শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

হলদেপাখি বাওধান খায়, পর্ব -১

অনুবাদকের কথা --

পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা একই।তাই হোমেন বরগোহাঞির ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায় ’উপন্যাসের রসেশ্বর চরিত্রের মধ্যে আর সুদূর রাশিয়ার গোগোলের ‘অভারকোট’গল্পের আকাকি বাশমাচকিন চরিত্রের মধ্যে আমরা এক আশ্চর্য ধরনের মিল দেখতে পাই। ১৮০৯ সনে রাশিয়ার ইউক্রেনে নিকোলাই ভাসিলিইভিচ গোগোলের জন্ম হয়,মৃত্যু ১৮৫২ সনে। ইউরোপের অনেক বিখ্যাত সমালোচকের মতে ইউরোপের বহু প্রখ্যাত গল্পকারের জন্ম হয়েছে গোগোলের ‘অভারকোট’থেকে।গল্পের সময়কাল ১৮৩৫,জারের শাসনকাল।মানবতার চরম অপমান ছিল অত্যাচারী জারের শাসনকালের প্রতিদিনের ঘটনা। রাশিয়ার সমগ্র শাসন অবস্থায় সেদিন পচন ধরেছিল।সাধারণ পাহারাওয়ালা থেকে শুরু করে দেশের শাসন ব্যবস্থার উচ্চ পদের চিফ সেক্রটারি পর্যন্ত সবাই বিনা প্রতিবাদে এই অপশাসনকে মেনে নিয়েছিল। নিকোলাই গোগোল এক আশ্চর্য ধরনের সহানুভূতির দৃষ্টিতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়া এই অরাজকতার ছবি আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন।

গল্পটি পড়ে আকাকিকে আমাদের পিটাসবুর্গের একজন সাধারণ কেরানি বলে মনে হয় না।আমাদের মনে হয় সরকারি অফিসে খোঁজ করলে এরকম অনেক আকাকিকেই আমরা দেখতে পাব।

হোমেন বরগোহাঞির ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়’উপন্যাসটি ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিতে সমাজ বাস্তবতার একটি করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।আমাদের সমাজে মানুষের মানবীয় সত্তা ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে এসেছে।তার ফলে প্রাণহীন কিছু নীতির জন্ম হয়েছে।আমরা যাকে নীতি বলছি তা প্রকৃতপক্ষে মানবতা বিরোধী এবং সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি উদাসীন।এই উদাসীনতা এক ধরনের শূন্যতার জন্মদান করেছে। উপন্যাসের সনাতন মহাজন এই শূন্যতার প্রতিভূ যার কপট আচরণ প্রান্তবাসী গরিব রসেশ্বরের জীবনে দুঃখ দুর্দশাকে ডেকে এনেছে।নিজের এক টুকরো জমি নিয়ে রসেশ্বর স্বপ্ন দেখেছিল,পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। সনাতন মহাজনের চক্রান্তে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সনাতনের এই জঘণ্য ষড়যন্ত্রে বিচারক থেকে শুরু করে আমলা-মহুরি-পিয়ন সবাই সাহায্য করেছে।রসেশ্বরের মতো একজন দরিদ্র,কৃপার পাত্র অসহায় মানুষকে এই প্রতিটি মানুষই ঠকিয়েছে।

এভাবেই কখন যেন গোগলের আকাকি বাশমাচকিন ,বিশ্বকবির ‘দুই বিঘা জমির’উপেন আর ‘হালদীয়া চরাই বাওধান খায়’উপন্যাসের রসেশ্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

জাহ্নু বরুয়ার নির্দেশনায় উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়ে ১৯৮৭ সনে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ইন্দ্র বনিয়া।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি বাংলা সাহিত্যের মননশীল পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে । নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা



এক

আবহাওয়া অনেকদিন শুষ্ক হয়ে থেকে শ্রাবণের তৃতীয় দিন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গত দুইমাস ধরে আকাশ থেকে অবিরাম আগুন বর্ষিত হচ্ছিল। মাঠগুলো বাঙির মতো ফেটে গিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে পড়েছিল।খাল বিলের জল শুকিয়ে গরম কাদায় গরৈ,খলসে মাছগুলো মরে পচতে শুরু করেছিল,চাষিদের চোখে ভয় এবং দুর্ভাবনা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল।অবশেষে শ্রাবণের তৃ্তীয় দিন মাঝরাত থেকে বৃষ্টি হতে শুরু করে।

মেঘের প্রচণ্ড গর্জন শুনে রসেশ্বর ধড়মড় করে জেগে উঠল।এই কিছুক্ষণ আগে সে ঘুমিয়েছে।অসহ্য গরমে ঘুমোতে না পেরে অনেকক্ষণ ধরে সে ছটফট করছিল।শিয়াল যখন তৃ্তীয় প্রহরের ঘোষণা করল,রসেশ্বরের মনে হল যে আজ রাতে আর বোধহয় ঘুমোনো হবে না,সারা রাত জেগেই কাটাতে হবে।একটা সাদা-চুরুট খাওয়ার ইচ্ছায় সে বালিশের নিচ থেকে দিয়াশলাইটা বের করে কেরোসিন তেলের প্রদীপটা জ্বালাল।প্রদীপের আলোতে ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর দিকে তার চোখ গেল।ওরা প্রত্যেকেই রসেশ্বরের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোয়।একপাশে রসেশ্বর,অন্যপাশে স্ত্রী,মাঝখানে সাত ছেলেমেয়ে।প্রদীপের আলোতে রসেশ্বর দেখতে পেল,ছেলেমেয়েরা একে অপরের ওপরে হাত-পা তুলে দিয়ে একাকার হয়ে একদল কুকুরের বাচ্চার মতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

নিজের ছেলেমেয়েদের ঘুম্নন্ত অবস্থায় দেখলে মা-বাবার মনে একটা অদ্ভুত মমতা জেগে উঠে।

রসেশ্বরও হঠাৎ তার বুকের ভেতর একটা আবেগ মোচড় দিয়ে উঠা অনুভব করল।তার সমস্ত জীবনের ফসল এই সাতটি ছেলেমেয়ে।(আরও একটি হয়েছিল,কিন্তু সাত বছর বয়সেই রক্ত আমাশা হয়ে মৃত্যু হয়)।সে জীবনে কিছুই করতে পারেনি,কেবল এই সাত ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে।

অসীম মমতায় প্রতিটি ছেলেমেয়ের নিদ্রিত মুখগুলো দেখতে দেখতে অবশেষে সে সাতটা ছেলেমেয়ের ওপারে ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকাল।

স্ত্রী মরার মতো ঘুমোচ্ছে।তার বুকটা সম্পূর্ণ খোলা।এক বছরের শিশুটি বাঁহাতে একটা স্তন খামচে ধরে দুধ খাচ্ছে।দুধ খেতে খেতে সে মাঝে মধ্যে ঘুমে ঢলে পড়ে,আবার মাঝখানে চমকে জেগে উঠে পুনরায় দুধ খেতে শুরু করে।রসেশ্বর বুঝতে পারল –শিশুটি বিরক্ত করায় মা বোধহয় দুধ খাওয়াতে শুরু করেছিল,কিন্তু শিশুটি দুধ খেতে খেতে মা ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। পড়বেনাই বা কেন,সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে বিছানায় ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সারাটা দিন বেচারি এক মুহূর্তের জন্যও শ্বাস নেবার সময় পায়?

লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতেই বেচারির সমস্ত দিন পার হয়ে যায়।

সেইজন্য রাতে বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের পুঞ্জীভূত ক্লান্তি তাকে একটা হাতির মতো চেপে ধরে।অনেকদিন সে স্ত্রীকে দেখেইনি এমন একটা ভাবে সে তার দিকে তাকিয়ে রইল।কিছু সময় এভাবে তাকিয়ে থেকে তার অনুভব হল সত্যিই সে স্ত্রীর মুখটা বহুদিন দেখেনি। দেখার মতো তার সময় ছিল না,প্রয়োজনও ছিল না।আজ সে ঘুমে অচেতন হয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে রসেশ্বর স্ত্রীর মুখটা ভালোভাবে দেখতে লাগল।

জীবনে প্রথমবারের জন্য সে অনুভব করল যে তার স্ত্রী বুড়ি হতে চলেছে।তার মাথার চুলগুলি আগের চেয়ে অনেক পাতলা হয়ে গেছে,কপালটাও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।আগের মাংসল নিটোল গাল দুটোর জায়গায় গালের হাড় দুটো বেরিয়ে পড়েছে।

ক্ষণিকের জন্য অস্পষ্ট আলোতে রসেশ্বরের চোখের সামনে বিয়ের প্রথম রাতের স্ত্রীর মুখের ছবিটা ভেসে উঠল।যেন মানুষ নয়-এক টুকরো আগুন,সেদিন এত রূপ ছিল তার স্ত্রীর। আগুন নিভে এখন আধা জ্বলা কাঠকয়লা গুলি মাত্র পড়ে রয়েছে।আর দুদিন পরে সেটাও হয়তো নিভে যাবে,শুধু একমুঠো ছাই পড়ে থাকবে।রসেশ্বরের নিজের অজান্তেই একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস তার বুক ভেদ করে বেরিয়ে এল।জীবন এভাবে পার হয়ে যায়-একটা পরম সত্য উপলদ্ধি করার মতো সে মনে মনে ভাবল।

স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মমতায় তার হৃদয় গলে যাচ্ছে বলে অনুভব করল।জাগ্রত অবস্থায় সে স্ত্রীর দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকানো দূরের কথা,জীবনে একবার কোমল স্বরে সে ডেকেও দেখেনি।বেশিরভাগ সময় সে স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহারই করে থাকে।যখন রাগ করার কোনো কারণ থাকে না তখনও স্ত্রীর সঙ্গে কর্কশ স্বরে কথা বলাটা তার একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

অবশ্য এর কারণ এই নয় যে স্ত্রীর প্রতি সে কখনও কোনোধরনের ভালোবাসা বা কোমলতা অনুভব করেন না। স্ত্রীর প্রতি মনে মনে ভালোবাসা অনুভব করার সময়েও তার মুখের কথা কর্কশ হয়েই বের হয়। আসল কথা হল এই যে স্ত্রীর সঙ্গে কোমল স্বরে কথা বলতে বা আবেগ দেখাতে তার ভীষণ লজ্জা হয়। কখনও অসতর্ক মুহূর্তে কোমল কণ্ঠে কথা বলে ফেললেও সে দ্রুত নিজেকে শাসন করে,নিজের দুর্বলতার জন্য ভীষণ লজ্জিত বা অপ্রস্তুত হয়ে পরের মুহূর্তে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রূঢ় হয়ে পড়ে।

কিন্তু এখন স্ত্রী যেহেতু ঘুমে অচেতন ,তার আর সেই সমস্ত সমস্যা নেই। অনেকক্ষণ সে স্ত্রীর মুখের দিকে তন্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তার খোলামেলা শরীরটার দিকে পর্যন্ত তার চোখ গেল।কেবল যে তার দেহের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তা নয়।অসহ্য গরম থেকে রাতের অন্ধকারের নিশ্চিন্ততায় কিছু আরাম করার জন্য তার শরীরের নিচের অংশের কাপড়চোপড়ও অনেকটাই অসংযত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দেখা একটা জিনিসও হঠাৎ কখনও কখনও এক নতুন রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠে।স্ত্রীর পরিচিত নগ্নতাও রসেশ্বরের চোখে হঠাৎ নতুনভাবে উত্তেজক এবং আকর্ষণীয় হয়ে দেখা দিল।তার প্রতি এক ধরনের শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করল।তাহলে বোধহয় তার তাড়াতাড়ি ঘুমও এসে যাবে।স্ত্রীকে ডাকতে গিয়েও সে কিছু একটা ভেবে থমকে গেল।

ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ে সে এভাবে গভীর ঘুমে এতটাই অচেতন যে তাকে জাগিয়ে দেওয়াটা এক ধরনের নিষ্ঠুরতা হবে।একদিকে কামনা অন্যদিকে বিবেক-এই দুয়ের টানাপোড়নে রসেশ্বর কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রইল। অবশেষে বিবেকেরই জয় হল। কামনাকে দমন করার ক্লান্তিতে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,আর বালিশের নিচ থেকে শাদার ডিবেটা বের করে নিয়ে একটা চুরুট পাকাতে লাগল।

নিজের মনকে অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত করার জন্য সে অন্য নানা ধরনের চিন্তা করতে লাগল। বিকেলের দিকে কখনও সময় পেলে সে তিওয়ারির দোকানে গিয়ে রেডিও শোনে।আজকাল দেখছি প্রায়ই বেশি ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে নেই বলে রেডিওতে বক্তৃতা দেয়।সে সেইসব কথাই মনে করতে চেষ্টা করল।কথাগুলি মিথ্যা নয় –সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল।এই সাতটা ছেলেমেয়েক জন্ম দিতে গিয়ে আর পালন করতে গিয়ে তার স্ত্রীর অবস্থা আজ এই পর্যায়ে পৌছেছে। এই বয়সে আরও একটি সন্তান হলে তারও কি কম কষ্ট হবে? স্ত্রী জাতি মাতা বসুমতীর মতোই কষ্টসহিষ্ণু বলেই এভাবে পারে,তাদের কতটা ক্ষতি হয় পুরুষ মানুষ কীভাবে বুঝতে পারবে? চুরুটটা জ্বালিয়ে নিয়ে প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে সে পুনরায় বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।এবং অন্ধকারের মধ্যেই চুরুটটা টানতে টানতে সে ঘুমোনোর চেষ্টা করল।

রসেশ্বর অনুভব করল যে গরমটা হঠাৎ নাই হয়ে গেছে।বাইরে বোধহয় বাতাস বইছে। সে ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

তারপর একটা সময়ে সে মেঘের গর্জন শুনে হঠাৎ জেগে উঠল।

বৃষ্টি পড়ছে?

একটা অসহ্য আনন্দের উত্তেজনায় তার সর্ব-শরীর শিউরে উঠল।

পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কিছু নেই।আজ দুইমাস ধরে প্রচণ্ড খরা চলছে।সে মাঠে হাল চাষ করতে পারেনি। দুদিন হল হাল বাইতে গিয়েও সে ফিরে এসেছে।।আগুনের মতো রোদে পুড়ে জমি এত শক্ত হয়ে পড়েছে যে লাঙলের আঁচ বসাতেই পারছে না। তার শালি ধানের মাটি মাত্র এক পোড়া,সেটাও বাম মাটি।

প্রথম থেকেই ধানের চারা লাগাতে না পারলে একেবারে ফসল হয় না। এই বছর অসময়ের খরাটা হয়ে তার মাথায় বজ্রাঘাত পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। প্রতিদিনই সকালে ঘুম থেকে ওঠে সে পূব আকাশের দিকে তাকায় এবং আগুনের উঠোন হয়ে উঠা সূর্যটা দেখে তার কলজে পুড়ে যায়।আর দুদিনের মধ্যে যদি সে হাল দিতে না পারে,তাহলে এই বছর আর শালিধানের চাষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তার অর্থ,অগ্রহায়ন মাস থেকে পুরো ছয়মাস পর্যন্ত অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ আষাঢ় মাসে আউশ ধান না কাটা পর্যন্ত বাড়ির সবাইকে অর্ধাহার বা অনাহারে কাটাতে হবে।পাঁচ বছর আগেও আরও একবার এইধরনের দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি হয়েছিল।

সেইবছর রসেশ্বরের জমি সারা বছর পতিত পড়ে রইল।

ছয়মাস একবেলা খেয়ে একবেলা উপোস দিয়ে থেকে তাকে এক বিঘা জমি বন্ধকে রাখতে হল।

একটা দুগ্ধবতী গাভী বিক্রি করে দিতে হল। তাছাড়া ঘরের কত থালা-বাটি বিক্রি করে দিতে হল,রেশমের কাপড় এবং স্ত্রীর নাকের কানের গহনা বেরিয়ে গেল তার লেখাজোখা নেই।

সেই বছর তার কোমরে যে ব্যথা শুরু হল,আজও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।এই অবস্থায় আরও এক বছর যদি চাষ বাস ছাড়া থাকতে হয় তাহলে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।এতদিন ধরে তার অবস্থাটা ছিল ফাঁসির আসামীর মতো।কোনদিন গলায় ফাঁস লেগে যায় তার ঠিক নেই।কিন্তু তার সমস্ত ভয় এবং দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে যেই আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠল,রসেশ্বরের হৃদয় যেন আনন্দে একটা বাছুরের মত লাফিয়ে উঠল।

ইস ভগবান দয়াময়,করুণাসিন্ধু,এবার অন্তত নিঃস্বকে রক্ষা করলে। আর ও একটা মেঘের গর্জন শোনার জন্য সে কান খাড়া করে রইল।তার মনে হতে লাগল মেঘের গর্জনের মতো মধুর শব্দ এই পৃ্থিবীতে আর কিছুই নেই।কিছুক্ষণ পরেই পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়ে মেঘ আবার গর্জন করে উঠল।তারপর হঠাৎ আকাশটা ভেঙ্গে পড়ার মতো অজস্র ধারায় বৃষ্টি নেমে আসতে লাগল,--তৃষ্ণার্ত মাটি এবং রসেশ্বরের সমস্ত চেতনাকে আনন্দ ধারায় প্লাবিত করে দিয়ে বৃষ্টি নেমে এল।

রসেশ্বরের আবার ঘুম পেয়ে গেল,কিন্তু মুরগির প্রথম ডাকেই সে পুনরায় জেগে উঠল।ইতিমধ্যে স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গেছে।সে স্ত্রীকে ডেকে বলল –‘শুনছ?’

‘কী?’

‘কী আর হবে? বৃষ্টি পড়ছে শুনতে পাচ্ছ না?এভাবে কেউ ঘুমোয় নাকি? সেই মাঝরাত থেকে বৃষ্টি পড়ছে,তুই বুঝতেই পারিসনি?’

'আমি টের পাইনি বলে তোমাকে কে বলল?'

'টের পেয়েছ যদি ভালোই হয়েছে। এখন শোনো। আমি হাল বাইতে যাচ্ছি। সোনের পড়া শেষ হলে তাকে বল গরুটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। গরুটার নাভিতে ঘা হয়েছে, তাতে পোকা হয়েছে। আর তুই বীজক্ষেতের প্রতি লক্ষ্য রাখবি। কাল বেড়া ভেঙ্গে গরু ঢুকেছিল।আজ সকালের দিকে বেড়া দেব ভেবেছিলাম কিন্তু বৃষ্টি যখন দিয়েছে আমি হাল বাইতে যাচ্ছি। দেখিস কোনোভাবেই যেন বীজ ক্ষেতের কাছে গরু না ঢুকে। যদি ঢুকে তাহলে কিন্তু দেখবি লাঠির ঘায়ে পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেব।'

সকালবেলাতেই রসেশ্বরের মুখে এই ধরনের কথা শুনে স্ত্রীর চট করে রাগ উঠে গেল। স্বামীর দিকে পিঠ দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে সে বলল 'হয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই। আমি তোমার বীজক্ষেতের দিকে লক্ষ্য রাখব না ঘরের ঝামেলা সামলাব। কাল পুরো বিকেলটা বসে রইলে,বেড়া দিতে পারলে না?'

'তুই আমাকে কাল বসে থাকতে দেখলি'--রসেশ্বর শান্ত কন্ঠে বলল।

''তুই-ই তো আমাকে ভাঙ্গা চালুনিটা মেরামত করতে বলেছিলি।শোন,এসব কথা শেষ নয়। মাঠ থেকে ঘুরে এসে যদি দেখি বীজক্ষেতে গরু মুখ দিয়েছে তাহলে কিন্তু আমার ক্রোধ কেউ ঠেকাতে পারবে না। তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিসনা'।

বিছানায় উঠে বসে রসেশ্বর তামাকের একটা চুরুট বানিয়ে একটা সুখ টান দিয়ে বেড়ায় গুঁজে রাখা গামছাটা টান মেরে কাঁধে ফেলে সে বাইরে বেরিয়ে গেল।

উঠোনে পা দিয়েই রসেশ্বরের দেহ মন জুড়িয়ে গেল।

বৃষ্টি পড়ছে তা কোনো স্বপ্ন নয়, সম্পূর্ণ বাস্তব।

দেখলেই বোঝা যায় রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়লে উঠোনটায় এভাবে কাদা হয়ে থাকত না।কিন্তু এখন জলের ঢল ধুয়ে নিয়ে যাবার মতো উঠোনটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

মোটা মোটা কিছু কেঁচো দলে দলে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। একটু পরে যখন হাঁসগুলোকে খাঁচার ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হবে তখন তাদের একটা বড় ভোজ হবে।

রসেশ্বর পুনরায় আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টি যদি এখনই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। তখন মিথ্যা আশা দেখিয়ে মানুষকে ছলনা করার মতোই হবে। কিন্তু না সেই ভয় নেই-- আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে রসেশ্বর ভাবল।বৃষ্টি বোধহয় আবার খুব জোরে আসবে। সমস্ত আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলেছে।এত মেঘ যে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল সে কথা ভেবে রসেশ্বর আশ্চর্য হল। মেঘগুলি যেখানে লুকিয়ে থাকুক না কেন অবশেষে যে তারা এল, পৃথিবীর তৃষ্ণার্ত হৃদয় শীতল করল,মাটির শুকনো ঠোঁটে জীবন দান করার জন্য, রসেশ্বরদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য--তাতেই রসেশ্বর ধন্য বোধ করল।

স্বাভাবিক সময় হলে রসেশ্বর বৃষ্টির গতিবিধি বোঝার জন্য এতটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত না।

ঘুম থেকে উঠেই মুখে জল দিয়ে হাল নিয়ে মাঠের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেত। কিন্তু আজ কথাটা স্বতন্ত্র।

দুই মাসের অগ্নি বৃষ্টির পরে আজ যে আকাশ সত্যি সত্যি বর্ষণ করছে সে কথা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এতদিন কাঁপতে কাঁপতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে থাকা মানুষটা আজ যেন নতুন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ফিরে পেয়েছে। মনের আনন্দে রসেশ্বর বুক ভরে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল। বৃষ্টির সুগন্ধ আর শীতলতাটুকু সে যেন ভালোভাবে অনুভব করে দেখতে চায়। ঠিক সেই সময় এক ঝাঁক সজল বাতাস সজোরে তার দিকে বয়ে এল। গাঁজার গন্ধ ,জলে ভেজা গোবরের গন্ধ, ভাঁড়ালের কাছের ফুলগুলির গন্ধ --এই প্রতিটি পরিচিত গন্ধ মিশ্রিত হয়ে তার নাকে এসে লাগল।

সেসবের সঙ্গে সে আরও একটা গন্ধ পেল। আর সেই গন্ধটা তাকে চঞ্চল করে তুলল। সে স্পষ্ট অনুভব করল ভিজে ভিজে বাতাসের কাঁধে চড়ে আসছে গোয়ালঘরের গরুগুলির শরীরের গন্ধ। রসেশ্বরের স্ত্রী গামছার সঙ্গে মুখ ধোয়া ঘটিটা নিয়ে বেরিয়ে এল।রসেশ্বর হাত পেতে ঘটিটা নিয়ে গর্জন করে উঠল --'হাল বাইতে বেরিয়ে এসে মানুষটা এখানে এক পহর দাঁড়িয়ে রইল। মুখ ধোয়ার জল আনার কথা তোর এতক্ষনে মনে পড়ল?'

মানুষটা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই যদি একপহর হয়ে যায় তাহলে সে আর কী করতে পারে।সেইরকম বেলা হয়ে থাকলে সে পরোয়া করে না ।সে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। স্ত্রীর দিকে রসেশ্বর কিছু সময় বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। তারপরে সে চিৎকার করে বলল, 'এইযে শুনছিস কিনা?জাপিটা নিয়ে আয়'।

তাড়াহুড়ো করে মুখটা ধুয়ে জাপিটা মাথায় দিয়ে রসেশ্বর হাল বাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেল।


ক্রমশ ...