শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

সমর চক্রবর্তীর একগুচ্ছ কবিতা

একটি রমণীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প

ভীড়ের ভেতর এক সুন্দরীর হারিয়ে যাওয়ার পর, তাঁর পথ খুঁজে ফেরা দেখছিলাম।
থামতে থামতে সে হাঁটছিল । কী-যেন খুঁজে ফেরা অসহায় চঞ্চল চোখ থেকে
ঝরে পড়ছিল হারিয়ে যাওয়ার করুণ বেদনা!

স্বচ্ছ জানালায় উঁকি দিয়ে আমি দেখছিলাম—তার শরীর ঘেঁষে রিক্সাগুলো ছুটে যাচ্ছিল
নিতম্বে হাত ছুঁইয়ে কোমর দোলাতে দোলাতে সড়ক অতিক্রম করছিল
কতিপয় ডিজিটাল যুবা, আর এ সব কিছু অতিক্রম করে তবু সে হাঁটছিল—
তারপর আলোর মুখ ওল্টাতে ওল্টাতে জন-যানের কোলাহলে রমণীটি হঠাৎ
দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার মাঝখানে। চাপা পড়ার আগেই আমিও ব্রেককষে জনতার ভীড় ঠেলে
তুলে নিলাম আমার মোটরযানে!

পারদ জোছনার অন্ধকার

নগরীর চাঁদ স্থির চোখে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের গভীর অন্ধকারে।
শহরময় এ্যাতো আলোর কুহেলিকা যে মানুষের কোনো ছায়াই নেই!
সমুদ্রে অলৌকিক এক সেতু গড়তে বুঝতে পারি ,যে সূর্য আলো ছড়ায়
তার শরীরে কোনো অন্ধকার থাকে না।
আবহাওয়া বদলে গেলে বদলে যায় আকাশের রঙ
চেনা দৃশ্য ভেঙে গ্যালে পড়ে থাকে কিছু মুখোশের ছবি!

মানুষের দুঃখ ঝরে যাওয়ার এমন কোনো নদী নেই যে সমুদ্রে মেশে!
মানুষের এমন কোনো মানুষও নেই, যার কাছে হৃদয় খুলে ফিরে পাওয়া যায়!

তবু কোথাও যেতে হবে বলেই বেরিয়ে পড়ে মানুষ
ভালোবাসতে হবে বলেই ভালোবাসে,
আসলেই মানুষের কোনো কাজ নেই, ঝগড়া-বিবাদ অভিমানে
হাসতে হাসতে কাঁদতে-কাঁদতে জীবন পার করা আর কি!

ফেসবুক

বেশ কয়েকদিন ধরেই ফেসবুকে তোমার মুখ দেখছি না। স্কাইপেও নেই!
কিছু ট্যাগ শেয়ার,বন্ধুদের ছবিতে ভরে আছে টাইমলাইন
নতুন কোনো স্ট্যাটাস নেই—
কয়েকটি পুরনো সেলফিতে ঝুলে আছে অদ্ভুত এক হৃদয়বৃত্তান্ত!
আমার ফ্রেন্ডলিস্টেও ঝুলে আছে হাজার তিনেক মুখ
ইনবক্সে হাজারো ম্যাসেজ ,শুধু কারো কোনো চিঠি নেই!

আয়নায় তাকাই, আমার চোখের ভেতর দিয়ে বয়ে যায় হারানো শৈশবের
তলনদীর বাঁকানো শরীর ।বুকে যার রোদ-ছায়ার নেই ছলচাতুরি!
আমি স্বপ্নগুলোকে নতুন করে আরেকবার লিখি আমার টাইমলাইনে,
তোমার ইনবক্সে ঢুকিয়ে রাখি কিছু কবিতা
আশ্চর্য শীতল হৃদয়ে দূর বসন্তের মতো তোমার শরীরের ঘ্রাণ
নাহ! ফেসবুক আর ভাল্লাগে না, তুমি নেই!

তোমার নীরবতা

এক আকাশ নীলের মতো তোমার অখণ্ড নীরবতা
ভাসতে ভাসতে বোশেখের মেঘ। যেন সূর্যের আড়ালে ঘুমিয়ে আছে নির্বাক একটি হরিণ।
তার চিত্রল শরীর থেকে বিদ্যুৎ ঝিলিক
ছড়িয়ে পড়ে সবুজের অন্ধকার গুহায়,
বিস্তীর্ণ আলোছায়ার বিস্ময়কর রঙের খেলায় নদীরা সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে
উদাস-বাতাসে বারবার স্রোত বদলায়!

ঝর্ণার পাশে অাগ্নেয়গিরি রেখে হাসে পাহাড়ের চোখ। মানুষেরা কাঁদে—
জীবন একাকী প্রার্থনায় নির্বিকার নিলীমাময় এক স্তব্ধতা।

শীত চলে যাচ্ছে

শীত চলে যাচ্ছে। ঠোঁট থেকে চুমুর ঠোঁট সরে যাওয়ার মতো চলে যাচ্ছে শীত।
পরিযায়ীর ঝরা পালক হাতে শীতল এক স্তব্ধতার ভেতর আমি বসে থাকি।
ভ্রামণিক ঋতুর হৃদয় নিয়ে ঘুরতে থাকি সূর্যের চারিপাশ,
তারপর তোর নিঃশ্বাসের কাছে বসে আছি ভেবে
চায়ের কাপে চুমুক দেই, দেখি
বুকের ভেতর গুচ্ছ গুচ্ছ ফুটে উঠেছে তৃষ্ণা, যেন অসংখ্য রক্ত পলাশের ডাল!

শীত চলে যাচ্ছে। কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে উদোম বুকের শ্যামল নারী
শরিষা ফুলের ক্ষেতে তোর মুখ মনে পড়ে
দুঃখ হারিয়ে যাওয়ার আগে
পানশালায় দুলে উঠি আমি শেষবার, যেন নতুন ঘড়ির পেণ্ডুলাম!
বসন্ত এসে গ্যাছে অথচ—অনেক আলোকবর্ষ দুরে আমার বসন্ত গ্রাম।

বিছানায় পড়ে আছে শুধু তোর ছায়া


আলিঙ্গনের ক্লান্তির পর হৃদয়ে হিম ঝরার মতো সারা শরীরে জেঁকে বসেছে শীত।

আমি তোর হৃদয়ের বহুবর্ণ রুমে ছেঁড়া একটা মাদুর পেতে শুয়ে আছি সোনা,

অথচ বাহুর মধ্যে তুই নেই, কুয়াশায় ঢেকে আছে বাড়িঘর-নগর-অফিস-চোখের

পাশেই উষ্ণতার চাদর আগলে জ্বলে আছে আগুন, আমার বুকের ভেতর অখণ্ড

শীত, আমি কাঁপছি, শূন্যতাকে ভেঙে আরেক নৈঃশব্দ্য আলিঙ্গনে আমি কাঁপছি…

আকাশে রোদ্দুর নেই, বিছানায় পড়ে আছে শুধু তোর ছায়া।