শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ২৫

সুখেরই বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয়; বস্তুত দুঃখ আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত। কথাটা শুনতে স্বতোবিরুদ্ধ কিন্তু সত্য। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

# পঁচিশ

নিজের উদ্দেশ্য সাধনে বিদেশ বিভূয়ে যাঁদের সাহায্য ও ভালবাসা পেয়েছেন, কিছুদিন পর তাদের জীবনে চরম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠার খবর শরতের কাছে নিশ্চয়ই সুখকর ছিল না। তিব্বত থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই হিমালয় অতিক্রম করে একেকটা বোমার মতন খবরগুলি আসতে থাকে, আর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে থাকে ব্রিটিশ ভারতের সফলতম বাঙালি গোয়েন্দা শরৎচন্দ্র দাসের হৃদয়কে। শরৎ তিব্বত থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই নাজানি কিভাবে লাহসা প্রশাসন তাঁর আসল পরিচয় জেনে যায়, বুঝতে পারে তাঁর যাত্রার উদ্দেশ্যও। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য লাহসার সরকার দার্জিলিং-এ গুপ্তচর পাঠায়। এরপর শুরু হয় ধরপাকড় । যাঁরা শরৎকে কোনও - না - কোনও ভাবেসাহায্য করেছে, আশ্রয় দিয়েছে, বাড়িতে এনে আপ্যায়ন করেছে ,তাঁর যাতায়াতেরসময় কুলি, ঘোড়া, চমরির ব্যবস্থা করেছে ; তাদের বিচার হয় এবং প্রত্যেককে দেশদ্রোহি ঘোষণা করে শাস্তি দেওয়া হয়। যাদের অপরাধের মাত্রা কম তাদের শিকল পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় , বাকিদের নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। শিগাৎসের বাজারে শিকল - পরা বন্দিদের দেখেছেন শরৎ ; লিখেছেন, একাধিক দল , তাদের কারোও হাতে পায়ে শিকলবেড়ি পরানো , কারোও বা হাতগুলো কাঠের পাটায় আঁটা ।অনেকেরই চোখ খুবলে নেওয়া , গায়ে অত্যাচারের টাটকা দাগ ।সরকার এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় না , বাজারে ভিক্ষে করে বেড়ায় । এক করুন বীভত্স দৃশ্য । তবে বিভিন্ন পর্যটকের লেখায় তিব্বতের কারাগারের যে বর্ণনা পাওয়া যায় – তা আরও বীভৎস! এগুলি আসলে ছিল পাথরের গুহার ভেতরে অন্ধকূপ , বায়ুচলাচলের জন্যশুধু একটি ফোকর, খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলা হতো সেই ফোকর দিয়ে । বাইরে বেরোবার পথ গেঁথে দেওয়া, বেরোবার দরকারও হতো না , কিছুকালের মধ্যেই মানুষগুলো এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত। জীবন্মৃত হয়ে টিকেও থাকত কেউ কেউ ।

১৯০৩ সালে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তিব্বত অভিযানে গিয়েছিল, তারা সেই অন্ধকূপের পাথর ভেঙে এমন কিছু বন্দিকে মুক্ত করে ।তাদের মধ্যে সেই দণ্ডিত দেশদ্রোহীরাও হয়তো ছিল । দীর্ঘ কুড়ি বছর অন্ধকূপে কাটানোর পর তাদের মানুষ বলে চিনতে পারাই কঠিন : সাদা ফ্যাকাশে কঙ্কালসার সরীসৃপের মতন জীব; পুরুষ নারী আলাদা করা যায় না , পোশাক পচে খসে গিয়েছে,চোখের মণিগুলোও সাদাঅ্যালবিনোর মতন , পাথরের ঘাম আর শ্যাওলা খেয়ে বেঁচে রয়েছে এত বছর – অবিশ্বাস্য! কিন্তু নিদ্রা বা অন্ধকার থেকে বের করে আনার পর ওদের কারও জবানবন্দী নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো অনভ্যস্ত দিনের আলোর চাপেই ছটফট করে মারা গিয়েছিল তাঁরা।

পাঞ্চেন লামার প্রধান পারিষদ সেংচেন দোর্জেচেনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল । চোখের সামনে সেই মৃত্যু দেখতে বাধ্য হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ । তাশিলুম্ফো মঠে পাঞ্চেন লামার প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ও কঠিন রোগ নিরাময়ের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, এমনটাই মনে করত সাধারণ তিব্বতিরা। সেজন্যেই হয়তো সকলের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে সাংপোর একটি ঝর্ণায় জীবন্ত ডুবিয়ে মারা হয়েছিল তাকে। করুণার অবতার বুদ্ধের অনুগামী হয়েও তিব্বতি প্রশাসন কতটা নৃশংস হতে পারে তার প্রমাণ এই শাস্তি।সেই দৃশ্য দেখতে গোটা শিগাস শহরটাই বুঝি ভেঙে পড়েছিল নদীর পাড়ে ।যেখানে প্রবল কলোচ্ছ্বাসে ঝর্ণাটি গিয়ে নামছে সাংপোতে , সেইখানে অনেক উঁচু থেকে তাকে পাথরে বেঁধে দড়িতে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে নামানো হয় ।

মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও নাকি আশ্চর্য শান্ত ছিলেন সেংচেন , একাগ্র মনে ধর্মগ্রন্থ পাঠ শেষ করেন। তারপর সেই নৃশংস মৃত্যু! সাংপোর গর্জন ছাপিয়ে উঠেছিল দর্শকদের সমবেত বিলাপের ধ্বনি ! অলোক ভাবে, — এটা খুবই অদ্ভুত যে শরৎ দাসের কাছে জরিপের যন্ত্রপাতি দেখেও তাকে একটিবারের জন্যে সন্দেহ করেননি লামা সেংচেন , উলটে শরতের কাছে জরিপ বিজ্ঞান শিখেছেন, কলকাতা থেকে ক্যামেরা আনিয়ে ফোটোগ্রাফির প্রযুক্তি শিখেছেন। ফোটোগ্রাফি নিয়ে তিব্বতি ভাষায় বইও লিখতে শুরু করেছিলেন । ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে শরৎ যখন তাশিলুম্ফায় ছিলেন, তখন তার কাছে নিয়মিত ইংরেজি, ফিজিক্স আর বীজগণিতের তালিম নিতেন লামা, দূরবীন আনিয়ে আকাশ নিরীক্ষণ করতেন, ম্যাজিক লন্ঠনে দুনিয়া দেখতেন। এইসব থেকে অলোকের একটা কথাই মনে হয়। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে সেংচেনের খিদে এতটাই তীব্র ছিল যে শরৎ দাস যে ব্রিটিশ গুপ্তচর হতে পারে , এই ভাবনাটাকে তিনি আদৌ গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। একবার তিনি শরৎকে বলেন, আমি চাই বিশ্বের দরজাটা খুলে যাক, নতুন যুগের হাওয়া আসুক। সেই দরজাটা রয়েছে ভারতে, প্রভু বুদ্ধের বাণী যে পথে এসেছে সেই পথেই আসবে সেই যুগ।

অলোক ভাবে, — সত্যিইযদি এটা হতো , তাহলে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ডের অভিযান ভিন্ন এক তিব্বত দেখত, অথবা হয়তো সেই অভিযানের প্রয়োজনই আর হতো না! ইংরেজরা হয়তো এমন অভিযানের সাহস পেত না!

খাংসারে সেই চাঁদের রাতে রিনপোচের হাতের রেখায় কী দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র? জন্মভূমির ঘন সবুজ পাহাড়শ্রেণী ও প্রাণবন্ত উপত্যকাগুলিকে আর কোনওদিন দেখতে পাননি মহিলা। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তাকেও নিক্ষেপ করা হয় অন্ধকূপে - আমৃত্যু বন্দিত্ব। কুড়ি বছর পরে পাথরের গাঁথুনি খুলে বের করে আনা ফ্যাকাশে কঙ্কালসার সরীসৃপের মতোপ্রাণীগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে, এমনকি যৌনাঙ্গ দেখেও শুরুতে পুরুষ নারী তফাৎ করা যায়নি। তাদের মধ্যে রিনপোচে ছিল কি ?

তিব্বতের কথা ভাবলে শরতের সবচাইতে বেশি মনে পড়ে সামদিং মঠে এগারোদিন অসহনীয় রোগযন্ত্রণার কথা। প্রবল শৈত্যের কথা। মনের জোরেই শেষপর্যন্ত সুস্থ হয়ে লাহসায় যেতে পেরেছিল সে। সেখানে লাচামের বাড়িতে থাকা আর তার সূত্রেই পোটালা প্রাসাদে গিয়ে ত্রয়োদশ দলাই লামার দর্শনলাভ। তারপর সাক্য প্রদেশ ও ইয়ার্লুং সাংপো উপত্যকা ঘুরে ১৮৮২ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক বছরেরও বেশি সময় পরে ভারতে ফিরে আসেন। নতুন গড়ে ওঠা শৈলশহর দার্জিলিঙে তখন বড়দিনের উৎসব চলছে । সেংচেনের কাছ থেকে শরৎ যেসব অমূল্য ধর্মগ্রন্থ, পুঁথি, থংকা...এইসব উপহার পেয়েছিলেন, আর যা কিছু সংগ্রহ করেছিলেন লাহসা ও শিগাৎসের বাজার থেকে, সেগুলি বয়ে আনতে দুটি চমরি ভাড়া করতে হয়েছিল। সেই পুঁথিপত্রের মধ্যে অনেকগুলো সংস্কৃত রচনা ও কাব্য ছিল, যা ভারতবর্ষ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল বহুকাল আগে। তবে সেগুলির মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল একটি দিনলিপি, যার পাতায় পাতায় যাত্রাপথের পূর্ণ বিবরণ, ব্যক্তিগত অনুভব থেকে শুরু করে ভৌগোলিক খুঁটিনাটি, প্রাকৃতিক নৈসর্গ, সামাজিক ও ধর্মীয় তথ্য অনুপুঙ্খভাবে লিখে রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র । দার্জিলিঙে ফিরে এই দিনলিপির ওপর ভিত্তি করে তিনি দুটি রিপোর্ট লেখেন, - ন্যারেটিভ অফ আ জার্নি টু লাহসা এবং ন্যারেটিভ অফ আ জানি রাউন্ড লেক পালটি ( ইয়ামদোক ) অ্যান্ড ইন লোখা, ইয়ার্লুং আন্ড সাক্য, যা সরকারি মহলে প্রকাশিত হয় অত্যন্ত গোপনীয় নথিরূপে। ফলে তিব্বত সংক্রান্ত বৈঠকে সরকারি প্রতিনিধি দলে চীন যাওয়ার সুযোগ পান শরৎচন্দ্র। রায়বাহাদুর খেতাব পান, রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মেডেলও পান। দার্জিলিঙের প্রান্তে তাঁর সুন্দর বাংলো ‘লাসা ভিলা’ ক্রমে দেশি - বিদেশি তিব্বতপিপাসুর ঠিকানা হয়ে ওঠে। তিব্বতের ভাষা সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে থাকেন এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে। গড়ে তোলেন বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি। একাধিক বই লেখার কাজেও হাত দেন। দার্জিলিঙে বসে তিনি যখন তিব্বতযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখছেন, শিগাৎসে ও লাহসা থেকে শুরু করে নানান জায়গায় তাঁর সংস্পর্শে আসার অপরাধে বিভিন্ন মানুষজন তখন অন্ধকূপে বন্দি। তখন কালিম্পং দিয়ে জেলেপ - লা হয়ে দার্জিলিং-এর সঙ্গে তিব্বতের নিয়মিত বাণিজ্য চলত, সেই ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই শরতের কাছে একেকটি তুষারধসের মতো খবর আসে, লামা সেংচেন দোর্জেচেনের মৃত্যুদণ্ডের খবরও নিশ্চয়ই শরতকে কষ্ট দিয়েছে! অথচ দিনলিপিতে প্রায় কাউকেই স্বনামে উল্লেখ করেননি শরৎ। মূলতঃ তাঁর এবং তাঁর পূর্বসূরি গুপ্তচর ‘পণ্ডিত’ দের সংগ্রহ করা তথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে ১৯০৩সালে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড তিব্বতে সামরিক অভিযান করেছিলেন। অন্ধকূপের ভেতর থেকে উদ্ধার হয়েছিল পাথরের ঘাম আর শ্যাওলা খেয়ে বেঁচে থাকা পাণ্ডুবর্ণ কঙ্কালসার মনুষ্যপ্রাণীরা। কিন্তু আলোয় তুলে আনতেই তাঁরা মারা যান।

ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে তিব্বতে সামরিক অভিযানটি ছিল মধ্যএশিয়ায় রাশিয়া ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের যে প্রতিযোগিতা চলছিল, যাকে বলা হতো ‘গ্রেট গেম’, তার অন্তিম পর্যায়ের অভিযান। সামরিক শক্তি আর বাণিজ্য বিস্তারের সুবাদে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত তখন অত্যন্ত মজবুত। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে রেলপথের জাল। টেলিগ্রাফ ছিলই, সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে টেলিফোন, মোটরগাড়ি, সিনেমা, সময়ের ধারণাটাই বদলে গিয়েছে । কিন্তু তিব্বতে পৌঁছে ইয়ংহাজব্যান্ড দেখলেন সময় যেন থমকে আছে, কুড়ি বছর আগে শরৎচন্দ্র দাস যেমন দেখেছিলেন ঠিক যেন তেমনই। রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির জার্নালে লেখা একটি প্রবন্ধে পথপ্রদর্শক হিসেবে শরৎচন্দ্রের ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন ইয়ংহাজব্যান্ড। তিনি লিখেছেন, দুঃসাহসী ব্রিটিশ অভিযার্থীদের জন্য, ভবিষ্যতের স্বেন হেদিনদের জন্য আরও একটি গন্তব্য কমে গেল দুর্ভাগ্যবশত; এভাবে খুব শীঘ্রই সেই অভিযাত্রীরা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মতন হঠে যেতে থাকবে পৃথিবীর বুক থেকে, মেরুতুষারের দেশে অদৃশ্য হয়ে যাবে একদিন!

ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড উল্লেখ করেছেন তিব্বতের অবর্ণনীয় নৈসর্গিক শোভার কথা, মাইলের পর মাইল রিক্ত অন্তহীন মালভূমির আশ্চর্য সমাহিত রূপ, ভোরে তাঁবুতে বিউগলের শব্দে জেগে উঠে চরাচরময় বরফের চাদরের ওপর নক্ষত্রের আলো ও তারপর লহরীর শীর্ষবিন্দুতে প্রথম রক্তাভা , দিনের পর দিন সূর্যাস্তের সময় স্বচ্ছ আকাশ জুড়ে যেন পীত ফিরোজা কমলা বেগনি রত্নের বর্ণচ্ছটা। তিব্বত নিয়ে তাঁর লেখা পড়ে অলোকের মনে হয় যেন এক অতীন্দ্রিয়বাদী কবির মরমিয়া প্রকৃতিপ্রেমের কাহিনি। দক্ষ অফিসার, দুঃসাহসী ভূপর্যটক, নাইট খেতাবপ্রাপ্ত স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড মহাজাগতিক রশ্মির দিব্য শক্তিতে বিশ্বাস করতেন, বিকাশ করতেন যে মহাবিশ্বে অলটেয়ার নামে এক সজীব গ্রহে যেখানে স্বচ্ছদেহী প্রাণীরা থাকে। তিনি নারীপুরুষের মুক্ত অবারিত প্রেমেও বিশ্বাস করতেন। আর শেষ জীবনে তিব্বত অভিযানের জন্য অনুশোচনার কথা লিখে গেছেন। কারণ বাস্তবে এই অভিযান ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। অত্যাধুনিক ম্যাক্সিম বন্দুকে সজ্জিত গোর্খা ও শিখ রেজিমেন্টের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আদ্যিকালের ম্যাচলক রাইফেল নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে হাজার হাজার তিব্বতি সৈন্য প্রাণ হারায়। ব্যাপক লুঠপাট চলে অসংখ্য মঠ ও গোম্পায়, দলাই লামা পালিয়ে যান মোঙ্গোলিয়ায়। বৃটিশ সামরিক শক্তির চাপে পৃথিবীর ছাদে দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ থাকা দেশটি খুলে যায় বিশ্ববাসীর সামনে।

এই সময় থেকেই সরকারি মহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র দাস। বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি কলকাতার বিদ্বৎসমাজেও উপেক্ষিত, দার্জিলিং-এর লাসা ভিলায় বসে তিব্বতি ভাষাসাহিত্য চর্চায় ডুবে থাকেন। তাঁর লেখা বইগুলো নতুন করে ছাপা না হওয়ায় বাজার থেকে হারিয়ে যায়, গোপন সরকারি রিপোর্টগুলো চাপা পড়ে যায় মহাফেজখানার ধুলোর নীচে, তাঁর নাম ঝাপসা হয়ে কিপলিঙের বিখ্যাত ‘কিম’ উপন্যাসে হারি চুন্ডার মুখার্জি নামে গুপ্তচর চরিত্রের আড়ালে থেকে যায় ছায়ার মতন। চাকরিতে অবসর নেবার পরে বকেয়া পাওনাগণ্ডা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলায় জড়িয়ে পড়েন শরত, তিব্বতি ভাষার অভিধান লেখার কাজ শেষ করেন। ১৯১৭ সালে আটষট্টি বছর বয়সে মারা যান শরৎচন্দ্র দাস। তাঁর বিপুল পুঁথি ও থংকার সংগ্রহ কিছু কিছু পরিবারের হাত ঘুরে ছড়িয়ে যায়, অধিকাংশই দার্জিলিঙের আর্দ্র আবহাওয়ায় অনাদরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ফরাসি প্রাচ্যবিদ আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীল কিনে নেন সেগুলি। তারপর একসময় লাসা ভিলাও হাতবদল হয়ে যায়। দার্জিলিঙে অবসর জীবনে প্রতিদিন বিকেলবেলায় নিয়ম করে লাসা ভিলা থেকে হেঁটে চৌরাস্তায় ব্যান্ডের বাদ্য শুনতে আসতেন। ম্যালে ঘুরতে আসা সাহেব –মেমরা দেখতো নিখুঁত বিলিত পোশাক-পরা এক নেটিভ জেন্টলম্যানকে – ব্যাণ্ডস্ট্যান্ড থেকে সামান্য দূরে ফোয়ারার কাছে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘গড সেভ দ্য কিং’-এর সুরে মৃদু দুলছেন, হাতের লাঠিতে জড়ো করা আঙুলে তাল দিচ্ছেন, তারপর একসময় ফিরে যাচ্ছেন শেষ বিকেলের কুয়াশা, ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে।

একদিন তেমনি কুয়াশা ভেদ করে ফেরার পথে রেলস্টেশনের কাছে এসে পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন শরৎচন্দ্র। নির্জন পথ। গাঢ় কুয়াশার মধ্যে কিছু দেখা যায় না । সতর্ক হয়ে হাঁটতে থাকেন, পেছনে পায়ের শব্দটা চলতেই থাকে। শরতের মনে হয় যে বেশ কিছুদিন ধরেই এই শব্দটা তিনি শুনছেন, কেউ একজন তাঁকে অনুসরণ করছে।

হাঁটতে হাঁটতে খাদের ধার ছেড়ে পাহাড়ের দিকটায় সরে আসেন শরৎ, অনুসরণকারীও দিক বদল করে। শরৎ চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নেন একবার। বিশ্রস্তকোট - ট্রাউজার পরা একটি ছায়ামূর্তি, জড়োসড়ো ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে তার দিকেই।

হঠাৎ একটিবিস্মৃতির ভাঁজ খোলে শরতের স্নায়ুতে। শিগাৎসের বাজারে ঠিক এমনই ঘন কুয়াশার ভেতর একদিন এক খঞ্জ ভিখিরি লাঠি ঠুকে অনুসরণকরছিল,তারপরআচমকা সামনে এসে দাঁড়িয়ে লাঠি দিয়ে পথ আটকে চেঁচিয়ে ওঠে, - ফাইলিং । ফাইলিং ! বাজারভর্তি লোকের মাঝে ভিনদেশিশনাক্ত করে ফেলেছিল সে। দ্রুত ভিখিরিটির হাতে একটি মুদ্রা গুঁজে দিয়ে কুয়াশার মধ্যে কোনওক্রমে গা ঢাকা দিয়েছিলেন সেদিন।

স্টেশন ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র, ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতেই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর । অপ্রস্তুত লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গলা খামচে ঠেসে ধরেন পাহাড়ের গায়ে, বাঁ হাতের লাঠির হাতলে মোচড় দিয়ে বের করে আনেন ইস্পাতের ফলার মতন গুপ্তি।

  • ‘ রাস্কেল! মেরা পিছ কিনা গরেকো হঃ ?’ চিৎকার করে ওঠেন শরৎ। এই বয়সেওনিজের স্নায়বিক ক্ষিপ্রতায় নিজেই বিমোহিত হয়ে পড়েন।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিবশ হয়ে পড়ে লোকটিও। তাঁর সরু কুতকুতে চোখদুটোপুঁজের দলার মতন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় লিকলিকে তিব্বতি ছুরিটির দিকে। শরৎ দেখেন, এক বেঁটেখাটো চেহারার টিবেটো - মঙ্গোলয়েড প্রৌঢ়, চোখের দু’পাশে অসংখ্যবলিরেখা, থুতনির ওপর সামান্য একটু দাড়ি , ডান কানে গোঁজা পেনসিলের টুকরো, - পাণ্ডিব লা ! হজুর । মো কিন্টুপ ! টেলার কিন্টুপ! লোকটি কাতর স্বরে বলে।

ওর ভীত খোলা মুখের উষ্ণ বাম্প এসে লাগে শরৎচন্দ্রের নাকে মুখে । জামার ভেতর পকেট থেকে হলুদ হয়ে আসা একটি চিঠি কাঁপা কাঁপা হাতে বাড়িয়ে ধরে সে। শরৎ এবার লোকটির কলার ছেড়ে জোব্বার পকেট থেকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ বের করে জ্বালিয়ে দেখে, তিব্বতি ভাষায় লেখা একটি চিঠি, লাহসা থেকে অজ্ঞাতনামা কেউ লিখছে দার্জিলিঙেতাকভরের বাসিন্দা জনৈক নিমা শেরিংকে। এতে লেখা, শুকরের বছরের বুদ্ধপূর্ণিমার পর থেকে ন’টি চাঁদের মাস শেষ হলে KP নামধারী এক ব্যক্তি অমাবস্যা থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন পেমাকো উপত্যকার একটি গোপন স্থান থেকে সাংপোর স্রোতে পঞ্চাশটি করে কাঠের টুকরো ভাসাবে। নিমা শোংকে জানানো হচ্ছে সে যেন পত্রপাঠ এই বার্তা জলাপাহাড়ে সার্ভে অফিসের হামান সাহেবের কাছে পৌঁছে দেয়।

শরৎচন্দ্র দাসকে পড়ানোর জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁকে অনুসরণ করছিল কিন্টুপ।

তিব্বত থেকে শরৎচন্দ্র ফিরেছিলেন ১৮৮২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে । বড়দিন আর নববর্ষের উৎসবে তখন সেজে উঠেছে দার্জিলিং। তার মাত্র কিছুদিন আগে কিন্টুপ ফিরেছিল এক অচেনা শহরে। তার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল দুটো হৃদয়বিদারী খবর। বুচারবস্তিতে ফিরে সে শোনে যে কিছুকাল আগেই অজানা রোগে মারা গিয়েছে তার বউ। ছোটো মেয়েটি মারা গিয়েছিল তার আগেই। ছেলে দুটিকে সিকিমের নামচে বাজারে নিয়ে গিয়েছে এক আত্মীয়। সেই কাঠের বাসাটিও দখল হয়ে গিয়েছে। এক পড়শির ঘরের দাওয়ায় ঠাঁই হয় তাঁর।

দ্বিতীয় দুঃসংবাদটি আরও কষ্টের। ফেরার পরদিন ভাঙামনে একমাত্র ধোপদুরস্ত পোশাক পরে জলাপাহাড়ে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসে গিয়ে কিন্টুপ শোনে যে, হার্মান সাহেব দেশে ফিরে গিয়েছেন, তাঁর জায়গায় এসেছেন নতুন ফিল্ড ডিরেক্টার ট্যানার সাহেব। অফিসে পরিচিত কাউকেই দেখতে পায় না সে। একজন কেরানিবাবুর পেছন পেছন সাহেবের চেম্বারে ঢুকে টেবিলের উলটোদিকে লাল গালপাট্টার সাহেবকে দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারে কিন্টুপ। আগের দিন সকালবেলায় শহরে এসে জীবনে প্রথম রেলগাড়ি দেখে আতংকে ছুটতে ছুটতে ঘোড়ায় চড়া এই সাহেবেরই পা জড়িয়ে ধরেছিল সে।

সাহেব তখন টেবিলের ওপর ঝুঁকে একটি মানচিত্রে নিবিষ্ট হয়েছিলেন, হাতে জ্বলন্ত চুরুট। পায়ের শব্দেও চোখ তোলেননি। কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিয়ে মিনমিনে গলায় কেরানিবাবু বলেন, স্যার, উই হ্যাভ আ ম্যান হিয়ার হু ক্লেমস হি ইজ আ পান্ডিট, হি ইজ সেয়িং দ্যাট কর্নেল হার্মান সাহিব সেন্ট হিম টু টিবেট রিজিয়ন অন আওয়ার সিক্রেট মিশন টু এক্সপ্লোর দ্য কোর্স অব রিভার সাংপো, স্যার!

টেবিল থেকে মাথা তুলে কিন্টুপের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান কর্নেল এইচ সি ট্যানার, এবং চিনতে পারেন।

  • ইউ!

সাহেবের মুখ থেকে একরাশ ধোয়া বেরিয়ে আসে। তাঁর বিস্ফারিত চোখে চিকচিক করে ওঠে বিস্ময় আর কৌতুক।

পেমাকো উপত্যকা থেকে পাঠানো কিন্টুপ ওরফে KP –র বার্তা সার্ভে অফিসে এসে পৌঁছয়নি। সরকারি সিল- আঁটা কাঠের টুকরোগুলো সাংপো / ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে ভেসে চলে গিয়েছে সবার অলক্ষ্যে। লাসায় এক কাপড়ের ব্যবসায়ীকে দিয়ে লিখিয়ে নেম সিংকে যে বার্তা সে পাঠিয়েছিল, সেই নেম সিং ওরফে নিমা শেরিং মারা গিয়েছে তার আগেই। তিব্বতি ভাষায় লেখা সেই চিঠিটি তার বাড়িতে এসে পড়ে আছে, খোলাই হয়নি।

তাকভরে নেম সিঙের বাড়ি থেকে চিঠিটি উদ্ধার করে সার্ভে অফিসে নিয়ে গিয়ে দেখালেও ট্যানারের মুখের অভিব্যক্তিতে বিশেষ পরিবর্তন হয় না। লামা উগেন গ্যাৎসোকে দিয়ে তার অভিযানের বিবরণ নিয়মমাফিক নথিবদ্ধ করে রাখা হয় বটে, কিন্তু কোনওরকম স্বীকৃতি বা পুরস্কার কিছুই জোটে না কিন্টুপের। মাসের পর মাস দুর্গম অরণ্যপাহাড়ে সাংপোর গতিপথের যে জরিপ সে করেছে, তার সম্পূর্ণ খুটিনাটি তাঁর স্মৃতিতে খোদাই হয়ে ছিল, এক টুকরো কাগজও সঙ্গে ছিল না। একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে যে এমন কাজ করা সম্ভব, এটা কর্নেল ট্যানার বিশ্বাস করতেই চাননি। তাছাড়া থঙ্কুক গ্রামে ক্রীতদাস হয়ে পড়া ও তারপর পেমাকোচুং মঠের জীবনে দীর্ঘ চার বছর কেটে যাওয়ার কাহিনি বিশ্বাস করেনি কেউই। এদিকে ঠিক সেই সময়েই ফিরে আসেন বেঙ্গল এডুকেশান সার্ভিসের শরৎচন্দ্র দাস। মধ্য তিব্বতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঘুরেছেন তিনি, জরিপ করেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নদী, পাহাড় ও সরোবর, এনেছেন অসংখ্য কাচের প্লেট নেগেটিভ, মানচিত্রের খসড়া, তথ্যসংবলিত নোটবই। তাঁর অভিযানের সাফল্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সরকারি মহল, এক নিরক্ষর দর্জির কথা কারও মনে থাকে না।

চকবাজারের দর্জিগুমটিতে পুরোনো পেশায় ফিরে যায় কিন্টুপ, চার বছরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জীবনটা রিফু করতে শুরু করে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ভুটিয়া বস্তিতে তাঁর খুপরি ঘরটি ফিরে পায়। সিকিমের নামচে থেকে পুত্রদের নিয়ে আসে, আবার একটি বিবাহও করে। অলোক ভাবে, সারাদিন দর্জিপাড়ায় সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর শব্দের ভেতর থেকে তাঁর স্মৃতিতে কখনও হয়তো ভেসে আসে একটা ঝর্ণার তান, একটি রঙধনু ফুটে ওঠে সেই ঝর্ণার গায়ে, আর রঙধনু সাতরঙ বেয়ে সাঁতার কাটে এক পরী! হঠাৎ আঙুলে সূচ একবিন্দু রক্ত বেরিয়ে এলে আঙুল চুষে স্মৃতি আর বর্তমানের মাঝে চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে যায়। এভাবেই গড়িয়ে যায় দিন , ক্রমশ স্মৃতি ফিকে হয়ে আসে, আফিমের নেশায় দেখা স্বপ্নের মতন মনে হয় সবকিছু। নেম সিং-এর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা সেই চিঠিটিও ঝাপসা হয়ে আসে, তাতে কালচে সবুজ ছোপ ছোপ ছত্রাক ধরে। স্যাতসেঁতে সেলাই গুমটিতে ক্ষীণ আলোয় দীর্ঘসময় কাজ করতে করতে চোখের দৃষ্টি কমে আসে কিন্টুপের, আঙুলগুলিতে সন্ধিবাত শুরু হয়, ফলে সে কাজে শ্লথ হয়, কাজ কমতে থাকে, শুরু হয় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই।

ইতিমধ্যে ট্যানার সাহেব বদলি হয়ে গিয়েছেন, জলাপাহাড়ের অফিসে এসেছেন নতুন ডিরেক্টর। কিন্তু আগের সেই অভিজ্ঞতার পর একা সেদিকে পা বাড়াতে আর হয় না কিন্টুপের। অভিযানে যাওয়ার আগে থেকেই শরৎচন্দ্র দাসকে চিনত সে। তিব্বত থেকে ফিরে আসার পর তিনি বিখ্যাত মানুষ, রায়বাহাদুর খেতাবধারী, উঁচুতলার সাহেবদের সঙ্গে অবাধ যাতায়াত। তিনি যদি দয়া করে একটা সুপারিশ করে দেন , সরকারবাহাদুরের কাছ থেকে একটা মাসোহারার ব্যবস্থা যদি হয়, নিদেনপক্ষে এককালীন ভাতা — এইসব ভাবনা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই শরৎচন্দ্রকে অনুসরণ করছিল সে। স্টেশন পেরিয়ে তার বিশাল বাড়ির সামনেও গিয়েছে কয়েকবার, ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। কিন্তু কিন্টুপ জানত না যে, ইতিমধ্যে সময়ের পট বদলে গিয়েছে। দিনশেষের নির্জন কার্ট রোডের ধারে, যখন পাইনের বনে কুয়াশার ছায়া আর নীচে বুচারবস্তির থেকে ভেসে আসছে আজানের স্বর, অভাবনীয় ভাবে সে যে মানুষটির মুখোমুখি, তিনিও তখন তারই মতন ইতিহাসের পরিত্যক্ত ভাঙা নৌকোর এক নিঃসঙ্গ সহযাত্রী মাত্র, আর কিছু নয়!

শরৎচন্দ্র শুনেছেন যে তিনি চীনে গিয়েছেন একথা জেনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়ে চীনে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছিলেন। একথা জেনে তিনি আহত হয়েছেন। ভেবেছেন যে যদি কখনও দেখা কবির কাছে জানতে চাইবেন যে একথা সত্যি কিনা? আর সত্যি হলে তিনি কেন তাঁকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন? কিন্তু কিন্টুপের দুঃখের কথা অনুভব করে সেই কবির উক্তি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, - সুখেরই বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয়; বস্তুত দুঃখ আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত। কথাটা শুনতে স্বতোবিরুদ্ধ কিন্তু সত্য।

লাসা ভিলার বৈঠকখানায় কিন্টুপের আবেগ তাঁকে ছুঁয়ে যায়। নাজানি কেন, কিন্টুপকে জড়িয়ে ধরে তাঁর দু’গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।


চলবে ...