বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

​মহাসত্যের বিপরীতে,তৃতীয় খণ্ড # দ্বিতীয় অধ্যায়

পূর্বের পর্বতমালার পেছন থেকে/ উদিত হয় উজ্জ্বল শাদা চাঁদ/ আর একটি মেয়ের মুখ বারবার মনে পড়ে। - ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)

# দলাই লামার ডাইরি

১৯৩৫ সালের ৬ জুলাইএ জন্মের পর আমার নাম রাখা হয়েছিল লহামো থোন্ডুপ। এই শব্দের মানে হল ইচ্ছাপূরণ দেবী। তিব্বতে ব্যক্তি, স্থান এবং বস্তুর নামের অর্থে থাকে চিত্রময়তা। যেমন ব্রহ্মপুত্রের জননী সাংপো-র নামের অর্থ হল বিশুদ্ধকারী। আমাদের গ্রামের নাম তাক্তেসর-এর মানে হল গর্জনকারী চিতা। উত্তর-পূর্ব তিব্বতের আমদো প্রদেশে একটি উপত্যকার গা ঘেঁষা খাড়া পাহাড়ের গায়ে ছোট একটি দরিদ্র গ্রাম। আবহাওয়ার চরম খামখেয়ালির শিকার এই গ্রামের সবুজ মাটিতে চাষবাস হতো না। গ্রামে সাকুল্যে ২০-২২ টি পরিবারের সকলেই যাযাবরের মতন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে রোজগার করতো।

ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিব্বতকে চারভাগে ভাগ করা ছিল। উত্তর-পশ্চিমে চেং-টাং প্রদেশ তুষারাবৃত মরুভূমি যা পূর্ব থেকে পশ্চিমে আটশো কিলোমিটার এলাকাকে মনুষ্যবাসের অনুপযোগীই বলা যায়। গাছপালা নেই, মাইলের পর মাইল ধু ধু সাদা, সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। যেখানে যেখানে সামান্য কিছু গাছপালা রয়েছে সেসব এলাকায় সামান্য কিছু কঠোর পরিশ্রমী মানুষের বাস। চেং-টাং এর দক্ষিণে ঊ এবং ৎসাং প্রদেশ। এই প্রদেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তুংগ হিমালয়। ঊ এবং ৎসাং এর পূর্বে খাম প্রদেশেই দেশের সবচাইতে উর্বর জমিগুলি থাকায় এই অঞ্চলেই সবচাইতে বেশি মানুষের বাস। খামের উত্তরে আমদো প্রদেশ। খাম আর আমদোর পূর্বে চীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত। আমার জন্মের কিছুকাল আগে চীনের সমর্থনপুষ্ট এক মোংগল মুসলমান সেনাপতি ওই প্রদেশ জবরদখল করে নিয়েছিল।

আমার বাবা মা ছিলেন সাধারণ কৃষক, তিনি খেতমজুর না হলেও কুলীন কৃষক ছিলেন না। তাঁরা উপত্যকায় সামান্য জমি ভাড়া করে চাষবাস করতেন। তিব্বতের প্রধান ফসল হল জৌ আর মোথি। আমার

বাবা মা আলুচাষের পাশাপাশি জৌ চাষ করতেন। কিন্তু প্রায়ই খরা কিম্বা অত্যধিক তুষারপাতে তাঁদের ফসল খারাপ হয়ে যেত। তাছাড়া ছিল কিছু গৃহপালিত পশু। চাষবাসের তুলনায় এগুলি থেকে অনেক নিশ্চিত রোজগার ছিল। আমার মনে পড়ে যে আমাদের পাঁচ- ছ’টি জোমো চমর ছিল। আর ছিল কিছু মুরগী। জোমো চমর হল গরু আর মোষের মাঝামাঝি প্রজাতির একটি প্রাণী যা শুধু আমাদের তিব্বতেই পাওয়া যায়। সেই গরুর দুধ ছাড়া তাঁরা আমাদের ছোট্ট পোলট্রির মুরগীর ডিমও বিক্রি করতেন। তাছাড়া ছিল আশিটার মতন ছাগল আর ভেড়া। বাবার দু- তিনটে ঘোড়াও ছিল। সেই ঘোড়াগুলি ছিল বাবার অত্যন্তগর্বের।

ইয়াক আর জোমোচমর হল উঁচু পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রকৃতির বরদান। এরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দশহাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় বেঁচে থাকে। অথচ সমতলের উষ্ণ আবহাওয়ায় বাঁচে না। এদের ভারবাহী ক্ষমতা অপরিসীম। চাষের ক্ষেতেও চমরই প্রধান অবলম্বন। মাদি চমর বা চমরীকে তিব্বতি ভাষায় বলে ‘দ্রী’। দ্রীর দুধও বেশ গাঢ়। চমরের মাংসও সুস্বাদু। তিব্বতের পরিবেশে এরাই সব থেকে বেশি উপযোগী। জৌ এর দানা পিষে যে ছাতু তৈরি হয়, তাকে বলে ৎসাম্পা। তিব্বতের প্রতিটি রান্নায় ৎসাম্পা অপরিহার্য। ভারতে আসার পর এই দীর্ঘ নির্বাসনেও আমি রোজ ৎসাম্পা খাই। কিন্তুৎসাম্পা আটার মতন খাওয়া যায় না। এর সঙ্গে সাধারণতঃ গরম চা বা দুধ(যা আমার প্রিয়) আর তিব্বতী বিয়ার ‘ছাং’ মিশিয়ে খাওয়া হয়। যে দ্রবই মেশানো হোক না কেন, আঙুল দিয়ে ছোট ছোট নাড়ুর মতন পাকিয়ে খাওয়া হয়। তাছাড়া অনেকে একে দালিয়ার সঙ্গেও মিশিয়ে খান। বিদেশিরা এই খাবার পছন্দ করে না, চীনারা তো একদমই পছন্দ করে না।

আমাদের পরিবারে যতটা ফসল উঠতো, তার অধিকাংশই বাড়িতে খাওয়ার কাজে লেগে যেত। সামান্য কিছু উদ্বৃত্ত হলে বাবা তা যাযাবরদের হাতে তুলে দিয়ে বিনিময়েচা, চিনি, জামাকাপড়,গয়না, লোহার কড়াই ও অন্যান্য জিনিস কিনতেন। তাছাড়া প্রয়োজনে ঘোড়ায় চেপে তিন ঘন্টা গিয়ে নিকটবর্তী ছোট শহর আমদো প্রদেশের রাজধানী সিলিংগ এর বাজারে গিয়ে কয়েকটি ভেড়া বা ছাগলের বিনিময়ে অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসতেন। সেই সময় ওই প্রান্তীয় অঞ্চলগুলিতে মুদ্রার ব্যবহার তেমন ছিল না বললেই চলে। বিনিময় প্রথাই চলতো। সিলিংগ যাওয়ার সময় বাবা সব থেকে নতুন ঘোড়াটিকে নিয়ে যেতেন। তখন তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখাত। তাঁর চেহারায় শৌর্য ফুটে উঠতো। বাবা খুব ভাল ঘোড়া চিনতেন। ঘোড়ার লালন পালন আর চিকিৎসাতেও দক্ষ ছিলেন।

আমাদের বাড়িটা অন্যান্য সাধারণ তিব্বতিদের মতনই পাথর আর মাটি দিয়ে বানানো, ওপরে তেচালা টালির আচ্ছাদন। সামনের ছোট উঠোনের মাঝামাঝি একটি মোটা কাঠের খুঁটিতে উপরে ও নিচে বাঁধা একটি পতাকায় অসংখ্য প্রার্থনা লেখা।

পশুগুলি বাড়ির পেছনে বাঁধা থাকতো। বাড়িতে ছ’টা ঘর। রান্নাঘরটি আকারে বড় আর সেখানেই আমরা সবাই দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতাম। যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বাবা মায়ের সঙ্গে তাঁদের শোবার ঘরে আর একটু বড় হলে বড়দি আর তৃতীয় দাদার সঙ্গে রান্নাঘরে পাতা বড় চৌকিতে ঘুমোতাম। রোজ সকালে আমরা প্রথমে প্রার্থনাগৃহে একত্র হতাম। সেই ঘরে একটি ছোট বেদী ছিল। বাড়িতে আর তিনটি ঘরের একটা অতিথিশালা, কখনো সখনো কোনও অতিথি এলে ওই ঘরে শুতেন। আরেকটি হল ভাঁড়ার ঘর। সেই বন্ধ ঘরে থাকতো আমাদের আর পশুদের খাবার আর আনাজপাতি। আর সব থেকে বড় ঘরটি হল বৃহৎ গোয়ালঘর কাম আস্তাবল।

আমাদের বাড়িতে কোন টেবিল, চেয়ার, খাট ছিল না। প্রত্যেক ঘরেই তক্তা বিছানো চৌকি। পাথরের মেঝেতেও সযত্নে তক্তা বিছানো। প্রত্যেক ঘরে রঙিন পালিশ করা কাঠের আলমারি।

বাবা ছিলেন মাঝারি উচ্চতার রাশভারী মানুষ। অল্পেতেই রেগে যেতেন। একবার না বুঝে তাঁর গোঁফ ধরে টান দিয়ে থাপ্পড় খেয়েছিলাম। এমনিতে অত্যন্ত দয়ালু এবং অভিযোগহীন। আমার জন্মের আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতেন, ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কী রোগ হয়েছিল সেটাই কেউ ধরতে পারছিলো না। সবাই ধরে নিয়েছিল যে তাঁর অন্তিম সময় এসে গেছে।

কিন্তু আমার জন্মের দিন থেকেই নাকি তাঁর শরীর ভাল হতে শুরু করে আর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আগের মতন সুস্থ সবল হয়ে ওঠেন।আমার জন্ম তাঁর জন্যে তেমন উৎসাহের কোনও কারণ ছিল না, কারণ আমি ছিলাম মায়ের অষ্টম সন্তান। কিন্তু আমার জন্মের সময় তাঁদের মধ্যে চারজনই বেঁচে ছিল। সেই সময় জীবনের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে বড় পরিবারকেই সঠিক মানা হতো।

আমার মা মোট ষোলজনকে জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে আমরা মাত্র সাতজন বাল্যাবস্থা অতিক্রম করতে পেরেছি। এই ডাইরি লেখার আগেই অবশ্য তাঁদের মধ্যে দুজন, ছোড়দা লোবসাংগ সামসেন আর সবার বড় দিদি, সেরিংগ ডোলমা প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আমার বড় দুই দাদা, ছোট বোন ও সবার ছোট ভাইটি এখনও জীবিত আছে।

আমি পৃথিবীতে যত মানুষ দেখেছি, তাঁদের মধ্যে আমার মা-ই সব থেকে দয়ালু। যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, প্রত্যেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন; সবাই তাঁকে ভালবেসেছেন এবং তার থেকে অনেকবেশি ভালবাসা পেয়েছেন। একবার নাকি প্রতিবেশী চীনে ভয়ানক আকাল শুরু হলে অনেক গরিব চীনা খাবারের সন্ধানে তিব্বতে ঢুকে পড়েন। একদিন এক দম্পতি একটি মৃত শিশুকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ান। তাঁরা মায়ের কাছে খেতে চাইলে মা তাঁদের খেতে দেন। তারপর ইশারায় জিজ্ঞেস করেন, মৃত শিশুটিকে মাটিচাপা দিতে তাঁদের সাহায্য চাই কিনা!

বাচ্চাটির মা মাথা নেড়ে বলেন, প্রয়োজন নেই, আমরা এঁকে খাব!

একথা শুনে মা ভয়ে কেঁপে ওঠেন। তিনি ওদের দাঁড় করিয়ে ঘর থেকে আরও আনাজপাতি এনে দেন, আর ইশারায় অনুরোধ করেন যাতে তাঁরা মৃত বাচ্চাটিকে না খান!

কিন্তু ওই চীনা দম্পতি মায়ের কথা বোঝেনই নি, এমন ভাব করে আমাদের দরজা থেকে চলে যান।

মা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকেন।

দিদি সেরিংগ ডোলমা আমার থেকে আঠারো বছর বড়। আমার জন্মের আগে বাবা অসুস্থ থাকায় তিনিই মাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করতেন। আমার জন্মের সময় দাইয়ের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। জন্মের পর আমারচোখ খোলা ছিল না, দিদি নাকি আঙুল দিয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস, এতে আমার চোখের কোনও ক্ষতি হয়নি।

তিব্বতে একটি গুল্মের ছাল থেকে তৈরি রস খাইয়ে শিশুদের অন্নপ্রাশন হয়। দিদিই আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই মহার্ঘ্য রসখাইয়েছিলেন। তাঁর কাছে শুনেছি, অন্নপ্রাশনের আগে পর্যন্ত আমার নাকি পেটের সমস্যা ছিল। কেউ আদর করে কোলে নিলেই আমি নাকি তাঁর জামাকাপড় নোংরা করে দিতাম। এই রস খাওয়ানোর পর থেকে আমার পেটের সমস্যা ঠিক হয়ে যায়।

আমার জন্মের আগেই বড়দা থুপতেন জিগ্মে নোরবুকে কুম্বুম মঠের অধ্যক্ষ সর্বজনপূজ্য লামা তাক্তসের রিম্পোচের অবতাররূপে চিহ্নিত করা হলে তিনি সেই মঠে চলে যান। ‘রিম্পোচে’ শব্দের অর্থ হল – বহুমূল্য! এই পদ আধ্যাত্মিক সাধকদেরই প্রদান করা হয়। বড়দা মঠে গিয়ে নিয়মিত পড়াশুনা আর আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে নিজেকে সেই পদের উপযুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন দীর্ঘকাল। কয়েক ঘন্টা ঘোড়া চালিয়ে তবেই সেই মঠে যাওয়া যেত।

মেজদা, গ্যালো থোণ্ডুপ আমার থেকে আট বছর বড়। তিনি আমার জন্মের আগেই এক প্রতিবেশী গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা করতে চলে গিয়েছিলেন। সেজন্যে তাঁদের নিয়ে আমার কোনও ছোটবেলার স্মৃতি নেই। ছোড়দা লোবসাংগ সামতেন আর আমি দিদির সঙ্গে রান্নাঘরের চৌকিতে ঘুমাতাম, দিদি আমাদের গল্প শুনিয়ে, গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ছোড়দাকেও ভিক্ষু হিসেবে কুম্বুম গোম্পায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেজন্যে তাঁর ছোটবেলার কথাও আমার তেমন মনে নেই।

সেই সময় কেউ স্বপ্নেও ভাবেন নি যে আমি সাধারণ শিশুদের মতন বড়ো হবো না! কেউ ভাবতেই পারেননি যে একই পরিবারে দুই তুলফু হতে পারে। আমার জন্মের পরই বাবার মারাত্মক রোগ সেরে যাওয়া, সুস্থ হওয়াকেও তখন কেউ অলৌকিক কোনও ঘটনা বলে ভাবেন নি। আমার শৈশবের স্মৃতিও তেমন প্রখর নয়। আমি ভেবে দেখেছি যে, আমার সবথেকে প্রাচীন স্মৃতি হল, দু’দল ছেলের মধ্যে মারামারি হচ্ছিল। যারা বেশি মার খাচ্ছিল তাঁদের দেখে কষ্ট হওয়ায় আমি ছুটে গিয়ে তাঁদের হয়ে শক্তিশালীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।

ছোটবেলার আরেকটি স্মৃতি হল মঙ্গোলিয়ার যাযাবর আর ঊট দেখা। আমদো থেকে মঙ্গোলিয়া সীমান্ত দূরে নয়। ওই উঁচু লম্বা ঊট দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মুরগীর ঘরে গিয়ে দানা ছিটিয়ে ওদের খেতে দেওয়ার কথাও মনে আছে। মা মুর্গীর ডিম তুলে ঘরে ফেরার পরেও আমি সেখানে থেকে মুর্গীগুলির মতন ‘কোক কোঁকর কো’ আওয়াজ করার চেষ্টা করতাম। মুর্গীর ঘরে বেশি যেতাম বলেই কিনা জানিনা, পূর্ব তিব্বতের অধিকাংশ শিশুর মতো আমার পেটেও কৃমি হয়েছিল।

কিন্তু, ছেলেদের সঙ্গে খেলার সময় আমার নেতা হওয়ার প্রবণতা ছিল। গ্রামপ্রধানের মতন টেবিলের উপর কিম্বা উঁচু জায়গায় বসে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া পছন্দ করতাম। আর মাঝেমধ্যেই একটি থলেতে অনেক জিনিস ঢুকিয়ে সেই থলে কাঁধে নিয়ে বলতাম, ‘আমি লহাসা যাচ্ছি...লহাসা যাচ্ছি!’ আমি নাকি মা ছাড়া আর কাউকে আমার খাওয়ার বাসন ধরতে দিতাম না। অপরিচিতদের দেখে ভয়ও পেতাম না! আমাকে দলাই লামা চিহ্নিত করার পর মা ব্যতিক্রমী শিশু হিসেবে তাঁর এরকম অনেক পর্যবেক্ষনের কথা বলেছেন।

দলাই লামা হিসেবে আমাকে কিভাবে চিহ্নিত করা হল সেকথা বলার আগে বৌদ্ধ ধর্ম ও তিব্বতের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হবে। তবেই সেই প্রক্রিয়াকে কিছুটা বোঝা যাবে।

বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ ঐতিহাসিক ব্যক্তি, পরে তিনি শাক্যমুনি নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। আজ থেকে আড়াইহাজার বছরেরও আগে তিনি বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনিতে জন্মেছিলেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষা বা বৌদ্ধ ধর্মমত তিব্বতে পৌঁছয় প্রায় একহাজার বছর পর। তারপর আরও কয়েকশো বছর লাগে তিব্বতের সংস্কৃতির গভীরে পৌঁছে দেশকে প্রাচীন বনধর্মের প্রভাবমুক্ত করতে। ফলে যুদ্ধপ্রিয় দুর্ধর্ষ তিব্বতিরা ক্রমে হয়ে ওঠে একটি শান্তিপ্রিয় জাতি।

অথচ একসময় তিব্বতের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাটের বাহিনী মধ্য এশিয়া, নেপাল, ভুটান আর উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চল দখল করে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।

তিব্বত একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে যখন গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সন নামক ইয়ার্লুং উপত্যকার একজন গোষ্ঠীপতি আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ঐ উপত্যকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সমস্ত গোষ্ঠীদের একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করে সমগ্র মধ্য তিব্বত নিজের অধিকারে নিয়ে আসেন এবং এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গঠন করতে সক্ষম হন।

তখন এই বিশাল জনবিরল মালভূমির বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্রিত হয়। ৬১৮ অথবা ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহীরা বিষক্রিয়ার মাধ্যমে গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সনকে হত্যা করতে পারলেওতাঁর পুত্র স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পো কঠোরহাতে এই বিদ্রোহ দমন করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তিনি সুমপা জাতি, ঝাংঝুং রাজ্য, তুয়ুহুন রাজ্য এবং ট্যাং সাম্রাজ্যের সীমান্তপ্রদেশ সোংঝৌ আক্রমণ করেন।

তিব্বতে তিনিই প্রথম বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে তাঁর স্ত্রী-র ইচ্ছায় লাহসা শহরে জোখাং সহ বহু বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন এবং লাহসাকে সুসজ্জিত করে রাজধানীর মর্যাদা দেন। তাঁর মন্ত্রী থু-মি-সাম-ভো-তা তিব্বতী লিপির জনক। তাঁর সময়েই তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ ও তিব্বতের সংবিধান রচনা শুরু হয়।

স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পো- র নাতি সম্রাট খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সান পশ্চিম তুর্কী খাগানাতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। এদের মিলিত সেনাবাহিনী ৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কাশগর ও ৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে খোটান দখল করে। ৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে এক ভয়ানক যুদ্ধে তুর্কী নুশিবাই তিব্বতের কাছে পরাজয় স্বীকার করে,ফলে ওয়াখান উপত্যকাও তাঁদের দখলে চলে আসে। ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতী বাহিনী ট্যাং সাম্রাজ্যের অধিকারে থাকা তারিম নদীর পশ্চিম উপত্যকা ও আকসু দখল করে নেয়। ৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা গানসু প্রদেশের সানঝৌ, কুওঝৌ, হেঝৌ, দিয়েঝৌ, মিগং ও ডানলিং আক্রমণ করে দখল করে নেয়।

৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিব্বতীদের দখলে সমগ্র তারিম নদী উপত্যকা চলে আসে। তখনই ইর হ্রদ অঞ্চলে বসবাসকারী ইরহে জাতি চীনের ট্যাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য তিব্বতের অধীনে আসে। আর তিব্বতীরা পূর্বে সংঝু ও লিয়াংঝৌ, দক্ষিণে ভারত, পশ্চিমে কাশগর ও উত্তরে তুর্কীদের এলাকা পর্যন্ত তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সান আর খ্রি-ল্দে-স্রোং-ব্ত্সান এর মতো পরবর্তী অনেক সম্রাটের ট্যাং সাম্রাজ্যের সঙ্গে আদা কাঁচকলা সম্পর্ক ছিল এবং বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে সাম্রাজ্যের সীমান্ত কমতে ও বাড়তে থাকে।

৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতী সৈন্যরা সির নদীর উত্তরে টালাসের যুদ্ধে ট্যাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব ও কার্লুক জাতিদের সাহায্য করে। এই নির্ণায়ক যুদ্ধের ফলে ট্যাং সাম্রাজ্যের পশ্চিমে সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায়।

তিব্বত সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তারলাভ করে খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানের শাসনকালে। এই সময় তিব্বতী সেনাবাহিনী চীন ও নেপালের কিছু অংশ ছাড়াও খোটান, বালটিস্তান, ব্রুঝা, হুঞ্জা, ঝাংঝুং, ইয়ুগুর, কামিলং, জিনজিয়াং ও গানসু অধিকারে আনে।

খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সানের আমন্ত্রণেই ভারত থেকে শান্তরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শান্তরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব ‘সম’ নামক স্থানে বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন, শান্তরক্ষিত ও অন্যরা সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধধর্মগুলি অনুবাদ করেন।

৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতি সৈন্যরা চীনের রাজধানীও দখল করে নিয়েছিল। চীন থেকে প্রতিবছর ভালই কর আদায় করতেন তাঁরা। কিন্তু তিব্বতি সমাজে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যত বাড়তে থাকে তিব্বত ক্রমে হিংসা ত্যাগ করে। অন্য দেশে আধিপত্য না করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে পুরোহিত-সংরক্ষক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আরেক প্রতিবেশী দেশ মঞ্চুরিয়ার বৌদ্ধ সম্রাটরা দলাই লামাকে বলতেন - বিস্তারশীল বৌদ্ধধর্মের সম্রাট।

সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান ‘সম’-য়ের বৌদ্ধবিহারে ৭৯২ থেকে ৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই বছর ব্যাপী লাহসা পরিষদ নামে এক ধর্মীয় বিতর্কসভার আয়োজন করেন। চৈনিক বৌদ্ধধর্মের প্রতিভূ হিসেবে চান গুরু হেশাং মোহেয়ান এবং ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রতিভূ হিসেবে শান্তরক্ষিতের শিষ্য কমলশীলের মধ্যে এই বিতর্ক হয়। বিতর্কের শেষে কমলশীল বিজয়ী ঘোষিত হলে তিব্বতে চীনা বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তে ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিস্তার হয়।

আজও প্রত্যেক তিব্বতী যে চীন থেকে অনেক বেশি ভারতের প্রতি আত্মিক টান অনুভব করেন, তাঁর পেছনে রয়েছে এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সান তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারকারী তিনজন ধর্মরাজার মধ্যে একজন। তিনি নেপাল, চীন, কাশ্মীর ও খোটান থেকে বহু কারিগর, পণ্ডিত ও অনুবাদককে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যান। তিনি বহু সংস্কৃত শব্দের তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করার কাজে উৎসাহ দিয়ে বহু তিব্বতী সাহিত্য ও অনুবাদকর্মকে সাহায্য করেন।

কথিত আছে, তিব্বত সাম্রাজ্যের শেষ সার্বভৌম সম্রাট গ্লাং-দার-মা বনদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু বৌদ্ধকে হত্যা করেন, কিন্তু এই ঘটনার ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে দ্বিমত রয়েছে। কথিত আছে,পদ্মসম্ভবের পঁচিশজন শিষ্যের মধ্যে একজন ল্হা-লুং-দ্পাল-গ্যি-র্দো-র্জে বৌদ্ধ ধর্মরক্ষার জন্যে গ্লাং-দার-মাকে হত্যা করেন। গ্লাং-দার-মার মৃত্যুর পর দুই স্ত্রীর দুই পুত্র য়ুম-ব্র্তান এবং ওদ-স্রুং সাম্রাজ্যের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করলে তিব্বত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। এই গৃহযুদ্ধের ফলে তিব্বতী রাজতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পায় এবং তিব্বত অনেকগুলি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই রাজ্যগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকায় ১২৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিব্বতে কোন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না।

গ্লাং-দার-মার মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে য়ুম-ব্র্তান মধ্য তিব্বতের দ্বুস অঞ্চল এবং ওদ-স্রুং গুজ অঞ্চলে শাসন করেন। ওদ-স্রুংয়ের দুই ছেলে। দ্পাল-'খোর-ব্র্ত্সানের ব্ক্রা-শিস-ব্র্ত্সেন-ব্র্ত্সান আর স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন। স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলের স্তোদ-ম্ঙ্গা-রিস অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লাদাখকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং লাদাখি রাজবংশের সুত্রপাত করেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্পাদিত লা-দ্ভাগ্স-র্গ্যাল-রাব্স বা লাদাখের রাজাদের ধারাবিবরণীতে পড়েছি,রাজা স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন তাঁর তিন ছেলেকে তাঁর সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। বড় ছেলে দ্পাল-গ্যি-ঙ্গোনকে মার‍্যুল বা লাদাখ ও হ্গোগের স্বর্ন খনি,রু-থোগ বা রুদোক, ল্দে-ম্চোগ-দ্কার-পো বা দেমচোক ও রা-বা-দ্মার-পো প্রদান করেন।

দ্বিতীয় ছেলে ব্ক্রা-শিস-ম্গোন পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলে রাজত্ব করে গুজ এবং পু-হ্রাং নামক রাজ্য স্থাপন করেন।

এই সময়ে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের প্রগতি স্তব্ধ হয়। রাজাদের লোভ আর বৌদ্ধদের অহিংস মানবতাবাদ যে পরস্পরবিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেজন্যে তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা, কারাবাস ও নির্বাসন দেওয়া হয়। এই সময় তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চল আমাদের আমদোতেই একমাত্র অতিব্বতী গোষ্ঠীদের মধ্যে তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম টিকে থাকে। এই সময় চারজন সাহসী বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্মার-বান-শাক্য-সেং-গে, গ্ত্সাং-রাব-গ্সাল , গ্যো-দ্গে-ছুং এবং ব্লা-ছেন-দ্গোংস-পা-রাব-গ্সাল পায়ে হেঁটে উত্তর-পূর্ব তিব্বত অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৌদ্ধধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটান।

স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোনের তৃতীয় ছেলে ল্দে-গ্ত্সুগ-ম্গোন ছিলেন জাংস্কার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পুত্রহীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে রাজা হন তাঁর সেনাপতি ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস-ওদ। তিনি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। তিনি উত্তর পশ্চিম হিমালয়ের গুজ, পু-হ্রাং, জাংস্কার, স্পিতি, লাহুল এবং উত্তর কিন্নর অঞ্চলকে একত্র করে এক সংগঠিত রাজ্যের অধীশ্বর হন। তিনি তাঁর রাজত্বকালের শুরুতেই ‘ব্কা'-শোগ-ছেন-মো’ নামক একটি আদেশ জারি করে তাঁর রাজত্বকে ধর্মীয় ভিত্তিতে চালনা করবেন বলে ঘোষণা করেন। তিব্বতে দ্বিতীয়বার বৌদ্ধধর্ম প্রসারের মাধ্যমে তিনি একাধারে রাজা ও লামা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তিনি তিব্বত থেকে বাছাই করা একুশজন ভিক্ষু কাশ্মীরে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার উদ্দেশ্যে পাঠান। মূল উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থগুলির অনুবাদ করানো। এঁদের মধ্যে দুজন ভিক্ষু রিন-ছেন-ব্জাং-পো এবং লেগ্স-পা'ই-শেস-রাব পরবর্তীকালে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রসারে সহায়ক হন। রিন-ছেন-ব্জাং-পো বহু সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং লাদাখ অঞ্চলে বহু বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন।

৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ থোলিং বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। তিনি একজন ভিক্ষুর কাছে পূর্ব-ভারতের অতীশ দীপঙ্করের প্রজ্ঞার কথা জেনে কয়েকজন দূতের হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বত ভ্রমণের আমন্ত্রন জানান। কিন্তু দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

এই সময় রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে পথে কারাখানী খানাতের শাসক তাঁকে বন্দী করে। মুক্তিপণ হিসেবে প্রচুর সোনা দাবি করলে রাজা তাঁর ছেলে ল্হা-লামা- ব্যাং-ছুব-ওদকে বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হলে রাজপুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ নতুন রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসক ও আরো কয়েকজন অনুগামীকে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ-এর বন্দী হওয়ার কাহিনি ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বলেন।

অতীশ দীপঙ্কর ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ–এর কথা শুনে অভিভূত হয়ে তিব্বতযাত্রা করেন। এর ফলে পশ্চিম তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বাড়ে। ১০৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা বৌদ্ধবিহার এবং ১১৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ম্ত্শুর-ফু বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হয়। এই সময় রাজধানী থোলিং বৌদ্ধধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থানে পরিণত হয়। ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ -এর ছেলেকে তাঁর ভাইপো র্ত্সে-ল্দেকে দ্বাং-ল্দে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করলে তাঁদের রাজ্য গুজ ও পু-হ্রাং নামে দুটি পৃথক রাজ্যে ভেঙ্গে যায়। দ্বাং-ল্দে গুজ রাজ্য নিজের অধিকারে রাখেন। ১১৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কারাখানী খানাতের আক্রমণে গুজ রাজ্যের রাজা ব্ক্রা-শিস-র্ত্সে মারা গেলে রাজ্য কয়েক বছরের জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে।

১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল সম্রাটেরা এই অঞ্চলের প্রশাসনিক অধিকার দ্রিগুং বৌদ্ধবিহারকে দান করেন। কিন্তু ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্রাগ্স-পা-ল্দে নামক এক শক্তিশালী রাজার অধীনে গুজ পুনরায় এক রাজ্যে পরিণত হয় এবং প্রতিবেশী য়া-র্ত্সে রাজ্যকেও নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ১২৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে এই অঞ্চলটি সা-স্ক্যা বৌদ্ধসম্প্রদায়ের কর্তৃত্বে চলে আসে। কিন্তু ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের পতন ঘটলে গুজের রাজারা আবার শক্তিশালী হয় এবং ১৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পু-হ্রাং অধিকারে আনতে সমর্থ হয়।

পরবর্তী সময়ে গুজ ও মুস্তাং রাজ্যের মধ্যে পু-হ্রাং অঞ্চল নিয়ে বহু বছর ধরে বিবাদ চালু থাকলেও শেষ পর্যন্ত পু-হ্রাং গুজের অন্তর্ভুক্ত হয়। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে গুজের শাসকেরা কয়েক বছরের জন্য লাদাখ অঞ্চল অধিকারে আনতে সমর্থ হয়। ১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গুজের শাসকেরা পশ্চিম মধ্য তিব্বতের নবনির্মিত রিন-স্পুংস-পা রাজ্যকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে গুজের রাজারা তিব্বতে শক্তিশালী হয়ে ওঠা দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে শুরু করে।

১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে দুই পর্তুগীজ যাজক আন্তোনিও দে আন্দ্রাদে ও তাঁর ভাই ম্যানুয়েল মারকুইস গুজরাজ্যে পৌঁছন। গুজের রাজা খ্রি-ব্ক্রা-শিস-গ্রাগ্স-পা-ল্দে তাঁদের দেওয়া উপহার, তাঁদের মুখে আধো আধো তিব্বতি আর বিনীত ব্যবহারে অভিভূত হন। আন্তোনিও রাজাকে দেশের সেচ কৃষিব্যবস্থার উন্নতিতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন এবং একটি গীর্জা নির্মাণ করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। কিন্তু রাজার সভাসদরা এই যাজক ভাইদের পছন্দ করতেন না। আন্তোনিওর লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, এই সময়ে গুজের কিছু সামরিক অধিকর্তা ষড়যন্ত্র করে রাজাকে সিংহাসনচ্যূত করতে লাদাখীদের আমন্ত্রণ জানায়।

১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখী সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণে গুজ রাজ্যের রাজধানী অবরোধ করে। গুজের রাজা খ্রি-ব্ক্রা-শিস-গ্রাগ্স-পা-ল্দে তখন তাঁর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ভাইয়ের উপদেশ মেনে আত্মসমর্পণ করেন। গুজরাজ্য তখন লাদাখের অধীনে করদ রাজ্যে পরিণত হয়। রাজাকে লাদাখে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই অভিযানের সময় গুজে নির্মিত সমস্ত গীর্জাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কথিত আছে, এই অভিযানে লাদাখী সেনাবাহিনী গুজের অধিকাংশ জনগণকেই হত্যা করে, মাত্র দু’শ জন প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন।

প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম দলাই লামা আবার গুজকে তিব্বতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। এই যুদ্ধে গুজের রাজধানী প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় গুজের বহু মূর্তি ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করে দেওয়া হলেও আমি শুনেছি বেশ কিছু অসাধারণ শিল্পকলা কোনওভাবে এই ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে গেছে।

প্রথম দলাই লামার জন্ম হয়েছিল ১৩৫১ খৃষ্টাব্দে। আমাকে তিব্বতের সমস্ত পূর্ববর্তী দলাই লামার অবতার মনে করা হয়। আবার আমি ও আমার পূর্ববর্তী তেরজন দলাই লামাকেই অবলোকিতেশ্বর বা চেনরেজিং এর অবতার মানা হয় – করুণার বোধিসত্ত্ব, যার হাতের শোভাবৃদ্ধি করে শ্বেতপদ্ম। চেনরেজিংকে বুদ্ধ শাক্যমুনির ঘনিষ্ট ব্রাহ্মণ বালকটির ৭৪তম অবতার মানা হয়।

বৌদ্ধ ধর্মের মূল সিদ্ধান্ত ‘পরস্পর নির্ভরতা’ অথবা ‘ কারণ আর ক্রিয়া’র সিদ্ধান্ত। এর সামান্য অর্থ হল, ইচ্ছা বা প্রেরণা থেকে উৎপন্ন ক্রিয়ার পরিণামই ব্যক্তির অনুভব এবং অভিজ্ঞতা। তাঁর মানে ইচ্ছাই ক্রিয়া আর অনুভবের মূলে। এই ভাবনা থেকেই বৌদ্ধধর্মে চেতনা এবং পুনর্জন্মের ধারণাগুলি বিকশিত হয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম ধারণা হল, কারণ থেকেই যেহেতু পরিণাম উৎপন্ন হয়,পরিণামই পরবর্তী পরিণামের কারণ হয়ে ওঠে। সেজন্যে চেতনাকে নিরন্তর প্রবাহিত তত্ত্ব মানতে হয়। প্রবহমান এবং প্রতি মুহূর্তেই ঘটমান অভিজ্ঞতা এবং নানা অনুভব ও প্রভাবগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলে। শারীরিক মৃত্যুর সময় ব্যক্তির চেতনায় তাঁর জীবনের সকল অভিজ্ঞতা, অনুভব, প্রভাব এবং ক্রিয়া অঙ্কিত থাকে – একেই বলে ‘কর্ম’। এই চেতনাই অঙ্কিত সবকিছু সহ পশু, মানুষ কিম্বা দেবতারূপে পুনর্জন্ম নেয়।

এর একটি সরল উদাহরণ হল, কেউ যদি নিজের জীবৎকালে পশুদের প্রতি ক্রুর ব্যবহার করে, তাহলে পরের জন্মে সে কুকুর হয়। আর পুনর্জন্মে সে অত্যাচারী মালিকের ক্রুরতার শিকার হয়। আর এজন্মে যাঁরা ভাল কাজ করেন তাঁরা পরজন্মে ভাল ফল পাবেন।

বৌদ্ধমতে চেতনার মূল প্রকৃতি যেহেতু নির্লিপ্ত, তাকে জীবনের অনিবার্য দুঃখ, কষ্ট, পুনর্জন্ম, আর এগুলির অনন্ত চক্র থেকে একেবারে মুক্তি পেতে জীবনের সকল বন্ধন এবং নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। এরকম পর্যায়ে পৌঁছুতে পারলে ব্যক্তির চেতনা আগে মুক্তি পাবে আর তারপর তিনি বুদ্ধত্ব অর্জন করবেন। কিন্তু তিব্বতের বৌদ্ধ পরম্পরা মনে করে, ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুর সাংসারিক চক্র থেকে মুক্ত হয়ে বুদ্ধত্ব অর্জন করবেন, তাকেও ততদিন পর্যন্ত বারবার জীবনধারণ করে অন্যদের সাহায্য করতে সংসারে আসতে হবে যতদিন পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি এই বৌদ্ধত্ব অর্জন না করেন!

৬ষ্ঠ দলাই লামা ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো ছিলেন একজন সুকবি। তাঁর কবিতায় প্রেমরসের বাহুল্য দেখে অনেকে ভাবেন যে কোনও মানবী প্রেমের প্রভাবেই তিনি এমন লিখে গেছেন। অনেকে বলেন যে, চীনের পথে কোকো নোরে তাঁর রহস্যজনক অন্তর্ধানের মূলেও রয়েছে সেই প্রেমিকার আকর্ষণ। এসব শুনলে আমার হাসি পায়।

কিন্তু আমি মুচকি হেসে নিজেকে সংযত রাখি। এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না!


ক্রমশ ...