শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব -১২

ঝড়ের পূর্বাভাস

‘...নিজের বুকে লুকিয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস কার/ গালে তুই রক্ত মুছিস, কাদের আবার” - কাইফি আজমি(হাওয়া রে তুই কোন শহর থেকে এলি)

এই দীর্ঘযাত্রায় গরব ও দেচমার প্রেমোন্মাদনা কমেনি। লাহসায় ঢোকার পর অবশ্য অন্য সবারমতন একআশ্চর্যঅলৌকিক পরিবেশ ওদেরও প্রভাবিত করে। কিন্তু সেদিন মহামহিম দলাইলামাকেদর্শনের পর সন্ধ্যায় এই মোহ অনেকটাই কেটে যায়। সরাইখানায় ফিরেই প্রেমিক-প্রেমিকা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ওরা একে অন্যের চোখে তাকায়। তারপর কামরার দরজা বন্ধ করেতীব্র আশ্লেষে ওরা পরস্পরকেজড়িয়ে ধরে। তারপর নিবিড় চুম্বনে ডুবে যায়। গরবের শরীর দৃঢ় ও স্ফীত হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান আবেগে গলতে থাকে দেচমা। গলে যেতে থাকে ।

লাসার পথে দীর্ঘযাত্রাকালে ওদের মাথায় ফেরার কথা আসেনি। দিনের পর দিন ওরা কাম ভাবনায় ডুবে থেকে মাইলের পর মাইল ঘোড়া চালিয়েছে। রাতে যেখানেই বিশ্রাম নিয়েছে বারবারপরস্পরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। তারপর গাঢ় আলিঙ্গনেঘুমের দেশে ডুবে গেছে। সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আবার সারাদিনের যাত্রা। ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতেওদের মাথায় সেই একটাই ভাবনা থাকতো--আগামী রাতের মিলনে ওদের জন্য কোন নতুন উদ্ভাবন অপেক্ষা করছে সেই সম্ভাবনার কথা।গত রাতেরআবিষ্কার ও অভিজ্ঞতার কথা ভেবে ভেবে উত্তেজিতহতো। দেচমাকে দেখিয়ে গরব মাঝেমধ্যেই ঝুঁকে পড়েনাগপোকেচুমু খেত। গরবেরচুম্বনে শিহরিতনাগপোর কেশরফুলে উঠতো। এসব দেখে দেচমা সলজ্জ হাসিতে গরবকে শাসন করতো। ওরা দুজনেইকামাগ্নিতে জ্বলতে থাকতো পরবর্তী বিশ্রাম মুহূর্তের অপেক্ষায়।

কিন্তু নরবৌলিং থেকে ফিরে এসে সেদিন সন্ধ্যারমিলনের পর ওরা অনুভবকরে আর মাত্র একদিন পরইওদের ফেরারপালা।আর মাত্র একদিন...এই চিন্তা ওদেরকে বিষন্ন করে তোলে।বিষন্নতার ঝোঁকে দুজনেই একটু বেশি মদ খেয়ে তারপর রাতের খাবার খায়। তবুও সেই খাবার দেচমার বিস্বাদ লাগে।বিষন্নতাকাটে না। শত চেষ্টা করেও কারও মুখে হাসিফোটে না।

এই দীর্ঘপথ ঘোড়া চালিয়ে ফেরার কথা ভেবে কোনও দুঃখ নয়। গরবের গ্রামের ডেরায় ফিরে যাওয়ার কথা ভেবে দেচমারমন খারাপ লাগে। যদিও সে কখনও সেই গ্রামে যায়নি, আর গরবের কথানুযায়ী তার বাড়িতে কেউ নেই যে কোনও খবরদারি করবে কিন্তু এই অভিযান আর যাত্রাপথের মতন গরবকে নিশ্চয়ই সবসময় কাছে পাওয়া যাবেনা! ভেড়ার পাল, গবাদি পশুর ব্যবস্থাপনা, বিকিকিনি আর ডাকাতি -যেগুলিতে সাধারণত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় না; সেসব কিছু নবীন দস্যুসর্দারকে তার কাছ থেকে সরিয়ে রাখবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, এমনকি কখনও কয়েকসপ্তাহকাল! স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে এই দূরত্ব কেমন করে সইবে সে, বিরহে, অদর্শনে রাতগুলি কেমন করে কাটবে তা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এই যাত্রা কেন শেষ হবে, তাদের জীবনের আনন্দঘন দিনগুলি কেন ফুরিয়ে যাবে? গরবও কি মনে মনে তার মতনভাবে ?

দীর্ঘ মিলনের পর এসব ভাবতে ভাবতেই কি সে দেচমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে? লণ্ঠনের নিভুনিভূ আলোয় দেচমার মনে হয় গরীবের পরিতৃপ্ত চেহারাতেও কেমন যেন বিষন্নভাব! দেচমা তার দুই চোখে চুমু খায়। তারপর হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনের আলো বুজিয়ে গরবের বুকে মুখ গুজে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন ভোরে দুজনের ঘুম ভাঙে পরস্পরের বাহুডোরে। দেচমা ফুলের মতন হাসলে গরব ওকে চুমু খায়। দেচমার শরীরে শিহরণ জাগে। সে গরবের বুকে উঠে আসে। তার সারা মুখে চুমু খায়। এই চুম্বনের আবেগে গরব ক্রমে দৃঢ় ও বিস্ফারিত হয়ে উঠে দেচমার কোমরে হাত দিয়ে আলগোছে তার শরীরে গেঁথে নেয়। দেচমা দুষ্ট হেসে গরবের গালে কামড়ে দেয়। আর তারপর প্রথমে মৃদুলয়ে এবং ক্রমে গতি বাড়িয়ে তার শরীরে গরবের দৃঢ়তাকে উপভোগ করতে থাকে, অস্তিত্বে হিল্লোল জাগে,ক্ৰমে গলে পড়তে থাকে টইটম্বুর মৌচাকের মধুর মতন—

গরবের মনে হয় সে এখন দেচমার ঘোড়া হয়ে পড়েছে। এই তন্বী অশ্বারোহী ঘোড়াটিকে চালনা করছে কখনও দুলকি চালে আবার কখনও বেশ দ্রুতগতিতে। এই দৌড়ে একসময় উত্তেজিত ঘোড়াটির মুখে ফেনা উঠেআসে, তারপর আগ্নেয়গিরির মতন লাভা উদগীরণ করতে থাকে। গরব জোরে চেপে ধরে দেচমার কোমর। থিরথির কাঁপতে থাকে। দেচমাও ওর বুকে শুয়ে পড়ে, থেমে যায়। চুল টেনে ধরে। আর তারপর ধীরে দুলকি চালে কোমর দোলাতে দোলাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়ে গরবও। কিন্তু একটু পরেই গরবকে উঠে পড়তে হয়। লাহসাবাসের শেষদিন গরবের অনেক কাজ। ফেরার পথের প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে তা দেখাশোনা করতে হবে। আগের রাতেই সে বলে রেখেছিল, সম্ভব হলে সূর্য ওঠার আগেই যেন ওকে ডেকে দেওয়া হয়।

কিন্তু সেদিন প্রায় প্রত্যেকেরই ঘুম ভাঙে সূর্য ওঠার পরে। একটি বড় পাত্রে মাখন মেশানো চা নিয়ে ওদের দলের একজন এসে দরজায় কড়া নাড়ে। ওরা ধড়মড়িয়ে উঠে বিছানা ছেড়ে দ্রুত জামাকাপড় পরে নেয়। গরব দরজা খোলার আগেই দেচমা ওর গালে আলতো চুমু দিয়ে আবার বিছানায় উঠে বসে।

দরজা খুলতেই একটি সোনালি রঙের মথ উড়ে এসে ঘরে ঢোকে। আর তারপরই সে আটকা পড়ে দরজারউপরেডানদিকেরকোণেএকটিবিশালমাকড়সারজালে।ছটফটকরতেথাকে।দেচমারইচ্ছেকরেউঠেগিয়েসেটিকেছাড়িয়েদেয়।নাহলেএকটুপড়েইমাকড়সাটিএসেমথটিকেখেয়েফেলবে।

দরজাখুলতেইদলের লোকটি বলে, সর্দার, আমাদের ৎসাম্পা আর মাখন বাড়ন্ত। গতরাতেতুমিঘুমাতে যাওয়ার পর তিনজন খ্যাং তিসের তীর্থযাত্রী সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমাদের ভাণ্ডারী ৎসোণ্ডু ওদেরকে থলে ভরে ৎসাম্পা আর মাখন দিয়েছে। ওরমতে এই দানআমাদের ফেরার পথকে নিরঙ্কুশ করবে। তুমি আবার এজন্যে ৎসোণ্ডুকে কিছুবলো না যেন।

গরব মুচকি হেসে বলে, আরে না, না, সেতো ঠিককাজই করেছে , এখন তোরা গিয়ে যথেষ্ট ৎসাম্পা, মাখন, আর যা যা আমাদের ফেরার পথে লাগবে- সব কিনে আন!টাকা আমার ভাগ থেকে কাটিস! তোরা যেহেতু ভালো মনে উৎসর্গ করেছিস, তাতে পুণ্যফল সবাই ভাগ করে নিতে পারবো!

লোকটি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চলে যায়। আর তখুনি দেচমাকে অবাক করে দিয়ে মথটি নিজেই মাকড়সার জাল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উড়ে গরবের কাঁধে বসে। দেচমাআনন্দে হাততালি দেয়। সে এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল।গরবৎসাম্পাআরমাখন চাহাতেঘরেঢুকতেইসেজিজ্ঞেসকরে, - খ্যাং তিসেকিএখানথেকেখুবদূরে ? তুমিসেখানেগেছ ?

গরববলে, - না , যাইনি , কিন্তুমায়ের কাছে শুনেছি ওই পবিত্র পর্বতেই আমার অস্তিত্বের শুরু।

– কেমনকরে ?দেচমা সোৎসাহে প্রশ্ন করে।

গরব এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেয় না । সে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। তার মায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী তার ঈশ্বর পিতার কথা, তাঁর বর্ণনা, আর মনিব লাগস্পার ধারণার কথা মনে পড়ে। যেটাই ঠিকহোক না কেন নিঃসন্দেহে তার উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ওই পবিত্র খ্যাংতিসে। এসব ভাবতেই হঠাৎ সে ওই পর্বতের সঙ্গে নাড়ির টান অনুভব করে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। মা ও লাগস্পার এই কাছে শোনা ওই অদেখা বন্ধুর পর্বতটি ধীরে ধীরে তার অস্তিত্বের কোনও দুরবর্তী অবস্থান থেকে ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করে। এই অভূতপূর্ব অনুভূতি একটা অস্পষ্ট কিছু মূর্ত করে তুলতে শুরু করে। যেখানে তার জন্মের অজানা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সেই পবিত্র পর্বতকে দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু সেখানে যেতে দীর্ঘ পথ পার হতে হবে, অনেক লম্বা সফর, বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে। অবশ্য ওকে তো আর কারও অনুমতি নিতে হবে না। টাকাপয়সা - থাবারদাবারেরও কোনও অসুবিধে নেই।

দেচমার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অবাক চোখে তাকে দেখছে। তার দৃষ্টিতে অজানাকে জানার আগ্রহ। গরব যে তার স্বপ্নপুরুষ, তার জন্মাবৃত্তান্তে একটি রহস্যের ছোঁয়া টের পেয়ে সে উৎকর্ণ। চোখ আর দুটি চকচক করছে উৎসাহে। সে যদি জানতে পারে গরবের মনে এখন কী চলছে, এই নতুন অভিযানের হাতছানির কথা জানলে খুবখুশি হবে। তাহলে ওরা এখন পরস্পরকে জানার, বোঝার, প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন আবিষ্কারের আনন্দে যেমন ভাসছে তেমনি ভেসে থাকতে পারবে আরও বেশ ক'মাস ! কিন্তু সে তার ইচ্ছের কথা গোপন রেখে দেচমাকে বলে, আমাকে এখুনি বেরুতে হবে, কিছু জরুরি কাজ রয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরবো! সে দেচমার মাথা ছুঁয়ে কপালে হালকা একটি চুমু খায়। তারপর কোনও কথা না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

স্বপ্নপুরুষের এই উদাসীনতা দেচমা সহজভাবেই নেয়। তার মনে হয় গরবের সৃষ্টিরহস্যাবৃতহওয়া সমস্ত গতিবিধি নিয়তিনির্দিষ্ট, সমস্ত আচরণ দেচমার স্বপ্নপূরণের সমার্থক ও স্বাভাবিক। নাহলে গতরাতে ঘুমুতে যাওয়ার পর তিনজন খ্যাং তিসের তীর্থযাত্রী সাহায্য চাইতে আসবে কেন? ৎসোণ্ডই বা ওদেরকে থলে ভরে ৎসাম্পা আর মাখন কেন দেবে? গরব আর দেচমা নরবৌলিং থেকে দলাই লামা দর্শন সেরে ফেরার পর থেকে দীর্ঘ যাত্রার যবনিকার কথা ভেবে ভেবে যখন বিমর্ষ, সেই রাতেই তাদের অলক্ষ্যে এসব কিছু ঘটেযাওয়া আর সকালে মাখন মেশানো চা দিতে এসে লোকটার বলায় সে নিয়তির ছোঁয়া অনুভব করে, মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়ে মথটার ছটফট আর তারপর আশ্চর্যমুক্তিও কেমন অর্থবাহী হয়ে ওঠে! সে মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপতে শুরু করে, ওম মণিপদ্মে হুম, ওম মণিপদ্মে হুম . . .

ইচ্ছে থাকলেও ওদের পোটালা প্রাসাদ দেখা হবে না। লাহসায় প্রচুর গুপ্তচর। সেজন্যে ওদের শেষদিনেও সতর্ক থাকতে হচ্ছে। তবু বেরুতে হবে।

তিব্বতে জ্যোতিষীর পরামর্শ না নিয়ে কেউ কোনও বড় কাজেহাত দেয় না। কোথাও যেতে হলে তো জ্যোতিষীর পরামর্শ আবশ্যিকই। গরবও যাত্রা শুরুর আগে একজন ভালো জ্যোতিষীর খোঁজে বেরোয়। সে এটাও জানতে চায়, মনে যে নতুন তীর্থের হাতছানি টের পাচ্ছে সেই যাত্রাপথে এখনই পা বাড়াবে নাকি আপাতত তা স্থগিত রেখে ফিরে যাবে! বাইরে ঘন কুয়াশা।

গরব মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে সরাসরি জোওবো মন্দিরে যায়। সেই মন্দিরে মহাজ্ঞানী বুদ্ধ হয়ে ওঠার আগের রাজকুমার গৌতমের প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। গরব সেই মূর্তির সামনে উপুড় হয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। প্রণাম শেষে সে মূর্তির পাদদেশ একটি লম্বা রেশমবস্ত্রে ঢেকে দিয়ে প্রার্থনা করে যাতে তার দল পরবর্তী যাত্রাপথে কোনও দুর্ঘটনার শিকার না হয়। তারপর মনে মনে বলে, হে ঈশ্বর, পথ দেখাও, আমি এখন কোন পথে যাব?

রাজকুমার গৌতমের প্রাচীন মূর্তি তেমনি নির্বিকার হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে। মন্দিরের কর্মচারীরা পূজাবেদির উপর রাখা দানপত্রগুলিতে জল ভরছিলো। গরব ওদের একজনের কাছে গিয়ে ওকে মূর্তির সামনে ১০৮টি ছোট্ট প্রদীপ কিনে জ্বালানোর টাকা দেয়। গরব ওকে বলে, সদলবলে তীর্থে এসেছিলাম, আগামীকাল ফেরার পথে রওয়ানা হবো, একটা মো চাই, যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক আছে কিনা আর যাত্রাদলের শুভাশুভ নিয়ে একটা দৈববাণী চাই!

কর্মচারীটি ওকে আপাদমস্তক দেখে। সে ভাবে, সুঠাম সুবেশ অভিজাত সুন্দর যুবকটি নিশ্চয়ই ভাল দক্ষিণা দিতে পারবে! সঠিক জায়গায় পাঠালে ভাল দালালি পাওয়া যাবে! সে তাকে একটি মঠের জ্যোতিষজ্ঞ লামার ঠিকানা বলে দেয়।

জোওবো মন্দির থেকে বেরিয়ে দেখে মিষ্টি রোদ উঠেছে। গরব আগে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বলে লেনদেন সম্পূর্ণ করে। তারপর মঠে যায়। সেখানে সেবাইতদের হাতে যথেষ্ট দক্ষিণা দিয়ে সে সহজেই সেই ত্রিকালদর্শী লামার কাছে যেতে পারে।

দস্যুসর্দার গরব নরবৌলিং এ সর্বজ্ঞ মহামহিম দলাই লামার কাছে যেরকম না ঘাবড়ে চলে গেছিল, এখানেও তেমনি যায়। খ্যাং তিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা শুধু এটুকুই সে জানতে চায়। কিন্তু একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার কাছে যাওয়াটা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু সেই লামার ঘরে ঢোকার পর নিভু নিভু আলোর মধ্যে চোখ সওয়ানোর সময়ই তার অস্বস্তি শুরু হয়। সে দেখে, ঘরের চার দেওয়ালে লাগানো প্রমাণ সাইজের বেশ কয়েকজন ত্রিকালদর্শী লামার তৈলচিত্রগুলিও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এত কম আলোতেও প্রত্যেকটি ছবির চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে। সেগুলির চারপাশে দেওয়ালে আঁকা নানা বিকৃতদর্শন দেবদেবীর মূর্তি ওই নিভু নিভু আলোতে এক ভয়ানক আবহ সৃষ্টি করে। ঘরের মাঝামাঝি আসন পিঁড়ি হয়ে বসে থাকা লামা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। কী তীব্র তার দৃষ্টি! গরবের বুক দুরুদুরু করে। সে কি বোকার মতন আত্মসমর্পণ করতে এসেছে? এখন আর পালানো যাবে না। মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। গরব নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল করে চারপাশ ভুলে মনে মনে নিজের প্রশ্ন তৈরি করে। সে বলে, জ্যোতিষঠাকুর, যে ব্যবসার কাজে আমি লাহসায় এসেছিলাম তা সুসম্পন্ন হয়েছে, এখন দেশে ফেরার পালা, কিন্তু মন চাইছেএকবার পবিত্র পর্বত খ্যাংতিসে ঘুরে দেশে ফিরি, এই যাত্রা শুভ হবে কিনা তা জানতে এসেছি!

জ্যোতিষী কি ওর কথা শুনতে পেয়েছে? সে আগের মতনই একদৃষ্টে গরবকে দেখছে। ওর দৃষ্টি গরবের মনের গভীরে ঢুকে পড়ছে যেন। জ্যোতিষী তেমনি নীরব। ওই নিস্তব্ধ পরিবেশ ও গভীর দৃষ্টি গরবকে কেমন অবশ করে দিতে চাইছে ! তার ভেতর থেকে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে মনের জোরে সেই চিৎকারকে থামায়।কিন্তু আর বেশিক্ষণ এই পরিবেশে, এই নিস্তব্ধতার মধ্যে থাকতে হলে কী হবে বুঝতে পারছেনা গরব।

অবশেষে লামা জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, তোকে কোনও প্রশ্ন করবো না, কোনও দৈববাণীর বইও পড়ার দরকার নেই। আমি স্পষ্ট তোর উত্তাল অতীত দেখতে পাচ্ছি। আর যা ঘটবে তা তোরই কর্মফল, সেগুলির ওপর তোর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তোর ইচ্ছা নয়, অদৃষ্টই তোকে খ্যাংতিসের দিকে টানছে!

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে তিনি আবার একদৃষ্টে থাকিয়ে থাকেন, তাকিয়েই থাকেন। গরবের ভীষণ অস্বস্তি হয়। সে কোনওদিন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। ঢোক গিলে সে কিছু বলতে যায়, তখনই লামা আবার বলে ওঠে, যেতে চাইলে যা! একটি সুক্ষ সুতো দেখতে পাচ্ছি এখনও রয়ে গেছে তোর আর তোর পূর্বপুরুষের মধ্যে। একটি ফুঃ দিলেই সেই সুতো ছিড়ে দেওয়া যায়। তোর চারপাশেপ্রচণ্ড ঝড়ের কারণগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

একটু থেমে লামা এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, তুই অন্যদের কষ্ট দিয়েছিস, ভু-গ–বি!

এটুকু বলেই লামা চুপ হয়ে যায়। আবার নিঝুম নিস্তব্ধতা। এবার যা ওর চোখে আর আগের শ্যেনদৃষ্টি নেই। কঠিন আওয়াজে লামা বলে, তোর অর্ঘ্য আর প্রণামী ফিরিয়ে নে! এগুলি পাপের টাকা। এখানে কোনও কাজে লাগবে না!

এই দক্ষিণা ও একটি সাদা পশমি চাদর সে জ্যোতিষী লামার সেবাইতকে দিয়েছিল। প্রথা অনুসারে সে ওই উত্তরীয় ও টাকা লামার আসনের সামনে রেখেছে। এই দক্ষিণা অস্বীকার করা এখন লামার অভিশাপের মতন। গরব শিউরে উঠে লামার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে। সে একটাও কথা বলতে পারে না।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর লামা শান্ত স্বরে বলে, ওঠ, ঠিকআছে তোর দেওয়া চাদরটা রাখছি। কিন্তু প্রণামীর টাকা নিয়ে গিয়ে গরিবদের চুপচাপ দান করে দেয়! গরব এবার আশ্বস্ত হয়। প্রণামীর টাকা ফেরালেও লামা ওর দেওয়া উত্তরীয় ফিরিয়ে দেয়নি। ও অভিশপ্ত হয়নি।

মঠের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গরব চোখ কচলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পথের পাশের ভিখিরিদের লামার ফিরিয়ে দেওয়া প্রণামীর মুদ্রাগুলি বিলিয়ে দেয়। তার সমস্ত আনন্দ উবে গেছে। এই জ্যোতিষী যে ত্রিকালদর্শী এতে গরবের কোনও সন্দেহ থাকে না। তিনি তার ভেতরটাকে ভালোভাবেই পড়ে নিয়েছেন। অভিশাপ দেননি, কিন্তু দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন। গরব ভেবে পায় না এই দুর্ভাগ্য ওর জীবনে কেমন করে আসবে!

গণৎকার লামার চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার বিভীষিকা তার মনকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখে। দৈববাণীর কথাগুলি মাথায় ঘুরতে থাকে, অদৃষ্ট তাকে খ্যাংতিসের দিকে টানছে . . . খ্যাং তিসের সঙ্গে ওর সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে!-এসব কথার মানে কী? গরব তো খ্যাং তিসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়তে চায় না! তাহলে তো তার সমগ্র অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে! হয়তো খ্যাং তিসে তীর্থে গেলে সেই পুণ্যফলে ওই সম্পর্কের সুতো অক্ষত থেকে যেতেও পারে। এটাই হয়তো তার চারপাশে জেগে উঠতে থাকা ভাবী ঝড় থেকে ওকে নিষ্কৃতি দিতে পারে অথবা ঝড়টাকেই থামিয়ে দিতে পারে! এভাবেই গরব তার আশা দিয়ে সম্ভাব্য বিপত্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে মনে মনে খ্যাং তিসে যাত্রাকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।

আর তখনই নবীন ডাকাত সর্দার ভগ্নমনোরথ সমস্ত দ্বিধা ও শঙ্কার বশবর্তী হয়ে বুঝতে পারে--তার সফলতার সুখী দিনগুলি হয়তো আর ফিরে পাবে না! এসব ভেবেও তার চোয়াল ক্রমে শক্ত এবং প্রত্যয় দৃঢ় হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়—-খ্যাংতিসে যাবেই, অদৃষ্টের অমোঘ টানে যেতে হলেও যাবে, নিজের ইচ্ছেতেই যাবে সে, পবিত্র মাফাম-ৎসো আর লাংগাক-ৎসো পরিক্রমা করবে। যদি ওই তীর্থযাত্রা অবশ্যম্ভাবী ঝড়কে কেবল বিলম্বিত করে, যদি শুধুই সাময়িক নিষ্কৃতি দেয়, এই তীর্থযাত্রা অন্ততপক্ষে আরও কয়েকমাস ওকে প্রিয়তমা দেচমার নিরবচ্ছিন্ন সান্নিধ্য দেবে। আপাতত এই সুখের কাছেই যেতে চায় গরব—সুখযাত্রায়!


চলবে ...