বুধবার, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ৩১

# একত্রিশ

ধর্মের নামেই অকারণ ভয়ে মানুষ পীড়িত হয়েছে এবং অদ্ভুত মূঢ়তায় আপনাকে ইচ্ছাপূর্বক অন্ধ করে রেখেছে। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রথম দর্শনেই সো সা লিং মঠ পর্যটকদের দু’হাত বাড়িয়ে ডাকে। তিব্বতের অন্যান্য সব নাক উঁচু সম্ভ্রান্ত মঠের মতন এটি উপত্যকা থেকে খুব উঁচু কোনও পাহাড়ে ডানা মেলে মেঘের কোলে বসে নেই। মাঝারি আকারের একটি টিলার উপর নির্মিত এই মঠ একটি প্রাচীন আরোগ্য ধাম। এর দরজাগুলি কয়েক মানুষ সমান বিশাল। দরজার কাছে দৈত্যাকৃতি দেবদেবীর অবয়ব আঁকা লাল ও সবুজ রঙে। চারপাশের দেওয়ালেও সেই লাল ও সবুজ রঙের প্রাধান্য। বছরের পর বছর ধরে রোদ ও জলে ওই রঙ এখন মলিন এবং বিবর্ণ প্রায়। যে শিল্পী বা শিল্পীরা দরজাগুলিতে ছবি এঁকেছিলেন তাদের কেউ এখনও জীবিত রয়েছেন কিনা কে জানে! কিন্তু জায়গায় জায়গায় কাঠে ফাটল ধরেছে। এর ফাক দিয়ে উঁকি দিলে আরোগ্যধামের নীরব নিস্তব্ধ প্রবেশ পথের অনেকটাই দেখা যায়। অসুস্থ মানুষ এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের মনে ভক্তি ও আস্থা বাড়ে। কিন্তু ভেতরে ঢুকে একের পর এক ভাঙা দরজা পেরোনোর সময় মনে সন্দেহও জন্মাতে পারে।

তারপরই একটি প্রশস্ত উঠোন। তার দু’' পাশে বিশাল সব ধূসর পাথরে গাথা সারি সারি কামরা। সামনেই উঁচু গাঁথুনিতে নির্মিত দেওয়ালটি মঠের দ্বিতীয় বেষ্টনী। ওই দেওয়ালের এক কোণে একটি সরু প্রবেশদ্বার। কিন্তু কোনও সংশোধনাগারের গেটের মতন দেখতে সেই দরজাটির পেছনে আরেকটি দেওয়াল থাকায় দরজা খোলা থাকলেও সেখান দিয়ে দ্বিতীয় বেষ্টনীর ভেতরটা দেখা যায় না।

ওই উঠোনের দু’ পাশে নির্মিত কক্ষগুলি হাসপাতাল। সেগুলিতেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা। তুলনায় কাছে পিঠের গ্রামগুলির রোগী কম। তারা অধিকাংশই বহির্বিভাগ থেকে ওষুধ নিয়ে যান। প্রয়োজনে চিকিৎসকরা কাছেপিঠের গ্রামগুলিতে গিয়ে চিকিৎসা করে সবুজ শাকসবজি , ফল এবং শস্যাদি উপহার নিয়ে মঠে ফেরেন।

দ্বিতীয় বেষ্টনীর ভেতর মন্দির , চিকিৎসক ও অন্যান্য মঠবাসীদের থাকার জায়গা। কিন্তু সেখানে রোগীদের কিম্বা ওদের আত্মীয়দের কোনও প্রবেশাধিকার নেই। সো সা লিং থেকে আরোগ্যলাভ করে ফিরে আসা মানুষের কাছে ওই দ্বিতীয় বেষ্টনীর ভেতরটা তাই রহস্যাবৃতই থেকে যায়।

সো সা লিং শব্দটির মানেও ‘আরোগ্য ধাম’। স্মরণাতীতকাল থেকেই এখানে চিকিৎসকরা থাকেন। এদের ধর্ম বন বা শামানিজম। এদের চিকিৎসাশাস্ত্র প্রাচীন এবং গোপন জাদুবিদ্যা মিশ্রিত। কথিত আছে, হাজার বছর আগে কোনও এক চীনা চিকিৎসক এই পাহাড়ে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে এসে এই হাসপাতাল নির্মাণ করান। এই প্রবাদের সমর্থনে কোনও নথি নেই। কিন্তু যাঁরা ওখানে গেছেন তারা বিশ্বাস করেন প্রাচীন চীনের সম্মোহনী জাদুর প্রভাব দেখা না গেলেও সো সা লিং-এর বাতাসে তা অনুভব করা যায়। কথিত আছে,, ওই আরোগ্য ধামের অধ্যক্ষ মহামহিম প্রবৃদ্ধ চিকিৎসক নাকি কয়েকশো বছর ধরে বেঁচে রয়েছেন! সাধারণ মানুষ ও রোগীরা অবশ্য তাঁর দর্শন পান না। তাঁর অনুগামীরাও অনেকে দীর্ঘজীবী। জটিল থেকে জটিলতর রোগে আক্রান্ত এবং মারাত্মক সব দুর্ঘটনায় আহত মৃতপ্রায় মানুষকে তাঁদের ধর্মীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছেন এই চিকিৎসকরা। এই খ্যাতির ফলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ঘোড়া ও খচ্চরে চাপিয়ে রোগী নিয়ে আসে।

এই হাসপাতালে পৌঁছানো অবধি যদি রোগীর শরীরে প্রাণবায়ু থাকে তাহলে সে একদিন সুস্থ হয়েই ফেরে। তবে অন্য তিব্বতি লামারা যতটা ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পান, বন চিকিৎসকদের মানুষ ততটাই ভয়মিশ্রিত সমীহ করে। মানুষের ধারণা ওদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রেতসাধনাও মেশানো রয়েছে। তিব্বতি বিশ্বাস অনুযায়ী সমস্ত রোগ ও দুর্ঘটনার কারণ দুষ্ট আত্মা,, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা বা কোনও জিনের ক্রোধ। ভালবাসার ধর্মে বিশ্বাসী লামারা এদের প্রতিহত করতে পারলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বন চিকিৎসকরা তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে এই ভূতপ্রেতদের নিজেদের বশে রেখেই নাকি এহেন অসাধ্য সাধন করতে পারে! রোগীদের পরিবার থেকে উৎসর্গ করা অর্থ, শস্য, ফলমূল ও আনাজপাতিই ওই আরোগ্য ধামের আয়ের উৎস। তিব্বতের সমস্ত মঠেই পুণ্যার্থীদের আকর্ষিত করতে লামারা মানুষের চোখের সামনে ভোজবাজি ও জাদুবিদ্যার মাধ্যমে আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটান। বন চিকিৎসকরা কিন্তু প্রকাশ্যে কোনও জাদু দেখান না। কিন্তু এই গোপনীয়তা এবং অদ্ভুত পদ্ধতিতে চিকিৎসায় সাফল্য ওদের তন্ত্রসাধনা ও গুপ্তবিদ্যার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রবাদগুলিকে সঞ্জীবিত রাখে। তেমন বিপদে না পড়লে কেউ ওপথ মাড়াতে চায় না।

দ্বিতীয় বেষ্টনীর পেছনে মন্দিরে রয়েছে একটি প্রশস্ত প্রার্থনাঘর। টিলার প্রস্থ জুড়ে নির্মিত ওই ঘরে সমস্ত চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও আবাসিকরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করতে পারে। মন্দিরের পেছনেই খাড়া ও মসৃণ সুউচ্চ পর্বতগাত্র। ওই পাথরে একটাও ঘাস গজায় না। ওই পাহাড়ের চূড়া অন্য একটি উঁচু পাথুরে পাহাড়ের গায়ে অদ্ভুতভাবে খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে থাকায় ওই দিকটা একেবারেই অগম্য। ওই পথে এমনকি সুর্যের আলোও কদাচিৎ আসতে পারে। এলাকার মানুষের ধারণা ওই অগম্য এলাকা ভূতপ্রেতের আবাসস্থল। সো সা লিং-এর চিকিৎসকরা ওই প্রেতাত্মাদের চেনে। ওই আরোগ্য ধামেরই চিকিৎসক মিগমার, তার ভাগ্নে অনগের সাহায্যে মুমূর্ষ গরবকে সেখানে নিয়ে আসে।

প্রায় পুরো রাস্তাটাই সে জ্ঞানশূন্য ছিল। মাঝেমধ্যে জ্ঞান ফিরলে অনগ তাকে জল খেতে দেয়। কিন্তু নিমেষেই সে আবার অর্ধচেতনে কিম্বা অচেতনে নিঃসাড় হয়ে পড়ে। আরোগ্য ধামে উপাচার শুরু হওয়ার পরও প্রথম কয়েক সপ্তাহ তার একই রকম কাটে। অবশেষে একদিন সকালে তার জ্ঞান ফেরে। সে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখে সামনে বসা সদ্যযুবক অনগের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকায়। সে কী কী প্রশ্ন করতে পারে তা কল্পনা করে মিগমার যা বলার নির্দেশ দিয়েছেন সেই অনুযায়ী অনগ বলে, তুমি গুরুতরভাবে জখম হয়েছিলে, আমার মামা একজন ডাক্তার, তিনিই তোমার চিকিৎসা করছেন। আমার নাম অনগ। তুমি এখন একটা গোম্পায় রয়েছ। তারপরই সে মামার নির্দেশ অনুযায়ী উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত ওখান থেকে চলে যায়। মামা তাকে এর বেশি কিছু বলতে মানা করেছেন। এর বেশি কিছু বললে সে নাকি আবার জ্ঞান হারাতে পারে!

গরব একা আধো অন্ধকার একটি ঘরে শুয়ে থাকে। তখনও ওর ওঠার ক্ষমতা নেই। ওর মাথার উপরের ছাদে একটা টিকটিকি আরেকটা টিকটিকিকে ধাওয়া করছে। কিন্তু একটু কিনারার দিকে চলে গেলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে টিকটিকি দুটিকে দেখার শক্তি পায় না। কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। সে চোখ বন্ধ করে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার স্মৃতিশক্তিও যেন ক্লান্ত। সে আবার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে গভীর অন্ধকারে। শুধু অন্ধকারে দুটি আলোকোজ্জ্বল টিকটিকি পরস্পরকে ধাওয়া করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর অনগ তার জন্যে গরম ৎসাম্পা আর চা আনে। কিন্তু সে খুব একটা ৎসাম্পা খেতে পারেনা, ওকি ওঠে। ওকি উঠলে কাঁধের ব্যথাটা বাড়ে। কেউ যেন পেরেক ঠুকে দিচ্ছে এমন ব্যথা! অনেক কষ্টে চুমুক দিয়ে দিয়ে চা-টা খেয়ে বেশ ভাল লাগে। অনগ ওকে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে বলে। ৎসাম্পাটা পাশের টেবিলে ঢেকে রাখে। তখনই মিগমার এসে ওকে দেখে যান। একটা পাথরের খাদার মধ্যে রাখা ভেষজ মলম নিয়ে ওর কাঁধের ক্ষতে লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করেন, কাঁধে গুলি ঢুকেছিল, সেদিন আমরা দৈবাৎ ওই পথে না গেলে কী যে হতো! কারা গুলি করেছিল? কে তুমি?

গরব মিগমারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। মিগমার বোঝেন, রোগীর এখনও অচেতনের ঘোর কাটেনি। তিনি মুচকি হেসে অনগকে ইশারায় বাইরে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়ে চলে যান।

সন্ধ্যায় অনগ তাকে বাকি ৎসাম্পাটা গরম জল মিশিয়ে লেই বানিয়ে খাইয়ে দেয়। তারপর আরেক বাটি গরম চা।

পরদিনই গরব উঠে বসতে পারে। কিন্তু সে নিজের সম্পর্কে নীরব থাকে। এমনিতেও খাওয়া আর প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া ওর আর কোনও কাজ নেই। অধিকাংশ সময় উপরের ছাদটাও ফাঁকা থাকে। শুধু মাঝেমধ্যে একটি টিকটিকি আরেকটির পেছনে ধাওয়া করতে থাকে। এই দৃশ্য দেখলেই সে উত্তেজিত হয়। কিন্তু টিকটিকিগুলি চোখের সামনে থেকে সরে গেলে ভীষণ দুর্বল লাগে। সে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। অনগ দু’ বেলা এসে নিয়মিত চা, ৎসাম্পা এবং গরম জল দিয়ে যায়। কাঁধে মলম লাগিয়ে দেয়। গরবের মন ওর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। পরদিন সে অনগের হাত ধরে শীতল মেঝেতে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু মাথা ঘোরে, আবার বিছানায় বসে পড়ে। অনগের হাত ধরে ধরে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে।

পরদিন একা একাই পায়ে পায়ে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে সে শীতল পাথুরে উঠোনে পা রাখে। সূর্যের আলোর দেখা পায়। কিছুক্ষণ রোদ পোহায়। কিন্তু ঘাড় উঁচু করে চারপাশে তাকাতে গেলে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সে আবার পায়ে পায়ে বিছানায় ফিরে আসে।

এভাবে যতদিন যায় ধীরে ধীরে গায়ে জোর ফিরতে থাকে। দু ' বেলা ঘর আর উঠোনে পায়চারি করে। রোদ পোহায়। ক্রমে এইটুকু জায়গায় দমবন্ধ লাগতে শুরু করে। সে চিকিৎসকের কাছে বাইরে বেরিয়ে কাছাকাছি গ্রাম পর্যন্ত হাঁটতে যাওয়ার অনুমতি চায়। তাকে এত যত্ন করে সুস্থ করে তোলার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানায়।

মিগমার ওর কথা শুনে হেসে ফেলেন, যাক, তুমি দেখছি তিব্বতী! আমি তো তোমার চেহারা দেখে ভেবেছিলাম বহিরাগত বুঝি।

গরব তখন ধীরে ধীরে নিজের জন্মের কথা চিকিৎসককে জানায়। নিজের পেশা আর দেচমার কথা ছাড়া কিছুই গোপন করে না। নিজেকে একজন সম্পন্ন চাষি ও পশুপালক পরিচয় দিয়ে খ্যাং তিসে থেকে অন্য দুই সঙ্গীকে নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা, অহেতুক সন্দেহবশে চীনা সৈন্যদের ধাওয়া ও এক সময় গুলি করার কথা বলে। মিগমারের চোখমুখ দেখে মনে হয় তিনি গরবের সব কথা বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু বাইরে বেরুনোর অনুমতি তিনি দেন না।

তিনি বলেন, তোমার শরীরে এখনও বাইরে বেরুনোর মতন শক্তি হয়নি বন্ধু, সেরে উঠতে এখনও অনেক সময় বাকি, ভুল করেও বাইরে কোথাও যাবে না! এই হাসপাতালের নিয়ম ভীষণ কড়া, এখানকার রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে দরজা পেরোনোর অনুমতি পায় না। একবার কেউঅনুমতি ছাড়া বেরিয়ে গেলে সে যতই অসুস্থ হোক না কেন,আর ফেরার সুযোগ পায় না। তোমার এত তাড়া কিসের? গরব ডাক্তারকে কি করে বোঝায় যে সে তার প্রেমিকা দেচমাকে খুঁজে পেতে চায়। দেচমা তার চোখের সামনে ডুবে গেছিল, বিদ্যুতের চমকে গরব ওর দু’ হাতের আঙুলগুলিকে শুধু ঢেউয়ের উপর দেখতে পেয়েছে। তারপর? সে কি জলে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে, নাকি ঢেউয়ের ধাক্কায় নদীর কিনারে কোথাও ছিটকে পড়ে বেঁচে গেছে? তখন যদি ওর কাঁধে গুলি না লাগতো, তাহলে কি দেচমাকে বাঁচাতে পারতো? অন্ততঃ নদীর পাড় ধরে দৌড়ে গিয়ে যেখানে দেচমাকে দেখতে পেত সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারের চেষ্টা করতো। এখনও আশা ছাড়ার কোনও কারণ নেই। এখান থেকে বেরিয়ে সে একজন ভাল জ্যোতিষীর কাছে যাবে। ধীরে ধীরে অনগের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এই বিশাল আরোগ্য ধামে অনগও প্রায় একা। গরব ওকে জ্যোতিষীর কথা বলায় অনগ বলে, এই আরোগ্য মঠের আবাসিকদের মধ্যে নিশ্চয়ই ভাল ভবিষ্যৎদ্রষ্টার খোঁজ পাওয়া যাবে, মামাকে বলবো।

এই সামান্য পরিচয়েই অনগ গরবকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। আসল পরিচয় না জানলেও তার সুঠাম শরীর, দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার ইচ্ছা, প্রবল আত্মবিশ্বাস এবং অভিযানপ্রিয় চরিত্রের সান্নিধ্য সে উপভোগ করে। আবার মনে মনে ঈর্ষাও করে। কিন্তু একদিন গরবের ঘোড়া দুটি তাকে না জানিয়েই নিকটবর্তী বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় অনগের ভীষণ রাগ হয়। মামাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কোনও জবাব না দিয়ে কঠিন চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন , এ বিষয়ে রোগীর সঙ্গে কোনও কথা বলতে হবে না! একী অন্যায়! এ তো জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়! গরব যদি সুস্থ হয়ে ওর ঘোড়াগুলি চায়? পুরানো ব্যাপারটাই ওর কাছে ধোঁয়াশা ঠেকে। এই ঘটনার পর থেকে সো সা লিং-এর পরিবেশ তরতাজা নবীন অনগের একদমই ভাল লাগে না। মামার কড়া শাসন আর আরোগ্য ধামের বাইরে কাছাকাছি গ্রামে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধ রয়েছে। শুধুমাত্র মঠবাসীরা যখন কোনও বিশেষ আনাজের খোঁজে নিকটবর্তী বাজারে যায় তখন ঝোলা, পুটলিবাহী ঘোড়া কিম্বা খচ্চর নিয়ে সঙ্গে যায়। আর চিকিৎসকরা নিকটবর্তী কোনও গ্রামে মুমুর্ষ কোনও রোগী দেখতে গেলে তাদের ওষুধপত্র ও পুজোর সরঞ্জাম বহন করার দায়িত্বও সে মহানন্দে নেয়। সামান্য সময়ের জন্যে হলেও সে এই সুযোগে এই কড়া শাসনের কয়েদ থেকে মুক্তির আনন্দ পায়, গ্রামবাসীদের সঙ্গে বসে কয়েক চুমুক দেশি মদ ও গল্পগুজব সেরে আসে।

একদিন সে এমনি এক খামারবাড়ির রান্নাঘরে উনুনের চারপাশে জড়ো হয়ে বসা রোগীর বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে বসে আড্ডা মারছিলো। ওই বাড়ির ছেলেরা তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি বনদের হাসপাতালে নতুন?

– হ্যাঁ!

– ওখানে কী করো?

– আমি ডাক্তার মিগমারের ভাগ্নে, তিনি আমাকে চিকিৎসা শেখাতে নিয়ে এসেছেন!

– ওঃ! তার মানে তুমিও ভবিষ্যতে বন চিকিৎসক হবে? তুমি কি সমস্ত ডাক্তারকে দেখেছো, অন্যদেরও দেখেছো, যারা মন্দিরে পুজো করে আর মঠাধ্যক্ষকে?

– না, আমি এখনও প্রার্থনাসভায় যাইনি, আমি তো নেহাৎই নবীন শিক্ষার্থী!

– তুমি কি শুনেছ, তাদের বিগ্রহের পেছনে বিশেষ কোনও দিনে ঈশ্বরের আবির্ভাব হয়?

– অবশ্য এটা গুজবও হতে পারে, গ্রামের একটা ছেলে আমাকে বলেছে, সে মাঝেমাধ্যেই মঠে যেত। তার বাবা-মা বনদের জমিতে চাষ করে। সে কখনও বীজ আনতে যেত আবার কখনও ফসল পৌঁছোতে। আমরা জানি না সে ঠিক কী দেখেছে বা শুনেছে, কিন্তু তার অতিরিক্ত আগ্রহের চরম মূল্য দিতে হয়েছে! সো সা লিং-এর বাসিন্দারা খুবই উপকারী, কিন্তু ওদের থেকে দূরত্ব রাখা ভাল!

বার্ষিক উৎসবের দিনে গোম্পার মন্দির সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আশপাশের গ্রামের বন ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষও সেদিন গোম্পায় জমায়েত হয়ে মন্দিরে প্রার্থনা করে। কিন্তু ওই ছেলেটা বন বাড়ির ছেলে হয়েও ততটা ধার্মিক ছিল না - অতিরিক্ত মদ খেত। একদিন সন্ধ্যার পর সে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে যা বলে, তা শুনে সবাই অবাক। ছেলেটি মদ খেয়ে থাকায় ধীরে ধীরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে বলে, আমাদের পূজ্য সো সা লিং-এর প্রভুরা ভীষণ অদ্ভুত। বৃদ্ধ মঠাধ্যক্ষ তো ভীষণ রকম খিটখিটে, আমাকে বেশ কয়েকবার মেরেছে, দোষ না করলেও মেরেছে। লোকটা ভয়ঙ্কর, ইতর বুড়ো, আমি তাকে কৌশলে ঠকাতে চেয়েছিলাম। এবার বার্ষিক উৎসবের দিন বিগ্রহের সামনে যখন মানুষের ভীড়, আমি দরজা দিয়ে ঢুকেই বিশালাকায় রঙিন চৌকো তাংখাগুলির পেছনে লুকিয়ে চুপিচুপি বিগ্রহ আর পাহাড়ের মাঝে অন্ধকার গোপন জায়গায় পৌঁছে যাই। তারপর যখন মঠাধ্যক্ষ পুজো করতে আসেন, আমি হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় তাঁর পেছনে বিগ্রহের কাছাকাছি লুকিয়ে থাকি। আমি ভেবেছিলাম, তিনি একটু সরলেই পুজোর উপাচার, ভোগ কিম্বা নৈবেদ্যর মধ্যে কিছু একটা উল্টোপাল্টা করে দিয়ে ওখান থেকে পালাবো। তারপর, মঠাধ্যক্ষ যখন মন্ত্র পড়ে ঈশ্বরকে আনাবেন, ঈশ্বর এসে দেখবেন জাদু-বৃত্তে সবকিছু নিয়মমাফিক নেই – তখন ওই জঘন্য বুড়ো মঠাধ্যক্ষকে শাস্তি দেবেন। এভাবেই আমার উপর অত্যাচাররের বদলা নিতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু সেদিন মঠাধ্যক্ষ এক মুহুর্তের জন্যেও সাজানো মহার্ঘ বৃত্তের থেকে দূরে সরেনি। আমি কোনও কিছু এলোমেলো করার সুযোগ পাইনি। আর তারপর লোকটা মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে যায়। আমি ওই অন্ধকারে বন্দি হয়ে পড়ি। আর ভাবতে থাকি, এবার নিশ্চয়ই ঈশ্বর আসবেন, আসবেন কি? আমি যেহেতু সত্যি সত্যি নৈবেদ্য কিম্বা কোনও উপকরণ এলোমেলো করে দিইনি – ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাকে কিছুই করবেন না! কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনও ঈশ্বর আসেনি। দুটো বিশালাকায় হিংস্র পিকা ইঁদুর ঘোরাঘুরি করছিল। আমি ওদের দেখে ভয় পেয়ে যাই। যে কোনওভাবে ওখান থেকে বেরুতে চাই। সে যে কি ভয়ানক সময় . . . আমাকে আরেক বাটি মদ দে . . . | সে এমনিতেই অনেক মদ খেয়েছিল, তারপরও সে আরেক বটমদ খেয়ে বলে,, অ-নে-ক কষ্টে পালাতে পেরেছি, না পারলে আর তোদের মুখ দেখতে পেতাম না, যেখান দিয়ে ঢুকেছি, সেখান দিয়ে বেরুনোর কোনও উপায় ছিল না! খাড়া পাহাড় বেয়ে . . . উফ! কী বিপজ্জনক! বলবো, . . . কাল তোদেরকে বলবো, স-ব খুলে ব-ল-বো!


চলবে ...