শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

​কিছু মনে কোরো না বাঙালি...


আমি ঠিক বাঙালি নই। ত্রিপুরী। একটি উপবাংলা আমার মাতৃভাষা।নিজের অপদার্থতার কারণে, আমি ভ্রাতৃভাষা ককবরকে সাবলীল নই। এমন অবশ্য অনেকেই। অনেক ককবরকভাষী চাকমা ভাষা জানেন না, কিংবা চাকমাভাষী ককবরক জানেন না। সে ভিন্ন। আমাকে পশ্চিমবঙ্গীয় উন্নাসিকতায় বাঙাল বলা যায়। মায়ের কথ্যভাষাটিই শিশুর মাতৃভাষা। সে হিসেবে কুমিল্লা অঞ্চলের ভাষাই আমার মাতৃভাষা।অথচ আমি আমাদের রাজ্যে প্রচলিত বাংলার সবকটি উপভাষা বুঝতে পারি। শুনতেও হাসি পায় না।কিন্তু, আমাকে ছাত্রবয়সে যেসব বাংলা বই পড়তে হয়েছে, সেসবের সঙ্গে আমার মাতৃভাষার কোনোমাত্র মিল নেই। ‘ঘোড়ায় চড়িল, আছাড় খাইল...’ পড়ে বুঝতে আমার অনেক কল্পনার কেরোসিন পোড়াতে হয়েছে। আমাদের অঞ্চলে ঘোড়া নেই, দেখিনি। ‘চড়িল’ কী আমি বুঝি না। কেবল ‘আছাড় খাইল’টি বুঝতে পারি।এমন করে সহজপাঠ, এমন করে ‘মধ্যাহ্নে’ ‘দেবতার গ্রাস’ আমাকে বুঝতে হয়েছে। আমি দেখেছি, আত্মীয়সূত্রে পশ্চিমবঙ্গে গেলে আমাকে চুপ করে থাকতে হত। কারণ, কথা বললেই ওরা হাসে। যৌবন এল। জানতে পারলাম, দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, শচীন দেববর্মণ খুলে বাঙাল বলেন। আমিও কলকাতা গেলে খুলে বাঙাল বলতে শুরু করলাম। দেখলাম, বেশ মাজাকি। ‘বাংলাদেশি মাল’ শুনলাম। শুনলাম, ‘বাংলায় বলুন’।

পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় পিতৃস্থানীয়রা পড়াশোনা করেছেন। আমাদের বন্ধুরাও পড়েছে। আমিও চেষ্টা করেছি, ফিরে এসেছি। আমরা স্কুলে যেসব পাঠ্যবই পড়তাম, সব পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের। আমরা ভূগোলে পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ আঁকতাম। এবং হুগলী নদীর তীরে পাটশিল্প বিকাশের কারণ মুখস্থ করতাম। ভাগ্য ভালো আমি এবং আমার বয়সীরা শেষ অব্দি ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনেই পরীক্ষা দিয়েছি। পরে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। সুতরাং, আমি পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলার একজন ব্যক্তিক উপনিবেশ। হাস্যকর এবং গাঁইয়া। এই পশ্চিমবঙ্গ, সাঁওতালি এবং এবম্বিধ বহু ভাষাকে খুন করেছে।

ক্লাস ফোর থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত আমি রমেশ স্কুলে পড়েছি। তার আগে গ্রামে নামতা শিখেছি আরও কী কী যেন পড়েছি। ছোটোবেলায় আমরা, শহরে এসে, যে পাড়ায় থাকতাম, সে পাড়ায় একজন মিশ্রজি ছিলেন। তাঁর একটি চোখ পাথরের। তিনি কেবিআই-এর হিন্দিশিক্ষক ছিলেন। ভাষাটি ছাড়া তাঁর সবকিছু বাঙাল হয়ে পড়েছিল।আমাদের তাঁকে (এবং তাঁর কন্যাদের) অবাঙালি মনে হয়নি।

যাইহোক, পশ্চিমবঙ্গ আমাযাইহোক, পশ্চিমবঙ্গ আমাদের কাছে তেমন ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে না আজকাল। সেই সেই উজ্জ্বল শিক্ষাসত্রগুলো হাস্যকর হয়ে গিয়েছে। আমাদের উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা সেদিকে যেতেই চায় না। কিন্তু এর ফাঁকে একটি বিস্তর ঘটনা হয়ে গিয়েছে। সারা ত্রিপুরায়, বিশেষত, নব্য মায়েদের কৃপায় আমাদের ছেলেমেয়েরা উপবাংলাকে ঘৃণা করতে শিখে গিয়েছে। তারা কলকাতার প্রকরণে, বাঙাল টোনে কথা বলে।মানে ‘প্রমিত’ বাংলায় কথা বলে। হাস্যকর। কারণ,যে প্রমাণিত হয়নি, তার আবার কী প্রমিতরূপ? এ ভাষা তো আসলে পশ্চিমবঙ্গের দেড়টা জেলার ভাষা। ভারত ও বাংলাদেশ মিলে কোটি কোটি বাঙালি এ ভাষা চেনে না, কিন্তু শুনে শুনে জানে। এটি আসলে সংখ্যালঘু বাংলা। কিন্তু এতেই আমাকে ঘাড় ধরে লেখানো হচ্ছে। এখন লিখছি। ঘটা করে চর্যাপদের ঐতিহ্যে নিজেকে স্থাপিত করেও যে ভাষা ক্লাসিক্যাল ভাষা হতে পারল না ,চেষ্টা করল না, ওড়িয়া হয়ে গেল, তার আবার কিসের রাজনৈতিক অহং? তথাপি, এই ‘কেলো’র দৌরাত্ম্য,এই কৌতুকটি, ভাষিক আগ্রাসনের কারণে। পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা অপরাপর বাংলা ও অন্য ভাষার সঙ্গে যে আচরণ করে, তা হিন্দি যা করতে চায় (তথাকথিত বিরোধবাদীদের মতে) তার চেয়ে কম নয়। ত্রিপুরার চাকরি, ত্রিপুরার টাকায় প্রতিপালিত পশ্চিমবঙ্গীয় অধ্যাপককুল কোনোদিন ত্রিপুরার ভাষায় কথা বলেননি। তাঁদের সামনে বাঙালে কথা বলাটা ছিল অপরাধ। পশ্চিমবঙ্গ, তোমার যেমন ইংরেজি বলিয়েরা, আমাদের তেমন কেলো বলিয়েরা...

একটা বিশেষ আমলের আগে কারা ঠিক বুদ্ধিজীবী সেটা বোঝা যেত না। আমরা বুঝতাম অভিভাবক। তাঁরা যতটা সামাজিক জীব, ততটা রাজনৈতিক ছিলেন না। একটা সময়ের পরে এই ত্রিপুরায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাতারে বুদ্ধিজীবী আমদানি করা শুরু হল। বিদ্যালয়ে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইনে, ইলেক্ট্রিকে... এরাই প্রভু হয়ে বসলেন। এরা আমাদের ভাষাকে ডিস্টোর্ট করলেন। আমাদের সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যহীন করলেন। কেবল রবীন্দ্রানুরাগী করে তুললেন।একটা এলিটিজম শুরু করলেন। মঞ্চানুগ নয় এমন ফসল তোলার নৃত্যকে হত্যা করে মঞ্চে নিয়ে তুললেন। নাম দিলেন, 'আদিবাসী নৃত্য'। এমন ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, যা আমরা বুঝি না, ফলে সম্ভ্রম করি। এরা আমাদের ব্যথাকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যথার দাস করে তুললেন।

যাক জাহান্নামে অতীত। কথা হল, আমাদের ছেলেমেয়েরা আজকাল পশ্চিমবঙ্গকে ঘৃণা করে। এরা বাংলা বলতে পারে। পড়তে পারে। কিন্তু জানে না, কী বাংলা এদের মাতৃবাংলা কী ধার করা... সুতরাং এরা প্রথমে ভারতীয় হতে চায়, একটু পরেই বৈশ্বিক।আমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা গরীব, পিছিয়ে পড়া, আমাদের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এখানেই ধুঁকছে। কিন্তু যারা পারছে, বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের রাজনীতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের অনুসারী। হায়। আমাদের ফলবান লিবারেশন আন্দোলনকে সেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কেড়ে নিয়েছিল সংশোধনবাদীরা...

যাই হোক, ত্রিপুরা রাজ্য হিসেবে আমরা ভিন্ন। ততটা বাঙালি নই। যদিও আমাদের সংবাদপত্রে, শখ করে লেখা হয় ‘কল্লোলিনী আগরতলা’... কথায় কথায় কথায় ত্রিপুরাকে বলা হয় বাংলা। পশ্চিমবাংলার অনুকরণে শিল্পীরা শাড়ি পরেন, টিভিতে হাহা-হিহির আয়োজন করা হয়, দশমীতে সিঁদুর খেলার ছবি আসে... হা হা হা, এসবই আসলে আমদানিকৃত বুদ্ধিজীবিতার ফল।অনুকারকদলের হীনমন্যতার রূপ। আমরা স্বতন্ত্র। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা কিংবা ককবরক পড়বে (যদিও শিক্ষক চাকমা কিংবা হালাম, নিজেই ওই ককরক জানেন না, কিন্তু চাকরি পেয়েছেন), ইংরেজি পড়বে, সঙ্গে হিন্দি কিংবা যে-কোনো ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা পড়বে (এমনই বলা হয়েছে খসড়া প্রস্তাবে)। তাদের তো করে খেতে হবে, নাকি? পশ্চিমবঙ্গে তো তোমরাই কাজ পাচ্ছ না, পড়তে পারছ না, চিকিৎসার জন্য দক্ষিণভারত যাচ্ছ... তোমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াবে? কাজ দেবে? আমি অন্তত তোমাদের সঙ্গে নেই