শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ১৫

# পনেরো

  • ''আমরা এখনও সে সব মেঘ অনুসরণ করি/ যারা পাহাড়ি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে/ আমরা এখনও সেই চা পান করি, আগুনও গিলে খাই/ আমরা খালি পায়ে হাঁটি ভ্রুক্ষেপহীন নিস্তব্ধতায়/ এবং কিছুটা দূরে মরীচিকার প্রান্তে/ আমরা এখনও দেখি, প্রতিটি বিকেলে/ সূর্যের সমুদ্রে ডুবে যাওয়া.''..(সূর্য এবং হাওয়ার সন্তানরা # মহম্মদ ইবনু # স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ সৌম্যজিৎ আচার্য)

এটা ঠিক যে আমরা এখনও অপেক্ষা করি নতুন ভোরের জন্য। আমরা এখনও অপেক্ষা করি শুরুর জন্যে আবার। কিন্তু প্রত্যেক শুরুর আগের ইতিহাস থাকে, আর থাকে কঠিন সলতে পাকানো। অতীত কে ভালভাবে অধ্যয়ণ করতে পারলে এগিয়ে চলার পথের বাধাগুলি দূর করা সহজ হয়। তিব্বতকে জানতে শরৎচন্দ্রদাস এর তিন দশক আগে ১৮৪৮ সালে প্রকৃতিবিদ জোসেফ ডাল্টন হুকার দার্জিলিং এলাকায় গিয়েছিলেন। শিংলিলার পাহাড়ি অরণ্যপথে টংলু পেরিয়ে সিকিম ও পূর্ব নেপাল হয়ে তিব্বতে ঢুকেছেন। অলোক এই পথের অরণ্য প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা পড়েছে হুকারের লেখা ‘হিমালয়ান জার্নাল’-এ।

৫ডিসেম্বর, ১৮৪৮।ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে একটা অদ্ভূত অনুভূতি হয় জোসেফের। কে বা কারা পা টিপে টিপে হাঁটছে তুষারপাতের মতন ছিপছিপ শব্দে, কিন্তুবাইরে মুখ বাড়িয়ে কিছুই বোঝা যায় না। রডোডেনড্রনের বনে তাঁবু ফেলা হয়েছে, পাতার ফাঁক দিয়ে ডোরাকাটা আলো এসে পড়েছে কুয়াশার ভাসমান শরীরে। তারপরেই হঠাৎ প্রায় নিঃশব্দে সারি দিয়ে ঢালু পথে নেমে আসতে থাকেপরিযায়ী মানুষের একটি দল, সঙ্গে অসংখ্য ভেড়ার পাল।খচ্চরের আকৃতির বড়ো বড়ো ভেড়াগুলির পিঠের দুপাশে ঝুলছে লবণের বস্তা। রাশি রাশি শুকনো ঝরা পাতার পথে খুরের শব্দ হচ্ছে তুষার পাতের মতন।বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা রয়েছে দলে, সকলের পরনে ভারী তিব্বতি পোশাক। চলার পথে ভেড়াগুলোমুখ নামিয়ে দুপাশের রডোডেনড্রনের গোড়ায় মুখ দিয়ে শিকড়ের গা থেকে একধরনের পরজীবী আগাছা খায়, কোনটা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়লে কেউ একজন জিভে অস্ফুট আওয়াজ করে এগিয়ে নেয় ওদের।এছাড়া কেউ কোনও কথা বলে না, নাক মুখ দিয়ে হিমেল হাসি বের হয় কেবল। ভোরের পলকা আলোয় এই দৃশ্য স্বপ্নের মতন।বনের মধ্যে তাঁবু পড়েছে, কিন্তু একটিবারের জন্যেও কেউ থামেনা কিংবা উৎসাহী চোখে ফিরে তাকায় না। সকলের দৃষ্টি সামনে পথের দিকে। কিন্তু তাঁরা যে যন্ত্র নয় তা প্রমাণ করে কেবল একটি মেয়ে, কোলেতার চামড়ার চেবু জড়ানো শিশু। সে ঘাড় ঘোরাতেই জোসেফের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। চেরাচোখে তার জানার আগ্রহ আর দুটি সরু বিনুনি পশমি টুপির ভেতর থেকে নেমে এসেছেঘাড়ের ওপর। চলতে চলতে বার কয়েক পিছন ফিরে তাকায় সে। ক্রমশ গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যায় দলটা, কুয়াশা ফিকে হয়ে আসে, খাদের থেকে ক্রমশ সপ্তমে উঠতে থাকা শিসের মতন স্নো ফেজেন্টের ডাক শোনা যায়।ভোরেরএইসময়টায় ঘাসের ডগায় শিশির পান করতে নেমে আসে ওরা।জোসেফ ঘুমিয়ে পড়ে আবার।

ঘুমভাঙে বেলায়। ততক্ষণে কুলিরা উঠে তাঁদের তাঁবু গুটিয়ে মালপত্র বেঁধে ফেলেছে। জোসেফ প্রকৃতির ডাক সেরে ফিরে এলে ব্রেকফাস্ট সেরে ফের শুরু হয় পথচলা। আডভান্স পার্টি আগেই বেরিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে চুরমা গিরিপথ টপকে ইয়ার লুংউপত্যকার দিকেএগিয়ে যায় ওঁরা।পথে নতুন নতুন উদ্ভিদেরচারাসংগ্রহও সেগুলি নিরীক্ষণের কাজ চলতে থাকে।শীত এসে গিয়েছে, দশহাজার ফুটেরও পরপুষ্পল উদ্ভিদ বেশিরভাগ শুকিয়ে গিয়েছে, বীজগুলো ঘুমিয়ে গিয়েছে মাটি পাথরের কবরে।পাহাড়ের কোলে শুকনো ডোবার মতন জলাশয়ের মাঝে ,বোল্ডারের নীচে, বেঁটে রডোডেনড্রন আর জুনিপারের ছায়ায়অনেক শুকনো প্রিমরোজ অ্যানিমোন আর পোটেটিলার ডালপালা ছড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় যে, গ্রীষ্মের তিনটি মাস গোটা উপত্যকা জুড়ে নানারঙের ফুলের প্লাবন লেগে থাকে।এপ্রিল মে মাসে সিঞ্চলের বিস্তীর্ণ ঢালে ও চারপাশের উচ্চতায় এত বেশি ম্যাগনোলিয়া ফোটে যে পাহাড়ের গায়ে ঝরা পাপড়ির স্তূপ দেখে দেখে মনে হয় বুঝি বরফ পড়েছে।

জোসেফের সঙ্গে রয়েছে একটি ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষাগার : থার্মোমিটার, সেক্সট্যান্ট, অণুবীক্ষণযন্ত্র, দূরবীন থেকে শুরু করে নানাধরনের কম্পাস, জরিপের বিবিধযন্ত্র, কীটপতঙ্গের বাক্স, এছাড়াবিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, ফুল আর বীজসংরক্ষণের সরঞ্জাম ।ধীরে ধীরে চলার পথে সারাদিন নমুনা সংগ্রহও নিরীক্ষণ চলে, সন্ধ্যার পর তাঁবুতে বসে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে সেগুলি নথিকরণ, ছবি আঁকা, অনুপুঙ্খ নোট নেওয়া । উদ্ভিদ আর প্রাণী জগৎছাড়াও ভূবৈচিত্র্য, পাথরের চরিত্র আর আবহাওয়ার বিভিন্ন খুঁটিনাটিতে ভরে উঠতে থাকেতাঁর খাতা।

তাঁর জার্নাল পড়তে পড়তে অলোক বুঝতে পারে, জোসেফ ছিলেন একেবারেই ভিন্ন ধাতুতে গড়া মানুষ। হিমালয়ে অনুসন্ধান কারীরা সাধারণত ভোরবেলায় যাত্রা শুরু করে দুপুরে আবহাওয়া অস্বচ্ছ হয়ে ওঠার আগেই পরবর্তী গন্তব্যে পেীঁছ তে চেষ্টা করে। কিন্তু জোসেফ সকালে তরতাজা শরীর মনে তাবুর কাছে পিঠে প্রকৃতি পাঠে ব্যস্ত থাকতেন । তারপর বেলায়ভারি প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে দিনের চলা থামাতেন বিকেলের পর। সেখানে ইতিমধ্যেই তাঁবু সাজিয়ে ফেলেছে অনুগত ভৃত্য আর কুলিরা :প্যাকিংবাক্সে তৈরি টেবিল, ওপরে পরিপাটি লেখার সরঞ্জামও মোমবাতি। রাতে পোকার উপদ্রবের জন্য সেটি আবার কাচে ঢাকা। বাইরে কোনো বড়ো গাছের নীচে রাতের খাবার বানাচ্ছে তাঁর নিজস্ব পাচক। রাতে তিনি খান আলুসিদ্ধ ভাত, ভেড়ার স্টু,বিস্কুট আর চা।কখনও স্বাদ বদলাতে টিনেরট্রাফল ( ছত্রাক ) ও শুকনো খেজুর। সন্ধ্যা থেকে কাজ করতে করতে রাত গড়িয়ে যায়।

জোসেফের জার্নালের পরের অংশ পড়ে অলোক তাঁর সঙ্গে আরও একাত্ম হয়ে পড়ে। সে নিজেও যে একজন আবহাওয়াবিদ! প্রকৃতি তারও বিষয়!

সেদিন দুপুরের আগেই আকাশের সিরাস মেঘগুলি গম্বুজের আকার নিয়ে জোসেফের চোখের সামনে অবলীলায় স্ট্র্যাটাস মেঘে পরিণত হতে থাকে। জলীয় বাস্পবাহী দখিনা বাতাস দ্রুতপাক খেয়ে উঠতে থাকে। অরণ্যের ভেতর ঢুকে যাওয়া নির্জন পথকে মাঝখানে রেখে একটি সোনালি ঈগল বার বার পাক খেতে খেতে যেন তাঁর সঙ্গে গল্প করতে অনেক নীচে নেমে আসে। চলতেচলতে জোসেফেরমনেআবছাস্বপ্নদৃশ্যেরমতনজেগে ওঠে একসদ্যকিশোরীর বাঁকাচাহনির উৎসাহ, রহস্যময়তা ; কোলেচামড়ার চেবু জড়ানো শিশু। কেন জানি মনে হয় যে ওই দলটির সঙ্গে আবার দেখা হবে, হবেই !

আর তাঁকে অবাক করে দিয়ে সেদিনই বিকেলের আগে দলটির সঙ্গে আবার দেখা হয়। জঙ্গলের প্রান্তে সতেজ ঘাসে ঢাকা এক টুকরো জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল দলটি, পাতার আগুন জ্বেলে চা বানাচ্ছিল একজন। ভেড়াগুলো চরছিল আশেপাশে। জোসেফের সঙ্গীরা কথা বলে জানতে পারে যে, ওরাওয়া লাংচুন থেকেই য়ালং যাচ্ছে।জোসেফদের তাঁবু পড়ে ছিল কাছেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি তার স্বামীর জন্য চোখের ওষুধ চাইতে আসে।মেয়েটি সুদর্শন–জোসেফ লিখছেন, ‘আমার জন্যউপহার স্বরূপ এনেছিল নস্যি। এই ডিসেম্বরে চোদ্দহাজার ফুট উচ্চতায় শিশুটি সম্পূর্ণ ন্যাংটো, প্রখরসূর্যের তাপ থেকে ওম পাওয়ার চেষ্টা।দীর্ঘসময় বরফে তাকিয়ে থেকে মেয়েটির স্বামী সাময়িক বর্ণান্ধ হয়ে গিয়েছে !

জোসেফ ওষুধ দেয়, শিশুটির গলায় ঝোলাবার জন্য দেয়একটি ফার্দিং।চকচকে রুপার মুদ্রা পেয়ে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মেয়েটির মুখ।এর আগে সে এমন শ্বেতাঙ্গমানুষ দেখেনি । ওদের দলের কেউই নাকি দেখেনি ! মেয়েটি অবাক চোখে খুঁটিয়ে দেখে জোসেফের চামড়া, চোখ আর চুলের রঙ।এতরকম বিচিত্রযন্ত্রও সে আগে কখনো দেখেনি, তাই তাঁবুর ভেতর ঘুরে ঘুরে নিঃশব্দে ছুঁয়ে ছুঁয়ে,নেড়ে চেড়ে দেখছিল সে।কোনও রকম জড়তা ছিলনা। হাতছানি দিয়ে ডাকতেই এগিয়ে আসে। জোসেফ কব্জিতে বাঁধা হাতঘড়িটা ওর কানে চেপে ধরতে মেয়েটির মুখে ফোটে তীব্র বিস্ময়ের অভিব্যক্তি।কিন্তু স্প্রিং আঁটা গোটানো ফিতেটা তুলে চাবি টিপতেই গোল বাধে। চামড়ার বাক্সের ভেতর থেকে পাকখুলে সাপের মতন সশব্দে ইস্পাতেরফিতেটা বেরিয়ে আসতেইমা ও ছেলে একযোগে প্রবল আর্তনাদ করে জোসেফের তাঁবু ছেড়ে ছুটে পালায়। জোসেফ হেসে ফেলে। কিন্তু তারপর খুব খারাপ লাগে, এটা সে না করলেই পারত!

একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখা অসংখ্য উদ্ভিদ,পাথর,মেঘ,পাখি আর নানা প্রজাতির মথ ও প্রজাপতি এবং হিমবাহের অনুপুঙ্খ বর্ণনার মাঝে এক ফোঁটা উষ্ণ মানবিক চিত্র সময়ের ব্যবধান সরিয়ে অলোকের মন ছুঁয়ে যায়।সেই উনিশ শতকের মধ্যভাগে দার্জিলিং থেকে উত্তর সিকিমের ভেতর দিয়ে তিব্বতযাত্রার পথিকৃত ছিলেন জোসেফ হুকার।পরেএকাধিক পর্যটক অনুসরণ করবে তাঁরপথ। তবে তিরিশবছর পর শরৎদাস কিন্তু সেইপথ ধরেন নি।কখনো সমান্তরাল, কখনো অপসায়ী, আবার কখনো একইপথে এগিয়ে গেছেন!

১৬ নভেম্বর , ১৮৮১ তারিখে রিংবি পেরিয়ে এসেইয়াম্পুংদোকনা মেযে শুনশানবসতি পেয়েছেন শরৎ,প্রায়তে মনই এক গ্রামে জোসেফ পারেখে ছিল ইয়াংমা উপত্যকায়। ১৪হাজার ফুট উচ্চতায় পাহড়ের ওপর খানিকটা সমতলভূমি, হিমবাহের সঙ্গে গড়িয়ে আসা বড়ো বড়ো পাথরের মাঝে একটি বসতি; কাঠ-পাথরে গোবর মাটিলেপা গুটিকয় কুঁড়েঘর।একসারিবেঁটে চোর্তেন, নানারঙের ধ্বজা উড়ছে, ঢালের দিকে পাথরে ঘেরা কয়েক ফালি ছোটো ছোটো জমিতে চাষ হয়েছে।

হুকার লিখেছেন, এখান থেকে উপত্যকাটা দুভাগে ভাগ হয়েছে; একটি শাখা গিয়েছে উত্তরপূর্বে বরফাবৃত পাহাড়ে, অন্যটি উত্তর পশ্চিমে কাংলাচেন গিরিপথে। এইউচ্চতায় জুনি পারগোত্রীয় গাছ হয় না।দৃশ্যপট নিষ্করুণ, জমকালো হিমবাহের প্রবাহে ভেসে আসা ছোট বড়ো পাথর, শুকনো প্রাচীন হ্রদের বুকে সবজে- বাদামিউদ্ভিদ, অতিকায় সব পাথরের চাঙড় আর আকাশের গায়ে অসংখ্য প্রহরীর মতো তুষার শৃঙ্গমালা। উত্তরপশ্চিমে ১৮হাজার ফুট উঁচু নাঙ্গোর শীর্ষ থেকে নেমে এসেছে এক সুবিশাল হিমবাহ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জালিকার মতন অসংখ্য ভাঁজতার গায়ে, খালি চোখেও দেখা যায়, বরফ গলে জল নামার পথ, পলকা স্বচ্ছ প্রায় ছায়ায় সুস্পষ্টরেখার জটগুলির সৌন্দর্য অতুলনীয়।আর এই আশ্চর্য দৃশ্যপটের মাঝে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বসতিটাকে দেখে মরুভূমির বুকে মরীচিকার মতন অবিশ্বাস্য মনেহয়, মৃত কিবা ঘুমন্ত, কোথাও প্রাণের লেশমাত্র নেই যেন।

নীচে শুকনো চাষের জমিতে তাঁবু খাটানো হয়েছিল।পরদিন সকালবেলায় গ্রাম দেখতে যান জোসেফ ।গোটা গ্রামটা তখনও যেন দীর্ঘ শীতঘুমে আচ্ছন্ন।ফল ঘরে তোলা হয়ে গিয়েছে, বন থেকে জ্বালানি কাঠ এনে ডাই করা হয়েছে, চমরির দুধে জমানো চিজ শুকনো হয়ে এসেছে, গিরিপথ বরফে ঢাকা, মাটি জমে ফ্রিন্ট পাথরের মতন হয়েছে।বড়ো বড়ো বোল্ডারের ফাঁকে ফাঁকে গায়ে গায়ে ঠাসা মৌচাকের মতন কুঁড়েগুলো, মাটিতে অর্ধেক ডোবা, ফাঁক ফোকর দিয়ে সরুসরু গলিপথ।গলিগুলিতে পা দিলে নীচু নীচু চালের নিচে খুপরি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়াটে বাতাসমুখে লাগে, চিজের টক টক গন্ধ নাকে লাগে। প্রতিটি কুঁড়ের নীচতলায় শুকনো জুনিপার কাঠ, পশম আর চমরির গোবর থাকে থাকে রাখা,আর মই বেয়ে ওঠা দোতলায় ছোটো ছোটো কুঠরিতে মানুষের বাস।বাইরের আলো এসে ঢোকে না, আঙিঠির আগুনে যতটা আলো থাকে তা দিয়েই তাঁরা সব কাজ সারে। প্রত্যেক ঘরে অনেক ছায়াচ্ছন্ন পুরুষ, মহিলা ও শিশু রয়েছে - ঝিমোচ্ছে, পশম বুনছে, কিংবা হাতের জপমালা ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপে চলেছে।এক অদ্ভূত অলস শ্লথ জীবনে অভ্যস্ত মানুষগুলির পরবর্তী চারটে মাস এভাবেই কাটবে, পাহাড়ি পিকা ইঁদুরের মতন শীতঘুমে। বাইরে ছেয়ে থাকবে মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতা। শুধু চমরিগুলো ছাড়া থাকবে খোলা পিঠে পুরু রোমের কম্বলে বরফ, তাদের গলায় ঝোলানো ঘন্টাধ্বনি শোনা যাবে পাথরের খাঁজে সবুজ ঘাস কিম্বা গুল্মের চিহ্ন থাকবে যতদিন।প্রতিদিন দিনের আলো ফুরানোর আগে মেয়েরা কাঠের বালতি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ডাকবে ওদের।এই শিসের শব্দ আর প্রাণীগুলোর ঘোৎ ঘোঁৎ প্রত্যুত্তরের ধ্বনিতে কিছুক্ষণের জন্য পাহাড়ের গায়ে প্রাণ ফিরবে। তারপর একসময় ওদের বাটেও দুধ শুকিয়ে যাবে, ঝর্ণাগুলো জমে বরফ হবে, গ্রানাইট নৈঃশব্দ্যের ভেতর মাঝেমধ্যে শোনা যাবে হিমবাহপতনের শব্দ।হিমস্বচ্ছ রাতে শুধু আকাশে জেগে থাকবে অসংখ নক্ষত্র, আশ্চর্য উজ্জ্বল আর বিস্ফারিত।

এখানে তিনদিন কাটিয়ে ছিল জোসেফ ।খাবার কমে এসেছিল, বিশেষত চাকরও মুটেদের রেশনে টান পড়েছিল।গোর্খাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল শুধুমাত্র সিদ্ধভাত, ঘি আর লঙ্কা ; তিব্বতিদের জন্য যবের ছাতু ৎসাম্পা, চা আর চমরি মাখন।গ্রাম থেকে কেনা হয়ে ছিল দুধ, আখরোট এর আকৃতি বিশিষ্ট আলু আর একটি কস্তুরী হরিণের পা ...।



চলবে ...।