শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,পর্ব ৫

পাঁচ.

নতুন অভিযান

লুটের মাল কতটা বিক্রি করা হবে আর কোথায় বিক্রি করা হবে এই নিয়ে আলোচনা আবার শুরু হলেও দুপুরে খাওয়ার আগে পর্যন্ত ওরা কোনও সমাধানে পৌঁছতে পারে না। গরব কিম্বা তার কোনও অনুগামী কোনও সর্বগ্রাহ্য সন্তোষজনক পরিকল্পনা ছকতে পারে না। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার সময় গরবের মনে ধীরে ধীরে একটি নতুন পরিকল্পনা অঙ্কুরিত হতে শুরু করে।

দীর্ঘ অভিযানের পর সবাই এখন বাড়ি ফিরতে চাইছে। অথচ লুটের মাল বিক্রি করে টাকা রোজগারের ইচ্ছাও প্রত্যেকের মনে প্রবল। আচ্ছা, সবাইকে বাড়ি যেতে দিয়ে গরব নিজেই কি এই মালগুলি বিক্রির দায়িত্ব নিতে পারে? সে যদি শুধু কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ীর বেশে লাহসা গিয়ে এগুলি বিক্রি করে আসতে পারে তাহলে বাকি লুটের মাল ও পশুগুলি নিয়ে অন্যরা অনায়াসে গ্রামে ফিরতে পারে। লাহসায় তো পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী এনে বিক্রি করে। এত ভিড়ের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের চোখ এড়িয়েই তাদের লুটের মাল বিক্রি করতে পারা যাবে। লাহসায় বিক্রি করলে অন্য যেকোনও শহর থেকে দামও বেশি পাওয়া যাবে। গরব এই দীর্ঘ যাত্রাপথে দেচমাকে সঙ্গে নিলে সকালে ভাবা স্বপ্নটাও অনেকটা বাস্তব রূপ নিতে পারে। ছোট সওদাগর দলের সঙ্গে একজন মহিলা থাকলে কোনও গোয়েন্দা কিম্বা রক্ষী ওদেরকে নিছকই শান্তিপূর্ণ ও সৎ ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছু ভাববে না। একজন ব্যবসায়ীর স্ত্রী তার স্বামীর কাজের অবসরে পুণ্য অর্জনের অভিলাষ নিয়ে তার সঙ্গে এসেছে, এই ভাবমূর্তি দলের মর্যাদা বাড়াবে।

একটা সংস্কার কয়েকদিন ধরে গরবকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। গত কয়েক মাস ওর বেশ ভাল গেছে। বেশ কয়েকটি অভিযান সফল হয়েছে। শেষতম অভিযানে অনেকগুলির তুলনায় অনেক বেশি ধন সম্পদ হাতে এসেছে। আর এসেছে দেচমা। তিব্বতী বিশ্বাস অনুযায়ী, একাধারে এত কিছু ভাল হওয়া বিপজ্জনক। গরবের আশঙ্কা হয়, এবার হয়তো তার নিজস্ব কিছু হারানোর পালা। হয় তাকে নিজে থেকেই প্রিয় কিছু ঈশ্বরকে উৎসর্গ করতে হবে, নাহলে ভাগ্য আরও মারাত্মক কিছু ছিনিয়ে নেবে। তার পেশায় ভীষণরকম ঝুঁকি, যে কোনওদিন কোনও প্রতি-আক্রমণে কারও একটি মাত্র বুলেট ছুটে এসে ওর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে মৃত্যুর কোলে টেনে নিতে পারে। আবার তার উষর বর্বর জীবনে হঠাৎ পাওয়া আনন্দলহরীর মতন এক অলীক কন্যা দেচমাকে হারিয়ে ফেলতে পারে। একথা ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠে। এই কাঁপুনি ওকে অবাক করে। এক জাগস্পা সর্দারের মনে এই কাঁপুনি শুভলক্ষণ নয়।

গরব দলের অন্যদের কাছে নতুন প্রস্তাব রাখার কথা ভাবে। দিনের পর দিন ঘোড়ায় চড়া, ভাবী রাতের মিলন মুহুর্তগুলির জন্য তীব্র কামনা, দুর্ভাগ্যের আশংকা, ঈশ্বরের ঈর্ষা আর অশরীরীদের বিদ্বেষ, গত দশ বছর ধরে নানা বাণিজ্যপথে ডাকাতির পাপ, প্রায়শ্চিত্যের প্রয়োজনীয়তা, এরকম পরস্পর বিরোধী নানা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে পায়চারি করতে করতে এক সময় এসে দলের সবাই যেখানে গোল হয়ে বসেছে তার মাঝে গিয়ে বসে।

গরব এবং তার দলের অন্য ডাকাতরা সাধারণ তিব্বতিদের মতনই সংস্কারাচ্ছন্ন। দেবতা, অপদেবতা ও ভূতপ্রেত নিয়ে যত গল্পগাথা ও লোক বিশ্বাস ওদের সমাজে রয়েছে সবই ওরা বিশ্বাস করে। গরব অবশ্য আগে কোনওদিন এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তার জীবনে এই প্রথম কিছু সংস্কার তার চিন্তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।

গরব ওদের মাঝে ঘাসের ওপর বসে বলে ওঠে, বন্ধুরা, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, গতকাল আমরা একটা বড় অন্যায় করেছি? অবশ্য আমরা কোনওকালেই পুণ্য করার মতন কিছু করিনি, কিন্তু এতদিন শুধু সওদাগরদের লুট করেছি, যারা মানুষকে ঠকিয়ে বড়লোক হয়। ওরা আরও ধনী হওয়ার জন্য অন্য শহরে পাড়ি দিচ্ছিল। আমাদেরও উদ্দেশ্য একই – সম্পদশালী হওয়া। তাই তাদেরকে লুট করলে হয়তো তেমন পাপ হয় না। আমরা ভীরুর মতন লোককে মিষ্টি হেসে কথার জালে ফাঁসিয়ে লুট না করে বীরের মতন একরকম লড়াই করে সেই সম্পদ দখল করি। এরকম অভিযানে আমাদের মধ্যে অনেকেই আহত হয় – এমনকি মারাও যায়; গতবছরই আমরা সহযোদ্ধা বন্ধু তপদেনকে হারিয়েছি। আমরা সওদাগরদের মতন কৃপণও নই। আমরা কখনও দুঃস্থ মানুষকে ভিক্ষা দিতে বা অসহায় কারও দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পিছপা হই না। যেসব ভিক্ষুরা আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করে শোনান এবং বিভিন্ন শিবিরেআমজনতার, জনসাধারণেরমঙ্গলের জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, পুজো দেন; তাদেরকেও আমরা উদার হস্তে অর্থ প্রদান করি। এককথায় বলা যায়, আমাদের চরিত্র সব মিলিয়ে সাদা না হতে পারে, কিন্তু কালোও নয়।

একটু হেসে গরব আবার বলে, কিন্তু গতকাল আমরা ধর্মপ্রাণ সাধারণ তীর্থযাত্রীদের লুট করেছি। ওরা যা নিয়ে যাচ্ছিল সবই মহামহিম দলাই লামাকে উৎসর্গ করার জন্য। যদিও আমরা কারও গায়ে হাত দিইনি, বিন্দুমাত্র শারীরিক হেনস্থা করিনি। ওরা যেহেতু মন থেকে এসব দানসামগ্রী দলাই লামাকে উৎসর্গ করেছিল, এর পুণ্যফল থেকেও ওরা বঞ্চিত হবে না, ইহজন্ম এবং পরজন্মেও অবশ্যই এর সুফল পাবে। সেজন্য আমরা ওদের তেমন কিছুই ক্ষতি করিনি। অন্যভাবে ভাবলে আমরা একরকম উপকারই করেছি, তাদের যাত্রাপথের ক্লেশকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছি; তেমন পাপও করিনি। কিন্তু আমরা যা লুট করেছি সবই ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা, এগুলি কি আমরা নিজেদের লাভের জন্য বিক্রি করবো? তাহলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চুরির মতন গর্হিত অপরাধ হবে। আমি স্বীকার করছি, এই প্রথম এ কাজ করতে আমার ভয় করছে! এর ফল শুধু ইহজন্ম কেন, পরজন্মগুলিতেও মারাত্মক হতে পারে!

একটু থেমে ঢোঁক গিলে গরব আবার বলে, আমার আরও মনে হয়, সৌভাগ্য দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে, এই ক্রমাগত সাফল্য ও সৌভাগ্য আমাকে ভাবাতে শুরু করেছে! তোমরা জানো এরপরই আসে দুর্ভাগ্য! আমরা কি এগুলি বিক্রি করে দুর্ভাগ্যকে আরও কাছে ডেকে আনবো? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি পুরোটা না হলেও এখন আমাদের উচিত সমস্ত মহার্ঘ্য চিনাংশুক, দামি গয়নাগাটি ও বাসনপত্রগুলি লাহসায় গিয়ে দলাই লামার হাতে তুলে দেওয়া। তাতে হয়তো আমরা এতটা পাপের ভাগী হবো না। তাছাড়া এখন আমাদের হাতে দলাই লামাকে উৎসর্গ করার মতন যে সমস্ত বস্তু রয়েছে এগুলি বিক্রি করে দিলে আর কোনওদিন ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার উপযোগী সামগ্রী আমাদের হাতে আসবে কিনা সন্দেহ। কাজেই এই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করবো কেন? এগুলি হাতে তুলে দিয়ে যদি তাঁর আশীর্বাদ পাই তা হয়তো সম্ভাব্য দুর্ভাগ্য থেকে এই বিপজ্জনক পেশায় আমাদের রক্ষা করবে!

একটু থেমে গরব আবার বলে, আমার কথা শেষ। তোমরা প্রত্যেকে নিজের মনে ভাবো, তারপর নির্ভয়ে মতামত দাও।

গরব সহজ ভাষায় নিজের কথা শেষ করে। তিব্বতি বিশ্বাস অনুযায়ী বেশি অলঙ্কার জুড়ে ভারী বক্তব্য রাখলে তা শ্রোতাদের মন জয় করতে সফল না-ও হতে পারে। গরব এমনিতে খুব কম কথা বলে। তার মুখে এই দীর্ঘ বক্তব্য শুনে কারও মনে হয়নি যে, তাদের পেশায় লাভ লোকসান, পাপ পুণ্য, লাহসা যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে গরবের দূরদৃষ্টি ছাপিয়ে প্রকাশ পেয়েছে নতুন প্রেয়সীর সঙ্গে মিলন পরবর্তী ভাবাবেগ। গরব তার পেশায় এতই আন্তরিক এবং নেতা হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য যে তার বিশ্বাসকে অনুগামীরা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। প্রত্যেকেই সোৎসাহে তার প্রস্তাবে সায় দেয়।

গরব তখন বাহান্নজন অনুগামীর মধ্যে কুড়ি জনকে লাহসা অভিযানে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। তারা দেবতার মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাবে, পুজো দেবে আর নিজেদের এবং অন্য যে সঙ্গীরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে তাদের হয়ে দলাই লামার আশীর্বাদ নেবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকের পুণ্যফল সমান হবে। পাশাপাশি যে পণ্য লাহসায় বিক্রি করা হবে ওরা প্রত্যেকেই তার সমান লভ্যাংশ পাবে। এই সিদ্ধান্তে প্রত্যেকেই খুব খুশি।

যারা গরবের সঙ্গে লাহসা যাবে তারা খসখসে মলিন ভেড়ার চামড়ায় তৈরি আলখাল্লা পাল্টে তীর্থযাত্রীদের থেকে নেওয়া বস্ত্র–সম্ভার থেকে যে যার নিজের গায়ের মাপ অনুযায়ী কয়েকজোড়া মূল্যবান শীতবস্ত্র বেছে পরে নেয়। পশমের কানঢাকা টুপির গায়ে সোনালী রেশমি জরির সুতো দিয়ে বোনা নানারকম কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের ভোল পাল্টে যায়। প্রত্যেকেই যেন একেকজন সম্পন্ন সওদাগর। এরা প্রত্যেকেই সশস্ত্র। পথে ওদেরই মতন অন্য কোনও ডাকাতদল সওদাগর ভ্রমে আক্রমণ করে বসলে যাতে যোগ্য জবাব দেওয়া যায়। ওদের পোশাক আশাক আর লহমায় পরিবর্তিত চালচলন দেখে অন্যরা হাঁ হয়ে যায়। কারও কারও চোখে ঈর্ষার সবুজ চাহনি দেখতে পায় গরব। এই নতুন পোশাকে ওরা এখন দীর্ঘপথ অতিক্রম করে পবিত্র তীর্থে যাবে। পোশাক পাল্টে ওদের শরীরেও কি বকধার্মিক লোভী সওদাগরদের আত্মা প্রবেশ করেছে? নাহলে ওরাও এখন কেন নিজেদের গ্রামে ফেরার জন্য প্রস্তুত এতদিনের সঙ্গী ডাকাতদের মলিন পোশাক-আশাক দেখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাবে, যেন ওরা কোনও নিচু জাতের লোক। গরব এসব দেখেও এক বুদ্ধিমান নেতার মতন চুপ থাকে।

তাঁবুতে ফিরে গরব দেচমাকে বলে, - আমরা এখানে আর মাত্র একদিন বিশ্রাম নেব দেচমা। পরশু ভোরের আগেই এই শিবির গুটিয়ে আবার যাত্রা শুরু!

দেচমা ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়। তারপর কোনোরকম উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে বলে, - আর তারপর মাত্র দিনপাঁচেকের মধ্যেই তোমার বাড়ি?

- কে জানে –

গরব কৌশলে ওর প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে বলে, - দেখো, তোমার জন্য কি এনেছি!

সে দেচমার সামনে কম্বলের ওপর একটি গাঢ় নীল রঙের মেয়েদের পোশাক আর তার ওপর পরার জন্য একটি লাল রেশমি জামা বিছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, - পছন্দ ? এ ধরনের আরও আছে।

দেচমার চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। গরব তার বিশাল আঙরাখার কোমরবন্ধের উপরে তৈরি হওয়া পকেটের মতন আমাফাগের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে জাদুকরের মতন বের করে একটি লম্বা অকীক আর প্রবালের মালা। এর ভারী সোনার লকেটে খচিত রয়েছে একটি বড় নীলকান্তমণি। অভিজাত তিব্বতি মহিলারা এ ধরনের মূল্যবান মালা পরে। গরব আবার দেচমাকে জিজ্ঞেস করে, - কী গো পছন্দ?

দোচমা হেসে সোৎসাহে বলে, ওহ, অ-সা-ধা-র-ণ!

গরব এবার দুষ্ট হেসে বলে, - তোমার জন্যে আরেকটি চমক আছে, তবে সেটা জানতে পরশু ভোর অব্দি অপেক্ষা করতে হবে!

দেচমা লক্ষ্মী মেয়েটির মতন মাথা নাড়ে। সে এখন গরবকে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছে। সে যখন যতটা বলার ততটাই বলবে। এরকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাশভারী পুরুষই পছন্দ তার। সে তাই যা পেয়েছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। মনে মনে যতই আগ্রহ থাকুক পরবর্তী চমকের জন্য সে পরশু ভোর অব্দি অপেক্ষা করতে রাজি।

ওরা দিনের শেষে একসঙ্গে গরম চা, শুকনো মাংস ও ৎসাম্পা খায়। দেচমার খুব ইচ্ছে করে গরবের দেওয়া সুন্দর উপহার দু’টি বারবার হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। কিন্তু সে সংযত থাকে। কিন্তু মনে মনে ভাবে, আগামী পরশুর উপহারটি কী হতে পারে? আরও সুন্দর কোনও গয়না, মহার্ঘ্য চিনাংশুকে তৈরি কোনও হাতব্যাগ, অথবা আজ উপহার পাওয়া পোশাক থেকেও দামি ও সুন্দর কোনও পোশাক, নাকি সুন্দর দেখতে একটি তেজি অথচ বাধ্য ঘোড়া!

যাই হোক না কেন, দেচমা এখন তা নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখাবে না। সে নিজে অভিজাত পরিবারের মেয়ে। তার মায়েরও এমনি বেশ কয়েক জোড়া দামি পোশাক আর মানানসই মূল্যবান গয়না রয়েছে। এসবের মায়া ছেড়েই তো সে শুধু স্বপ্নের পেছনে ছুটেছে। পেয়েওছে। তাই পোশাক আর গয়না নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানো তার শোভা পায় না।

পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নেমে এলে মেঘহীন আকাশে ঝলমলে পরীদের শোভাযাত্রার মতন ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নিঃশব্দে ঝিকমিক করতে থাকে।

তখনই দেচমার স্বপ্নপুরুষ তাকে তীব্র আশ্লেষে দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। তার উষ্ণ ঠোঁটের চুম্বন যত গাঢ় হয় দেচমা তত অবশ হতে থাকে। পাহাড় চুঁইয়ে গড়াতে থাকে বিন্দু বিন্দু আনন্দধারা। জাগতিক সবকিছু তার অস্তিত্বে ক্রমে ঝাপসা হতে থাকে। প্রবল হতে থাকে গরবের শরীর আর দেচমার বাসনা। ওরা সব ভুলে মেতে ওঠে নতুন নতুন আবিষ্কারের আদিম খেলায়। তারপর একসময় মিলন সুখে পরস্পরকে জড়িয়ে কখন ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়, তা কেউই বলতে পারে না।

ভোরের আলো ফোটার আগে ঠাণ্ডা বাতাসে খচ্চরের ডাক, অনেককটা ঘোড়ার চিহিহি-হ্রেষা আর গলায় বাঁধা ঘুঙুরের টুঙটাঙে গরব-দেচমা ও পাখিদের ঘুম ভেঙে যায়। ওরাও কিচিরমিচির করতে শুরু করে। গরব দেচমাকে ওর উপহার দেওয়া পোশাকটি পরে নিতে বলে। দেচমা অবাক হয়ে দেখে, গরব নিজেও একটি সুন্দর পোশাক পরে। কী হতে যাচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারেনা। গরব কি কাকভোরে ওকে বিয়ে করবে?

বিচ্ছেদের আগে ডাকাতরা তিব্বতি কায়দায় পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বণিকবেশী অশ্বারোহী গরবের পাশেই আরেকটি সুন্দর ঘোড়ার জিনে বসে দেচমা নকল সওদাগর দলের পোশাক-আশাক আর হাবভাব দেখে অবাক। অন্যরা সাধারণ বেশে ওদের থেকে আলাদা পঙক্তিতে দাঁড়িয়েছে কেন? সে কী স্বপ্ন দেখছে? তখনই দেচমাকে চমকে দিয়ে গরব হাত উঁচিয়ে অন্য পঙক্তির ঘোড় সওয়ারদেরচেঁচিয়ে বলে, - আমরা চললাম বন্ধুরা!

তারপর সে দেচমার দিকে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে বলে, - দেচমা, তোমাকে চমকে দেব বলেছিলাম, আমরা লাহসা যাচ্ছি... পোটালা প্রাসাদ...মহামহিম দলাই লামা...একমাসেরও বেশি সময় লাগবে পৌঁছুতে, তুমি কি খুশি, প্রিয়ে?

বাঁধনহারা আনন্দের একটি উদ্দাম ঢেউ তরুণী দেচমার অস্তিত্বে আছড়ে পড়ে। সে আনন্দে শিহরিত হয়ে নিজের অজান্তেই লাফিয়ে ওঠে। এমনি হঠাৎ আন্দোলনে আরোহিনীর অজান্তেই ঘোড়ার লাগামে হেচকা টান পড়ে। ঘোড়াটি ঘাবড়ে গিয়ে হঠাৎ পা শূন্যে তুলে দেয়। দেচমা ভারসাম্য হারিয়ে ঘোড়ার পিঠে থেকে পড়ে যেতে গেলে গরব হাত বাড়িয়ে ওর কোমরের কাছে দৃঢ়ভাবে ধরে ওকে আবার জিনের ওপর বসিয়ে দেয়। ঘোড়াটি অগত্যা এই আন্দোলন মেনে নেয়। কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর অভিযাত্রীটি তার প্রেয়সীর কোমর থেকে হাত সরায় না। কিছুক্ষণ ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। আর তারপর তাদের নতুন গন্তব্যের দিকে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে যায়। অন্য অনুগামীরা সস্নেহে দলপতির এই আচরণ মুচকি হেসে উপভোগ করে। যতক্ষণ দেখা যায় ওরা হাত নেড়ে সঙ্গীদের বিদায় জানাতে থাকে। তারপর ক্রমে প্রত্যেকের ঘোড়ার গতি বেড়ে যায়।