শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

অপ্রেম, অনুবাদ গল্প

লেখক পরিচিতি -১৯৫৩ সনে অসমের পাথরকুচিতে গল্পকার,ঔপন্যাসিক ফণীন্দ্রকুমার দেবচৌধুরীর জন্ম হয়.১৯৭৬ সনে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে প্রথম শ্রেণির বি টেক ডিগ্রি লাভ করেন।লেখকের বিখ্যাত উপন্যাস‘অনুরাধার দেশ’।

পৃথিবীতে যখন কেবলই অপ্রেম

এক

হ্যাঁ,আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন,এই গল্পটা আমি আপনাকে নিয়েই লেখার কথা ভাবছি।কল্পনায় আমি সিদ্ধহস্ত এবং শব্দও আমার অবাধ্য নয়।তবু কল্পনার যাদু এবং শব্দের কারসাজিতে একটা সুখপাঠ্য কাহিনি রচনা করে নিজের সঙ্গে পাঠককেও প্রবঞ্চিত করার চেয়ে মাঝে মধ্যে এভাবে বাস্তব থেকেই একটা চরিত্র তুলে এনে পাঠকের সঙ্গে পরিচিত করে দেবার আইডিয়াটি কি অধিক মনোগ্রাহী নয়?অন্ততঃ সভ্যতার ফাঁকি দিয়ে ঢেকে রাখা আমাদের এই সুষম জীবনে সত্যের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা চালানো যাবে।

রিঙ্কুর আজ জন্মদিন।

আপনি এতদিন ধরে বলছেন যখন আমি নিশ্চয় যাব।রিঙ্কু আপনার একমাত্র মেয়ে,জন্মদিনের আয়োজনটা বড় করে করাই স্বাভাবিক।

আপনার সঙ্গে একই অফিসে কাজ করি,অফিসে বলে দিলেই হত,তবু আপনি বাড়িতে এসে আমাদের দুজনকেই-অনু এবং আমাকে আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করে গেলেন,না যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

অনুকেও বলে গেছেন আপনি-অনু,নীরা কিন্তু তোমার কথা বিশেষভাবে বলে পাঠিয়েছে।না গেলে খারাপ পাবে।

আমি জানি কথাগুলির মধ্যে যতটা আন্তরিকতা আছে বলে মনে হচ্ছে ততটা নেই! অনুও যে জানে না তা নয়।তবু অনু হাসতে হাসতে বলেছে-নিশ্চয় যাব।যাব না কেন?

প্রতিদিনের মতো আজও অফিস যাবার সময় তাড়াহুড়ো ছিল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বাইরের গেটের হুকটা লাগানোর সময় বারান্দা থেকে অনু চিৎকার করেছিল-

তোমার অফিস থেকে আসার সময় প্রতিদিনি দেরি হয়।আসার সময় বাজারে ঢুকে রিঙ্কুর জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসবে।নাহলে বিকেলে বাজারে যাবার সময়ই হবে না।

রাস্তার আশেপাশে কাউকে চোখে পড়ল না।তাই বললাম-আমার দ্বারা ঐ সব হবে না।মেয়ের জন্মদিনে কী দিতে হয় তার আমি কি জানি।নিজেরও কিছু একটা হতে দাও,তখন জানতে পারব।

অনু কিছুক্ষণের জন্য সেভাবে লাল হয়ে উঠল,যেভাবে লাল হলে আমি বুকের ভেতরে একটা গরম উষ্ণতা অনুভব করি।বিয়ের দুই বছর পরেও।মুহূর্তের জন্য মাত্র দুই মিনিট সময়ের জন্য বাড়িতে যাবার একটা তীব্র বাসনা অনুভব করেছিলাম যদিও অফিসের কথা ভেবে সেই ইচ্ছা সম্বরণ করে নিলাম।

অনুর দুই মাস চলছে।শোবার ঘরে কিছুদিন থেকে একটি নতুন ছেলে শিশুর ছবি ঝুলিয়ে নিয়েছে।মা নাকি উপদেশ দিয়ে পাঠিয়েছে।

-তুমি ছেলের ছবি ঝুলিয়েছ দেখছি,মেয়েও তো হতে পারে।মেয়ের ফোটো ও ঝুলিয়ে নাও।

-সবকিছুতেই তোমার ফাজলামি।এভাবে বলতে নেই।

আমার মতো অকর্মণ্য মানুষের দ্বারা যে কোনো কাজ হয় না সেকথা অনু জানে এবং জেনেশুনেই কাজের মেয়ে রূপাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু একটা কেনার জন্য বাজারে চলে গেছে।

আর ক্ষণিকের এই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে হঠাৎ আপনাকে নিয়ে আমার একটি গল্প লিখতে তীব্র ইচ্ছা করছে।

স্মৃতির পাতাগুলি এক এক করে উলটে গেলে আপনার কখনও নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কং নামের সেই খাসিয়া মেয়েটির প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে কি?সেই তেজস্বী মেয়েটির পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠা মুক্ত হাসির শব্দ স্মৃতির সরণি বেয়ে ভেসে এসে আপনার হৃদয়ে কখনও অজান্তে মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে চায় কি?

আপনি মিছামিছি চমকে উঠেছেন।

ভয়ের কোনো কারণ নেই।

গল্প লেখক আপনার সামনে সবসময় বিচরণ করতে থাকা মানুষটাকে গল্পে এভাবে উপস্থাপিত করে যে আপনার মনে হয় যে তা অন্য কোনো জায়গার একজন অপরিচিত লোকঃগল্পের জন্যই যেন সেই চরিত্রের জন্ম।

আমার এই গল্প পড়েও কোনো পাঠক জানবে না যে এই গল্পের প্রধান নায়ক আপনিই।শব্দের যাদুতে কেবল ইঙ্গিতময় করে মূল চরিত্রকে আমি রহস্যের মধ্যেই আবৃ্ত করে রাখব।তাই আপনার জীবনের একটি ভুলে যাওয়া অতীত পাঠকের সামনে এভাবে আচম্বিতে তুলে ধরে আপনার সুখের সুষম জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করব বলে অকারণে আশঙ্কি্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।আপনার সুন্দরী পত্নী নীরা জানে নীরাকেই আপনি হৃদয়ের সর্বস্ব উজার করে ভালোবেসে এসেছেন।সমস্ত পত্নীরাই ঠিক এই একইভাবে নিজেকে ফাঁকি দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে থাকে,যেভাবে আমার পত্নী অনুও (সে এক অন্য কাহিনি,অন্য একদিন বলব)


দুই

গুয়াহাটি থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে ছোট শহরটার সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আপনি।একই শহরের ছেলে বলে আপনার পরিবারকে,আপনাকে ছেলেবেলা থেকেই চিনি।অঞ্চলটিতে আপনাদের পরিবারের নাম আছে।গ্রাম থেকে শহরে উত্তরণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলটির কয়েকটি পরিবারের ভিত ধীরে ধীরে খসে পড়ল।কারও ছেলে মা-বাবার কথা না শুনে বেজাতে বিয়ে করে বাড়ির কথা ভুলে গেল কারও ম্যাট্রিক ফেল ভাই প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এক ঢোক গিলে চৌ্রাস্তার মোড়ে ঝগড়া করতে দেখা গেল।কার ও উৎপাতে বাড়ির মেয়েরা রাস্তায় বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল-আর ও কত কী?

আপনাদের বাড়িটা কিন্তু বিশাল আকাশে ধ্রুবতারার মতোই স্থির হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকল।চৌধুরী বংশের সুদৃঢ় ঐতিহ্যে সময় সামান্যতম কল্পনারও সৃষ্টি করতে সক্ষম হল না। একজন একজন করে কেউ ডাক্তার হল,কেউ ইঞ্জিনিয়ার এবং কেউ হয়তো অধ্যাপক।এক এক করে কয়েকজনের ধূমধামের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।আজকের যুগের যুবকের চরিত্রে সামান্যতম উচ্ছৃঙ্খলতা না দেখে সবাই বংশের ঐতিহ্যের এই মহীয়ান রূপ সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখতে লাগল।

এই বংশ,এই ছেলে,ভালোভাবে পড়াশোনা করেছে,চাকরি করছে,পিতা-মাতার কথা শুনেছে,লক্ষ্মী মেয়েকে বিয়ে করেছে।বিহুতে-উৎসবে এসে সবার সঙ্গে হাসি স্ফুর্তি করে গেছে।আমাদেরটাকে দেখ,চাকরি একটা পেতে না পেতেই বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠল।কোথা থেকে একজনকে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে এল-এই ধরনের কথাবার্তা বাড়িতে গেলে এখনও কানে আসে।

এবার বাড়িতে যাবার পরে জিতেন স্যার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং প্রাক্তন ছাত্রের প্রশংসায় গদগদ হয়ে আপনমনে বলেছিল–সেইসব ছেলের কথাই আলাদা বুঝেছ।কী সুন্দর ব্যবহার,চরিত্রে একটা দাগ নেই।আজকের যুগে এই ধরনের ছেলে কয়জন আছে।ওদের মা-বাবা গর্ব না করে কে গর্ব করবে।

আপনার মনে আছে বোধহয়-জিতেন স্যারের বড় ছেলে আমাদের স্কুলে এক সঙ্গে পড়ত।অরুণাচলের দিকে কোনো একটি স্কুলে কাজ করার সনয় ওদিকেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করে।জিতেন স্যার আজ পর্যন্ত বাড়ি ঢুকতে দেয়নি।


তিন

আপনি শিলঙে চাকরি করার সময় আমি গুয়াহাটিতে।কিছুদিন পরে আমারও শিলঙে বদলি হল।প্রথমে মনে হল আপনি যেন সন্ধ্যেগুলি আমার থেকে দূরে সরে থাকতে চান।মনে করলাম আমাদের দুজনের চাকরির তারতম্য বজায় রাখার প্রয়োজনে আপনি এরকম করছেন।আমিও নীরবে মেনে নিয়ে দূরে সরে থাকলাম।কিছুদিন থাকার পরে আমি আবিষ্কার করলাম খাসিয়া মেয়েটির সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতার কথা।

আপনি আর নীরা-একটা সুখী দম্পতি,একটা সুখী পরিবার।আমার এভাবে আজ আপনাকে সময়ের সীমা ভেদ করে অতীতে টেনে নেবার প্রয়াস করা উচিত হয়নি।কিন্তু যে মেয়েটির সঙ্গে একসময় প্রতিটি সন্ধ্যে নিবিড় অন্তরঙ্গতায় পার করে দিয়েছিলেন,তাঁকে আপনার জীবনের এই সুখের মুহূর্তে,মাত্র ক্ষণিকের জন্য ভুলে যাওয়ার গর্ভ থেকে বের করে আনলে কি সাংঘাতিক অন্যায় করা হবে?

লেকের পারে হঠাৎ একদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।অপ্রস্তুত হয়েছিলেন যদিও আপনিই আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন-সেই সজীব মুখর খাসিয়া মেয়েটির সঙ্গে-কং,এই যে আমার বন্ধু দেবচৌধুরী,একই স্কুলে পড়া।এই হল কং।

নমস্কার।

-দেবচৌধুরী গল্প লিখে।

-গল্প লেখা মানুষকে আমার ভীষণ ভয় করে।কী না কী সব লিখে দেবে,লিখে দেবে বলে মনে হয়।

কঙ বলেছিল।

-ভয় নেই।আমি কিছুটা স্বার্থপর লেখক।নিজের কথা ছাড়া অন্যের কাহিনি লিখতে পারি না।

কঙের সরলতা আমার ভালো লেগেছিল।

আপনাদের অন্তরঙ্গতার গভীরতা দেখে আমি কেবল সংশয়ের সঙ্গে ভেবেছিলাম চৌধুরী বংশের এই ব্যতিক্রম কী গৃহীত হবে।আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তায় আমার বিশ্বাস ছিল,ধরে নিয়েছিলাম-বংশ পরম্পরা সমস্ত অতিক্রম করে একদিন হৃদয়ের জয় হবে।


পাঁচ

আপনি একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলেন।ছুটির সময় মাঝে মধ্যে হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা বাজারে সেই সরল মুখর মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।শিলঙের পাইন গাছের পাতার মৃদু মধুর কম্পনে হয়তো তাকে আপনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল,হয়তো লেকের নিস্তরঙ্গ জলে সে আপনার প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছিল,হয়তো সন্ধ্যের ফুরফুরে বাতাস তাকে আনমনা করে তুলতে চাইছিল।

আপনি ফিরে এলেন না।

বহুদিন পরে জানতে পারলাম আপনার বাবা চেষ্টা চরিত্র করে আপনাকে অন্য এক জায়গায় বদলি করে দিয়েছে।

বড়দিনের মধ্যে বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম নীরার সঙ্গে বিয়ের পরে আপনি বাইরে বেড়াতে গেছেন-লম্বা ছুটিতে।

কঙের সঙ্গে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল।তাঁর সেই সজীব মুখে যেন সন্ধ্যের আকাশের বিষণ্ণ ছায়া এবং শরীরে পুরোপুরি মাতৃ্ত্বের চিহ্ন।

আমি কেবল মনে মনে ভেবেছিলাম-হয়তো দূরের কোনো পাহাড়িয়া শহরের হোটেলের বন্ধ ঘরে এখন আপনার বুকে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে আছে নীরা এবং আবেগজড়িত অস্ফুট কণ্ঠে আপনি সেই সব কথাই নীরাকে বলছেন,যেসব একদিন আপনি কাউকে বলেছিলেন।


ছয়

আপনি ভাববেন না,আপনাকে খারাপ কিছু করেছেন বলতে চাইছি।আপনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে,একটা বংশের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে আপনারও দায়িত্ব রয়েছে।যুগ যুগের সংযম গড়ে তোলা এই ঐতিহ্য একটি সাধারণ মেয়ের জন্য একদিনে ধুলোয় মিশিয়ে দিলে আপনাকে কেউ ক্ষমার চোখে দেখবে না। যে সমস্ত লোক আজ আপনার গুণানুকীর্তনে মাঝে মধ্যে সরব হয়ে উঠে,তাঁরাই আপনাকে নিয়ে,আপনার বাড়ি নিয়ে হাসাহাসি করত।

অঞ্চলটিতে গেলে এখনও সবার মুখে শুনতে পাই আপনার নিষ্কলুষ চরিত্রের অকৃপণ গুণকীর্তন।আপনার মা আর বাবার মুখে তৃপ্তির ঝলক।চৌধুরী বংশের ঐতিহ্য এখনও অম্লান।অঞ্চলটির মানুষ আপনাকে নিয়ে গৌ্রব অনুভব করে,সবাই মনে প্রাণে কামনা করে নিজের ছেলে যেন আপনার মতোই চরিত্রবান হয়।

আপনার পত্নী নীরা ভালো মেয়ে।রিঙ্কুকে দেখলেও আদর করতে ইচ্ছা করে।আপনার সঙ্গে মিল আছে।একমাত্র মেয়ে বলেই হয়তো আপনি এবং নীরা তাকে গভীর অপত্য স্নেহে ঘিরে রেখেছেন।

কেউ হয়তো এই একইভাবে তাঁর সন্তানকে ঘিরে রাখে।জন্মদিনের আয়োজন করে (যদি করে)।কেবল সেই জন্মদিনে কোনো আমন্ত্রিত থাকে নাঃ কোনো বাবা থাকে না।