছতে বলে ওঠেন, ‘আরে না না আমার ক্ষুদে বন্ধুরা, তোমরা কেন অপরাধ বোধে ভুগছ, এই প্রশ্নটা উঠে আসাই স্বাভাবিক...।’ বলতে বলতে তিনি হেসে ফেলে পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইলেন।তারপর আবার বললেন, ‘ সে অন্য গল্প, হে আমার ছোট্ট বন্ধুরা, এই সুন্দর পরিবেশে ওই গল্প বড় গম্ভীর, বেমানান হয়ে যাবে, আমরা ওই গল্প অন্য সময়ে ,অন্য অবকাশে শুনি, কি বলো?’

বুলটিরা সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দেবদূতদাদু আবার বললেন, ‘এখন শুধু এ টুকুই জেনে রাখো,গেল তিরিশ বছর ধরে আমি একাই এই চাষভূমির দেখাশোনা করেছি ... আমি তো এই দ্বীপভূমির সব গাছপালা , এই ক্ষেত আর ওই আগ্নেয়গিরিটার সঙ্গেই দিনরাত কাটাই...।’ বলতে বলতে তিনি তাঁর ব্যাক-প্যাকটা পিঠ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখলেন।

বুলটিরা দেখল দেবদূতদাদু ব্যাক-প্যাকটা খুলে ওটা থেকে বের করে আনলেন নানা রকমের খননযন্ত্র...। ওগুলো কাঁধে হাতে আর বগলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘হে আমার সোনা বন্ধুরা, এবার আমি এই চাষের জমির কাজে লেগে পড়ব। ছোটো ছোটো চাড়াগাছগুলোকে প্রতিদিন অল্প অল্প পুষ্টি দিতে হয়, যত্ন করতে হয়... এটা আমার দৈনন্দিন কর্তব্য আর শখও...এগুলো তো আমার সন্তানের মতো... এখন তোমরা কে কি করবে সেটা তোমাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম,তবে অনুরোধ, আমার চোখের বাইরে চলে যেও না তোমরা...’। বলতে বলতে একটা গাল ছড়ানো হাসি দিয়ে জমির ভেতরে পা চালালেন তিনি।

ওই মুহূর্তে ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু আমরা কি তোমার এই কাজে একটু হাত লাগাতে পারি না?’

দেবদূতদাদু ঠোঁটে এবার একটা ব্যঙ্গের হাসি খেলিয়ে বলে উঠলেন, ‘ তোমরা খোকা খুকুরা আমাকে আবার কি হেল্প করবে, তোমরা বরং ওই পাশের খালি জমিটাতে গিয়ে তোমাদের ইন্ডিয়ান হা-ডু-ডু খেল গে যাও--’।

বুলটি আর শিম্মি একত্রে জোর গলায় প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘দেবদূতদাদু তুমি কিন্তু আমাদের পাত্তাই দিচ্ছ না, আমরা কিন্তু বাগান চর্চা করি , আমাদের স্কুলের বাগানটা যাও গিয়ে দেখে আস , কি বানিয়েছি...’।

দেবদূতদাদু অবাক হয়ে বলে ওঠেন, ‘ওহ, তাই নাকি !’

--হ্যাঁ তাই, আমরা আলপিন টু এলিফেন সব পারি...।’বিট্টুস দু ঠোঁট বেঁকিয়ে, দু হাত কোমরে নিয়ে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথাটা যেন ফোঁস করে ছেড়ে দিল।

দেবদূতদাদু বেশ মজা পেলেন বিট্টুসের এই কথার ভঙ্গিমাটা দেখে।তিনি বিট্টুসের দিকে স্থির তাকিয়ে হাসতে থাকেন।ভোম্বল ডাব্বুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ ডাব্বু, বিট্টুস ইংলিশ-স্যারের ডায়লগটা কেমন ঝেড়ে দিল এখানে...।’বলতে বলতে মুখ আঙুল চেপে হাসতে থাকে সে।ডাব্বুও ওই ভাবেই হাসে।

দেবদূতদাদু অনেকটা অলস গলায় বলেন, ‘ ঠিক আছে ,তাহলে চলো, তোমরা যখন একেবারে নাছোড়বান্দা কী আর করা...।’

বুলটিরা সবাই একত্রে হৈ হৈ করে দেবদূতদাদুর ব্যাক-প্যাক থেকে ছোটো ছোটো খননযন্ত্রগুলো নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা চাষের জমিতে।ওই মুহূর্তে সেন্সর ম্যান সাবধান করে ওঠে, ‘কুল ডাউন...কুল ডাউন...শান্ত হও...শান্ত হও...।’ বিট্টুস সেন্সর ম্যানের উদ্দেশ্যে মুখ ভেংচিয়ে বলে ওঠে, ‘কী করব বস, আমাদের এই দেবদূতদাদুই তো কলকাঠি নাড়ছেন, তিনিই তো মনের ভেতর ঢুকে গিয়ে কী ভাবে যে আমাদের চালাচ্ছেন আমরা নিজেরাই টের পাচ্ছি না...।’

দেবদূতদাদুর চাষের জমিতে বুলটিদের কেটে গেল প্রায় সারাটা দুপুর। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। হঠাৎ ওদের চোখ চলে যায় আগ্নেয়গিরিটির দিকে। কাজের নেশায় এতক্ষণ ওটার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল ওরা।ওটাকে দেখে তো এখন আর আগের মতো চেনা যায় না।ওটা আগ্নেয়গিরি হলেও ঢাকা থাকে তো বরফে, ভোর থেকে যা দেখা গিয়েছিল। মাঝখানে তুষারের ঢল নামলো ওটার শরীর থেকে। এখন ওখানে দেখা যায় সরু সরু তুষারের ঝরনা শুধু।কিন্তু চুড়োটায় এখনো ছেয়ে আছে কঠিন বরফ! ওটাই তো দেখার মতো ! বুলটিদের চক্ষুস্থির ওটার দিকেই। আগ্নেয়গিরিটা যেন একটা বরের মতো টোপর পরে বসে আছে।রুপোর টোপর।

শিম্মি অনেকটা নত স্বরে প্রশ্নকাতর হয়ে ওঠে, ‘আচ্ছা ইয়েতিগুলো এখন কোথায় রয়েছে রে? ওই টোপরের ভেতর?’ বিট্টুস যেন অনেকটা সুনিশ্চিত হয়েই জবাব দেয়, ‘হয়তো তাই, আগামী কাল দেখে নেব ওদের, যদি হ্যান্ড-শেক না করে রে ...’

ওই মুহূর্তে দেবদূতদাদু এসে হাজির।বিট্টুসের শেষ কথাটুকু বলা হল না। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘ ক্ষুদে বন্ধুরা তোমাদের নিশ্চয় এবার ক্ষিদে পেয়ে গেছে,পাওয়ারই তো কথা,আধা দিন তো পেরিয়ে গেল...।’

ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ঠিকই বলেছ দাদু , ক্ষিদেয় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে...।’

--তাহলে চলো বন্ধুরা, আমরা লাঞ্চটা সেরে নি...।’বলতে বলতে তিনি তাঁর ভেজিটেবল ল্যান্ড থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন। বুলটিরা তাঁকে অনুসরণ করে।

দেবদূতদাদু একটা ফলের বাগানের কাছে এনে ওদের দাঁড়া করিয়ে বলে ওঠেন, ‘এটা হল এই দ্বীপের ফ্রুটস ল্যান্ড(ফলের বাগান), আমরা এখানেই লাঞ্চটা সেরে নেব...।’ বলতে বলতে তিনি ঢুকে পড়লেন তাঁর এই ফ্রুটস ল্যান্ডে।বুলটিরা হতভম্ব! শিম্মি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে ওঠে, ‘ এখানে কী লাঞ্চ করব?’

---কেন,দেখছ না গাছে গাছে কত ফল ধরে আছে , ম্যাঙ্গোস্টিন, গুয়াভা, লিচি, গুয়ানাবানা...এগুলোই তো এই দ্বীপের লাঞ্চ ডায়েট(দুপুরের খাবার), গত কালও তো তোমরা তাই খেয়েছিলে ভুলে গেলে এখনই!’

দেবদুতদাদুর এ কথা শুনে বুলটি ক্ষমা চেয়ে নেয়, ‘সরি দাদু, সরি...।’

নিচু গলায় ডাব্বু বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, তাই তো...আমরা ভুলেই গিয়েছি।’ওদের কথা শুনে দেবদূতদাদু হেসে ফেলেন, কিছু বলেন না আর ।

অনন্যোপায় হয়ে ওরা সবাই সারা বাগানে ছড়িয়ে পড়ল একে একে।খেল পেট ভরে। তবে দেবদূতদাদু খেলেন কিনা কেউ দেখল না।বুলটি বলে ওঠে, ‘ দাদু,গতকালের চেয়ে আজকের ফলগুলোর স্বাদ যেন আরও দারুণ...।’ দেবদূতদাদু তাঁর মুখে পরিচিত হাসিটি এনে বলেন, ‘একেবারে গাছ থেকে পেরে খেয়েছ তো, তাই...।’

দেবদূতদাদুর ফ্রুটস ল্যান্ডেই বিকেল নেমে এল।শিশির পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।আকাশে শুরু হয়ে গিয়েছে শিশির আর রোদের মায়া রঙের খেলা। ঠাণ্ডার মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে।আগ্নেয়গিরির আগুনশিখরের শরীরে ওই মায়ারঙের ছায়া। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘চলো আমার খোকা খুকুরা এবার ফিরে যাওয়া যাক শিবিরের দিকে...।’ বলতে বলতে তিনি ফ্রুটস ল্যান্ড থেকে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন।

বুলটিরাও তাঁকে অনুসরণ করে। ফেরার পথে যেতে যেতে ওরা একবার ফ্লাওয়ারস ল্যান্ডের প্রোটিয়া নামের ফুলগুলোকে দেখে আবার। ওরা সবাই মোহিত হয়ে যায়! সত্যই ফুলগুলি বহুরূপী! এখন ফুলগুলির রং ও রূপ অন্য রকম! ওরা সবাই বিভ্রমে পড়ে যায়!


চলবে ...