শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -৭

সাত

রাঙ্গলীকে বিক্রি করে পাওয়া ১০০ টাকার ৫০ টাকা বাপুরাম শইকীয়াকে এবং ৩০ টাকা সাব-ডেপুটি হাকিমের মদের বোতল এবং মুরগির জন্য ডিম্বেশ্বর মন্ডলকে দিয়ে রসেশ্বরের হাতে বাকি রইল মাত্র কুড়ি টাকা। মন্ডল ৩০ টাকা নিতেই চাইছিল না।

-‘তোমাকে তো আগেই আগেই হিসাব করে দিয়েছিলাম যে কমপক্ষে ৩৫ টাকা লাগবেই। এখন তুমি যে আমাকে মাত্র ৩০ টাকা দিলে। বাকি পাঁচ টাকা আমার নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হবে নাকি?’

রসেরশ্বর মন্ডলের হাতে পায়ে ধরে বলল –‘দাদা, আপনাকে ৩৫ টাকা দিলে আমার হাতে থাকবে মাত্র পনেরো টাকা। সেই পনেরো টাকা দিয়ে আমি কোন সাহসে মামলা করতে যাব? দরকার হলে আমি একদিন আপনার বাড়িতে হাজিরা খেটে দেব, আর তা না হলে মামলাটা জেতার পরে কিছু একটা উপায় বের করে বাকি টাকা পরিশোধ করে দেব।এবারের মতো আপনি আমাকে রেহাই দিন।‘

মন্ডল কোনোমতেই ছাড়ে না। অনেক ধরাধরি করার পরে ঠিক হল যে মুরগির দামের পরিবর্তে রসেশ্বর বাড়ির একটা হাঁস নিয়ে মন্ডলকে দিয়ে যাবে। হাকিম যদিও মুরগির মাংসই বেশি পছন্দ করেন তবুও এই যাত্রায় মন্ডল তাকে হাঁসের মাংসের স্বাদ নেবার জন্য অনুরোধ করবে।

হাকিমের ঝামেলাটা এভাবেই মেটানো গেল।বাপুরাম শইকীয়ার বাড়িতে গিয়ে রসেশ্বর আরও একটা বিপদে পড়ল। শইকীয়া কোনোমতেই রসেশ্বরের কাছ থেকে টাকা নিতে চায় না। শইকীয়ার মুখে কেবল একটিই কথাঃ ‘এসব হল আইন-কানুনের কথা, আইনের ধারা মতে সমস্ত কিছুর বিচার হবে। আইন যদি তোমার দিকে থাকে তাহলে তুমি মাটি পাবে কিন্তু আইন যদি তোমার বিপক্ষে থাকে তাহলে টাকা নিয়েও আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারব না।’

রসেশ্বর বাপুরাম শইকীয়ার ধর্মনিষ্ঠতা দেখে সাতবার তাকে প্রণাম জানাল। যেচে দিলেও টাকা নিতে চায়না আজকের জগতে এই ধরনের মানুষ কজন আছে? ডিম্বেশ্বর মন্ডল মিছামিছি এই ধরনের একজন মানুষের বদনাম করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাপুরাম শইকীয়া যতই আইনের কথা বলুক না কেন রসেশ্বরের মনে দৃঢ় ধারণা যে টাকার তেল ঢাললে তবেই আইনের বাতিটা জ্বলবে না হলে বাতি জ্বললেও সঙ্গে সঙ্গে নিভে যাবে। জীবনে সে মামলা-মোকদ্দমা করে নি সত্যি, কিন্তু জন্মের পর থেকেই উঠতে-বসতে শুনে আসছে যে চাহিদা মতো প্রচুর টাকা ঢালতে না পারলে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমায় না যাওয়াই ভালো। বাপুরাম শইকীয়া টাকা নিতে না চাওয়ার অর্থই হল যে তার হয়ে কথা বলার ইচ্ছে বাবুরামের নেই। সে গল-বস্ত্র হয়ে বাপুরাম শইকীয়ার প্রায় পায়ে পরার মতো করে বলল-‘আইন যেদিকেই থাকুক প্রভু,কেবল আপনি আমার দিকে থাকলেই হল। অনেক কষ্টে টাকাগুলি জোগাড় করে আপনার কাছে এসেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইলে আমার আর শক্তি নেই। আপনি টাকাগুলি না রাখলে আমি বুঝবো যে আমার হয়ে কথা বলার আপনার ইচ্ছা নেই। আমি মন্ডলের মুখে শুনেছি, দুঃখী আধিয়ারের হয়ে উচিত কথা বলার জন্য সরকার আপনাকে বোর্ডের নাম্বার করেছে। এখন আপনি যদি আমার হয়ে কথা না বলেন তাহলে আর কে বলবে বলুন? আমি আপনার পায়ে ধরে কাকুতি করছি,টাকাগুলি রাখুন। না হলে আজ আমি বাড়ি ফিরে যাব না। আপনার পায়ের কাছেই পড়ে থাকব।’

ডিম্বেশ্বর মন্ডল যে বিপদে পড়েছিলেন, বাপুরাম সেই একই বিপদে পড়লেন। সনাতন শর্মা এর আগেই এসে তাকে ১০০ টাকা দিয়ে গেছে। সেই টাকা নিতে তার বিন্দুমাত্র সংকোচ হয়নি। তিনি জানেন যে যাই বলুক না কেন পুলিশ বা হাকিম সনাতন শর্মার হয়ে কথা বলবে।আধি বোর্ড সনাতনের বিপক্ষে গেলেও সনাতন রসেশ্বরকে জজের কোর্ট পর্যন্ত ছেঁচড়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু দৌড়ে যাওয়া একটা মানুষ একটা মোটর গাড়ি কে যেভাবে প্রানপনে দৌড়েও ধরতে পারেনা তেমনি সনাতনকে মামলার দৌড়ে কোনোদিনই ছাড়িয়ে যেতে পারবেনা। লাভের মধ্যে মাঝপথে সে মূর্ছিত হয়ে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। তাই সনাতনের টাকা খেলেও সেই টাকা বদ হজম হওয়ার কোনো ভয় নেই। কিন্তু নিঃস্ব ভিখারি রসেশ্বরের টাকা খেলে তার কাজ করে দিতে পারার কোনো আশা নেই। পায়ের কাছে পড়ে থাকা দশ টাকার পাঁচটা নোটের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাপুরাম নিজের মনের ভেতর অনেকক্ষণ যুদ্ধ করল। হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলা ঠিক নয়। এদিকে পাপের ভয় রয়েছে ষোলো আনা। টাকাগুলি না নেবার জন্য তিনি শেষবারের মতো চেষ্টা করলেন। শোনো চুতিয়া, তোমার হয়ে যা করা দরকার আমি এমনিতেই করব তার জন্য তুমি আমাকে টাকা দিতে এসেছো কেন? আইন যদি তোমার দিকে থাকে তাহলে তুমি মাটি পাবে। তার জন্য তোমার টাকা খরচ করতে হবে কেন? আমি তোমার কাছ থেকে কখনও টাকা নিতে পারব না।’

শেষের কথাগুলি বাপুরাম শইকীয়ার মুখ থেকে এত জোরে বেরিয়ে এল যে তিনি নিজেই বড় অবাক হয়ে গেলেন। বাপুরামের কথা শুনে রসেশ্বরের মনে ভীষণ ভয় জন্মাল। টাকা না নিয়ে আজকের দিনে কে কার কাজ করে দেয়? বাপুরাম শইকীয়া তার কাছ থেকে টাকা নিতে অস্বীকার করার অর্থই হল এই যে তিনি ইতিমধ্যেই তার বিপক্ষাচরণ করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।

সে সোজা হয়ে বসে বাপুরামের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল-‘আপনি আমাকে আইনের কথা বলবেন না প্রভু। আইন মতো সংসারটা চললে যে মাটি আমার সাত পুরুষের সম্পত্তি, যে মাটিকে আমি আমার স্ত্রীর থেকেও বেশি জানি, যে মাটিতে সনাতন শর্মা জীবনে পা দেওয়া দূরের কথা মাটির চারিসীমা পর্যন্ত বলতে পারবেনা সেই মাটিতে সেটেলমেন্টে তার নামে পাট্টা কিভাবে হয়? এরকম একটি অঘটন আইনে করে নি টাকায় করেছে, আপনি আমাকে এক কথায় বলুন তো আপনি আমার টাকা রাখবেন কিনা? যদি না রাখেন তাহলে বুঝব যে আপনি ইতিমধ্যেই সনাতনের কাছ থেকে টাকা খেয়েছেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য আমার কিছু বলার নেই। রসেশ্বরের কথা শুনে এবং মুখ-ভঙ্গি দেখে বাপুরাম শইকীয়ার বুকটা সামান্য কেঁপে উঠল। বেশি কথা না বাড়িয়ে তিনি দ্রুত বললেন- ‘তোমার ভালোর জন্য কথা বলছি তুমি উল্টোটা বুঝলে। নেব না বললেও গায়ের জোরে টাকা গুঁজে দিতে চাইলে। আমি আর কি করব? কিন্তু সনাতন ঠিকাদারের সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করতে যাওয়াটা মাছি হয়ে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো হবে। পরে যদি টাকা দিয়েও ফল হল না দেখ, আমাকে কিন্তু দোষ দিও না এখনই বলে রাখলাম। বাপুরাম শইকীয়াকে টাকাগুলি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতে দেখে রসেশ্বর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড় একটি যুদ্ধে জয়লাভ করার মতো মুখের ভাবটা করে সে উঠে দাড়িয়ে আল পথের দিকে এগিয়ে গেল।


ক্রমশ ...