শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১০

(১০)

পঁচিশ টাকা....... পঁচিশ টাকা…….. আর দুদিনের মধ্যে পঁচিশ টাকা জোগাড় করতেই হবে না হলে মামলার তারিখ তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না। আজ শ্রাবণের ২৯ তারিখ। ভাদ্র মাসের সাত তারিখের মধ্যেও যদি মামলার দিন পাওয়া যায় এবং পনেরো তারিখের মধ্যে যদি কিছু একটা দফারফা হয়ে যায়, নিজের মাটি পুনরায় ফিরে পায়, তাহলে জমি চাষ করতে পারুক আর না পারুক ধানের চারা অন্তত লাগিয়ে রাখতে পারবে। তা দিয়ে এই বছরের হয়তো খাবার জুটবে না কিন্তু আগামী বছরের জন্য সুবিধা হবে। তাও যদি না হয়, বৃষ্টির অভাবে সে যদি জমিতে একটাও ধানের চারা লাগাতে না পারে, তবু তার নিজেরজমিটা নিজের হয়ে থাকবে। কেবল এই খবরটাই তার ক্ষুধা তৃষ্ণা সমস্ত কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে। এই খবরটাই তাকে নতুন জীবন দিতে পারবে না কি? তার নিজের জমিটা তার নিজের হয়ে রয়েছে বলে জানতে পারলে এ বছর চাষ না হওয়ার ফলে ভাঁড়ারে ছয় মাস ধান নাথাকলেও প্রতিবেশীরা ভবিষ্যতে প্রতিদান পাওয়ার আশায় তাকে নিশ্চয়ই দুই চার মণ ধান দিয়ে সাহায্য করবে। মহাজনও একশো ছয় কুড়ি টাকা ধার দিতে সংকোচ করবে না। কিন্তু কিছু একটা না হয়ে মামলা যদি ছয় মাস এক বছর চলতে থাকে তাহলে এই বছর চাষ করা তো যাবে না, জমি কার হাতে যাবে তার কোনো ঠিক নেই ভেবে কোনো মানুষই তাকে ধার দিয়ে সাহায্য করতে সাহস করবে না। তখন তার কী অবস্থা হবে? কিছুক্ষণ সে সেকথা ভাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ভবিষ্যতের করাল ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তার এত ভয় হল যে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথাটা এপাশ-ওপাশ করে ভীষণভাবে ঝাঁকিয়ে সে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তাটুকু মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল। সাব ডেপুটি হাকিমের অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসার সময় রাস্তাতেই রসেশ্বরের জ্বর এসে গেল। কয়েকদিন ধরে তাঁর ভালো করে খাওয়া দাওয়া হয়নি। ভয় দুশ্চিন্তা এবং উত্তেজনায় তার শরীর মন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তবু সে সেই সমস্ত দুঃখ ক্লান্তি ভুলে যেত যদি আজ অফিসে সে কোনো ভালো খবর পেত। ঘরের লক্ষ্মী স্বরুপা কামধেনুর মতো গাভী বিক্রি করে পাওয়া একশত টাকার একটি পয়সাও হাতে নেই, ইতিমধ্যেই সব খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু এতকিছু করেও সে আজ পর্যন্ত মামলা আরম্ভ করতে পারল না। কাছারিতে মামলার দরখাস্ত জমা দিতে যদি এত টাকা খরচা করতে হয়, এত ঘোরাঘুরি করে পায়ের জুতো ক্ষয় করতে হয়, তাহলে আসল মামলা শুরু হলে কত টাকা জলের মতো খরচ করতে হবে, আর কত জনের হাতে পায়ে ধরে ঘুরে বেড়াতে হবে তার কোনো সীমা আছে কি? রসেশ্বরের উপোস থেকে শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেরকম অবস্থায় অফিসের কাণ্ডকারখানা তার মনে এত ভয় ঢুকিয়ে দিল যে সেই ভয়ে তার জ্বর এসে গেল। কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে কোনোমতে সে বিকেল হওয়ার আগেই বাড়ি পৌছাল। বাড়ি পৌছে বিছানায় আশ্রয় নিল। সেদিন রাতে স্ত্রী অনেক কাকুতি-মিনতি করেও তাকে ভাত খাওয়াতে পারল না। তার পেটে ক্ষুধা ছিল না এমন নয়, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আগের দিন রাতের একমুঠো ঠান্ডা ভাত খেয়ে যাওয়া ছাড়া সারাদিনে তার পেটে একটি দানাও পড়ে নি। কিন্তু এখন পেটে ক্ষুধা থাকলেও কিছু একটা খাবার তার শক্তি নেই। কারণ একটা প্রকাণ্ড হিংস্র ভয় পাথরের মতো তার গলায় চেপে বসে খাবার খাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে ফেলেছে। এমনকি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

পঁচিশ টাকা ….পঁচিশটা টাকা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে কাঠে গজাল ঢোকানোর মতো কেউ যেন তার মাথায় আঘাতের পরে প্রচণ্ড আঘাত হেনে এই একটাই মাত্র চিন্তা ঢুকিয়ে দেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে যে আগামী দু'দিনের মধ্যে পঁচিশ টাকা যোগাড় করতে না পারলে তার আর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই। সেই উপর্যুপরি আঘাতে তার মস্তিষ্কের ভেতরটা থেতলে গিয়ে একটা লাড্ডুর মতো হয়ে যেন রক্তের পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে।

অপদেবতায় পাওয়া মানুষের মতো অন্ধকারে অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করে সে এবার প্রকৃতিস্থ হওয়ার চেষ্টা করল। তখন বোধহয় মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। এতক্ষণ সে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের অস্তিত্বের কথা ভুলেই গিয়েছিল। ওদের কথা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার হঠাৎ তার মনে হল যে সেই মধ্যরাতে স্ত্রী ও যেন ঘুমোতে পারেনি, স্বামীর সঙ্গে একটুও কথার বিনিময় হয়নি, যদিও সে নিজে নিজেই সমস্ত কথা বুঝতে পারছে এবং স্বামীর মত সেও উজাগরি বিছানায় ছটফট করে চলেছে।

…..টাকা …..মদ….. মেয়ে মানুষ- সংসার থেকে ন্যায় বিচার পাবার জন্য ক্ষমতার ওদের অধীশ্বরদের এই সমস্ত উপচারে পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারতে হবে। তার টাকা নেই, টাকা না হলে মদও জোগাড় করতে পারবে না। থাকার মধ্যে তার রয়েছে একজন স্ত্রী। একটা উন্মাদ মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে একটা চিন্তার ঢেউ খেলে গেলঃ অন্য কোনো উপায় যখন নেই,হাকিমের হাতে এক রাতের জন্য নিজের স্ত্রীকে তুলে দিলে কেমন হয়? জমি যদি তাকে হারাতেই হয়, তাহলে স্ত্রীকে রেখে সে কী করবে? তাকে সে কীভাবে খাওয়াবে? দিকচিহ্নহীন অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা আলোর ক্ষীণ বিন্দু দেখার মতো রসেশ্বর মুহূর্তের জন্য সামান্য স্বস্তি অনুভব করল। কিন্তু সেই স্বস্তি ও বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। হাকিমের পূজার উপচার স্বরূপ নিজের স্ত্রীকে কিছুক্ষণের জন্য মনের চোখের সামনে তুলে ধরে নিরুপায় হতাশার যন্ত্রনায় সে নিজে নিজেই শিঁউরে উঠল। সেই কপালে ভাঁজ পরা,গাল ভাঙ্গা, গলার চামড়া ঝুলে পড়া এবং বুকটা চ্যাপ্টা হতে হতে ধান মেলা উঠোনের মত হয়ে পড়া মহিলাকে সে নিজে ছাড়া অন্য কোনো মানুষ স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করতে পারবে কি?

তাকে দেখলে মানুষের মনে লোভ সঞ্চার হওয়া দূরের কথা, রাস্তার লোম ঝরেপড়া কুকুরকে দেখলে ঘৃণা হওয়ার মতো বোধহয় ঘৃণাই বেশি হবে। সে নিশ্চয় দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে, না হলে তার মনে এরকম একটি অসম্ভব চিন্তার উদয় হল কীভাবে? হাকিমের পূজার উপচার স্বরূপ স্ত্রীকে নাকচ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি চিন্তা এসে তার মনে প্রবল ভাবে আঘাত করল। সে আজ সত্যি সত্যি এরকম একটি অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে যে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করে আনা স্ত্রীকে সম্পত্তি রক্ষার জন্য বেশ্যা-বৃত্তিতে নিয়োগ করার কথা ভাবতে হল? কে আজ তাকে এই মহাপাপের দিকে দিকে ঠেলে দিয়েছে? নিজের অজান্তে সে যে কোন অতল নরকের পথে নেমে গিয়েছে সেকথা উপলব্ধি করে তার সমস্ত জ্বরতপ্ত চেতনা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। জীবন্ত পুড়ে যাওয়া মানুষের মতো সে বিছানায় ছটফট করতে লাগল। হিংস্র জন্তু বা ভূত পিশাচের সামনে থেকে দৌড়ে পালাতে যাওয়া মানুষের মতো তার চিন্তা ও বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াতে শুরু করল। একবার তার মনে হল যে সে যেন দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দেহ মন গ্রাস করা আগুনটাকে নেভাবে। পরের মুহূর্তেই সে ঠিক করল যে এখনি একটা দা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে সনাতন শর্মাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই তার মনে হল যে সনাতন শর্মার বাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে যাবার সামর্থ্য তার নেই, পথে মুখ থুবড়ে পড়ে সে নিজেই আধমরা হবে। তারচেয়ে বরং দা-টা দিয়ে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের প্রত্যেককে কেটে শেষ করে অবশেষে নিজের গলায় কোপ মেরে সমস্ত চিন্তা ভাবনা এবং সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করবে। দৌড়ে দৌড়ে অবশেষে তার মনটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল, করার মতো কিছুই খুঁজে না পেয়ে সে এবার হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-‘ এই যে শুনছ কি?’

তখন ভোর হয়ে আসছিল, স্ত্রী বিছানা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। স্বামীর ডাক শুনে জিজ্ঞেস করল ‘কী হল?’

'আজ সারাদিনের মধ্যে পঁচিশ টাকা যোগাড় করতে না পারলে আমি নিজেও আত্মঘাতী হব, তার আগে তোমাদের সবাইকে কেটে শেষ করে রেখে যাব।'

বিছানা থেকে উঠতে চাওয়া রসেশ্বরের স্ত্রী আবার শুয়ে পড়ল। একটা আকস্মিক প্রচন্ড আঘাতে কেউ যেন মাটিতে আছড়ে ফেলে তার মাথাটা খন্ড খন্ড করে ফেলেছে।



ক্রমশ ...