শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -৮

(আট)

রসেশ্বর টাকা পয়সা জোগাড় করে মামলা করার জন্য তৈরি হতে হতে শ্রাবণ মাস প্রায় শেষ হতে চলল। শ্রাবণের ৪ তারিখ সেই যে বৃষ্টি আরম্ভ হল তারপর থেকে বৃষ্টি থামার আর কোনো লক্ষণই নেই। নতুন জল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙগুলি সমস্বরে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে দেওয়ার মতো গ্রামের কৃষকদের মধ্যে একটা বিরাট ব্যস্ততা এবং চাঞ্চল্য জেগে উঠল। ভোররাত থেকে ভর দুপুর পর্যন্ত আশেপাশের মাঠ হাল বাওয়া মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখরিত হয়ে থাকেঃ হেই হেই, ঘুরঘু্‌র, এই মরাটাকে সরিয়ে দে, লাঙ্গলটাকে ওটা নিতেই পারে না। ঘুর ঘুর কাজলা ঘুর –ইত্যাদি। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ, হাঁটু জলে গরু এবং মানুষের পা ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ,হালোয়াদের মুখে হেই হেই, ঘুরঘুর শব্দ- সমস্ত কিছু মিলে একটা অদ্ভুত সুর- সমলয়, চাষার জীবনের ছন্দে যেন একটা নতুন উন্মদনা জাগিয়ে তোলে।

দিন পার হয়ে যায়, রসেশ্বর যন্ত্রণায় পাগল হয়ে উঠল।

বৃষ্টির জল পেয়ে রসালো এবং কোমল হয়ে ওঠা তার জমি দুর্নিবার আকর্ষণে তাকে টানতে শুরু করেছে। বিয়ের পরে নতুন বউয়ের বিছানাও এমনভাবে তাকে আকর্ষণ করেনি। কিন্তু তার কী পোড়া কপাল যে, যে সময়ে সঙ্গের সমস্ত চাষি মনের উৎসাহে রাতকে দিন করে হাল বেয়ে মাটি উর্বর করে তুলছে, সেই সময়ে সাব-ডেপুটি, মণ্ডল, এবং আধি বোর্ডের মেম্বারদের বাড়িতে বাড়িতে টাকার পুঁটলি নিয়ে সে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়ানোটাই বরং বেশি ভালো। যে সময়টুকু বাড়িতে বসে থাকে সেই সময় সে আরও বেশি পাগল হয়ে উঠে। সকালে সে বারান্দায় একটি পিঁড়ি পেতে বসে উদাস দৃষ্টিতে সামনের আল পথের দিকে তাকিয়ে থাকে ।

তার চোখের সামনে দিয়ে এক এক করে গ্রামের মানুষগুলি গরুগুলিকে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠে নিয়ে যায়। বারান্দায় রসেশ্বর স্থির হয়ে বসে থাকে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কেউ কোনো কিছু না ভেবে চিন্তে হঠাৎ চিৎকার করে প্রশ্ন করে উঠে-‘কী হে অসুখ হয়েছে নাকি?হাল বাইতে যাবেনা?’ রসেশ্বর কোনো উত্তর দেয় না। অবশ্য তার উত্তর শোনার জন্য কেউ পথ চেয়ে থাকে না। কিন্তু মানুষগুলির হাল বাইতে যাওয়ার দৃশ্য এবং ওদের প্রশ্ন রসেশ্বরকে যন্ত্রণায় পাগল করে তোলে। দাঁত-মুখ কামড়ে সে নীরবে বসে থাকে। মাঝেমধ্যে এক ঝাঁক সজল বাতাস বয়ে যায়। সেই বাতাসে সে কুকুরের মতো একটা পরিচিত গন্ধ অনুভব করতে চেষ্টা করেঃ মাঠের কাদার গন্ধ,পচা ঘাসের গন্ধ, বৃষ্টিতে ভিজে হালের গরুর শরীর থেকে বের হওয়া গন্ধ।গন্ধটা নাকে লাগার সঙ্গে সঙ্গে রসেশ্বর আরও বেশি পাগল হয়ে উঠে। তার একেকবার এরকম ইচ্ছা হয় যে কারও কোনো বাধা নিষেধ না মেনে সে মাঠে গিয়ে হাল জুড়বে আর সনাতন বাধা দিতে এলে তাকে দায়ের কোপে দু টুকরো করে ফেলবে। কিন্তু তার এই সাহস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নরহত্যার অপরাধে সে যদি জেলে পচে মরে তাহলে এই ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে তার স্ত্রীর কী অবস্থা হবে সেই দৃশ্য কল্পনা করে তার মনটা নিজে থেকেই সংকুচিত হয়ে আসে। তাছাড়া সনাতন শর্মার ক্ষমতা কি কম? এই মৌজাতে তাকে রাজা বলে মানা হয়। মন্ত্রী এম এল এ বড় সাহেব এলে ও তার ঘরেই খাওয়া-দাওয়া করে। সেইজন্য পুলিশের দারোগা থেকে আরম্ভ করে সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা তাকে বাঘের মতো ভয় করে, তার আঙ্গুলের ইশারায় তারা উঠাবসা করে। এরকম একজন মানুষের সঙ্গে সে কোন সাহসে লড়াই করবে? সনাতন ঠিকাদারের তুলনায় সে হাতির সামনে মাছির মতো কিছু ছোট হতে পারে কিন্তু কিছুতেই বড় নয়।

… কিছুই করতে না পেরে রসেশ্বর নিজের মাংস নিজেই কামড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।

একাটা পান-সুপারি আর চার আনা পয়সা নিয়ে একদিন গ্রামের জনার্দন বাপুর কাছে রসেশ্বর দেখাতে গেল। পাঁজি পুঁথি দেখে বাপু সিদ্ধান্ত জানালো যে ২৯ শ্রাবণ বৃহস্পতিবার মামলা করার জন্য ভালো দিন। সেই দিন মামলা করলে তার জয় হবেই হবে। সেদিন সকাল বেলা স্নান করে রসেশ্বর ভগবান,সত্রের গোঁসাই এবং নয় পুরুষের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে সাবডেপুটি হাকিমের কাছারিতে মামলা দেওয়ার জন্য যাত্রা করল। স্ত্রী স্বামীকে না জানিয়ে মনে মনে সংকল্প করল যে মামলায় জিতলে সে দেবী কামাখ্যাকে সোনার ফুল দেবে।


ক্রমশ ...