বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

আমি এক রঙিন চশমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিঃ তুষ্টি ভট্টাচার্য

তুষ্টি ভট্টাচার্য রম্যরচনা থেকে গদ্য থেকে কবিতা, সাহিত্যের নানা ধারায় অনায়াস যাতায়াত তাঁর। ইতিমধ্যেই দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে তুষ্টি ভট্টাচার্যের। আজ তাঁর জন্মদিন।তাঁর একগুচ্ছ কবিতায় তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে অন্যদেশ পরিবার।



ডার্করুম

১২)

মাঝেমাঝেই আমি অন্ধকারে আটকা পড়ে যাই

চোখ দেখতে পেলেও, মস্তিষ্কে পিচ কালো অন্ধকার

আর তখনই ভাবি আর যেন কিছু দেখতে না হয় আমার!

নিজেকে শক্ত করে বেঁকিয়ে একটা বলের মত গড়িয়ে দিই

যেন মহাকাশে বেশ কিছুক্ষণ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি!

মাঝেমাঝেই আমি মহাকাশে আটকে যাই

আমার আবেগ, আমার ভাবনাগুলো খাদ্যনালী দিয়ে বেয়ে ওঠে

দমবন্ধ হয়ে আসে…

এই তুলোর বল যদি কেউ

কাঁটা দিয়ে তুলে নিত!

মাঝেমাঝে বিনা কারণেই হতাশায় ভুগি

কোন শব্দ দিয়ে বোঝানো যাবে না, এমন অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে

মনে হয়ে কতগুলো পোকা বেয়ে বেয়ে আমার মাথার ভেতরে এসে বসেছে

কুরে কুরে খাচ্ছে আমার ঘিলু, হাড়, চামড়া।

মনের অন্দরে বিশাল কালো কূপ খুঁড়ে চলেছে এক অতিকায় দৈত্য

এমন কোন শব্দ নেই যা দিয়ে আমি বোঝাতে পারব এই খননকে

শুধু থরথর করে কেঁপে ওঠে আমার শরীর



১৩)

কালো কোট পরা এক ছায়া

শীতল ইস্পাতের মত এপাশে এসে বসল

এক কালো গোলাপ যে অন্ধকারেই দৃশ্যমান

আলোতে যার গন্ধ হারিয়েছে আঁধারে রঙিন হয়ে উঠল

ও পাশে লুকিয়ে পড়ার সময় এসে গেছে আমার?

আবারও সে যখন কালো চাদরের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসে

আমি তাকে এক দৃষ্টে লক্ষ্য করি

খানিক থমকে দাঁড়িয়ে

সে আকাশের দিকে আঙুল তুলে কী যেন বলল-

সেই প্রখর গ্রীষ্মের দিনগুলো, যখন আমাদের দেখা হয়েছিল-

ঘাড় হেলিয়ে আমি সেই দিনগুলোকেই দেখতে পেলাম।

আমি এক রঙিন চশমার ভেতরে ঢুকে পড়েছি

চাঁদের আলোয় দুধের নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখি

এক আগুনের বল আমার দিকে গড়িয়ে আসছে

আর যেই তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে গেছি

রাতের আকাশ আমাদের ঘিরে ধরল

হৃদপিণ্ড থেকে আগুনের ফুলকি লাফিয়ে উঠল গলায়

এই সময়ে মনে হল,

শুধু আমাদের দুজনেরই অস্তিত্ব টিকে রয়েছে

ভালবেসে জড়িয়ে রয়েছি আমি ও আমার কালো রাত্রি।



১৪

এপিডারমিসের নীচে প্রত্যেকটা শিরা উপশিরায়, নার্ভ, মাসল, প্রতিটি কোষে

এমন কিছু উপসর্গ, যা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না

অথচ সেখানে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে উইপোকার দল

খুঁচিয়ে ফেলে দিতে চাইছি, পেস্ট কন্ট্রোল ডাকতে চাইছি,

তীব্র অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে যেতে চাইছি এক শুদ্ধ স্নানের কাছে-

যতই উপড়ে ফেলতে চাইছি ওরা বংশ বিস্তার করছে আরও দ্রুত

আমি আর পেরে উঠছি না ওদের সাথে

কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে অস্থি মজ্জা আমার-

আমি মরে যাইনি তবুও

রোঁয়া ওঠা কালো কালো মাকড়শার স্তূপে চাপা পড়ে গেছি আমি

কয়েকটা আমার হাত টেনে নামিয়ে আনতে চাইছে

যাতে ওদের আমি ছুড়ে ফেলতে না পারি

কয়েকটা আমার চামড়ার ওপর দিয়ে সরসর করে হেঁটে চলেছে

মুখের ভেতর পা ঢোকাচ্ছে

খোলা চোখের ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে

কানের ভেতর সেঁদিয়ে গেল দুটো-

চামড়া চেটে খেয়ে নিল

গলা দিয়ে অনায়াসে নেমে গেল পেটে

শরীরের ভেতরে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে ওরা

সুস্থ ভাবে বাঁচতে গেলে এখন আমি কী করব?

চিৎকার করে কাঁদব?

বল?

একটা মাত্র ভুল পদক্ষেপ আর পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দে আবার জেগে উঠেছে শ্বাপদ চোখ

ওই হাওয়া আবার ধরে ফেলেছে ওকে

ওর শরীরের সমস্ত ছিদ্র থেকে তীব্র হুইসল বেজে উঠছে

যেন পুরনো দুর্গের দেওয়ালে টর্নেডো আছড়ে পড়বে এইমাত্র-

গাছের বাকল, পাতা থরথর করে কেঁপে উঠল

নেকড়ের হাসির সঙ্গে দুলে দুলে চাঁদটাও হাসছে-

পরিত্রাতা হয়ে কেউ এল কিনা, জানা যায়নি

শুধু কালো অন্ধকার স্ক্রিনে সাদা অক্ষর ধীরে ধীরে স্ক্রল করে উঠছে-

‘দ্য এন্ড!’




ঘৃণা

আঁখের খেতে গেলে একটা গন্ধ পাওয়া যায়
রক্তমাংসর সঙ্গে ফুলের পাপড়ির গন্ধে
গা গুলিয়ে ওঠে।
নারকোল গাছের সারির মধ্যে কবরখানায়
বোবা মৃত্যু-ইঁদুরের হাড়গোড় পড়ে থাকে।
টুপি পরে, কলার উঁচিয়ে কে যেন কী বলে চলেছে...
এই ছোট্ট জায়গাটা ঘড়ির মত জেগে আছে
আর এ প্রান্ত থেকে হাততালির শব্দ
ও প্রান্তের সদ্য কবর দেওয়া নীল মুখ থেকে উঠে আসা
মৃত স্বরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
গাছ যেমন নিঃশব্দে মাটিতে বীজ ছড়িয়ে দেয়
যে অন্ধ পাতারা আলো না থাকলেও বেড়ে চলে
তেমনই কান্নাকে দেখা যাচ্ছে না এখানে
পরতে পরতে ঘৃণা আর
ঘ্যাসঘ্যাস শব্দে জল উঠে এসে
বিশ্রী ভাবে নাকের ডগা ফুলে উঠছে
নিঃশব্দে...