শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হরিদ্বার থেকে প্রয়াগরাজ -- পূর্ণ কুম্ভের সন্ধানে, পর্ব --২

প্রয়াগরাজের উদ্দেশ্যে দিল্লি ছেড়ে গৌহাটি আসা হয় ২৭ এর ইণ্ডিগো ধরে । মন তো প্রস্তুত সেই টিকিট বুকিং এর দিন থেকেই । দলপতি দেবাশিস সেনগুপ্ত মহাশয়ের মাত্রাধিক উৎসাহ বাড়তি ইন্ধন জোগায় । যাবে ? প্ল্যান করা যাক তবে । কানে কানে বার্তা তুলে দিতেই গুণগুণানি শুরু । আমি যাব , আমি । উত্তর দক্ষিণ থেকে ফিসফাস । বেশ তো চলো তবে । লক্ষ্য স্থির হল ৪ ফ্রেবুয়ারির তারিখের মৌনী অমাবস্যা । গৌহাটি থেকে রাজধানী ট্রেন ধরে প্রয়াগরাজ । দেবাশিস বাবু বললেন চলো এইবার ক্যাম্পে থাকি । নদীর চরে সারি সারি ক্যাম্পের একটা আমাদের ও হোক । চমৎকার! হোক হোক । তোড়জোড় পাক্কা , বুকিং এর দিন কন্যাদের চোখরাঙানি পাগল হলে নাকি ? ক্যাম্পে থাকবে । কমন টয়লেট হবে জানো । তোমাদের বাজেটে সিঙ্গল টয়লেটের শিবির পাচ্ছ না । জননী এই বয়সে শিশুসুলভ বায়না ছেড়ে হোটেল কর । নয়ত তোমাদের যেতে দেওয়া হবে না । ওরে বাহ কেমন পাক্কা অভিভাবক হয়ে উঠেছেন তিনিরা । কী আর করা যায়,

অগত্যা ...
প্রয়াগে হোটেল তখন কুম্ভমেলার দৌলতে অহংকারী তিমি মাছ । গাল ফুলিয়ে রাঙা চোখ দেখাচ্ছে । দেবাশিস বাবুর তৎপরতায় পাওয়া গেল হোটেল । ঠিক হল , ৩ এ পৌঁছে ৪তারিখে স্নান সেরে রাতের দিকে রওনা দেবো বেনারস । বেনারসের সঙ্গে একটা গভীর আত্মীয়তা রয়েছে অন্তরে অন্তরে । আমার একাদিক প্রিয় প্রণম্য মানুষদের নাম জড়িয়ে রয়েছে বেনারসের সঙ্গে । চৈতন্য মহাপ্রভু ত্রিবেণী স্নান করে একমাস বেনাবসে কাটিয়ে ছিলেন রূপ গোস্বামীর সঙ্গে । এই বেনারসের সঙ্গে নাম জড়িয়ে আছে কাশীর চলন্ত শিব তৈলঙ্গ স্বামীর । এখানে বসেই কর্মযোগের পাঠ দিয়েছেন শ্যামানন্দ লাহিড়ী । ইতিহাসে যিনি লাহিড়ী মশাই নামে বিখ্যাত । তাঁর সুযোগ্য গৃহী ভক্ত পঞ্চানন ভট্টাচার্য, স্বামী যুক্তেস্বর ও স্বামী যোগানন্দ । মথুরাবাবুর সঙ্গে কাশী দেখতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব । রয়েছে অপুর স্মৃতি সব মিলিয়ে হোক না একবার কাশী !

দলবল এলেন কেউ বাংলাদেশ থেকে , কেউ ত্রিপুরা থেকে তো কেউ কেউ উজান অসম ধেমাজী থেকে । আমরা আট , যাত্রা শুরু গৌহাটি স্টেশন থেকে । ভোর সাতটার ট্রেন এলো সাড়ে আটে । ট্রেন চললো নদীসঙ্গমের লক্ষ্যে । আমরা দলেবলে রাজধানীর পেটে ।

ছুটে চলছে ট্রেন । বাইরের পৃথিবী তখন ঘুমে । ঘুমে আছে সহযাত্রী । অতল ঘুমে কামরা । ছায়া ছায়া আলোরা কামরার পর্দা ভেদ করে মায়াময় আলো ছড়িয়ে রেখেছে । ' সকলের মধ্যে থেকে আমিই কেবল আলাদা ,
আমারই চোখে ধাঁধা ?' ঘুম ভাঙা চোখ মেপে নিচ্ছে বাইরের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার । সরে যায় শহর নগর বন বনানি , সরে যায় স্টেশনের পর স্টেশন । কয়েকঘন্টা পরে রাত পোহাবে । উদয় হবে ঝকচকে একটি আনকোরা নতুন প্রভাত । নিষ্পাপ নির্মল । পৃথিবীর মানুষেরা ক্রমশঃ ক্লেদ বিষ্ঠা কামমন্থনে দিবসের গায়ে এঁকে দেবে যারতীয় বার্ধক্য এর গ্লানি । দিনটি মলিন থেকে মলিনতর হয়ে শরীর ঢেকে নেবে কালো আবরণে । আলো আর অন্ধার এইদুইয়ের যোগেই মায়ার দেশ । মায়ার খেলা । বিকেলে ট্রেনটি যখন বারাউনির পরিচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্মে জল ভরছে আপনকুম্ভে ,তখন জানালার স্কিনে ফুটে উঠেছে সাত আট বছরের একটি দেবশিশুকন্যার সহাস্য মুখ । শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরার জানালার অপর পারে শব্দরা অতরঙ্গিত , ধ্বনি আছে শব্দ নেই । হাসি কাষ্ঠ বদনেও হাসি জোগায় । জিজ্ঞেস করলাম ইশারায় কী চাই রে , চোখে ভাষা ফুটিয়ে শিশুকন্যা টেবিলে উপরে পড়ে থাকা উদ্বৃত্ত খাবারের দিকে ইঙ্গিত করলো , ফেলেই তো দিবি , দে না তার থেকে কিছুটা । সঙ্গী বললেন কাগজে মুড়ে দাও ,আমি দিয়ে আসি । চকলেট বিস্কুট পাউরুটিতে সাজিয়ে দিলাম নৈবেদ্য । নে মা আমার ফেলনা কুড়িয়ে তুই তৃপ্ত হ । মেয়েটি দৌড়ে গেল দরজার দিকে । ছোট প্যাকেটটি হস্তগত করে পালিয়ে গেল না , ফিরে এলো আবার জানালার কাছে । মুখের হাসিটি আরো বিস্তৃত হল । হাত তুলে জানালার দিকে ছুঁড়ে দিল কৃতজ্ঞতা ,
ফ্লাই কিস । তারপর টা টা দেখিয়ে ছুট দিল । বসে রইলাম নিথর হয়ে । কেন যে চোখের পাতা ভিজে গেল ! কী ছিল মেয়েটির হাসিতে , চাহনিতে ! ওর তো স্কুলের বয়স । কেন স্টেশনে স্টেশনে ঘুরতে হয় খাদ্যের সন্ধানে !

পরবর্তী ...