বুধবার, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

আকনবিন্ধীর সোনাপোকা,-- চ

(চ)

মেঘালয়ে অবস্থিত হলেও ময়ূরভঞ্জের ইতিহাস আরম্ভ হয়েছিল মেঘালয়ের বাইরে।ময়ূর এবং ভঞ্জ এই দুটি রাজবংশ।প্রত্নপ্রস্তর মেদিনীপুর জেলা এবং তার আশেপাশের জেলায় এই রাজবংশ রাজত্ব করত।ভঞ্জে্র রাজার সঙ্গে ময়ূর বংশের রাজা কুনজহরের এরকম সুসম্পর্ক গড়ে উঠে যে দুটি রাজ্য কালক্রমে একজন রাজাই শাসন করতে শুরু করে।স্বাধীনতার পরে উড়িষ্যা রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়া পর্যন্ত,প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভঞ্জ রাজারা ময়ূরভঞ্জে রাজত্ব করেছিল।১৯৪৯ সনে ময়ূরভঞ্জ উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়।

সেই মহারাজা ময়ূরভঞ্জের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ উত্তরপূবের ময়ূরভঞ্জ চৌহদ।উত্তর পূর্ব পার্বত্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল প্রাসাদ গৃহকে গ্রন্থাগার হিসেবে গড়ে তোলা হয়।১৯৭৩ সনে শিলঙের আপার লেচ্চুমারিতে মাত্র ৬০০ বই নিয়ে গ্রন্থাগারটি আরম্ভ হয়.১৯৭৪ সনে ময়ূরভঞ্জ প্রাসাদে স্থানান্তরিত করার সময় এই সংখ্যা হয় ১,৭০০।বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোড়ার ক্ষুরের আকৃ্তির প্রশাসনীয় ভবন সংলগ্ন ইতিহাস এবং অর্থনীতির বিভাগীয় গ্রন্থাগার ও ময়ূরভঞ্জের মূল গ্রন্থাগারের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৯৭৫ সনের শেষের দিকে এক অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে।

মৌচাকের আকৃ্তির গ্রন্থাগার,কোমল কার্পেটের ওপর বসে সারা দিন অনায়াসে বইয়ের জগতে আত্মহারা হয়ে যাওয়া যায়।পাঠককে নিমেষের মধ্যে সাহায্য করার জন্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সব সময় প্রস্তুত।বইয়ের অভাব অথবা যাবতীয় তথ্যের অভাব ময়ূরভঞ্জে পাঠকের জন্য কখনও অন্তরায় হওয়ার নজির নেই।মৌচাকের দরজার সামনে ভদ্রোচিত ব্যবহারের প্রতিমূর্তিস্বরূপা কঙ লামন য়ানচুকল্যাণ ইংরেজরা রেখে যাওয়া পাঁচটা শব্দের ষোলো আনাই কাজে লাগায়,হাউ কেন আই হেল্প ইউ?

ছাত্র ছাত্রী অথবা গবেষকদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি,সাম্প্রতিক গ্রন্থের চাহিদা অনুসারে মৌচাকের অন্য একটি ঘর প্রস্তুত থাকে।নিজের প্রয়োজনের বইটি না পেয়ে এক সপ্তাহ আগে নিজের নাম ঠিকানা সহ কাকলি অনুরোধ জানিয়ে গেছে।আজ মেহগনি কাঠের চৌকাঠে পা রাখতেই তাকে খবর দেওয়া হল,তার বই এসে গেছে।

-সত্যিই স্পুন ফিডিং কারবার।

–কাকলি আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে না পেয়ে স্বগতোক্তি করল।

-ফাগুর যথোপযুক্ত ব্যবহার।

–কলাপী এক্সপার্ট মন্তব্য দেয়।

মৌচাকের ভেতরে নিঃশব্দ ব্যস্ততা আরম্ভ হয়।কাঠের মেঝের ওপরে ভারী কার্পেটে জুতোর শব্দ হয় না।

বাইরের ছবির মতো ছোট এবং সুন্দর ঘরগুলিতে কঙ বিম্বাইরা ছোট ছোট ব্যস্ত পদক্ষেপে সারাদিনের গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করার জন্য তৈ্রি হয়ে নেয়।স্টেইনলেস স্টীলের বাসন গুলি মুখ দেখার মতো ঝকঝক করছে।ছোট হাড়িটা সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন।বেশিরভাগ গ্রাহকই নিজে নিজে পরিবেশন করে কঙ বিম্বাইদের সাহায্য করে।ময়ূরভঞ্জের এটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

গ্রন্থাগার এবং কঙ বিম্বাইদের রান্নাঘরের মাঝখানে রয়েছে সামার হাউস বা বিশ্রামের ঘর।চৌহদটা ছিল ময়ূরভঞ্জে্র রাজার গ্রীষ্মকালীন আবাস।এই বিশ্রামঘর ছাত্র-ছাত্রীদের দুপুর বেলার আড্ডার ঠাঁই।

জাপির মতো গোলাকার চাল এবং হাফ-ওয়াল দিয়ে তৈরি এগুলি ছাত্র-ছাত্রী,গবেষক-গবেষিকা এমনকি পথিকদেরও সামারহাউস।ময়ূরভঞ্জের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই সামার হাউসগুলি।গোল করে বসতে দেবার মতো বেঞ্চ পাতা আছে।কংদের রান্নাঘরের জনপ্রিয় খাদ্য শূয়োরের মাংস ভাজা এবং ভাত,মুরগির মাংস এবং ভাতের থালাগুলি কিন্তু এই সামারহাউসের ভেতরে ঢুকে না।অলিখিত নিয়ম অনুসারে ভাতের থালা নিয়ে গ্রাহক কঙের চালার নিচে বেঞ্চিতে আর বেশিরভাগই পাইন গাছের নিচের পরিষ্কার শিলাখণ্ডে্র ওপরে বসে দুপুরের আহার খায়।সামার হাউসে দশ বারোজন গ্রাহককে এক সঙ্গে বসে থাকতে দেখলে কঙ নিজে চকচকে একটা কেটলিতে গরম গরম চা এনে দিয়ে যায়।সঙ্গে থাকে বাঁশের পাত্রে আনা জিমবাম(সকালের জলখাবার,কেক মিষ্টি জাতীয়)।কেটলি এবং জিমবামের পাত্র রেখে কঙ নিজের চালায় ফিরে যায়।ছাত্র ছাত্রীরা কে কী খেয়েছে যাবার সময় নিজে থেকে বলে যায়।কঙ সেই অনুসারে দাম বলে দেয়।দাম দেবার সঙ্গে সঙ্গে কেটলি এবং জিমবামের পাত্র ও কঙের হাতে তুলে দিয়ে যায়।

সামার হাউসগুলির সুবাদে এক নম্বর অর্থাৎ ময়ূরভঞ্জ চৌহদের বিভাগ গুলির মধ্যে ঈর্ষনীয় মেলামেশা।একটা বিভাগের কাজ কর্মের অগ্রগতি,আলোচনা চক্র অন্য বিভাগের ছেলেরা জানতে পারে।সহযোগিতা করে,যোগদান করে।মতামত ভাবাদর্শের বিনিময় হয়।কথা কাটাকাটি হয়।

নাওমি বুয়ানের সমাজসেবা,পল লিংডর রাজনীতি,আঙ্গিরা বসাকের রূপ,অশোক গোস্বামীর কবিতার আদিপাঠ,ডঃফিলিপসের বায়োলজিকেল ক্লকের মহিমা,সীমন্তিনী মীণাক্ষির অভিসার,অধ্যাপক দুহিতার ড্রাগস সেবন,সূর্যের অভাবে অনবরত এক নম্বর চৌহদে তৃষ্ণার্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দুটো ময়ূরের পেখম -এই সমস্ত বিষয়গুলির সরস আলোচনা সামার হাউসে সম্ভব। সামার হাউসের প্রেমে যে পড়েছে ,সেই ডুবে ডুবে জল খেয়েছে।

বিকেল পাঁচটায় এক নম্বর চৌহদের মৌচাক সদৃশ গ্রন্থাগারের মেহগিনি কাঠের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়।সামার হাউসে শেষ পর্যন্ত অসময়ের সূর্যের অপেক্ষায় না এক ছিলিম ভাঙের আশায় বসে থাকা ময়ূররা বাধ্য হয়ে পেখম গুটিয়ে নেয়। মানুষের সংখ্যা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে উঁচু চৌহদটায় হাঁটু কামড়ে ধরা শীতের আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। সামার হাউসগুলি দরজাবিহীন,তার মধ্যে আবার দেওয়ালগুলি কোমর পর্যন্ত উঁচু।

সামার হাউসকে গরম করে রাখা কঙদের চা-কফির চালা পাঁচটার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়।স্টেইনলেস স্টীলের বাসন-বর্তন,হাড়ি-কলসি গুছিয়ে বিম্বাইরা বাড়িমুখো হয়।

ময়ূরভঞ্জ নির্জন হয়ে যায়।জনশূন্য হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এত সুন্দর নৈসর্গিক শোভার চৌহদটাও যেন আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে।

কঙ বিম্বা পেছনে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হেলানো পথটা দিয়ে নেমে যায়।

নির্জন স্থান সবসময় নির্জন থাকে না।কাল সকালেই চৌহদ নিজের প্রশান্ত বাতাবরণ মেলে ধরবে।সমগ্র চৌহদ কলরবে ভরে উঠবে।

সৃষ্টিকর্তা নির্মাণ করা ধরণীটাও আদিতে নির্জন ছিল।ঈশ্বর বসুমতী কা রেমীয়ু এবং পতি য়ু বাছাক সৃজন করেছিলেন।পত্নী কা রেমীয়ু এবং স্বামী য়ু বাছা সংসার পেতে সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগলেন।সন্তান-সন্ততি না থাকা নির্জন সুখ-সন্তোষ একদিন দুজনকেই বিরক্ত করে তুলল।এই নিঃসঙ্গ জীবন তাদের কাছে অর্থহীন বলে মনে হতে লাগল।বসুমতী কা রেমীয়ু সৃষ্টিকর্তাকে এই নির্জনতা দূর করার জন্য কাতর প্রার্থনা জানালেন। এই প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর তাঁদের পাঁচটি সন্তান দিলেন।নাম দিলেন-রোদ,জ্যোৎস্না,জল,বাতাস এবং আগুন।

এর মধ্যে মেয়ে আগুন যেহেতু কনিষ্ট সন্তান,তাই সেই হবে গিয়ে পিতা-মাতার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।

রোদ,জল এবং বাতাসের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বসুমতী কা রেমীয়ুর শরীরে সুখের সঙ্গে সবুজ সম্ভ্রমের জ্যোতি দেখা দিল।সংসারটা জাতিষ্কার হতে লাগল।মনের আনন্দে বসুমতী সাজ বদলাতে লাগল।বসুমতী সাজ বদলালেই ঋতুর পরিবর্তন হয়।সন্তান সন্ততি হওয়ার আগে বসুমতী মা সাজ পরিবর্তন করার কথা ভাবেই নি।জ্যোস্নার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাবার কথা ভাবেইনি।এখনই মা বসুমতী রূপবতী হয়ে উঠল।সবুজের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ধরণীর বুকে অন্যান্য জীব্জন্তুর ও আগমন হল।বসুমতীর রূপে রঙ চড়ল।

তাহলে মানুষকে কে সৃষ্টি করল?সেই একই সৃষ্টিকর্তা।মানুষকে আদিতে সৃষ্টিকর্তা নিজের সঙ্গে স্বর্গে রেখেছিল।মানুষ মূলত ষোলো ঘর ছিল।সৃষ্টিকর্তা তারই মধ্যে সাত ঘরকে বসুমতী কা রেমীয়ুক সাহায্য করার জন্য মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দিলেন।বাকি নয় ঘর তিনি নিজের সঙ্গে স্বর্গে রেখে দিলেন।পৃথিবীতে আসা সাত ঘর বসুমতীর দেখাশোনা করে, সেবা করে সৃষ্টিকর্তার আজ্ঞা পালন করলেন।তাতে সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর সাতঘরকে আশীর্বাদ দিয়ে ভরিয়ে দিলেন।তার ফলে সাত ঘর থেকে জনসংখ্যা বাড়তে লাগল।বর্ধিত জনসংখ্যা বসুমতী কা রেমীয়ুকে শ্যামলা এবং সমৃদ্ধ করে তুলল।সংখ্যায় অনেক হলেও মূলতঃ যেহেতু মোটে সাতঘর—এই কথা মাথায় রেখে বসুমতীর বুকে বিভিন্নতার মধ্যেও মানুষ শান্তি-সম্প্রীতির অদৃশ্য বাঁধনে বসবাস করতে লাগল।