শুক্লা ব্যানার্জি -- প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী ,' গান্ধবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাত্রী । অভিনয় গান সবকিছতেই জড়িয়ে আছেন । সংযুক্তা ( united women forum) এর সংস্কৃতি বিভাগের পূর্ণ দায়িত্বে আছেন । শাড়ি প্রসংগ তুলতেই স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন শুক্লা । অন্যদেশকে দিলেন মনোজ্ঞ লেখা , সম্পর্ক ।
ওলো সই, পর জন্মে
আর যা কিছু হই বা না হই
তাঁতির ঘরে জন্ম লই
তাঁতে বোনা প্রথম শাড়ী
গায়ে তুলে নি-রে সই
সম্পর্ক
শাড়ি আর আমি যেন সম্পর্কের এপিঠ আর ওপিঠ । জড়িয়ে আছি মায়ার বন্ধনে । এই বন্ধন আজন্মের ।
কবে যে শুরু হয়ছিল মনেই নেই। একদম ভুলে গেছি।তাছাড়া মনে করতেও চাইনা, কারণ বড়-ই মধুর এ সম্পর্ক। এ যেন জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। সে আমার অনেক সুখ ও দুঃখের সাথি।
চলো যাই, একবার আমার ছোটবেলা থেকে ঘুরে আসি।তখন আমার ৭/৮ বছর বয়স, মা আমাকে প্রথম শাড়ি কিনে দেন কলকাতার New Market থেকে একটা লাল টকটকে জরির কাজ করা tissue বেনারসি। সেই শাড়িটি পরবর্তী কালে মা , ঠাকুরের আসনে ব্যবহার করতেন। এখন ওটা আমার জিম্মায়।
প্রথম শাড়ি , টিসু বেনারসি
তবে সেটাই হয়ত আমার শাড়ির সাথে প্রথম পথ চলা শুরু। তারপর কবে যে আমার মনের সই হয় উঠল মনে নেই।আমার যখন ১৪/১৫ বছর বয়স মা আমাকে silk এর শাড়ি পডতেই দিতেন না কারণ ওনার কথায়, হ্যাঙ্গারে ঝোলানো বলে মনে হত ।
আসলে তন্বী ছিলাম ত তাই !! ধীরে ধীরে বাংলার তাঁত,ঢাকাই জামদানি ও মসলিন আমার পরম বন্ধু হয়ে উঠল। এখনও তারা আমার সবচেয়ে প্রিয় ও কাছের।
একসাথে চলতে চলতে দিন বয়ে গেল কিন্তু শাড়ির আকর্ষণ বেড়েই চলল। তারপর কত ধরনের শাড়িই না আমার আলমারিতে জায়গা নিল। ভারতবর্ষের সব প্রদেশের শাড়ই-ই মোটামুটি আমার খাজানাতে আছে। তবে এদের মধ্যে সবথেকে বেশী প্রাধান্য পেয়েছেকালো রঙের শাড়ি আর ঢাকাই জামদানি শাড়ি । কারণ ওই রঙ ও শাড়ি দুটোই আমার খুব পছন্দের। কালো জগতের আলো।
কালো জগতের আলো
তবে আমার জীবনে আমার থেকেও বেশীশাড়িকে ভালবাসএন , এমন একজন মানুষকে বন্ধু রূপে পেয়েছি,যাঁর শয়নে স্বপনে শুধু শাড়ি প্রেম । তিনি হচ্ছেন আমার একদিদি, নাম অনুরাধা।তাঁর শুধু নিজের জন্য নয়, পছন্দের মানুষদের নতুন শাড়ি কিনে উপহার দিয়েও যেন অফুরন্ত আনন্দ।এরকম উদার মন পাওয়াও দুর্লভ।ভাবতেও কেমন অবাক লাগে যে আমার থেকেও বেশী কেউ শাড়িকে ভালোবাসতে পারে !! একটা কথা হয়ত না লিখলে আমার এই শাড়ির সাথে সম্পর্কের যোগাযোগটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে কারণ অনুরাধা দিদির উপহারের তালিকায় আমার নামটি সব থেকে প্রথম সারিতে থাকে। তাই আমার আলমারির ৫০ শতাংশ শাড়ি তাঁর কাছ থেকে পাওয়া উপহার।
জামদানি
শাড়ি উপহার তো জীবনে অনেকি পেয়েছি। তাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।তবে গুরুজনদের পরণের শাড়ি প্রাপ্তি, সে এক অনন্য অনুভুতি।আমার মায়ের, শাশুড়ি মায়ের ও কাকিমাদের শাড়ি আমার অমূল্য সম্পদ।এর মধ্যে একটি শাড়ির কথা উল্লেখ না করলেই নয়।ওটি একটি অভাবনীয় প্রাপ্তি। আমার ছোটকাকা (মৃণাল সেন) জীবনে হয়ত একটি শাড়ী নিজে কিনেছিলেন আমার কাকিমার (গীতা মা) জন্য এবং সেই শাড়িটিএখন আমার শাড়ির ভান্ডারের একটি অমূল্য সম্পদ হয় আছে।
তসর
তবে গত ছয়মাস যাবত আমার আলমারি বন্দি শাড়ি গুলো হয়ত ভাবছে যে তাদের সই হঠাৎ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তার আর দেখা হচ্ছে না কেন ? । একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে হয়ত.....
জামদানি.....কিরে !!!সই আমাদের মরল নাকি COVID 19 এ ?
লিনেন.....নানা, বাইরে গেলে ত musk পরতে হবে !! তাহলে আর সাজুগুজু হবেনা। তাই এখন শাড়ি পড়েনা।
কাতান.....উফ !!! কত দিন যে এমন বাক্স বন্দী হয়ে থাকতে হবে কে জানে।
তসর....নারে !!! দূর্গা পূজা আসছে। এবার আমরা সই এর নিশ্চয়ই দেখা পাব।
বালুচরি....হ্যাঁ ঠিক বলেছিস !! ম্যাডামকে পুজোয় সেজেগুজে দূর্গা মাকে দেখতে বেরোতে হবেনা !!
না এখনো বেঁচে আছি।
আমার COVID 19 হয়নি।পূজোতে শাড়ী পড়ব,সাজব,musk ও পড়ব আর মাদূর্গা কে দেখতেও যাব।
হতাশ হওনা বন্ধুরা। আমরা আবার আমাদের পূরানো দিন ফিরে পাব।আমাদের জয় করতেই হবে। জয় আমরা করবই।
.......আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে.........
আসাম মুগা সিল্ক
চলো এবার একটু যাই ঘুরে আসি শাড়ির ইতিহাসের পাতায়।
শাড়ীর ইতিবৃত্ত.........
সংগৃহীত
শাড়ি বাংলার রীতি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের শাড়ি পরার প্রচলন ছিল। যদিও নাম ও পরার ধরন ছিল অন্যরকম এবং সেই প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের একেক অঞ্চলের নারীরা একেকভাবে শাড়ি পরে আসছেন।
আসাম সিল্ক
পন্ডিতদের মতে-প্রাকৃত ভাষার ‘সাট্টিকা’ শব্দ থেকে শাড়ি শব্দের উদ্ভব। আদি বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে ‘সাট্টিকা’ শব্দটি পাওয়া যায়। প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীদের পোশাকের যে বর্ননা পাওয়া যায় - তা অনেকটা শাড়ির মতোই, বিশেষ করে পুরোহিতদের পরিধেয় বসনের বর্ননা থেকে আমাদের সেরকমই মনে হয়। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথাই প্রযোজ্য।
কাঞ্জিভরম
দক্ষিণ ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীন লেখনীতে শাড়ির মতন বস্ত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ভারতের একজন অন্যতম বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন ভরত। তিনি 'নাট্যশাস্ত্র' নামে একখানা বই লিখেছিলেন। সে বইতেও এক ধরনের দীর্ঘ সূক্ষ্মবস্ত্রের কথা রয়েছে যা আমাদের শাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে আর প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে যে সেলাইবিহীন দীর্ঘ সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা শাড়ি বলেই ধারণা জন্মায়। রামায়ণ-মহাভারতে তো শাড়ির আকছার ব্যবহার স্পষ্ট।
ইক্কত
প্রাচীনবঙ্গেও নারীর পোশাক ছিল বর্তমান কালের শাড়ির অনুরূপ । অর্থাৎ, সেলাইবিহীন দীর্ঘ বস্ত্র খন্ড। কালে কালে অবশ্য শাড়ি পরার ধরন বদলেছে-যা স্বাভাবিক। শাড়ি নিয়ে গবেষনা করেছেন বিশিষ্ট ফরাসী নৃতাত্ত্বিক চানতাল বোউলানঞ্জার। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে শাড়ি পরার ধরনকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে অতি অবশ্যই বাঙালি নারীর শাড়ি পরার ঢংটিও রয়েছে।
পাছা পাড়ের শাড়ি
এবং কে না জানে বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির অবদান কত গভীর। সে বাড়ির মেয়েরাই উনিশ শতকে শাড়ি পরার একটি ঢং ঠিক করে দিয়েছিল। সম্ভবত কলকাতার উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী সেটির অনুসরণ করেছিল। গ্রামের চিত্র সম্ভবত অন্যরকম ছিল।
গামছা শাড়ি
শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা চমৎকার কথা আছে, কায়া অতিক্রম করেছে মায়া দিয়ে আপনার বাঁধা রূপ। এ কথাটি লোকশিল্পীদের জন্য বড্ড বেশি খাটে যেন। শিশুর আঁকা নকশা অভিজ্ঞদের চোখে যেমনই ঠেকুক, তা কিন্তু শিশুর মনে বাস্তব দৃশ্যটির প্রভাব বিস্তারকারী রূপ। কাজেই সে নকশাকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়ার জো নেই। একজন শিল্পীও যেকোনো কিছুর বাস্তব কায়াকে নিজের মায়ায় ভিন্নরূপে দেখেন এবং রূপ দেন। যেমন শিল্পী সুলতানের আঁকা কৃষকের পেশিবহুল কায়া শিল্পীর মায়ায় সৃষ্টি। সাধারণের চোখে তা প্রায় অবাস্তব। আমাদের লোকশিল্পেও আমরা এ রকম অনেক নকশা পাই, যেগুলো শিল্পীর মায়ায় সৃষ্টি। এ লোকশিল্পে শাড়ি একটি বিশেষ শাখা।
চলে নীল শাড়ি ...
বঙ্গ ললনাদের এক আর একমাত্র পরিধান হচ্ছে শাড়ি।”নিঙারিয়া নীল শাড়ী শ্রীমতি চলে”......