বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

​উনিশে মে : কিছু ভাবনা

ইতিহাস কখনো কোনও জাতি গোষ্ঠীর প্রতি বড়ই নির্মম হয়ে ওঠে । আর সেই ঐতিহাসিক নির্মমতার সাক্ষ্য বহনকরে যায় মানব সভ্যতা। শুধু আসাম বা বরাক উপত্যকা নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির কাছেই উনিশে মে ঐতিহাসিক নির্মমতার স্মারক, প্রতিবাদের স্মারক, নিজের বিপন্ন ভাষিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার রক্তাক্ত লড়াইয়ের স্মারক।

১৯৬১-র যে ভাষা আইনকে কেন্দ্র করে এই লড়াই, শহিদের আত্মবলিদান ,-- তারও একটি ন্যক্কারজনক অধ্যায় আছে, যার সুত্রপাত হয়েছিল ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭ এর আগেই। ১৮৭৪ সালে যে শ্রীহট্ট ও কাছাড়কে সুরমা ভ্যালী ডিভিশন নাম দিয়ে নব গঠিত আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হল, বলা যেতে পারে যে তখন থেকেই , শ্রীহট্ট-কাছাড়ের বাঙালীর ভাগ্যাকাশে অন্ধকারের সূচনা, যার নিবৃত্তি আজ হয় নি।আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া শ্রীহট্টকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ,

‘ মমতাবিহীন কালস্রোতে

বাংলার রাষ্ট্র সীমা হতে

নির্বাসিতা তুমি

সুন্দরী শ্রীভুমি--’

অথচ ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পর আসামের তৎকালীন রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরীর দেওয়া ১৯৪৭, ৫ নভেম্বর তারিখে আসাম বিধান সভায় প্রদত্ত ভাষণে বলেন,

“The natives of Assam are now the masters of their own house. They can take what steps are necessary for the propagation of Assamese language and culture… the bangalee has no longer the power, even if had the will, to impose anything on the people of these hills and valleys which constitute Assam. The basis of such feelings against him as exist is fear – but now there is no cause for fear. I would, therefore, appeal to you to exert all the influence you possess to give the stranger in our midst a fair deal, provided of course, he in his tern deals loyallywith us.”

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই মহামান্য রাজ্যপাল বাঙ্গালীদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তার মধ্যেই লুকিয়েছিল আসামের বাঙ্গালীদের ভবিষ্যৎ । বিশেষ করে আসামের রাজশক্তি বাঙ্গালীদের প্রতি কি মনোভাব নেবে তার ইঙ্গিতও এর মধ্যে নিহিত ছিল। বলা বাহুল্য সেই নিহিত ইশারা আজও পরিবর্তিত হয় নি।

১৯৪৭ এর ২০ জুলাই Assam Tribune এডঃ বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া লিখেছিলেন,

“Culturally , racially and linguistically , every non assamese is a foreigner in Assam. In this connection we must bear in mind that Assam from the very ancient time never formed a part of India. Mythological and legendary allusions apart, viewed in this perspective, every foreigner who came to and resided in Assam for trade and other purposes after the occupation of the province by the British in 1826 A.D. might be treated as alien if she wants to save herself from the grips of foreigners. An aliencan not be expected to take a dispassionate view of public affairs of our future free State.”

উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরকার বক্তব্যগুলো উনিশে মে’র পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি যদি বাঙালী বিদ্বেষের সরকারী সিল মোহর হয়, দ্বিতীয়টি বিচ্ছিন্নতাবাদের। এখনো যখন খিলঞ্জিয়া কে, তা নিয়ে একটি বড়সর ঝড়ের পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে, তখন বাঙ্গালীকেই অসমীয়া ভাষা সংস্কতির পক্ষে বিপদ হিসেবে কেউ চিহ্নিত করতে চাইছে।

২৮-১০-১৯৬০ এর কারিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যুগশক্তি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “আসাম কোন পথে?”

“...আসাম বিধান সভায় একমাত্র অসমীয়াকে রাজ্য ভাষা করিয়া বিল পাস করানো হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত এই বিল যে আকার ধারণ করিয়াছে, তাহাতে অসমীয়া ভাষার ষ্টীম রোলার চালাইয়া অন্যান্য ভাষাভাষীদের সাংবিধানিক অধিকার ধুলিস্যাত করিয়া দেওয়া হইয়াছে...।’’

২৩-১২-১৯৬০ এর যুগশক্তিতে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে “বহু নিন্দিত ও বহু বিতর্কিত আসাম সরকারী ভাষা বিলে রাজ্যপাল শেষ পর্যন্ত সম্মতি প্রদান করিয়াছেন... এখন আসামের বাঙালী প্রধানগণকে এবং বিশেষ ভাবে কাছাড় জেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তাহাদের আশু কর্তব্য নিরধারন করিতে হইবে...।’’

২৬শে ডিসেম্বর ১৯৬০, শিলচর জেলা কংগ্রেস অফিসে প্রয়াত সন্তোষ কুমার রায়ের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ১৫ জানুয়ারির মধ্যে কাছাড়ের সকল পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগ করা উচিত বলে মত প্রকাশ করা হয়।

১৯৬১ থেকেই শুরু হয় আসাম সরকারী ভাষা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি। গঠন করা হয় গণ সংগ্রাম পরিষদ। ঘটনা ক্রমে ১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ। তাই স্থির হয়, ১৫ মে’র মধ্যে শত বর্ষ উৎসব শেষ হবে এবং ১৯ মে থেকে গণ সংগ্রাম পরিষদের ধারাবাহিক আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হবে। ১৯ শে এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। অবশেষে ১৯শে মে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচর – আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। সর্বত্র আন্দোলন শান্তি পূর্ণ ছিল। কিন্তু বিকাল ২ টা ৩৫ নাগাদ শিলচরে পুলিশ শান্তি পূর্ণ আন্দোলনে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। মারা যান ১১ জন সত্যাগ্রহী। তাঁরা হলেন – কামলা ভট্টাচার্য ( ১৬ বছরের ছাত্রী), শচীন্দ্র পাল ( ১৯ বছরের ছাত্র), চণ্ডী চরণ সূত্রধর( ব্যস ২২, পেশা কাঠ মিস্ত্রি), কুমুদ দাস ( ২৪, দোকান কর্মচারী) সত্যেন্দ্র দেব( ২৪, দোকান কর্মচারী), বীরেন্দ্র সুত্রধ্র(২৪, কাঠ মিস্ত্রি) , সুকোমল পুরকায়স্থ (৩০, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী), হিতেশ বিশ্বাস (২২, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী) ও কানাই লাল নিয়োগী ( ৩৭, রেল কর্মচারী)।

এর পর উত্তাল হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকা। প্রায় এক মাস কোনও রাজ্য সরকারী অফিস বন্ধ ছিল। সংগ্রাম পরিষদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে দিল্লী যান। বরাক উপত্যকার সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হয়। কিন্তু কালক্রমে আরও দুই বার ১৯৭২ এবং ১৯৮৬ তে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। শহীদ হন আরও তিন জন। সুজিৎ চৌধুরীর ভাষায় “...মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে স্বাধীন ভারতের একটা অংশে দু’বারে তেরো জন বাঙালী পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বরণ করে শহিদ হয়েছেন। ... বরাক উপত্যকার দুখিনী বাংলা বর্ণমালাকে সসম্মানে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইটা একটা নিত্য দিনের লড়াই, যা এখনও বহমান রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’’

ভাষা কিম্বা নাগরিকত্বের প্রশ্নে অনঅসমীয়াদের উপর সেই আগ্রাসন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে চলে আসছে। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে এর বিরুদ্ধে সচেতন সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তরও নেই। ১৯ শে মে’র চেতনা সেই শিক্ষাই দিয়েছে।